সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির প্রধান উৎসই চাল। বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে প্রচুর পরিমাণে ভাত খেতে হয় শুধু শর্করার চাহিদা পূরণের জন্য নয়, তাঁদের আমিষেরও একটা বড় অংশ আসে ভাত থেকে। তাই চালকে বলা হয় আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য এবং এর দাম যেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়সাধ্যের সীমা অতিক্রম না করে, সরকারকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। কিন্তু আমাদের বাজার যেহেতু মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মে চলে, তাই সরকারের পক্ষে খোলাবাজারে চালের দাম বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে চালের বাজারের প্রতি সরকারের কোনো নজরদারি থাকবে না। দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারের গতি–প্রকৃতি অনুযায়ী চালের দাম ওঠানামা করা স্বাভাবিক, কিন্তু যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই যখন চালের দাম বেড়ে যায়, তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষগুলোকে কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হয়। এটা তাদের দায়িত্বের একটা অংশ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের বাজারে চালের দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম তিন থেকে চার টাকা বেড়ে যাওয়া সামান্য বিষয় নয়। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর আর্থিক চাপ বেড়েছে। কিন্তু চালের এই মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের (বিটিসি) দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত অর্থবছরে (২০১৭–১৮) দেশে আগের বছরের তুলনায় ২৪ লাখ ৭৪ হাজার টন বেশি চাল উৎপন্ন হয়েছে। একই বছরে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে ৪২ লাখ টনেরও বেশি চাল। অন্যদিকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম প্রতি টনে প্রায় ৪০ মার্কিন ডলার কমেছে। ফলে টিসিবির দ্রব্যমূল্য মনিটর সেল বলছে, বাংলাদেশের বাজারে চালের যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।
তাহলে চালের দাম বাড়ার কারণ কী? এর দায় কার?
চাল ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলেছেন, চালকলমালিকেরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। এটা একটা বহুল উচ্চারিত অভিযোগ, কয়েকটি বড় চালকলের মালিকেরা একজোট হয়ে চালের বাজার নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করেন। চালের সর্বশেষ দাম বাড়ানোর পেছনে রয়েছে তাঁদের কারসাজি। খাদ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী ১০ জানুয়ারি চালকলমালিক ও ধান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসলে তাঁরা চালের দাম কমানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর অর্থ চালের দাম তাঁরা ইচ্ছা করলেই বাড়াতে কিংবা কমাতে পারেন, এর সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক নেই। আশ্বাস দেওয়ার পর বড় কলগুলো চালের দাম কেজিপ্রতি মাত্র ১ টাকা কমিয়েছে; কিন্তু তার কোনো সুফল খুচরা বাজারে পড়েনি। খোলাবাজারে মানুষকে এখনো প্রতি কেজি চাল তিন থেকে চার টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
অযৌক্তিক মুনাফার লোভে কারও এ ধরনের তৎপরতাকে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে। যুক্তিসংগত কারণ ব্যাখ্যা না করে খেয়ালখুশিমতো চালের দাম বাড়ানোর পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এটা শুধু এই মুহূর্তের সমস্যা নয়, একটা স্থায়ী সমস্যা হিসেবে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। এর স্থায়ী সমাধানের জন্য বাজারে নিয়মিত নজরদারি জোরালো করতে হবে এবং অযৌক্তিক দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী চালকলমালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের আশ্বাসে সরকারের বা আমাদের আশ্বস্ত হওয়ার সুযোগ নেই, চালের দাম অবিলম্বে আগের অবস্থায় নামিয়ে আনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে অযৌক্তিকভাবে চালসহ যেকোনো ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো একটা অপরাধ। এই অপরাধের বিচার হওয়া উচিত।
- Courtesy: Ptothom Alo/ Jan 27, 2019