Search

Sunday, February 3, 2019

পোস্ট মর্টেম : জাতীয় নির্বাচন ২০১৮

তৈমূর আলম খন্দকার

গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনের ছদ্মাবরণে যে ঘটনা ঘটে গেল, যাকে শেখ হাসিনা সরকারের মহা বিজয় বলতে দেশের গোটা বুদ্ধিজীবী সমাজ, যারা সরকারের অধীনে বড় বড় চেয়ারে অধিষ্ঠিত আছেন তারা তো বটেই, বরং দেশী-বিদেশী অভিনন্দনবার্তা সব মিলিয়ে ইতিহাসের পাতায় কোথায় অবস্থান নেবে তা এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বহুবার বলা হয়েছে, গায়েবি মামলা বিরোধী দলকে নির্যাতন নিষ্পেষণ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সরকার তাদের কথামতো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, যার জন্য সরকারপ্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ জনসভায় নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ/প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উপকারীর উপকার স্বীকার করতে হয় বিধায় প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়ে কোনো ভুল করেছেন তা বলতে চাই না। তবে গায়েবি মোকদ্দমা প্রধানমন্ত্রীকে ইতিহাসের পাতায় কোথায় স্থান করে দেবে তিনি হয়তো এখনো উপলব্ধি করেননি। উপলব্ধি না করার কারণ এও হতে পারে যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের গ্রিন সিগন্যাল থেকেই গায়েবি মোকদ্দমার উৎপত্তি, যার কারণে এত সমালোচনার পরও সরকার বা কোনো মহল বা সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবী গায়েবি মামলার অস্তিত্ব স্বীকারই করেন না।

গায়েবি মোকদ্দমা কী? জাতীয় পত্রিকায় ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদ থেকেই গায়েবি মামলার আকার, রঙ, প্রকার প্রভৃতি চিত্রায়িত করা যাবে। সংবাদটির নিজস্ব রূপ, পঙ্গু তারা মিয়া, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যার বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দেয়া হয়েছিল, তাকে নিয়ে জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ২৩ জানুয়ারি তিনি হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। পুলিশের করা ওই মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের দু’দিন আগে বিকেল ৪টার পর সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর বাজারে চাপাতি, হকিস্টিক ও রড নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মামলায় ৫২ জনকে আসামি করে পুলিশ। তারা মিয়া সেই ৫২ জনের একজন। তবে জামিনের সময় শেষ হয়ে গেলে তারা মিয়াকে সুনামগঞ্জের নি¤œ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

জানা গেছে, ডান হাতটি অস্বাভাবিক চিকন, নাড়াতেই কষ্ট হয়। কিছু ধরতে বা কাজ করতে পারেন না ডান হাত দিয়ে। এমনকি ডান হাতে খেতেও পারেন না। এটি তার জন্মগত সমস্যা। বাম হাত তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং বাঁকানো। খুব কষ্ট করে বাম হাত দিয়ে খেতে হয়। ছবির ওই মানুষটির ডান হাত অচল, বাম হাতও প্রায় অচল। সুনামগঞ্জের অধিবাসী তারা মিয়া চাপাতি, হকিস্টিক ও রড হাতে নিয়ে আক্রমণ করেছেন পুলিশের ওপর। ভিক্ষা করে জীবনযাপন করা তারা মিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ এমন অভিযোগ এনে মামলা করেছে। যার সামান্য বোধ শক্তি রয়েছে এই সংবাদ পাঠ করার পর তার মনে নিশ্চয়ই গায়েবি মামলা সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মাবে। আর যিনি একটি একতরফা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে গায়েবি মামলার সমর্থক তার কথা ভিন্ন। কিন্তু একজন বিবেকবান মানুষের কোনো কারণেই এ গায়েবি মামলা সমর্থন করার কথা নয়। যদিও গায়েব থেকে সৃষ্ট এই গায়েবি মামলাই বিরোধী দলের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

যদিও পদোন্নতির ভাগ্যাকাশ অনেকের জন্যই খুলে গেছে। অথচ বাম জোটের মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পথে। তারা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত এ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে গত ২৮ জানুয়ারি বাম গণতান্ত্রিক জোটের ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির নির্বাচন গণশুনানির অভিজ্ঞতা নাগরিক সমাজের ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পৃথিবীর ২০০টি দেশের মধ্যে ৫০টি দেশে গণতন্ত্র আছে। বাকিগুলোতে স্বৈরতন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মিছিলে ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে থাকা অবস্থায় নিহত হন। কেউ বলতে পারবে না কোন নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ ভয় এবং লোভ ব্যবহার করে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। তিনি এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পন্থায়। বাংলাদেশ অন্ধকার পথে প্রবেশ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। অধ্যাপক আকাশ বাম জোটকে ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’ আন্দোলন গড়ে তোলায় আহ্বান জানান। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে পূর্বপরিকল্পিত পদ্ধতিতে নির্বাচনে অতি বিজয় অর্জন করেছে। (সূত্র : ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ জাতীয় পত্রিকা)

এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেভাবে আওয়ামী লীগকে জেতানো হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর সম্মানের প্রতি আঘাত করা হয়েছে। যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন, তারা কেউ আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী নয়। এতে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। (সূত্র : ২৯ জানুয়ারির জাতীয় পত্রিকা)

নির্বাচনে মহা বিজয় সম্পর্কে ২৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাজয়ের কারণ হিসেবে ১৪টি এবং বিএনপি জোটের তথা ঐক্যফ্রন্টের হারের সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে সাতটি ব্যর্থতার কারণ হিসেবে নির্ধারণ করে মন্তব্য করেছেন, সেহেতু বিএনপির পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানো দরকার। নতুবা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অখণ্ডিতভাবেই থেকে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করাই রাজনৈতিক দলের ধর্ম হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতিবাদ ও জবাবদিহিতা না থাকলে ‘রাজনীতি’ থাকে না। নির্বাচনে হেরে যাওয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন তার আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়া জনগণের মধ্যে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার করবে, অন্য দিকে কর্মীদের কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। বিএনপির ওপরে শেখ হাসিনা সরকার যে স্টিম রোলার চালিয়েছে, তা তিনি জেনেও সাফাই গাওয়ার জন্যই ২৫ জানুয়ারি জনসভায় নির্বাচনের মহাজয় ও প্রতিপক্ষের পরাজয়ের ব্যাখ্যা করেছেন, যা তার নিজস্ব আঙ্গিকেই তিনি করেছেন, যা সুনির্দিষ্টভাবে খণ্ডানোর দায়িত্ব বিএনপির রয়েছে বলে মনে করি। প্রবাদ রয়েছে, ‘চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না’।

এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানোর বিষয়ে বিএনপি পিছিয়ে থাকলে পরিস্থিতি বিএনপিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেবে। ফলে বিষয়টি অনেক গুরুত্ব বহন করে। স্মরণ করা দরকার, কে কি করে তা নিয়ে অন্যকে ফাঁকি দেয়া যায়, কিন্তু নিজেকে কি ফাঁকি দেয়া সম্ভব? ঘটে যাওয়া ‘নির্বাচন’ নামক প্রহসন সম্পর্কে ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে, বিদেশীদের চোখে ধুলো দেয়া যাবে, কিন্তু তারা কি তাদের নিজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন যারা ভূমিধস বিজয় অর্জনের কারিগর হিসেবে ব্যবহার হয়েছেন? জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে যাদের স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন লালিত-পালিত তাদের বিবেক কি জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করেনি? জাতির বিবেক কি নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যাবে? কারো কারো পদোন্নতি, বিলাসবহুল জীবনধারণ ও আকাশচুম্বী উন্নতির কামনা-বাসনার কাছে কি জাতি হেরে যাবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহিতার কি কোনো প্রয়োজন নেই? (ক্রমশ)

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন) 
  • সুত্র- নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৯ 

রিজার্ভ চুরি — ৩৬ মাসেও উত্তর নেই অনেক প্রশ্নের!

রিজার্ভ চুরির ৩৬ মাস পর অবশেষে মামলা করল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় ভোর ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এ মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির ৩৬ মাস পার হলেও আজও কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। অথচ অর্থ উদ্ধার ও তদন্তের নামে ব্যয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ঘণ্টায় প্রায় ৪০০ ডলার ব্যয়ে ১ হাজার ৪০০ ঘণ্টা তদন্ত করেছে ফায়ার আই নামক একটি সফটওয়্যার কোম্পানি। রাকেশ আস্তান নামের একজন ভারতীয় নাগরিক এ তদন্তে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এ ব্যয়বহুল তদন্তের ফলাফল কি তা জানে না দেশের জনগণ।

জানা গেছে, সুরক্ষিত সুইফট সিস্টেমের সাথে আরটিজিএস নামের একটি সফটওয়্যার সংযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কেউ অতিউৎসাহী ছিলেন। আরটিজিএস সংযোগের পরেই রিজার্ভ চুরি হয়। কারা অতিউৎসাহী ছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। আবার ফিলিপাইনের দৈনিক পত্রিকা ইনকোয়েরার’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়। চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখায় ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেখান থেকে অর্থের বড় অংশ চলে যায় দেশটির ক্যাসিনোতে (জুয়ার আসরে)।

আবার ক্যাসিনোতেও সেই অর্থ ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ আরো ২০ দিন। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারকে সময়মতো অবহিত করলে চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব ছিল কি না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে এ অর্থের বেশির ভাগই ফেরত আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু কেন সরকারকে জানানো হলো না, কারা বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরকে ঘটনাটি না জানাতে পরামর্শ দিয়েছিল তা জানা যায়নি। এদিকে ঘটনা জানার পর পরই তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে ফিলিপাইনে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওই প্রতিনিধিদল কোনো সরকারি আদেশ (জিও) ছাড়া কিভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সেখান থেকে আসার পর এ সংক্রান্ত কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন কেন দেয়নি এ প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো উত্তর পায়নি রিজার্ভ চুরির ওপর তদন্তে নিয়োজিত সিআইডি কর্মকর্তারাও। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, সিআইডি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে ড. আতিউর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলেন। তবে তিনি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি বলে এক সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, চুরি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক অবহিত হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ ঘটনা অবহিত হওয়ার পরও অর্থ ফিলিপাইনের ব্যাংকিং সিস্টেমে ছিল দুই দিন ( ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি)। এর পর এক টানা বিশ দিন ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে এই অর্থ ঘোরাফেরা করে। সরকারকে যথাসময় জানানো হলে অর্থ উদ্ধার কিভাবে সম্ভব হতো, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যখন চুরি যাওয়া অর্থ ব্যাংকে ছিল তখন সরকারকে জানালে এবং সাথে সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার চাপ প্রয়োগ করলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা টাকা উত্তোলন বন্ধ করা যেতো। এরপর জুয়ার আসরে যাওয়ার পরেও সরকারকে অবহিত করা হলেও টাকা উদ্ধার করা সম্ভব ছিল। যেমন, সরকার টু সরকার পর্যায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতো। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা উদ্ধারের জন্য ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেয়া যেত।

কিন্তু এতগুলো সম্ভাবনা থাকার পরও কেন বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো সরকারকে অর্থ উদ্ধারে অবহিত করল নাÑ এ দায় নিয়ে চাপের মুখে তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। আরো দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম ও নাজনীন সুলতানাকে অপসারণ করা হয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া পদত্যাগপত্রে ড. আতিউর রহমান লিখেছেন, ‘চুরি হওয়ার ঘটনা পরবর্তী কার্য দিবসেই বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে অবহিত করি এবং অর্থ পুনরুদ্ধার, জড়িত পক্ষগুলো শনাক্ত করার এবং অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার বিষয়গুলোর দিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই।’

তার পদত্যাগপত্রের ভাষা দেখে বোঝা যায়, তিনি বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর পরই বিএফআইইউকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু বিএফআইইউ কেন সরকারকে অবহিত করল না এটাই এখন বড় রহস্য।

প্রসঙ্গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে মার্চের শুরুতে। ১৫ মার্চ এ ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল থানায় মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের নির্দেশে ওই মামলার তদন্ত ভার পেয়ে দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে কাজ শুরু করে সিআইডি। একটি অংশ রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত দেশীয় সূত্রগুলো নিয়ে তদন্ত করতে থাকে। আরেকটি অংশ রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদেশী সূত্রগুলো নিয়ে কাজ করে। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করা ২ কোটি ডলার আগেই ফেরত পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের বড় অংশই এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি। এ অর্থ থেকে এখন পর্যন্ত ফেরত পাওয়া গেছে মাত্র দেড় কোটি ডলার। এ অর্থ ফেরত পেতেই তিন বছর পর মামলা করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।

অবশেষে মামলা : রিজার্ভ চুরির ঘটনায় প্রধান আসামি করা হয় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংককে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ফিলিপাইনের মানি এক্সচেঞ্জ হাউজ, দুটি ক্যাসিনো এবং বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় আরসিবিসি ব্যাংকসহ ৬টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ ব্যক্তির নাম আছে বলে জানা গেছে। এতে চুরি হওয়া অর্থসহ মামলা পরিচালনার সমুদয় ব্যয় এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা আইনি প্রতিষ্ঠান কোজেন ও’কোনর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মামলাটি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক বনাম রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন শিরোনামে করা এ মামলা নথিভুক্তির নম্বর ১৯-০০৯৮৩।

নথিতে যা আছে : মামলায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নিউ ইয়র্ক শাখায় রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার অজ্ঞাত হ্যাকাররা হাতিয়ে নেয়। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির মধ্যে ফিলিপাইনে যায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় যায় ২ কোটি ডলার। শ্রীলঙ্কা থেকে ২ কোটি ডলার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

৮ কোটি ১০ লাখ ডলার গেছে আরসিবিসিতে। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এতে জড়িত রয়েছে। তারা মানিলন্ডারিংয়ের বিধিবিধান পরিপালন না করে ওই সব অর্থ ছাড় করার মাধ্যমে পাচার করতে সহায়তা করেছে। নথিতে আরো বলা হয়, ব্যাংকটির শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তা এ অর্থ চুরির জন্য কয়েক বছর ধরে ‘বড় ধরনের’ ‘জটিল ষড়যন্ত্র’ করেন। অজ্ঞাত উত্তর কোরীয় হ্যাকাররা এ চুরিতে সহায়তা করেছে। অর্থ চুরির পর তা ফিলিপাইনের আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেখান থেকে মানিএক্সচেঞ্জ হয়ে বেশির ভাগ অর্থ ফিলিপাইনের ক্যাসিনোর মাধ্যমে পাচার করে দেয়া হয়।
  • সুত্র - নয়াদিগন্ত / ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
  • https://goo.gl/ndTLqv

আন্তর্জাতিকভাবেই সমাধান পেতে হবে

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন
x
স্বাধীন দেশে যদি প্রশাসন জনগণের না হয়, তাহলে দেশ তো পরাধীন আমলের মতোই থেকে যায়। জনজীবনে অন্যায়-অবিচার বাসা বাঁধার মূল কারণ আমাদের প্রশাসনে স্বাধীনতার মূল্যবোধের অভাব। দেশ ও জাতির ক্ষতি সাধনে আমরা নিজেরাই অনেক সময় নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে থাকি।

দুর্নীতির সুযোগ বহাল রাখার জন্যই ভোট ডাকাতির ব্যাপারে প্রশাসনের সব স্তরের সহযোগিতা পাওয়া সহজ হয়েছে। জনগণকে তাদের পছন্দমতো সরকার গঠনের শাসনতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। সরকারকে বিভ্রান্ত করার জন্যও লোকের কোনো অভাব নেই।

প্রকাশ্যে নির্বাচনে ডাকাতির পর স্বাধীন জাতি হিসেবে অহঙ্কার করার মতো আমাদের আর কতটা কী অবশিষ্ট আছে তাই নিয়ে ভাবছি। আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে- জাতীয়ভাবে, দলীয়ভাবে নয়। নির্বাচনে কোনো দলেরই জয়-পরাজয় হয়নি।

জাতির অসহায়ত্বকেই দেখানো হয়েছে বিশ্বের কাছে। এভাবে ভোটাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে শুধু জনগণের শাসনতান্ত্রিক মৌলিক অধিকারই হরণ করা হয়নি। জনগণ কিছু নয়। তাদের ভোটও কিছু নয়। এর নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়।

৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়লাভ করা সমকালীন পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে প্রায় অচিন্তনীয়। আর অতিলোভীদের দোষ এটাই। কতটা হজম করা যাবে সেটাই বুঝতে চায় না। ভোট ডাকাতির সাক্ষ্য-প্রমাণ তারা নিজেরাই রেখে দিয়েছে।

পুলিশি মামলা দিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে বিচারব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে ফেলা হয়েছে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতাটিও কম লজ্জাকর নয়। এটি সত্য যে, টেলিভিশন টকশোতে আমি বহুবার নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক শক্ত কথা বলেছি। এজন্য অনেকেই বলেছেন, আপনি বিপদে পড়বেন।

আমি তো সংঘাত-সংঘর্ষের বিরুদ্ধে বলেছি। যুক্তির বাইরে কিছু বলিনি। কোনো দলের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য রাখিনি। দেখা গেল নির্বাচনের আগে আমাকে জেলে পাঠানো হল একটি খোঁড়া অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে।

যে পরিপ্রেক্ষিতেই হোক, আর প্রশ্নটি যতই অশোভন হোক, ৭১ টিভির টকশোতে যে মহিলাটিকে আমি চরিত্রহীন বলতে চেয়েছি তাতে তার মানহানি হলে তিনি মামলা করতে পারেন। তিনি কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেননি।

শব্দটির ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে মনে করে পরদিন ফোন করে আমি তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করি। ৭১ টেলিভিশনকেও আমি লিখিতভাবে জানিয়েছি। তারা আমার চিঠির বিষয়বস্তু সম্প্রচারও করেছে। তারপর প্রকাশ্যে আর কী করার থাকতে পারে?

আশ্চর্য হলাম যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই এক প্রেস কনফারেন্সে সবাইকে বললেন আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে। তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, তিনি তাদের সঙ্গে আছেন। মহিলাটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কী সম্পর্ক বুঝতে পারলাম না।

সাধারণ মানহানির বিষয়টি এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার হয়ে গেল! মানহানির মামলা যে তৃতীয় পক্ষের কেউ করতে পারে না তা-ও চিন্তা করতে হয়নি। হবেই বা কেন? আইনকানুন তো নেই। আসলে সমগ্র বিষয়টি ছিল সাজানো। সরকারি আইনজীবীদেরও তো আমার জামিনে বাধা দেয়ার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না।

‘পবিত্র চরিত্রের’ অধিকারী আওয়ামী লীগের কিছু অতিউৎসাহী সমর্থকও নেমে পড়লেন এ অভিযোগ নিয়ে যে, মহিলাটিকে চরিত্রহীন বলে আমি সমগ্র নারী জাতির অবমাননা করেছি। তাদের দাবি, আমাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। সরকারের কাছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করতেও বিশেষ উৎসাহ দেখা গেছে। বিষয়টির ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা বুঝে ওঠার আগেই সন্ধ্যায় ডিবির লোকজন তৃতীয় পক্ষের এক মানহানির মামলায় আমাকে গ্রেফতার করে। সরকারের ডিটেকটিভ শাখার ব্যস্ততা দেখানোরই বা যুক্তি কোথায়? আমার নিরাপত্তা নিয়ে একদল পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে দেখলাম।

তাদের ধারণা আওয়ামী লীগ ‘কর্মীরা’ আমাকে আক্রমণ করতে পারে! রংপুরে কোর্ট চত্বরে তা-ই হল। এ হল আমাদের দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কর্মী!

আওয়ামী লীগের মহিলা কর্মীরা উপরের নির্দেশমতে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয় না, তবুও একটি-দুটি নয়, ২২টি মানহানির মামলা করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলে বিচারব্যবস্থায় নিশ্চয়ই এরকম মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করতে দিত না।

আশার কথা যে, দু-একজন ম্যাজিস্ট্রেট এ ধরনের মামলা গ্রহণ না করার সাহস দেখিয়েছেন। মামলা হয় না, তবুও মামলা দেয়া হল, মামলা নেয়াও হল এবং আইনত জামিনযোগ্য মামলা হলেও জামিন হল না। আমাকে তাই তিন মাসেরও বেশি জেলে থাকতে হল।

মোটকথা, নির্বাচনের সময় আমাকে বাইরে থাকতে দেয়া হবে না। সবার জানা আছে, আমি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছি। দলীয় রাজনীতি করি না বলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। তবে আমি ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে ছিলাম।

আমার বিরুদ্ধে শুধু মামলা করার নির্দেশই দেয়া হয়নি। শুনেছি, আমার যাতে ‘অসুবিধা’ হয় সেই নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। সুযোগ পেয়ে অন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন মহিলা সাংবাদিক আমাকে চরিত্রহীন রাজনীতিবিদ বলে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধাবোধ করলেন না।

ভালো কথা, তাহলে তাদের যুক্তিতে নিশ্চয়ই তিনি সব রাজনীতিবিদকে চরিত্রহীন বলেছেন। তাতে কিন্তু কোনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদের মানহানি হয়নি! প্রধানমন্ত্রী মানহানির কোনো মামলাও করতে বলেননি!

আমার কোনো দল নেই। তাই সরকারদলীয় মামলা-হামলার মোকাবেলায় বিশেষভাবে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা অন্য আইনজীবীদের সঙ্গে মিলে আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দেশে-বিদেশে অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন। আমি তাদের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।

যাই হোক, অসুবিধা সৃষ্টির ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে আমাকে জেলে নিয়ে দু’দিন সাধারণ আসামিদের সঙ্গে রাখা হল। আমাকে ডিভিশন দেয়া হল না। কিন্তু আসামিদের মধ্যে যে সুন্দর মন ও মানবিক গুণাবলীর পরিচয় পেলাম তাতে মুগ্ধ ও অবাক হয়েছি।

কীভাবে আমার থাকাটা কিছুটা হলেও সহনীয় করা যায় তার জন্য তারা অস্থির হয়ে পড়লেন। জেলের বিভিন্ন স্থান থেকে আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কিছুটা উঁচুমানের খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী আনা হতে থাকল।

অর্থাৎ জেলের অনেকেই জানতে ও বুঝতে পারেন আমাকে অসুবিধায় রাখা হয়েছে। যারা সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, তাদের কাউকেই আমি চিনতাম না। তাদের ব্যবহারে আমার কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়।

যারা জেলে আছে তাদের বেশিরভাগই সত্যিকার কোনো ভয়াবহ মামলার আসামি নয়। দেখেই বোঝা গেছে তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতির গন্ধ খোঁজা হয়েছে, না হয় ড্রাগস সম্পর্কিত মামলা হয়েছে। আসলে চাইলেই মামলা করা যায়। অপরাধ তো প্রমাণ করার দায় নেই। বিচার ত্বরান্বিত করার কোনো আগ্রহও নেই।

জামিন না দিয়েই জেলে আটক রাখা যাচ্ছে মাসের পর মাস। এসব আসামির অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্ব দেখে আমিও কষ্ট কম অনুভব করিনি। অনেকের কোর্ট-আদালতে ছোটাছুটি করার কোনো লোকও নেই। এমনও কিছু আসামি আছে যাদের আত্মীয়স্বজনরা কেউ জানে না তারা কোথায় আছে।

শাসনতন্ত্রে বলা আছে, একজন আসামি আইনজীবীর সাহায্য নিতে পারবে। কিন্তু একবার জেলে ঢোকাতে পারলে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগই দেয়া হয় না। কোনো আইনজীবী যোগাযোগ করলে তবেই সে তার সাহায্য নিতে পারে। শাসনতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্পর্কে পুলিশ ও জেল কর্তৃপক্ষকে অধিকতর সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু করবে কারা? রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো নেই।

বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছে, জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি যেন তাদের আইনগত সাহায্য করি। কতটুকু তাদের জন্য করতে পারব জানি না। জেলে পুরলেই সমস্যার সমাধান হয় না। যারা অন্যায়কারী তাদের শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু বিনা জামিনে, বিনা বিচারে পুলিশ দিয়ে জেলে পাঠানোর রাজনীতি তো নির্যাতন। পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার। একটি সুন্দর দেশ গড়তে উদার মনের নেতৃত্ব ও সুন্দর মনের মানুষের প্রয়োজন। আমি আশান্বিত হলাম এটা দেখে যে, তরুণদের মধ্যে এখনও সুন্দর মন মরে যায়নি। জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও যথেষ্ট সম্মান ও সহযোগিতা পেয়েছি। নিজের দেশে এটাই তো আশা করি। যারা মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য তাদের অবশ্যই মর্যাদা দিতে হবে।

আমার এ লেখাটির মূল লক্ষ্য একটি সাধারণ মানহানির মামলা নিয়ে আমার প্রতি যে নোংরা আচরণ করা হয়েছে সেটা নয়। দেশব্যাপী রাজনীতিতে পুলিশি মামলার যে ছড়াছড়ি, তার বিপজ্জনক দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

জনগণের ওপর মামলা-হামলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা পুলিশের দায়িত্ব নয়। ফরমায়েশি পুলিশি মামলার ভয়ে সারা দেশের মানুষ ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে আছে। পুলিশ তো হবে জনগণের বন্ধু। রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদরা।

পুলিশে এখন অনেক ভদ্র, শিক্ষিত লোক যোগ দিয়েছে। তাদের দিয়ে রাজনীতি করাতে গিয়ে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অর্থাৎ একটি যোগ্য, সৎ পুলিশ বাহিনী যে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য সে প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে না।

কমপক্ষে জেলের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বন্দি রাজনৈতিক মামলার শিকার। একেকজনের বিরুদ্ধে ২৫-৩০টি করে মামলা দেয়া হয়েছে। মামলার সত্যতা কোনো বিষয় নয়, জামিনে মুক্তি পাওয়াকে অসম্ভব করতে পারলেই হল।

গুরুতর মামলা হলে তো একটিই যথেষ্ট। এসব বিষয় নিয়ে ভাববার লোক দুর্লভ। কারাগারগুলোতে ঠাঁই নেই। অথচ বেশিরভাগ বন্দিকে ছেড়ে দেয়ার, জামিন দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের প্রতি চরম অন্যায় করা হচ্ছে।

অবশেষে হাইকোর্টের নির্দেশে আমাকে ডিভিশন দেয়া হল। আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল হোসেনের ল’চেম্বারে আমি তার জুনিয়র ছিলাম। তিনি কোর্টে আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘মানিক মিয়ার ছেলেকে জেলে ডিভিশন পেতে হাইকোর্টে আসতে হয়!’

মানিক মিয়ার ছেলে ছাড়া আমার নিজেরও তো কিছু অর্জন আছে। আমি বঙ্গবন্ধুর সময় সংসদ সদস্য ছিলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ছিলাম। নিজে একজন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী।

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলাম। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছি। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রেস কমিশনের রিপোর্ট তৈরিতে আমি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলাম।

স্বাধীন দেশে মানুষের সাহস জোগায় বিচারব্যবস্থা। এজন্য জনগণ শাসনতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে বিচার বিভাগের ওপর। এর অর্থ জনগণের অধিকার ও শাসনতন্ত্রসম্মত শাসনের ব্যাপারে জনগণ রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা না রেখে আস্থা রেখেছে বিচার বিভাগের ওপর।

বিচার প্রক্রিয়ায় ভয়ভীতির স্থান থাকতে পারে না। মানুষের অধিকার নিশ্চিত না হলে স্বাধীনতা অর্থহীন। বর্তমানে মানুষ তাই বড় অসহায়। জামিনের আবেদনের ভিড়ে সুপ্রিমকোর্টে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সুপ্রিমকোর্ট এখন জামিনের আবেদন নিয়ে মহাব্যস্ত। সুপ্রিমকোর্টের অস্তিত্ব ও সাহস না থাকলে দেশের বিচারব্যবস্থা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ত।

আমরা নিশ্চয়ই একটি সুস্থ, সভ্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালানোর যোগ্যতা রাখি। সেই শিক্ষাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আমাদের শিখিয়ে গেছেন।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বাঙালিদের উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বেই তদানীন্তন পাকিস্তানে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মানিক মিয়াসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই তখন জাতি গঠনে নীতি-আদর্শ ও সততার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মুখেই শুনতে হয়েছে, তারা কল্পনাও করতে পারেননি যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এত নির্লজ্জভাবে ভোট ডাকাতি হবে। তারা ছোটাছুটি করতে থাকলেন সাক্ষীগোপাল নির্বাচন কমিশন অফিসে।

এমনকি তারা জনগণের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ রক্ষা করেননি। ভেবেছিলেন জনগণ তো সরকারের বিপক্ষে, তাই জনগণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীকেই ভোট দেবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপির মতো একটি বড় দল রাজনৈতিক দল হতে পারছে না। শুধু নির্বাচনের আশায় ব্যস্ত থাকার কারণে। এখন তো নির্বাচনও গেল।

দীর্ঘদিনের সংগ্রাম শেষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ অবস্থায় বৈরুত থেকে আব্বার কাছে লেখা এক পত্রে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন, আমরা যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য লড়াই করছি তারা ব্যর্থ থেকে গেলাম।

পরবর্তী সময়ে যে রাজনীতি দেখা দেবে তা হবে ভয়াবহ নৈরাজ্যিক চরিত্রের। শহীদ সাহেব এ বক্তব্য যখন রাখেন তখন দেশে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। পরবর্তী সময়ে কী ধরনের ভয়াবহ হিংসা-বিদ্বেষ দেশে চলেছে তা তো সবাই দেখেছি।

মনে হচ্ছে ১৮ কোটি লোকের এ দেশে এত শিক্ষিত, যোগ্য ও সৎ লোক থাকা সত্ত্বেও আমরা দেখাতে পারছি না যে, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের কোনো গঠনমূলক ভূমিকা আছে বা আমরা জাতির কোনো উপকারে আসছি।

আপস ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে সচেষ্ট ছিলাম। কোনো সমঝোতা নয়, আমলা সাহেবদের ভোট ডাকাতির ষড়যন্ত্রই সহজ পথ মনে করা হল। এ হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই আমাদের মতো কিছু লোককে হয়তো বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। বোবা হয়ে থাকাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।

নির্বাচনে কারচুপি এত বিশালভাবে হয়েছে যে, সংশ্লিষ্টরাই তার প্রমাণ রেখে গেছে। আমলাদের বুদ্ধিতে এটা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু তারা সমাধান দিতে পারবে না। ভোট কারচুপি হয়েছে জাতির বিরুদ্ধে।

তাই সংকটের সমাধানও হতে হবে জাতীয়ভাবে, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়। ভোটাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা সর্বজনীন মানবাধিকার লঙ্ঘন। কোনো স্বাধীন জাতি ভোটাধিকারহীন হয়ে থাকতে পারে না। আমরাও থাকব না। পুলিশি মামলা-হামলার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। জনগণের ভোটের শাসনতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাই নিরাপদ, সহনশীল রাজনীতির পথ।

—  লেখক আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। 

খেলাপি ঋণে নাজুক দশা জনতা ব্যাংকের

এক বছরে বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণ

সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু

বেশ নাজুক অবস্থায় চলে গেছে জনতা ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি মুনাফা করেছে। কিন্তু এখন লোকসান গুনছে জনতা ব্যাংক। খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ব্যাংকটির ভিত এখন অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রার সূচনার পর এখনই সবচেয়ে বাজে সময় পার করছে ব্যাংকটি। ফলে এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গত বছর (২০১৮) ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ফলে এক বছরেই জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এই ঋণের পুরোটাই আবার দুইটি গ্রুপের কাছে। যাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই ঋণ প্রদান করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকটির এমন উদ্বেগজনক খবরে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার সরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে ‘বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি’র অগ্রগতিবিষয়ক এক আলোচনা সভায় জনতা ব্যাংক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যাংকটিকে দ্রুত তার খেলাপি ঋণ আদায়ের যাবতীয় কার্যকর ও আইনি পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

জানা গেছে, কর্ম সম্পাদন চুক্তি অনুযায়ী জনতা ব্যাংকের জন্য চলতি অর্থবছরে বেশ কয়েকটি টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খেলাপি বা শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, কৃষি ঋণ বিতরণ, এসএমই ঋণ বিতরণ, অন্যান্য বিনিয়োগ, পরিচালন মুনাফা অর্জন, লোকসানি শাখার সংখ্যা হ্রাস, রিট মামলা নিষ্পত্তি, অর্থঋণ ও অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তি, বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি, শাখাগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ইত্যাদি।

ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সূচকে জনতা ব্যাংক টার্গেট পূরণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। খেলাপি বা শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে চলতি বছরের জন্য আদায়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর’২০১৮) আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৫৮ কোটি টাকা। টার্গেট অনুযায়ী এ সময়ে আদায় করার কথা ছিল ২৫০ কোটি টাকা। একইভাবে অবলোপনকৃত (ডেট রিট অফ) ঋণ থেকে আদায় করার টার্গেট ছিল ১৫০ কোটি টাকা। এই হিসাবে ছয় মাসে আদায় হওয়ার কথা ছিল ৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে জনতা ব্যাংক আদায় করেছে মাত্র ১৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের মোট ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণের মধ্যে দুইটি গ্রুপের কাছেই রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই দুইটি গ্রুপ হলো- ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও অ্যাননটেক্স। অ্যাননটেক্সের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রায় পুরোটাই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল নিজেই নিয়েছেন। অ্যাননটেক্স তার কোম্পানির নামে বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুললেও টাকা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ব্যাংক নিজেই বাধ্য হয়ে বিদেশী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করেছে। গ্রাহককে তা পরিশোধের কথা থাকলেও তারা তা পরিশোধ করেনি। এসব দায়ের বিপরীতে ফোর্সড ঋণ তৈরি করেছে জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে এই গ্রুপটি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।

অন্য দিকে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ বিভিন্ন সরকারি তহবিল ও জনতা ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চামড়ার ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে সরকার থেকে নগদ রফতানি সুবিধা নিয়েছে, পক্ষান্তরে রফতানি করেও দেশে টাকা ফেরত আনেনি। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ক্রিসেন্টের পাদুকা বিক্রির দোকান রয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে ৭৫ ভাগ ছাড়ে তারা জুতা বিক্রি করছে বলে জানা গেছে।

এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রয়েছেন দুই ভাই। একজন এম এ কাদের এবং অন্যজন এম এ আজিজ। কাদের জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধানও। সম্প্রতি মুদ্রা পাচার আইনে এম এ কাদেরকে এনবিআরের দায়ের করা মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জনতা ব্যাংকও এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করার সবেমাত্র আইনি আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের এই বিশাল অঙ্কের অর্থ শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাত ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় জনতা ব্যাংক এসব ঋণ দিয়েছিল। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত এমডি ছিলেন এস এম আমিনুর রহমান। তাদের সময়েই এসব অর্থায়ন হয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়।

ব্যাংক খাতের যে শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপি রয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশই জনতা ব্যাংকের। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে খেলাপিদের এই তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। দেশের শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির মধ্যে জনতা ব্যাংকের গ্রাহকেরা হলো কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম, রেমিক্স ফুটওয়্যার, রুবাইয়া ভেজিটেবল ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্ট, চৌধুরী নিটওয়্যার, আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস, মুন্নু ফেব্রিকস, সিক্স সিজন অ্যাপার্টমেন্ট, রহমান স্পিনিং মিলস, ওয়ান ডেনিম মিলস, হিন্দোল ওয়ালী ট্রেডিং, গ্লোবাল মেটাল কমপ্লেক্স, অ্যাপেক্স নিট কম্পোজিট, আলী পেপার মিলস, ড্রেজ বাংলা লিমিটেড, গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ডায়িং, রেপকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও ফাইবার শাইন লিমিটেড।

জনতা ব্যাংক ২০১৭ সালে নিট মুনাফা করেছিল ৯৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ২৫১ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৪৬২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল। যা ছিল সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু এ বছর ব্যাংকের অবস্থা অনেক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় এই ব্যাংকটিকে আগের অবস্থায় নিতে হলে এখনই ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালানো, ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করা এবং খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করার পাশাপাশি সৃষ্ট খেলাপি ঋণের পেছনে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট লোকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
  • সুত্র - নয়াদিগন্ত / ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
  • https://goo.gl/wmWsg6

Saturday, February 2, 2019

মামলাগুলো গায়েবি, মানুষগুলো নয়

আলী রীয়াজ


ঘাটাইলের আজিজ মুনশিকে আমি চিনি না, আপনাদের অধিকাংশও চেনেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি বিখ্যাত হতে চাননি, তাঁর নাম পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই খবর তিনি পেয়েছেন কি না, জানি না। সম্ভবত পাননি। রাজধানী ঢাকায় তিনি আগে এসেছিলেন কি না, তা নিয়েও আমার মনে সংশয় আছে। কিন্তু সম্প্রতি তাঁকে আসতে হয়েছে। সেই সূত্রে আমি-আপনি তাঁর নাম জানতে পেরেছি। আমরা জানতে পেরেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামপুর গ্রামের বর্গাচাষি মিলন মিয়ার নাম। জানতে পেরেছি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে প্রায় অচল মানুষ, কানেও শোনেন না এমন একজন শামসুল হকের কথা। তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার কোনো গ্রামে। আপনাদের মতো আমিও এখন স্বস্তি বোধ করছি যে সুনামগঞ্জের অধিবাসী শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তারা মিয়ার শেষ পর্যন্ত জামিন হয়েছে, ছয় সপ্তাহের জামিন। আতর বিক্রেতা ‘হাতকাটা’ ইউসুফের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, সেই খবর আমি জানি না। ১১টি মামলার আসামি মোহাম্মদপুরের ‘হাতকাটা’ ইউসুফের জামিনের ব্যবস্থা কে করবেন, তাঁর পরিবার তা পেরেছে কি না, সে খবর আমি কোথাও খুঁজে পাইনি, সম্ভবত ওই পরিবার আর তাঁর নিকটজনেরা ছাড়া আর কেউ জানার প্রয়োজন বোধ করছেন না।


এই যে এসব মানুষের কথা বললাম, তাঁরা সবাই রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী, ৩০ ডিসেম্বরের ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, সংসদে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আসন নিয়েছেন, তাঁদের প্রতিপক্ষ। আইনের ভাষায় যদি বলি তাহলে তাঁদের সরকারের প্রতিপক্ষ না বলে অন্য কিছু বলার উপায় নেই। কেননা, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলো যেনতেন মামলা নয়। তাঁরা নাগরিকের ভোট দেওয়ার কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছেন, সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত থেকেছেন। ভিন্ন ভিন্নভাবে এসব কথা আছে পুলিশের করা মামলায়। সংবাদপত্রের ভাষায় এগুলো হচ্ছে ‘গায়েবি’ মামলা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘গায়েবি মামলা বলতে কোনো কিছু আমাদের অভিধানে নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আসামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ তাহলে কি আমাদের এমন অদ্ভুত অভিযোগ সত্য বলে মনে করতে হবে যে, ডান হাত অস্বাভাবিক চিকন, কোনো চেতনা নেই, বাঁ হাতেও সমস্যা, কোনো কাজ করতে পারেন না, সেই তারা মিয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী? মানতে হবে যে তিনি রামদা, হকিস্টিক ও রড নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছেন—এই অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য?

মামলাগুলো ‘গায়েবি’; কিন্তু মানুষগুলো বাস্তবের, রক্ত–মাংসের মানুষ। তাঁদের অনেকেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কেউ কেউ চলতে পারেন না, চাষাবাদের কাজে যাঁদের দিন কাটে, যাঁরা জানেন না তাঁদের অপরাধ কী। কিন্তু এখন তাঁদের আসতে হয়েছে এবং হচ্ছে রাজধানীর হাইকোর্টে। তাঁদের চাওয়া একটাই, ‘জামিন’। এমন মানুষের সংখ্যা কত? গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেড় মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ১৮২টি ‘গায়েবি’ মামলা হয়েছে বলে বলা হয়েছে। এসব মামলায় ৮৮ হাজার জনের নাম উল্লেখ আছে। আর আসামি করা হয়েছে পৌনে তিন লাখ ব্যক্তিকে। এই হিসাব তো নভেম্বরের আগের, তারপর নির্বাচন হয়েছে।

সরকার, ক্ষমতাসীন দল, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশন একটি ‘আন্তর্জাতিক মানের’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করেছে। বারবার বলা হচ্ছে যে এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দেখে বলাই যায় শান্তিপূর্ণই ছিল নির্বাচন। কিন্তু তা–ই যদি হবে, তবে এই যে লাখ লাখ মানুষ অভিযুক্ত, এই যে হাজারে হাজারে মানুষ আদালতের দরজায় মাথা কুটে মরছেন, তাঁরা কারা? তাঁদের অপরাধ কী? অন্য যেকোনো সময়ে আমরা বলতে পারতাম যে এই সব মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা ভুলে যাবেন না, ভবিষ্যতে তাঁরা এর রায় দেবেন। এখন যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখানে এই সব ক্ষোভ–বিক্ষোভের তোয়াক্কা করার দরকার নেই।

হাইকোর্টের বাইরে যেমন জামিনপ্রত্যাশীদের ভিড়, তেমনি কারাগারের বাইরে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজনের ভিড়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আটক হয়েছেন ‘রাজনৈতিক’ কারণে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে জানতে পারি এক জননীর কথা; হেনা, সন্তানের নাম হাবিব। ‘(হাবিব) নভেম্বর মাসে ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে আসছিল। মুড়ি কিনতে বাসা থেকে বের হলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর খুঁজে পাইনি।’ হেনা জানান, নির্বাচনের আগে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে ঘটে যাওয়া পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় হাবিবকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। হাবিব জামালপুরেই থাকেন। তাঁর মা হেনা বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। বাড়িতে থাকে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসছিল। পুলিশ শুধু শুধু মামলা দিয়েছে।’ তিনি জানান, গ্রেপ্তারের পর তিন মাস ধরে কেরানীগঞ্জ কারাগারেই আছেন হাবিব, (মানবজমিন, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯)।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামপুর গ্রামের বর্গাচাষি মিলন মিয়া। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে নাশকতার মামলা। আগাম জামিন নিতে ঢাকা এসেছেন তিনি। প্রথম আলো। 



পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায় আবিদ উল্লাহর কথা। আবিদ উল্লাহ বলেন, ‘আমার ভাইকে মামলা দেওয়ার বয়সই হয়নি। সে এখনো অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে আটক করে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ছোট ভাইয়ের জামিন নিয়েও প্রতিদিন এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন কত নেতার কাছে ঘুরি। কোনো কাজ হয় না। একটা অবুঝ ছেলে, সে মামলার কী বোঝে। উকিল ধরছি, এখনো জামিন কবে পাইব জানি না।’ কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ আটক আছেন। এই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে নির্বাচনের অব্যবহিত আগের মাসগুলোতে। গত কয়েক বছরে আটক বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কথা তো আমরা প্রায় বিস্মৃতই হয়েছি। মানুষ গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বছরের পর বছর ধরে। ২০১৮ সাল থেকে আমরা গায়েবি মামলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।

এসব গায়েবি মামলায় যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের অনেকেই এসব জামিনের ব্যবস্থা করতেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মামলাগুলো তো বাতিল হচ্ছে না। সেগুলোর হাজিরা চলবে ভবিষ্যতে। কত দিন? কেউ জানে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা অব্যাহত আছে, নিয়মিতভাবেই তাঁদের হাজিরা দিতে হয় বলেই জানি। শুধু তা–ই নয়, সম্প্রতি পোশাকশ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করলে আটক করা হয়েছে অনেককে, তাঁদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার উপায় কোথায়? এ নিয়ে কথা বললেই ষড়যন্ত্রের গল্প শোনানো হবে। শুধু তা–ই নয়, ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই সব দেখে সবকিছুকেই ‘গায়েবি’ বলেই মনে হয়।

এই যে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হয়েছে, তার উদ্দেশ্য একটাই—সবাইকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া যে তাঁদের কী পরিণতি হতে পারে। রাজনীতি না করলেও এই যদি অবস্থা হয়, তবে রাজনীতি করলে কী হবে, সেটা অনুমানের ব্যবস্থা করা। সাধারণ মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখা। এর একটা শ্রেণিবিভাজনও আছে। শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এ নিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন না, কেননা তাঁদের পরিচিত কাউকে তো এমন অবস্থায় পড়তে দেখছেন না। পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বাড়ল কি না, তাঁদের চাকরি থাকল কি না, ঘাটাইলের আজিজ মুনশির কী হলো, তা নিয়ে বাংলাদেশের নতুন মধ্যবিত্তের উদ্বেগের কিছু নেই। কেননা, শ্রেণিগতভাবে এটা তাঁদের জানাই আছে যে প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ তাঁদের পাতেই আসবে। তাঁদের সম্ভবত করার আরও অনেক কিছুই আছে। সংবাদপত্রের পাতায় এসব খবর বড়জোর কতগুলো সংখ্যামাত্র।

রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাসীনেরা যে এই মানুষদের কথা ভাবছে না, তা দরিদ্র, সাধারণ মানুষ জানে। আদালতের কাছে ‘জামিনের’ জন্য এসেছেন, আসছেন, আসবেন—কিন্তু সেখানে বিচার পাবেন, এমন আশা তাঁদের নেই। সে কারণে আজিজ মুনশি বলেছেন, ‘দোয়ার দরখাস্ত রাখলাম। এক বিন্দু অপরাধ করি নাই। ওপরের উনি সব দেখছেন।’ (প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯)।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

সূত্র — প্রথম আলো/ শনিবার, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৯। 

Thursday, January 31, 2019

বেগম জিয়াকে মুক্ত করাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ — শামসুজ্জামান দুদু


কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন দলটির ভাইস-চেয়ারম্যান ও কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদু। বৃহস্পতিবার ৩১ জানুয়ারি, রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কৃষকদলের বর্ধিত সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি।

দুদু বলেন, ‘আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বের করে আনা। বেগম জিয়াকে মুক্ত করা এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরে আনাই হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই দুটি পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই কেবল মাত্র দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা ফিরে আসবে।’

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন,‘আমাদের মাঝে হতাশা যেমন আছে, তেমনি সম্ভবনার পথও আছে। হতাশা থেকেই সম্ভবনার পথ উন্মুক্ত হয়। কৃষকদল সুশৃংঙ্খল সংগঠন, আমাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, আমাদের এই ঐক্যকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে।’

বর্ধিত সভায় কৃষক দলের সহ-সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, নাজিম উদ্দীন আলম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তকদির হোসেন, মো. জসিম, জামাল হোসেন মিলন, কেন্দ্রীয় নেতা গৌতম চক্রবর্তী, সহ-দফতর সম্পাদক এসকে সাদী, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ সেলিম হোসেন, আলিম হোসেন, বংশাল থানা কৃষকদলের সভাপতি আব্দুর রাজি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে দুর্নীতির ভয়াবহ রূপ প্রকাশ হচ্ছে না — রুহুল কবির রিজভী


প্রকাশিত রূপের চেয়ে দুর্নীতির মাত্রা আরও ভয়াবহ বলে দাবি করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত বলে সব তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে না। কেবল টিআই-ই নয়, ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি গত সোমবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে শুধু ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর গত ১০ বছরে পাচার হয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই দুর্নীতির টাকা আওয়ামী ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকেরাই পাচার করেছে। সুতরাং তথ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে ডেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সত্যকে আড়াল করতে পারবেন না।’

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৩১, সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রেসব্রিফিং এর পূর্ণপাঠ নিচে দেওয়া হল -

সুপ্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আস্সালামু আলাইকুম। সবার প্রতি রইল আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন যে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মতোই আগামী উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটারদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে সাহায্য করে তিনি বড় ধরণের অপরাধ করার পরেও তাঁর ঐ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভোটারদের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালের সেরা রসিকতা করলেন । প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার’রা নিজেদের জীবন কোন মূল্যবোধের ওপর গড়ে তোলেন নি। তারা নিজেদের জীবনে মনুষ্যধর্মকে বিসর্জন দিয়েছেন। তারা ভোটের আগের দিন রাতে জাল ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স পূরণের তদারকি করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কতিপয় কমিশনারবৃন্দ নিজেদের জীবন গড়ে তুলেছেন ভোটারবিহীনভাবে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার জন্য। তারা মূলত: আওয়ামী লীগের ইচ্ছায় নির্বাচন-ব্যবস্থা ধ্বংস করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। মন্ত্রীসভা ও সংসদ বহাল রেখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে তারা দাবি করেছেন। অথচ এটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দুরে থাক, বরং এটি খানা-খন্দে ভরা মাঠ, সেই বিষয়টি দেখেও নির্বাচন কমিশন তা উপেক্ষা করেছে। তারা ন্যুনতম সুষ্ঠু একটি নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দিলেন না আওয়ামী সরকারের মোসাহেবী করতে গিয়ে। 

এদের দ্বারা অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রকৃত জনরায়ের প্রতিফলন ঘটানোর দিন শেষ হয়ে গেল। সুতরাং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে এটি সুষ্পষ্ট হলো যে, এই কমিশনের তদারকিতে উপজেলা নির্বাচনগুলোও ভুয়া ভোটের নির্বাচনেরই মহৌৎসবে পরিণত হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের আগের রাতেই একই কায়দায় সরকার মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করা হবে। এবারে নির্বাচন কমিশনের জন্যই ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন প্রাণসংহারী হয়ে উঠেছিল, কারণ নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততায় মহাভোট ডাকাতিতে লিপ্ত পুলিশ প্রশাসন ও সরকারী দলের ক্যাডার’রা উৎসাহবোধ করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্ত ঝরেছে ধানের শীষের প্রার্থী ও সমর্থকদের। সুতরাং নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে চেয়েছে কিন্তু সুষ্ঠু করতে নয়। ভোট ডাকাতির সাক্ষ্য-প্রমান তারা নিজেরাই রেখে দিয়েছে। 

সাংবাদিকবৃন্দ,
ঐতিহ্যগতভাবেই জনরায়ের প্রতি আওয়ামী লীগের অবজ্ঞা। আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী দু:সহ অপশাসনের এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী করে, যাতে তারা সবসময় প্রতিপক্ষের প্রতিশোধ আশঙ্কায় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশকে বন্ধ করে দেয়। মূলত: আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মানবিকতার কোন স্থান নেই। ‘রক্তপাতময় রাজনীতি’ই এদের স্বভাবধর্ম। সব যুগেই এরা নির্বাচনে ভোট ডাকাতির সাথে সহিংসতা ও খুন জখমের পদ্ধতি অবলম্বন করে। দখল, হরণ ও প্রাণঘাতি প্রবণতাই আওয়ামী রাজনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি। খোঁড়া অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে তারা বিরোধী দলকে কারাগারে প্রেরণ করে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবী মামলা দিয়ে এরা বিচার ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে ফেলেছে।

বন্ধুরা,
২৯ ডিসেম্বরের রাতের নির্বাচনে গঠিত ভুয়া ভোটের সরকার আরও জোরালোভাবে রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে একই কেন্দ্রের অধীন করলো। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য ক্ষয় হতে হতে এখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিরোধী দল, মত ও বিশ^াসের ওপর চলছে টার্গেটেড দমন-পীড়ণ। নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সংকুচিত হতে হতে এখন নি:শেষিত হয়ে জনগণকে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্বে এসে উপনীত হয়েছে। রাষ্ট্রের মেশিনারিজ ভুয়া ভোটের সরকারের অনুকুলে এখন বিভৎস চেহারায় জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ‘এক ব্যক্তি, এক দল’ নীতির বেপরোয়া আস্ফালন জনগণকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। জনগণকে পরাধীন করে এখন আওয়ামী লীগ উপনিবেশ কায়েম করেছে। দেশে এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, মানুষ নিজের ছায়া দেখলেই চমকে উঠে।

সুহৃদ সাংবাদিকবৃন্দ,
গতকাল তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন-ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর রিপোর্ট বিএনপি’র আমলে সঠিক ছিল, এখন মনগড়া।’ আসলে তথ্যমন্ত্রী যেন তথ্যযন্ত্রী। তিনি তার তথ্যযন্ত্রের মাধ্যমে এমন তথ্য দেন, তাতে শুধু দেশবাসীই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও স্ববিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। টিআই এর রিপোর্টে বাংলাদেশের দুর্নীতি বেড়েছে, এটি স্বীকার করে নিলে তো তথ্যমন্ত্রীর মন্ত্রীত্ব থাকে না। এজন্য টিআই-এর রিপোর্টের বিরুদ্ধে তাকে অপ-তথ্য দিতে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির মাত্রা ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত বলে সব তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে না। কেবল টিআই-ই নয়, ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ গত সোমবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে-শুধু ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর গত দশ বছরে পাচার হয়েছে পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দুর্নীতির টাকা এবং এই টাকা আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকেরাই পাচার করেছে। সুতরাং তথ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে ডেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সত্যকে আড়াল করতে পারবেন না।

কর্মসূচিঃ-
‘গণতন্ত্রের মা’, বিএনপি চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে অন্যায়ভাবে কারান্তরীণ নেতাকর্মীদের নি:শর্ত মুক্তির দাবিতে আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯ শুক্রবার বেলা ২টা সোহরাওয়াদী উদ্যানে বিএনপি’র উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়াও দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারীর জনসভা সাফল্যমন্ডিত করার জন্য দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীকে প্রস্ততি গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি।    
ধন্যবাদ সবাইকে। আল্লাহ হাফেজ।

‘ওপরের উনি সব দেখছেন’


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামপুর গ্রামের বর্গাচাষি মিলন মিয়া। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে নাশকতার মামলা। আগাম জামিন নিতে ঢাকা এসেছেন তিনি। গতকাল হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে।  ছবি: আশরাফুল আলম

  • নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জেলায় গায়েবি মামলা হয়েছে 
  • জামিনের জন্য মানুষ এখন হাইকোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছেন
  • মামলার আসামিদের অনেকের বয়স ষাটের বেশি
  • অভিযোগ—মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলার


সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স চত্বরে ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য ঘিরে দলে দলে ভাগ হয়ে জামিনের জন্য অপেক্ষা করছেন ‘আসামি’রা। একেক জেলার একেক দল। যশোর জেলার দল থেকে বেরিয়ে আবু বকর মোল্লা বললেন, ‘আমার বয়স এক কম আশি। আমি নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করেছি।’

ওই দলে আবু বকর মোল্লা সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। চোখে ভালো দেখেন না। শীতকালে বার্ধক্যজনিত কষ্ট বাড়ে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মামলার যন্ত্রণা। তবে বৃদ্ধ বয়সে ছেলেকে সঙ্গে পাচ্ছেন। কারণ, একই মামলায় তাঁর একমাত্র ছেলে আবু হানিফাও আসামি। আর সঙ্গে পাড়া–প্রতিবেশী আছেন অনেক। হয়েছিল কী? আবু বকর মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, কীভাবে কী হলো কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি ভোটকেন্দ্রের কাছাকাছি, তখন হঠাৎ গুলির শব্দ শোনেন। ভোট না দিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় তাঁকে। হঠাৎ শোনেন, তিনি ও তাঁর ছেলে দুজনেই ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি।

হাইকোর্ট চত্বরে গতকাল আবু বকর মোল্লার কথা শেষ হতে না হতেই ষাটোর্ধ্ব আরও তিন–চারজন ব্যক্তি জটলা থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁদের একজন আবু তালেব খান। তাঁর বিরুদ্ধেও ভোটকেন্দ্রে গুলি ও বোমা হামলার অভিযোগ। বললেন, ‘এজাহারে সব অভিযোগই আছে। যেসব নিয়ে হামলা কইরেছি বলে বলছে, সেসব তো চোখে দেখিনি। এখন মামলার কাগজে দেখছি। ককটেল, গুলি আরও কী কী সব।’

এই মানুষগুলোর বড় অংশই এলাকায় চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন গ্রেপ্তারের ভয়ে এলাকাছাড়া। তাঁদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত চটপটে ও অল্প বয়স্ক কয়েকজন জানান, যশোরের মনিরামপুর থেকে এক মামলায় ৪০ জন, যশোর সদরের দুই মামলায় ১৫০ জন, অভয়নগরে ৭৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শার্শা উপজেলাতেও একই ধরনের মামলায় আসামি অনেক। তবে তাঁরা সংখ্যা বলতে পারেননি।

এই ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা কতটুকু? যশোর জেলার পুলিশ সুপার মঈনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে তাঁদের সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে হয়েছে। সে কারণেই মামলা হয়েছে। তদন্তে তাঁদের অপরাধ প্রমাণিত না হলে নাম বাদ যাবে।

যশোর জটলায় বৃদ্ধদের সঙ্গে আলাপের ফাঁকে বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকজন এলেন। বাহাত্তর বছর বয়সী মো. আবদুল হাইয়ের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া। মামলা কিসের জানতে চাইলে বলেন, ‘কইতারি না গো। মামলার পরও বাড়িতেই রইসি। পুলিশের পাশ দিয়া গেছি। চিনছেও না। তাও আইসি। হগলে জামিনের কথা কইতাছে।’

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার আবদুল আজিজ ওরফে আজিজ মুন্সি শুধু নিজেই মামলার ঝামেলায় জড়িয়েছেন তা নয়, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে প্রায় অচল মানুষ শামসুল হককে। শামসুল কানেও ভালো শোনেন না। দু–একটি কথা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করতে জবাব দেন তিনি, তারপর থেমে যান। তাঁর হয়ে আজিজ মুন্সিই কথা বলছিলেন। তাঁদের মামলায় আসামি ৫১ জন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঘাটাইলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অফিসে হামলার। যে মানুষ নড়তেচড়তে পারেন না, অত দূরে গিয়ে তিনি হামলা করবেন কীভাবে?

বৃহত্তর ময়মনসিংহ জটলা থেকে জানা গেল, আইনজীবীর খরচ, বাড়ি থেকে আদালতে আসা, থাকা–খাওয়ার খরচ সবাই মিলে বহন করছেন। কিন্তু শামসুল হকের জন্য খরচটা বেশি। তিনি বাসে যাতায়াত করতে পারেন না। তাঁর জন্য আট হাজার টাকা খরচ করে মাইক্রোবাস ভাড়া করতে হয়েছে। ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাকসুদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন বয়সের মানুষগুলোর মতো এই বৃদ্ধরা কয়েক দিন ধরে আদালত চত্বরে ন্যায়বিচারের আশায় ঘুরছেন। হাতে টাকা নেই, বেশির ভাগের পরনে জীর্ণ পোশাক, পায়ে চপ্পল, দিন কাটে মুড়িমাখা বা বাদাম খেয়ে। তবু আশা, জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরে নিজের বিছানায় ঘুমাবেন। ফেরার সময় ঘাটাইলের আজিজ মুন্সি বললেন, ‘দোয়ার দরখাস্ত রাখলাম। এক বিন্দু অপরাধ করি নাই। ওপরের উনি সব দেখছেন।’
  • প্রথম আলো/ জানু ৩১, ২০১৯ 

আন্দোলনের শাস্তি ঢালাও ছাঁটাই!


সাভারের নিট এশিয়া কারখানার এক শ্রমিক কালের কণ্ঠকে যখন চাকরি হারানোর কথা বলছিলেন, তাঁকে দেখাচ্ছিল একই সঙ্গে হতাশ ও আতঙ্কিত। নিজের নাম প্রকাশ করতেও রাজি হননি সদ্য সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এই শ্রমিক। চাকরি খোয়ানোর সকালটির স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, “অফিসে গেলে আমাকে অফিসের গেটে আটকে দেওয়া হয় এবং দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়। তখন আমার সাথে আরো কয়েকজন ছিল। পরে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে কার্ডটি রেখে দিয়ে বলে, ‘চলে যাও। আর কখনো কারখানায় আসবা না।’” 

একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান সাভারের আরেক কারখানা এআর জিন্সের অন্য এক শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘শুধু ছাঁটাই নয়, আমাদের নামে মামলাও করেছে কারখানার মালিক। পুলিশ বাড়িতে গিয়ে গিয়ে খুঁজছে।’

চলতি মাসের শুরুতে ত্রুটিমুক্ত নতুন মজুরি ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনকারী হাজারো শ্রমিক এভাবেই চাকরি থেকে বরখাস্ত কিংবা হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে তথ্য মিলছে। তৈরি পোশাক শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজে ফিরলেও বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের নোটিশ ঝুলছে বলে দাবি শ্রমিক নেতাদের। একজন নেতা দাবি করেন, এই পর্যন্ত সাভার-আশুলিয়ার ১২ থেকে ১৫টি তৈরি পোশাক কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিককে এই ছাঁটাইপ্রক্রিয়ায় কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। অনেক কারখানার গেটে ঝুলছে ছাঁটাইয়ের নোটিশ। 

কোনো কোনো সূত্র মতে, ছাঁটাই বা মামলার শিকার শ্রমিকের সংখ্যা সাত হাজারেরও বেশি। শিল্প পুলিশ ও শ্রমিক সংগঠন এবং পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রও এমন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করছে। এমনকি আরো ছাঁটাই এবং কারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছে খাতসংশ্লিষ্টরা। গত মঙ্গলবার ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, মজুরি নিয়ে আন্দোলনের পর বাংলাদেশের পোশাক খাতের পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক তাদের কর্মস্থল থেকে বহিষ্কার হয়েছে। দেশের শ্রমিক নেতাদের দাবি এই সংখ্যা সাত হাজারেরও বেশি। তাঁরা বলছেন, মালিকরা শ্রমিকদের ঠকাতে এই কৃত্রিম সংকট তৈরি করতেই দমন-পীড়ন-নির্যাতন ও ছাঁটাই করছেন। মালিকরাও অস্বীকার করছেন না ঘটনা, তবে তাঁরা বলছেন, ছাঁটাই নয়, সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে।

আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকার এআর জিন্স প্রডিউসারের জেনারেল ম্যানেজার র‌্যাক লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের ছাঁটাই করিনি। আমরা তাদের সাময়িক বরখাস্ত করেছি। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রতিষ্ঠানে মোট ১৪৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সেই সাথে শ্রমিকদের কাছে ডাকযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশও পাঠানো হয়েছে। এই নোটিশের উত্তর পাওয়ার পর কোন শ্রমিক কাজ করতে পারবে তা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং আইনিভাবে যে সিদ্ধান্ত হবে আমরা সে সিদ্ধান্তই  গ্রহণ করব।’

সাভার ও আশুলিয়া থানা সূত্রে জানা গেছে, এখন পযন্ত ১১টি পোশাক করাখানা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা করেছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মতো আটক রয়েছে।

সাভার মডেল থানার ওসি আব্দুল আউয়াল বলেন, কোনো নিরপরাধ শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়নি, হবেও না। কারখানা ভাঙচুর বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

গামেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, মালিকরা জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন। মজুরি না বাড়াতে এই দমন-পীড়ন, ছাঁটাই ও নির্যাতন করছেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিককে ছাঁটাই করেছেন মালিকরা। রাজধানীর লোমান ফ্যাশন ও লোপা গার্মেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। অথচ অন্যদিকে মালিকদের রপ্তানি আয় বাড়ছে, বড় বড় কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। সিএম (কাটিং ও মেকিং) কমাতে না পারলেও শ্রমিকদের মজুরি কম দিতে নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে।

এদিকে রাজধানীর কাকরাইলের ইয়লক গার্মেন্টের অপারেটর রিনা আকতার কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো অনুসারে একজন হেলপারের বেতন আট হাজার টাকা হলেও তিনি গত ডিসেম্বর মাসে অতিরিক্ত কাজের মজুরিসহ মোট বেতন পেয়েছেন মাত্র সাত হাজার টাকা। সরকারের ঘোষিত মজুরি দেওয়ার দাবি জানালে মালিক তাঁকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।

রামপুরার লোমান ফ্যাশনে কাজ করেন চায়না আকতার। তিনি জানান, সরকার ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো অনুসারে বেতন দেন না কারখানার মালিক। নতুন কাঠামোতে মজুরি দাবি করলে মালিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন নিয়মিত।

শ্রমিক অধিকার নিয়ে সক্রিয় সংগঠন ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নিয়ে আন্দোলনের পর শ্রমিকরা কারখানায় ফিরে যেতে চাইলেও তা পারছে না। অনেক কারখানার ফটকে গিয়ে দেখে, তাদের ছবিসহ চাকরিচ্যুত কর্মীদের তালিকা টাঙিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি আন্দোলনের সময় ক্ষতিসাধনের অভিযোগে সাভার ও আশুলিয়া থানায় বিভিন্ন কারখানার পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলোয় আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার শ্রমিককে।

নতুন মজুরি পোশাকশিল্প খাতে বড় চাপ সৃষ্টি করেছে মত দিয়ে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সংশোধিত নতুন মজুরি কাঠামো অনুসারে মজুরি দেওয়ার সক্ষমতা নেই অনেক পোশাক কারখানার মালিকদের। ফলে মালিকরা বিভিন্ন আগাম সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছেন, মজুরি নিয়ে যেন সামনে শ্রম অসন্তোষ তৈরি না হয়। এর ফলে কারখানা থেকে অতিরিক্ত শ্রমিক কমিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়াসহ শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে সবাইকে শ্রম আইন মেনেই তা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

মামলার তথ্য দিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু (কে এম মিন্টু) কালের কণ্ঠকে বলেছেন, কারখানায় ভাঙচুরসহ মারপিট করে ক্ষতিসাধন, চুরি ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বেশ কিছু কারখানা মালিক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের দেওয়া তথ্য মতে, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ও উত্তরা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি শ্রমিক নেতা জয়নাল আবেদীন, উত্তরা আঞ্চলিক নেতা মাসুদ, সাজুসহ ৪০-৫০ জন শ্রমিক গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে সাভার-আশুলিয়ায় গ্রেপ্তার হয়েছে ২০-২৫ জন। হাজার হাজার শ্রমিক গ্রেপ্তার অতঙ্কে আছে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের অনেক নেতা পুলিশের নজরদারিতে আছেন বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে।
  • kalerkontho/ jan 31, 2019 

Wednesday, January 30, 2019

আওয়ামী লীগ নেতার সুদের ফাঁদে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার


সুদখোর আওয়ামী লীগের মৎস্যজীবী লীগ নেতার ঋণের জালে পড়ে নিঃস্ব গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর শতাধিক পরিবার। নিয়মিত সুদের টাকা না দেওয়ায় মারধর, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির অভিযোগও পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, উপজেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান রাসেলের ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন’ সংস্থা নামে একটি সমিতি থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তাদের এ অবস্থা।  সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে তা বাড়ে।  সেই টাকা দিতে না পারলে ঘরের আসবাবপত্র, গরু, ছাগল ও ভ্যান যা পায় নিয়ে যায়। করা হয় মিথ্যা মামলাও।

পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের দূর্গাপুর ও নয়াবাজার গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিম্নআয়ের ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। স্থানীয়দের অভিযোগ, জীবিকার প্রয়োজনে তারা চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয় দাদন ব্যবসায়ী ও উপজেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি রাসেলের  ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন’ সংস্থার কাছ থেকে। এক হাজার টাকায় মাসিক ২০০ টাকা সুদ দিতে হয়। এই সুদ কেউ দৈনিক বা সপ্তাহে দিতে সম্মত হয়ে সাদা কাগজে সই করে। দিন বা সপ্তাহে কিস্তির টাকা দিতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়ে।

ভুক্তভোগীদের দাবি, টাকা পরিশোধ করলেও অনেক সময় নির্যাতন, অত্যাচার করা হয়। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন জানার পরও কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাদের দৌরাত্ম  বেড়েছে।

তারা আরও জানায়, কিস্তি দিয়ে মাস শেষে টাকা পরিশোধ না করলে প্রথমে হুমকি দেওয়া হয়।এরপর ঘরের মালামাল, গরু-ছাগল নিয়ে যায়। এছাড়া মারধরসহ নির্যাতন করা হয়। সুদের টাকা দিতে না পেরে অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেছে। টাকা দিতে না পারায় মনিরুজ্জামান ও তার পরিবার কয়েকজনের নামে তাদের বাড়িতে ডাকাতির মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।








সুদখোর আওয়ামী লীগ নেতা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান রাসেল

ভুক্তভোগীদের কয়েকজনভুক্তভোগী সাহেদ মিয়ার অভিযোগ, ‘অভাবের কারণে রাসেলের কাছে দৈনিক কিস্তিতে ১০ হাজার টাকা নেই। কিছুদিন ঠিকভাবে কিস্তি দেওয়ার পর হঠাৎ কিস্তি দিতে পারিনি। কিস্তির টাকা না পেয়ে রাসেল নানাভাবে আমাকে হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে রাসেলের মা আমাকে আটক করে মারধর করে।’

মিজবুল আকন্দ নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ‘প্রথমে রাসেলের কাছে ছয় হাজার টাকা নেই। দুই মাস কিস্তি দিয়ে ছয় হাজার টাকার লাভ দেই ১২০০ টাকা। পরে আবারও ছয় হাজার টাকা নেই। কিছুদিন কিস্তি দিতে না পারায় রাসেলের মা আরজিনা বেগম আমাকে বেদমভাবে মারধর করে আহত করেন।’

আঙ্গুরা নামে এক গৃহবধূ বলেন, ‘ব্যবসার জন্য রাসেলের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেই। সুদে আসলে মিলে তাকে প্রায় দেড় লাখ টাকা দেই। এরপর তার কাছে আর টাকা না নেওয়ায় বারবার রাসেল হুমকি দিয়ে বলেন, কেন টাকা নিবি না? টাকা নিলেও হুমকি দেয়, না নিলেও দেয়। তাদের অত্যাচারে ভয়ে অনেকে মুখ খুলতে পারেন না।’ বিষয়টি দ্রুত প্রতিকারের দাবি করেন তিনি।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সমিতি বা দাদন ব্যবসার সঙ্গে আমি ও আমার পরিবার জড়িত নয়। মূলত আমার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এবং হেয় করতে এসব মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন স্থানীয়রা।’

ভুক্তভোগীদের কয়েকজনএ বিষয়ে মহদীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়মনীতি তোয়াক্কা না ভুয়া সমিতির নামে সুদখোর মহাজনের সুদ ব্যবসার বিষয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। নিরীহ মানুষকে ফাঁসাতে রাসেল বাড়িতে ডাকাতির মিথ্যা অভিযোগও করছেন। যা তদন্তে ইতোমধ্যে মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে।’ তবে এ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ও প্রশাসনের নিকট দাবি জানান তিনি।

পলাশবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিপজুর আলম মুন্সি বলেন,  ‘রাসেলের  সুদের ব্যবসার অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তের সত্যতাও পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত রাসেলের বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাউল হোসেন বলেন,  সমবায় সমিতির বাইরে এবং অনুমোদন ছাড়া কেউ ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারপরেও কেউ সমিতির নাম ব্যবহার করে বা ব্যক্তিগত সুদ ব্যবসা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
  • বাংলা ট্রিবিউন/ জানু ২৯, ২০১৯