সম্পাদকীয়
আপিল নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সন্তোষজনক ভূমিকা রাখতে পেরেছে। খুলনা মহানগর পুলিশ কমিশনার বদলের মতো ঘটনায়ও ইসির যথাযথ বিবেচনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা গেলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মাঠ সমতল করার ক্ষেত্রে ইসির সদিচ্ছার প্রমাণ মিলবে। ইসির সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো, তাদের এ ধরনের ভূমিকা পালনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
কিছু রিটার্নিং কর্মকর্তার মনোনয়নপত্র বাতিলের অপরিণামদর্শী ও বৈষম্যমূলক ভূমিকা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল। নতুন করে একটা অস্বস্তি তৈরি হতে শুরু করেছিল। ইসির যথাবিহিত ব্যবস্থার কারণে দ্রুততার সঙ্গে এর অনেকটাই অবসান ঘটেছে বলা যায়। খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে ইসিতে ৪:১ ভোটে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইসির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেহেতু আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে, তাই আমরা আশা করব এ নিয়ে কোনো মহলেই অহেতুক বাগ্বিতণ্ডায় জড়াবে না।
আপিল জমা পড়েছিল ৫৪৩টি। গত তিন দিনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ২০৪ জন, যাঁদের বেশির ভাগই বিরোধীদলীয়; তাঁদের কেউ কেউ সরকারি দলের শক্ত প্রতিপক্ষ হবেন। ৩০ ডিসেম্বরের আগে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে মাঠ সমতল করতে ইসির যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। এখন নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়ে যাবে। আগামী ২০ দিন তাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধ করা। আচরণবিধির নানাবিধ লঙ্ঘন আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি। সবার বিরুদ্ধে সমান প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না, সেটা দেশবাসীর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। অনেক বেশি আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা ক্ষমতাসীন দল যে দেখাতে পারে, তার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির নির্লিপ্ততার বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার উষ্মা ব্যক্ত করেছেন। কারণ, আচরণবিধি লঙ্ঘনের নানা ধরনের ঘটনাই সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে আসছে। কিন্তু তেমন কোনো ক্ষেত্রেই প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ৩০০ আসনে বিচার বিভাগীয় ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিলিয়ে এক হাজারের বেশি লোকবল নিয়োজিত রয়েছেন। ইসি দরকার হলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিগুলোকে অধিকতর সক্রিয় করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে প্রশাসনিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। ইসি নিজেদের সামর্থ্য বাড়ানোর যতগুলো উপায় রয়েছে, সেসব বাস্তবায়নে যদি তারা মনোযোগী ও যত্নশীল হয়, তাহলে এখনো সময় আছে মাঠ সমতল করার ধারণা বেশ একটা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারে।
হলফনামায় ভুল তথ্য দেওয়ার কারণে কারও প্রার্থিতা যেকোনো সময় বাতিল হতে পারে, সে বিষয়ে ইসির বিশেষ উদ্যোগ প্রত্যাশিত। কারণ, ইসি শুধু আপিলটাই বিবেচনায় নিয়েছে। তাদের উচিত উপযুক্ত লোকবলের সমন্বয় ঘটিয়ে হলফনামা, ব্যাংক হিসাব, নির্বাচন পরিচালনার খরচ এবং সম্পদ, দায়দেনা–সংক্রান্ত বিবরণীগুলো যাচাই-বাছাইয়ে ব্রতী হওয়া। মনোনয়নপত্র টিকে যাওয়ার অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রার্থী হওয়ার সব শর্ত পূরণ করা বোঝায় না। অনেক প্রার্থীর হলফনামায় গুরুতর গলদ থাকতে পারে, এসব বিষয় নির্মোহভাবে প্রকাশিত হওয়া দরকার। সব প্রার্থীর মনোনয়ন-সংক্রান্ত সব নথিপত্র মনোনয়নপত্র দাখিলের সঙ্গে সঙ্গে ওয়েবসাইটে সহজলভ্য করা আইনের শর্ত ছিল। অথচ এই শর্ত পূরণ করা হয়নি। ইসিকে মনে রাখতে হবে, তারা তাদের প্রতিটি কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বাধ্য।
মনোনয়নপত্রের বৈধতার বিষয়টি যে কেবলই নির্দিষ্ট দিনক্ষণনির্ভর কোনো বিষয় নয়, সেই ধারণা নির্বাচনী প্রার্থীদের মগজে-মননে কার্যকরভাবে গেঁথে দিতে হবে। প্রার্থীরা যাতে কোনোভাবেই মনে না করেন যে মনোনয়নপত্র একবার টিকে গেলেই হলো। আইন হলো, কোনো ভুল বা অসত্য তথ্যের কারণে নির্বাচনে জয়ী হলেও কেউ সাংসদ পদে থাকতে অযোগ্য হতে পারেন। এ ধরনের অব্যাহত জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া নির্বাচনী মাঠ সমতলে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ১০ ডিসেম্বর ২০১৮