Search

Wednesday, December 19, 2018

সারা দেশে সাড়ে ৫ হাজার কিমি ভাঙাচোরা সড়ক

যানবাহনপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয় কিলোমিটারে গড়ে ১১ টাকা

শামীম রাহমান

সড়ক ভালো থাকলে পণ্য পরিবহনে একটি বড় ট্রাকের পরিচালন খরচ হয় প্রতি কিলোমিটারে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। খারাপ সড়কে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ৬৯ টাকা। অর্থাৎ ভাঙাচোরা সড়কে ট্রাকপ্রতি পরিবহন মালিককে পরিচালন ব্যয় বাবদ প্রতি কিলোমিটারে সর্বোচ্চ ১৮ টাকা ৯ পয়সা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়।

ভালো সড়কে দূরপাল্লার একটি বাস পরিচালনায় কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় ৩৫ থেকে ৩৯ টাকা। ভাঙাচোরা সড়কে এ ব্যয় কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ৫৯ টাকা পর্যন্ত উঠছে। এ হিসাবে ভাঙাচোরা সড়কে বাস পরিচালনায় কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ১৮ টাকা ৪২ পয়সা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে মালিকদের।

সারা দেশে ভাঙাচোরা সড়ক রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার, দেশের মোট সড়কের যা ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক। ভাঙাচোরা এ সড়কে পরিচালন ব্যয় বাড়ছে সব ধরনের মোটরযানের। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের প্রতিবেদনমতে, যানবাহনপ্রতি (সব ধরনের) কিলোমিটারে অতিরিক্ত এ ব্যয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১১ টাকা ৯ পয়সা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাঙাচোরা সড়ক প্রধানত দুভাবে যানবাহনের পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। প্রথমত, ভাঙাচোরা সড়ক যানবাহনের কারিগরি ক্ষতি করে। এতে মেরামত খরচ বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, খারাপ সড়কে গাড়ির গতি কমে আসে। ভাঙা অংশ পার হতে ইঞ্জিনে বাড়তি চাপ পড়ে। তখন জ্বালানি খরচও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক ভালো থাকলে রোড ইউজার কস্ট সহনশীল পর্যায়ে থাকে। কিন্তু খারাপ হলে যানবাহনের ট্রিপের সময় বেড়ে যায়। এর প্রভাবে বেড়ে যায় ভ্যালু অব ট্রাভেল টাইম। একইভাবে বেড়ে যায় যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও। বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হয়। ভালো সড়কে একটি গাড়ি ঘণ্টায় যে পথ পাড়ি দেবে, খারাপ সড়কে একই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে তার দেড়-দুই গুণ। এ পুরোটা সময়ই কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকে। ফলে জ্বালানি ব্যয় বাড়ে।

ভাঙাচোরা সড়কে যানবাহন পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার কথা বলছেন পরিবহন মালিক ও চালকরাও। অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানান, খারাপ সড়ক যানবাহনের গতি কমিয়ে দেয়। এতে ট্রিপের সংখ্যা কমে যায়। এটাকেও আর্থিক ক্ষতি হিসেবে দেখছেন তারা।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) তথ্য বলছে, দেশের এক-চতুর্থাংশ সড়ক-মহাসড়ক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। (সওজ) অধিদপ্তরের নেটওয়ার্কভুক্ত সড়কের দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৪৮১ কিলোমিটার। সরকারি হিসাবেই বর্তমানে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা দশায় রয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল রাফনেস ইনডেক্স’ বা আইআরআই সূচক অনুযায়ী সারা দেশে প্রায় ১৮হাজার কিলোমিটার সড়কে জরিপ করে ভাঙাচোরা সড়ক পরিমাপ করেছে এইচডিএম।

আইআরআই সূচকের মান ধরা হয়েছে ১ থেকে ১৪ পর্যন্ত। এ মানদণ্ডের ভিত্তিতে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় সড়ক-মহাসড়ক। এর মধ্যে ১ থেকে ৬ সূচকের মধ্যে থাকা সড়কগুলো ‘ভালো’ ও ‘চলনসই’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। আইআরআই সূচকে ৬ থেকে ৮ পর্যন্ত থাকা সড়কগুলোকে চিহ্নিত করা হয় ‘দুর্বল’ হিসেবে। ৮ থেকে ১০ সূচকপ্রাপ্ত সূচকগুলোর মান ‘খারাপ’। আর ১০ থেকে ১৪ সূচকে থাকা সড়কগুলো ‘খুব খারাপ’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।

এইচডিএমের হিসাব বলছে, সারা দেশে ৬-৮ আইআরআই সূচকের ‘দুর্বল’ সড়কের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৫২৮ কিলোমিটার। ৮-১০ আইআরআই সূচকের ‘খারাপ’ সড়কের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ২৮২ কিলোমিটার, আর ১০-১৪ আইআরআই সূচকের ‘খুব খারাপ’ সড়ক রয়েছে ১ হাজার ৮৪৩ কিলোমিটার।

সড়কের মান যত খারাপ হয়, যানবাহন পরিচালন ব্যয় তত বাড়ে— এমনটাই বলা আছে সড়ক গবেষণাগারের প্রতিবেদনে। ভাঙাচোরা সড়কে বড় ট্রাক, মাঝারি ট্রাক, ছোট ট্রাক, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ইউটিলিটি যান, প্রাইভেট কার, টেম্পো, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল— ১১ ধরনের যানবাহন পরিচালন ব্যয় নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ‘দুর্বল’ সড়কে সব ধরনের যানবাহনের অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয় কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ গড়ে ১ টাকা ৯২ পয়সা। ‘খারাপ’ সড়কে এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪ টাকা ৪৬ পয়সা। আর খুব খারাপ সড়কে যানবাহনের কিলোমিটারপ্রতি অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয় গড়ে সর্বোচ্চ ১১ টাকা ৬ পয়সা।

নির্দিষ্ট যানবাহনের হিসাব করে দেখা গেছে, ‘দুর্বল’ সড়কে একটি ভারী ট্রাক পরিচালনায় কিলোমিটারপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয় হয় সর্বোচ্চ আড়াই টাকা। ‘খারাপ’ সড়কে অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ টাকা, আর খুব খারাপ সড়কে একটি ভারী ট্রাকে কিলোমিটারপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১৮ টাকা ৯ পয়সা। মাঝারি ট্রাকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় সর্বনিম্ন ১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা ১০ পয়সা। ভাঙাচোরা সড়কে ছোট ট্রাকে অতিরিক্ত ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১০ টাকা ২ পয়সা।

‘দুর্বল’ সড়কে একটি বাস পরিচালনায় কিলোমিটারপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয় হয় ৩ টাকা। ‘খারাপ’ সড়কে অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ ৭ টাকা, আর ‘খুব খারাপ’ সড়কে একটি দূরপাল্লার বাস পরিচালনায় কিলোমিটারপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১৮ টাকা ৪২ পয়সা। একইভাবে একটি মিনিবাস পরিচালনায় সর্বনিম্ন ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৬ টাকা ৭৭ পয়সা পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় হয়।

সড়ক গবেষণাগারের তথ্য অনুযায়ী, ভাঙাচোরা সড়কে একটি মাইক্রোবাস পরিচালনায় কিলোমিটারপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১৪ টাকা ৮১ পয়সা, ইউটিলিটি যানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ টাকা ৩৩ পয়সা, প্রাইভেট কারে সর্বোচ্চ ৯ টাকা ৮৩ পয়সা, টেম্পোতে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ টাকা, অটোরিকশায় সর্বোচ্চ ১ টাকা ৭ পয়সা ও মোটরসাইকেলে সর্বোচ্চ ৫ পয়সা।

খারাপ সড়কে শুধু পরিচালন ব্যয়ই বাড়ে না, যানবাহনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কালও কমে যায়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার বলেন, সারা দেশেই ভাঙাচোরা সড়ক রয়েছে। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে আমাদের কোনো গাড়িই বেশি দিন ভালো অবস্থায় রাখা যায় না। নানা ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশও ঘন ঘন বদলাতে হয়। রাস্তা ভালো হলে একটি গাড়ি ১০-১২ বছর অনায়াসে চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু আমাদের এখানে রাস্তা খারাপ হওয়ার কারণে সব ধরনের যানবাহনের আয়ুষ্কাল দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

এইচডিএমের তথ্যানুযায়ী দেশের ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ জাতীয়, ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ আঞ্চলিক ও ২৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ জেলা সড়ক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের কোনো মহাসড়ক ভাঙাচোরা নেই। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের কোনো মহাসড়ক আর ভাঙাচোরা নেই। ভাঙাচোরা বলতে আছে শুধু কিছু গ্রামীণ সড়ক। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-যশোর, ঢাকা-খুলনা সড়কগুলো ভালো অবস্থায় রয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের উন্নয়নকাজ চলছে। বেশির ভাগ সড়কের কোনো না কোনো উন্নয়নকাজ চলছে।

ভাঙাচোরা সড়কের কারণে যানবাহনের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি সাময়িক হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, সারা দেশের সড়ক-মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দরকার, সে পরিমাণ বরাদ্দ আমরা পাই না। এক অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে যা বরাদ্দ দেয়া হয়, তা দিয়ে সারা দেশের সড়ক মেরামত করা কঠিন। এর পরও চলতি অর্থবছর আমরা ওভার প্রোগ্রামিং করে সব প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। আগামী জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কাজ হবে। এসব কাজ শেষ হলে দেশে ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণ অনেকটাই কমে আসবে।

  • Courtesy: Banikbarta /Dec 19, 2018

No comments:

Post a Comment