সমন্বয়হীনতায় রাজধানীর উন্নয়ন প্রকল্প
রাজধানীর তেজগাঁও থেকে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। আগামী বছরের জুনে নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজ এগিয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণ জটিলতাকে এ ধীরগতির কারণ বলছেন ডিএনসিসি কর্মকর্তারা। কারণ প্রকল্পের জন্য যে জমি দরকার, তার পুরোটাই সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার। এ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে সময়মতো জমি পায়নি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
ঢাকার শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল ও সারুলিয়ায় সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নে ২০১৭ সালে ৭৭৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। ধীরগতির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকা সদ্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা আগে ইউনিয়ন ছিল। ইউনিয়ন থেকে সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়ায় বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতিই ধীরগতিতে রেখেছে প্রকল্পটিকে।
রাজধানীজুড়ে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ১৪টি বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কোনোটির অগ্রগতিই কাঙ্ক্ষিত মানের নয় বলে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকেই এর কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, শহরের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান ও সাতটি মন্ত্রণালয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই আবার একে অন্যের ওপর প্রাধিকারপ্রাপ্ত বলে মনে করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে ফ্লাইওভার কিংবা মেট্রোরেল প্রকল্পের কথা বলা যায়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট থাকছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও দৃশ্যমান। রাজধানীর রাস্তার বাতি পরিবর্তনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হলেও বাতির খুঁটি স্থাপন কিংবা সেগুলো স্থানান্তরের ক্ষমতা নেই তাদের হাতে। সব মিলিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের অভাবে নগরীতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বাস্তবায়নাধীন পাঁচটি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত আছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল ও সারুলিয়া এলাকায় সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৭৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পটি এর মধ্যে অন্যতম। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২০ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ। মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল্ড উন্নয়নের একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ৭২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ। ঢাকা দক্ষিণের ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের জুনে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ। ডেমরা, মাণ্ডা, নাসিরাবাদ ও দক্ষিণগাঁও এলাকার সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি প্রকল্প শুরু হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। মেয়াদ ধরা আছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। ৪৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজে টেন্ডার আহ্বান ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একটি প্রকল্প নেয়া হয়। প্রকল্পটিতে বরাদ্দ দেয়া রয়েছে ১ হাজার ২১৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যার মেয়াদ ধরা হয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৫৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে হলে বাকি ৪৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে হবে পরবর্তী নয় মাসে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন ধরনের নয়টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পগুলোর সার্বিক অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত মানের নেই। ফলে সংশয় রয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে এসব প্রকল্প শেষ হওয়া নিয়ে।
ভৌত অগ্রগতিতে আরো নাজুক অবস্থায় আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এলইডি সড়কবাতি, সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার সরবরাহ ও স্থাপন শীর্ষক একটি প্রকল্প। চলমান এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটির মাধ্যমে ডিএনসিসি এলাকায় ৪০ হাজারটি আধুনিক এলইডি সড়কবাতি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ।
২০১৬ সালের জুনে নেয়া ১ হাজার ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণের একটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পেরও ভৌত অগ্রগতি ৬২ শতাংশ।
৭৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট (ইউআরপি ডিএনসিসি অংশ) প্রকল্পের কাজ চলছে, যার মেয়াদ ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি ইমার্জেন্সি অপারেটিং সেন্টার ও কয়েকটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস স্থাপন করার কথা রয়েছে। বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতিও স্থাপন করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৩০ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
২৭৯ দশমিক ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উন্মুক্ত স্থানগুলোর উন্নয়ন ও সবুজায়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, যা ২০১৯ সালের জুনে শেষ হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২২টি পার্ক ও চারটি খেলার মাঠ উন্নয়ন, ১৫টি ফুটওভার ব্রিজ উন্নয়ন ও সৌন্দর্যকরণ, ৭৩টি স্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট নির্মাণ এবং চারটি কবরস্থানের উন্নয়নকাজ করা হবে। এ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮ শতাংশ।
৬১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ইসিবি চত্বর থেকে মিরপুর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন এবং কালশী মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান আছে, যার মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন এবং কালশী মোড়ে ৮৪৪ মিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে মিরপুর, পল্লবী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা ও মহাখালীর মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতকরণ হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ১০ শতাংশ।
২৪ দশমিক ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সড়ক উন্নয়নকাজের জন্য অ্যাসফল্ট প্লান্ট-সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পের আওতায় গাবতলীতে একটি অত্যাধুনিক অ্যাসফল্ট প্লান্ট স্থাপন ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ১০ শতাংশ।
১৭৭ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে গাবতলী সিটি পল্লীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ক্লিনারদের জন্য বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। ২০১৭ সালের জুনে নেয়া প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ক্লিনার কর্মীদের জন্য চারটি ১৫ তলা আবাসিক ভবন ও একটি স্কুল নির্মাণের কথা রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৬ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) মো. মাহবুব হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে সাধারণত সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অবশ্যই যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। কেস টু কেস ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারলে সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। তবে নির্দিষ্ট সময়ে কেন কাজ সম্পন্ন হয়নি, প্রকল্প পরিচালকই তা ভালো বলতে পারবেন।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮
No comments:
Post a Comment