সম্পাদকীয়
সারা দেশে ২৮টি হাই-টেক পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দাবি করা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে এসব হাই-টেক পার্কের কাজ শেষ হলে তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ উপকারভোগী হবে। এরই মধ্যে কয়েকটি জেলায় হাই-টেক পার্ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু সেগুলোয় আশাতীতভাবে কর্মচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সম্প্রতি বণিক বার্তার প্রতিনিধি যশোর থেকে ঘুরে এসে লেখা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আইসিটি শিল্পের সুষম বিকাশ ও উন্নয়নে যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক প্রকল্পটি অনুমোদন হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। একই বছরের সেপ্টেম্বরে এটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়। প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এতে ব্যয় বেড়ে হয় ২৫৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয় একই বছরের জুন পর্যন্ত। বাস্তবায়ন শেষে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। যদিও অব্যবস্থাপনায় প্রকল্পটির কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। ১৯৯৯ সাল থেকে হাই-টেক পার্ক সম্পর্কিত আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উন্নতি চোখে পড়ছে না কারো। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও এ খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়েনি।
হাই-টেক পার্ক থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল না পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, কোম্পানির অব্যবস্থাপনার কারণে শুরু থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। সেই সঙ্গে সরকার ঘোষিত সুবিধাদি না পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। বিশেষায়িত এ পার্কে প্রাণ সঞ্চার করতে দক্ষ জনবল পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। যে কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন পুরনো ও নতুন উদ্যোক্তারা। ঠিক একই কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। আইটি খাতের অগ্রগতির সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতের আইটি খাতে অগ্রগতির পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আইটি খাত উন্নয়নে দেশটি প্রথমেই সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য বাজার উপযোগী দক্ষ জনবল তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলে। পরবর্তী ধাপে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য গড়ে তোলে আইটি পার্ক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টোপথে, পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল তৈরি না করেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হাই-টেক পার্ক গড়ে তুলতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে যে কয়েকটি পার্ক চালু হয়েছে, তার অধিকাংশই দক্ষ জনবল সংকটের কারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। যশোর হাই-টেক পার্কে প্রথম দফায় লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলে শিক্ষিত বেকারদের রীতিমতো ঢল নামে। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই এ খাত সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। তাই সরকারকে সর্বাগ্রে এসব হাই-টেক পার্কের জন্য দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রমেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ।
দক্ষ জনবল ছাড়াও অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে হাই-টেক পার্কে। হাই-টেক পার্কগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া হাই-টেক পার্কের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যশোর হাই-টেক পার্ক সম্পন্ন হলেও জায়গা বরাদ্দের কাজই শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে বিপুল জায়গা অব্যবহূত রয়ে গেছে। শুধু হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করলেই হবে না, পাশাপাশি থাকা-খাওয়া-বিনোদন-শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার জন্য মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে হবে। নতুবা দক্ষ জনবল সেখানে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ঢাকা থেকে কাউকে সেখানে কাজে রাখাও কঠিন হয়ে পড়বে। হাই-টেক পার্ক একটি সমন্বিত প্রকল্প। একে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে উদ্যোগ সামনে রেখে সরকার আইটি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বিপুল বিনিয়োগ করছে, তা থেকে বাস্তব ফল লাভে পরিকল্পনার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকাও আবশ্যক। শুধু পরিকল্পনা নয়, বাস্তব রূপও দিতে হবে এসবের। হাই-টেক পার্কে বিদ্যমান সমস্যা দ্রুত চিহ্নিতপূর্বক তা সমাধানে উদ্যোগ নেয়া উচিত কর্তৃপক্ষের। এক্ষেত্রে কালক্ষেপণের কারণে বিনিয়োগ হারিয়ে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়তে পারেন। তখন হাই-টেক পার্কগুলো ভবনসর্বস্ব হয়েই থাকবে, অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব থাকবে না।
কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮
No comments:
Post a Comment