এম সাখাওয়াত হোসেন
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এযাবৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে ৩০ ডিসেম্বর। এর আগে বাংলাদেশের কোনো সংসদ নির্বাচন ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা এমন শক্তিধর দলীয় সরকারের অধীনে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিপরিষদ এবং ৩৫০ জন সাংসদ বহাল থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়নি। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রাক্–নির্বাচনী এমন জটিল এবং চমকপ্রদ জোটের (সম্ভাব্য) নির্বাচন হয়নি। নির্বাচনী মাঠে রয়েছে একাধিক জোট, যার মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে ঘিরে যে জোট গড়ে উঠেছে, তার গঠনপ্রক্রিয়া এবং শরিকদের রাজনৈতিক দর্শন বলতে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই।
দুই জোটের এবং দলের মনোনয়নপ্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহের সময় যে উন্মাদনা দেখা গেল, তা আগে তেমন ঘটেনি। দুই দলের বা জোটের প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া নিয়েও যথেষ্ট জটিলতা দেখা দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আগামী নির্বাচন বাংলাদেশ সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের জটিল পরিস্থিতি এবং চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের বিগত নির্বাচন কমিশনগুলোর, বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পরের কমিশনগুলোর কোনো কমিশনকেই মুখোমুখি হতে হয়নি।
এবারের নির্বাচন কমিশনের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, সেগুলোর মুখোমুখি হয়ে এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে হয়তো মোটামুটি একটি ভালো নির্বাচনের আশা করা যায়। তবে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান এবং আইন দ্বারা যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তার সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবহারের ওপর তা নির্ভর করবে। আমরা দেখেছি যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে কমিশন তাদের এই ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে বরিশাল নির্বাচন নিয়ে একজন নির্বাচন কমিশনারের প্রতিবেদনের দৃষ্টান্ত বিবেচনায় নিতে পারি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ওই প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সেই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম এবং নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত প্রশাসনের নিরাপত্তা সদস্যসহ, পক্ষপাতিত্ব বা নির্লিপ্ততা যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদন থেকে এ বিষয় নিশ্চিত যে নির্বাচন কমিশন তাকে প্রদত্ত ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারেনি অথবা কোনো কারণে করতে চায়নি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি যেহেতু কমিশনের সর্বসম্মতিক্রমে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল (ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে), তাই তাৎক্ষণিক না হলেও পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশন তা বাতিল করতে পারত। নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১১৯ ধারায় সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ওই ধারার আওতায় নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান বা প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, এমন যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে।
১৯৭৭ সালে ভারতের লোকসভার (সংসদ) নির্বাচনকালে পাঞ্জাবের ফিরোজপুর সংসদীয় আসনের কয়েকটি কেন্দ্রে ব্যাপক ভোট কারচুপির কারণে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ সংসদীয় এলাকার নির্বাচন বাতিল করে। এই বাতিলের বিরুদ্ধে একজন প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে উচ্চ আদালতে মামলা করেন (মহিন্দর সিং গিল ও অন্যান্য বনাম নির্বাচন কমিশন: এআইআর ১৯৭৮ এসসি ৮৫১)। মামলার আরজিতে বলা হয়, যে কয়েকটি কেন্দ্রে গোলযোগ এবং ভোট কারচুপি হয়েছিল, সেগুলো বন্ধ না করে নির্বাচন কমিশন এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে সম্পূর্ণ সংসদীয় এলাকার নির্বাচন বন্ধ করায় প্রার্থীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই মামলার নিষ্পত্তি করে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, সেটি ছিল যুগান্তকারী এবং ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ ধারার আওতায় অবাধ ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাখ্যা। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়, নির্বাচন কমিশন অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তার যেকোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। ওই ক্ষমতা সংবিধান অথবা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলেই হলো। কাজেই নির্বাচন কমিশনের সব ক্ষমতা যে লিখিত আকারে রয়েছে, তেমন নয়। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে।
ভারতের সংবিধানের অনুরূপ আমাদের সংবিধানের ধারা ১১৯ একই ভাষায় প্রণীত। এ ধারাবলে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনেরও অনুরূপ সীমাহীন ক্ষমতা (প্লেনারি পাওয়ার) দেওয়া রয়েছে। ভারতের অনুরূপ বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ২০০৫ সালের একটি মামলার নিষ্পত্তিকালে (আবদুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য: রিট ২৫৬১ আগস্ট ২৪,২০০৫) সংবিধানের ধারা ১১৯ (১)-এর অবাধ ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। কাজেই শুধু নির্বাচন চলাকালে নয়, নির্বাচনের দিনের আগে এবং পরে নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যে কোনো এলাকায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে ওই নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। এর আওতায় বরিশালের নির্বাচনটি বাতিল করা হলে কমিশন জনগণের আস্থা অর্জন ও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত, যার সুফল সামনের জাতীয় নির্বাচনেও পাওয়া যেত।
২.কোনো নির্বাচনই অতীত নির্বাচনের মতো ভালো বা খারাপ হবে বা অনুরূপ ব্যবস্থাপনার ছকে হবে, তেমন ভাবার অবকাশ নেই। সম্পূর্ণ নির্বাচন–প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশনের আওতায় রাখতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে যেমন দায়িত্ব নিতে হবে, তেমনি নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনার (মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট) দিকে নজর দিতে হবে। এই ব্যবস্থাপনার ছক, তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাতেই রাখতে হবে। তা রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘাড়ে চাপালে হবে না। অনেক ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদনের অপেক্ষা না করে পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে নির্বাচন কমিশন নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নিতে পারে এবং প্রয়োজনে তা–ই নেওয়া উচিত। অভিযোগ মৌখিক, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অথবা দৃশ্যমান—সর্বক্ষেত্রেই আমলে নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে এসব অভিযোগ খণ্ডন অথবা ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব সিদ্ধান্ত অবশ্যই জনসমক্ষে উন্মুক্ত করতে হবে। অন্যথায় নির্বাচন কমিশন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।
৩.মনোনয়নপত্র বাছাই নিয়ে এবার যা হয়েছে, তা আগে কখনো হয়নি। যেখানে বিএনপির ১৪১ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের বাতিল হয়েছে মাত্র তিনজনের। বাতিলের ফলে ছয়টি আসনে বিএনপি প্রার্থীশূন্য হয়ে পড়েছে, যদিও এসব আসনে একাধিক প্রার্থী দিয়েছিল। প্রথম আলোর (৩ ডিসেম্বর, ২০১৮) শিরোনাম ছিল ‘মনোনয়ন বাতিলের রেকর্ড’। তবে এই বাতিলের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে আপিলের সুযোগ রয়েছে এবং তারপরেও রয়েছে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ। ইতিমধ্যেই অনেক প্রার্থী আপিল করেছেন।
২০০৮ সালে (আমার তথ্য অনুযায়ী) ২ হাজার ৫৪২ জনের মধ্যে বাতিল হয়েছিল ৫৫৭ জনের, যাঁদের মধ্যে ৮৯ স্বতন্ত্রসহ ৩৯৮ জন আপিল করেছিলেন, যার মধ্যে ১২৪ জন বৈধ প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্তভাবে বৈধ হন। এঁদের মধ্যে বেশির ভাগই রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আইনের ব্যাখ্যাজনিত কারণে। শুধু একজনের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। স্মরণযোগ্য যে ওই সময়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। ছোটখাটো ত্রুটির জন্য বাতিল না করার নির্দেশ দিয়ে কয়েকটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ওই সময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাতিল হয়েছিল আদালত কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত, ঋণখেলাপি এবং বিলখেলাপির কারণে। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, এবারও ঋণখেলাপিদের সংখ্যাই বেশি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষিত হতে হবে।
প্রসঙ্গত, ওই সময়ই অর্থাৎ ২০০৮ সালে প্রথম বৈধতার বিরুদ্ধে আপিল গৃহীত হয়েছিল, এ ক্ষেত্রেই ৮৯ জনের আপিল গৃহীত হয়েছিল এবং কয়েকজনের প্রার্থিতা বাতিলও করা হয়েছিল। পরে আরও ১৭ জন প্রার্থী আদালতের রায়ের কারণে এমন সময় মুক্ত হয়েছিলেন, যখন আমাদের প্রায় ২৮ লাখ ব্যালট পেপার পোড়াতে হয়েছিল নতুন ব্যালট পেপার তৈরি করতে। পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আদালতের প্রতি পরোক্ষভাবে হতাশা ব্যক্ত করায় উচ্চ আদালত কর্তৃক আপিল শুনানি বন্ধ হয়েছিল। ওই সময় বাতিলের কারণে প্রধান দলগুলোর কোনো আসন প্রার্থীশূন্য হয়নি।
ওই সময়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং হিউম্যান রাইটস থেকেও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। আমরা প্রতিটি আপিল ধৈর্যসহকারে শুনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেককে চাহিদামতো রায়ের কপি দেওয়া হয়েছিল, যাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি উচ্চ আদালতে যেতে পারেন।
আমি এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ এ কারণে দিলাম, কারণ নির্বাচন কমিশনের কাছেই আপিল আসবে এবং নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে নির্মোহভাবে শেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুনানি হতে হবে প্রকাশ্যে এবং পরিচ্ছন্নভাবে। এ ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাতিল হয়ে থাকে, তবে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. সন্দেহ নেই যে নির্বাচন কমিশন এক জটিল পরিস্থিতি এবং কঠিন নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছে। কাজেই বেলা শেষে সব দায়দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনের ওপরে বর্তাবে। দৃশ্যত মনে হয়, নির্বাচন কমিশন একটি ভালো নির্বাচনের আশা করে কিন্তু সে আশা বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হলে সময় থাকতেই দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার প্রতি সুবিচারের মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি হোক মনোনয়ন–প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে, তাদের সঠিক ও সাহসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। অন্য কেউই তাদের ব্যর্থতার অংশীদার হবে না।
- ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং বর্তমানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এসআইপিজির সম্মানিত ফেলো
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮