তৈমূর আলম খন্দকার
গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনের ছদ্মাবরণে যে ঘটনা ঘটে গেল, যাকে শেখ হাসিনা সরকারের মহা বিজয় বলতে দেশের গোটা বুদ্ধিজীবী সমাজ, যারা সরকারের অধীনে বড় বড় চেয়ারে অধিষ্ঠিত আছেন তারা তো বটেই, বরং দেশী-বিদেশী অভিনন্দনবার্তা সব মিলিয়ে ইতিহাসের পাতায় কোথায় অবস্থান নেবে তা এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বহুবার বলা হয়েছে, গায়েবি মামলা বিরোধী দলকে নির্যাতন নিষ্পেষণ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সরকার তাদের কথামতো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, যার জন্য সরকারপ্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ জনসভায় নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ/প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উপকারীর উপকার স্বীকার করতে হয় বিধায় প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়ে কোনো ভুল করেছেন তা বলতে চাই না। তবে গায়েবি মোকদ্দমা প্রধানমন্ত্রীকে ইতিহাসের পাতায় কোথায় স্থান করে দেবে তিনি হয়তো এখনো উপলব্ধি করেননি। উপলব্ধি না করার কারণ এও হতে পারে যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের গ্রিন সিগন্যাল থেকেই গায়েবি মোকদ্দমার উৎপত্তি, যার কারণে এত সমালোচনার পরও সরকার বা কোনো মহল বা সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবী গায়েবি মামলার অস্তিত্ব স্বীকারই করেন না।
গায়েবি মোকদ্দমা কী? জাতীয় পত্রিকায় ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদ থেকেই গায়েবি মামলার আকার, রঙ, প্রকার প্রভৃতি চিত্রায়িত করা যাবে। সংবাদটির নিজস্ব রূপ, পঙ্গু তারা মিয়া, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যার বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দেয়া হয়েছিল, তাকে নিয়ে জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ২৩ জানুয়ারি তিনি হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। পুলিশের করা ওই মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের দু’দিন আগে বিকেল ৪টার পর সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর বাজারে চাপাতি, হকিস্টিক ও রড নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মামলায় ৫২ জনকে আসামি করে পুলিশ। তারা মিয়া সেই ৫২ জনের একজন। তবে জামিনের সময় শেষ হয়ে গেলে তারা মিয়াকে সুনামগঞ্জের নি¤œ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
জানা গেছে, ডান হাতটি অস্বাভাবিক চিকন, নাড়াতেই কষ্ট হয়। কিছু ধরতে বা কাজ করতে পারেন না ডান হাত দিয়ে। এমনকি ডান হাতে খেতেও পারেন না। এটি তার জন্মগত সমস্যা। বাম হাত তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং বাঁকানো। খুব কষ্ট করে বাম হাত দিয়ে খেতে হয়। ছবির ওই মানুষটির ডান হাত অচল, বাম হাতও প্রায় অচল। সুনামগঞ্জের অধিবাসী তারা মিয়া চাপাতি, হকিস্টিক ও রড হাতে নিয়ে আক্রমণ করেছেন পুলিশের ওপর। ভিক্ষা করে জীবনযাপন করা তারা মিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ এমন অভিযোগ এনে মামলা করেছে। যার সামান্য বোধ শক্তি রয়েছে এই সংবাদ পাঠ করার পর তার মনে নিশ্চয়ই গায়েবি মামলা সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মাবে। আর যিনি একটি একতরফা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে গায়েবি মামলার সমর্থক তার কথা ভিন্ন। কিন্তু একজন বিবেকবান মানুষের কোনো কারণেই এ গায়েবি মামলা সমর্থন করার কথা নয়। যদিও গায়েব থেকে সৃষ্ট এই গায়েবি মামলাই বিরোধী দলের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
যদিও পদোন্নতির ভাগ্যাকাশ অনেকের জন্যই খুলে গেছে। অথচ বাম জোটের মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পথে। তারা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত এ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে গত ২৮ জানুয়ারি বাম গণতান্ত্রিক জোটের ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির নির্বাচন গণশুনানির অভিজ্ঞতা নাগরিক সমাজের ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পৃথিবীর ২০০টি দেশের মধ্যে ৫০টি দেশে গণতন্ত্র আছে। বাকিগুলোতে স্বৈরতন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মিছিলে ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে থাকা অবস্থায় নিহত হন। কেউ বলতে পারবে না কোন নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ ভয় এবং লোভ ব্যবহার করে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। তিনি এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পন্থায়। বাংলাদেশ অন্ধকার পথে প্রবেশ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। অধ্যাপক আকাশ বাম জোটকে ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’ আন্দোলন গড়ে তোলায় আহ্বান জানান। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে পূর্বপরিকল্পিত পদ্ধতিতে নির্বাচনে অতি বিজয় অর্জন করেছে। (সূত্র : ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ জাতীয় পত্রিকা)
এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেভাবে আওয়ামী লীগকে জেতানো হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর সম্মানের প্রতি আঘাত করা হয়েছে। যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন, তারা কেউ আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী নয়। এতে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। (সূত্র : ২৯ জানুয়ারির জাতীয় পত্রিকা)
নির্বাচনে মহা বিজয় সম্পর্কে ২৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাজয়ের কারণ হিসেবে ১৪টি এবং বিএনপি জোটের তথা ঐক্যফ্রন্টের হারের সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে সাতটি ব্যর্থতার কারণ হিসেবে নির্ধারণ করে মন্তব্য করেছেন, সেহেতু বিএনপির পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানো দরকার। নতুবা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অখণ্ডিতভাবেই থেকে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করাই রাজনৈতিক দলের ধর্ম হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতিবাদ ও জবাবদিহিতা না থাকলে ‘রাজনীতি’ থাকে না। নির্বাচনে হেরে যাওয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন তার আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়া জনগণের মধ্যে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার করবে, অন্য দিকে কর্মীদের কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। বিএনপির ওপরে শেখ হাসিনা সরকার যে স্টিম রোলার চালিয়েছে, তা তিনি জেনেও সাফাই গাওয়ার জন্যই ২৫ জানুয়ারি জনসভায় নির্বাচনের মহাজয় ও প্রতিপক্ষের পরাজয়ের ব্যাখ্যা করেছেন, যা তার নিজস্ব আঙ্গিকেই তিনি করেছেন, যা সুনির্দিষ্টভাবে খণ্ডানোর দায়িত্ব বিএনপির রয়েছে বলে মনে করি। প্রবাদ রয়েছে, ‘চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না’।
এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানোর বিষয়ে বিএনপি পিছিয়ে থাকলে পরিস্থিতি বিএনপিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেবে। ফলে বিষয়টি অনেক গুরুত্ব বহন করে। স্মরণ করা দরকার, কে কি করে তা নিয়ে অন্যকে ফাঁকি দেয়া যায়, কিন্তু নিজেকে কি ফাঁকি দেয়া সম্ভব? ঘটে যাওয়া ‘নির্বাচন’ নামক প্রহসন সম্পর্কে ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে, বিদেশীদের চোখে ধুলো দেয়া যাবে, কিন্তু তারা কি তাদের নিজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন যারা ভূমিধস বিজয় অর্জনের কারিগর হিসেবে ব্যবহার হয়েছেন? জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে যাদের স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন লালিত-পালিত তাদের বিবেক কি জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করেনি? জাতির বিবেক কি নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যাবে? কারো কারো পদোন্নতি, বিলাসবহুল জীবনধারণ ও আকাশচুম্বী উন্নতির কামনা-বাসনার কাছে কি জাতি হেরে যাবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহিতার কি কোনো প্রয়োজন নেই? (ক্রমশ)
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
- সুত্র- নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৯