এক বছরে বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণ
সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু
বেশ নাজুক অবস্থায় চলে গেছে জনতা ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি মুনাফা করেছে। কিন্তু এখন লোকসান গুনছে জনতা ব্যাংক। খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ব্যাংকটির ভিত এখন অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রার সূচনার পর এখনই সবচেয়ে বাজে সময় পার করছে ব্যাংকটি। ফলে এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গত বছর (২০১৮) ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ফলে এক বছরেই জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এই ঋণের পুরোটাই আবার দুইটি গ্রুপের কাছে। যাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই ঋণ প্রদান করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকটির এমন উদ্বেগজনক খবরে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার সরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে ‘বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি’র অগ্রগতিবিষয়ক এক আলোচনা সভায় জনতা ব্যাংক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যাংকটিকে দ্রুত তার খেলাপি ঋণ আদায়ের যাবতীয় কার্যকর ও আইনি পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
জানা গেছে, কর্ম সম্পাদন চুক্তি অনুযায়ী জনতা ব্যাংকের জন্য চলতি অর্থবছরে বেশ কয়েকটি টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খেলাপি বা শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, কৃষি ঋণ বিতরণ, এসএমই ঋণ বিতরণ, অন্যান্য বিনিয়োগ, পরিচালন মুনাফা অর্জন, লোকসানি শাখার সংখ্যা হ্রাস, রিট মামলা নিষ্পত্তি, অর্থঋণ ও অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তি, বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি, শাখাগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ইত্যাদি।
ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সূচকে জনতা ব্যাংক টার্গেট পূরণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। খেলাপি বা শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে চলতি বছরের জন্য আদায়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর’২০১৮) আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৫৮ কোটি টাকা। টার্গেট অনুযায়ী এ সময়ে আদায় করার কথা ছিল ২৫০ কোটি টাকা। একইভাবে অবলোপনকৃত (ডেট রিট অফ) ঋণ থেকে আদায় করার টার্গেট ছিল ১৫০ কোটি টাকা। এই হিসাবে ছয় মাসে আদায় হওয়ার কথা ছিল ৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে জনতা ব্যাংক আদায় করেছে মাত্র ১৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের মোট ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণের মধ্যে দুইটি গ্রুপের কাছেই রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই দুইটি গ্রুপ হলো- ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও অ্যাননটেক্স। অ্যাননটেক্সের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রায় পুরোটাই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল নিজেই নিয়েছেন। অ্যাননটেক্স তার কোম্পানির নামে বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুললেও টাকা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ব্যাংক নিজেই বাধ্য হয়ে বিদেশী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করেছে। গ্রাহককে তা পরিশোধের কথা থাকলেও তারা তা পরিশোধ করেনি। এসব দায়ের বিপরীতে ফোর্সড ঋণ তৈরি করেছে জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে এই গ্রুপটি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।
অন্য দিকে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ বিভিন্ন সরকারি তহবিল ও জনতা ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চামড়ার ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে সরকার থেকে নগদ রফতানি সুবিধা নিয়েছে, পক্ষান্তরে রফতানি করেও দেশে টাকা ফেরত আনেনি। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ক্রিসেন্টের পাদুকা বিক্রির দোকান রয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে ৭৫ ভাগ ছাড়ে তারা জুতা বিক্রি করছে বলে জানা গেছে।
এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রয়েছেন দুই ভাই। একজন এম এ কাদের এবং অন্যজন এম এ আজিজ। কাদের জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধানও। সম্প্রতি মুদ্রা পাচার আইনে এম এ কাদেরকে এনবিআরের দায়ের করা মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জনতা ব্যাংকও এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করার সবেমাত্র আইনি আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের এই বিশাল অঙ্কের অর্থ শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাত ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় জনতা ব্যাংক এসব ঋণ দিয়েছিল। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত এমডি ছিলেন এস এম আমিনুর রহমান। তাদের সময়েই এসব অর্থায়ন হয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়।
ব্যাংক খাতের যে শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপি রয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশই জনতা ব্যাংকের। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে খেলাপিদের এই তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। দেশের শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির মধ্যে জনতা ব্যাংকের গ্রাহকেরা হলো কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম, রেমিক্স ফুটওয়্যার, রুবাইয়া ভেজিটেবল ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্ট, চৌধুরী নিটওয়্যার, আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস, মুন্নু ফেব্রিকস, সিক্স সিজন অ্যাপার্টমেন্ট, রহমান স্পিনিং মিলস, ওয়ান ডেনিম মিলস, হিন্দোল ওয়ালী ট্রেডিং, গ্লোবাল মেটাল কমপ্লেক্স, অ্যাপেক্স নিট কম্পোজিট, আলী পেপার মিলস, ড্রেজ বাংলা লিমিটেড, গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ডায়িং, রেপকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও ফাইবার শাইন লিমিটেড।
জনতা ব্যাংক ২০১৭ সালে নিট মুনাফা করেছিল ৯৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ২৫১ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৪৬২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল। যা ছিল সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু এ বছর ব্যাংকের অবস্থা অনেক নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় এই ব্যাংকটিকে আগের অবস্থায় নিতে হলে এখনই ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালানো, ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করা এবং খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করার পাশাপাশি সৃষ্ট খেলাপি ঋণের পেছনে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট লোকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
- সুত্র - নয়াদিগন্ত / ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
- https://goo.gl/wmWsg6