Search

Thursday, February 21, 2019

নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা — সরকারের ‘ঘুমে’ বাড়ছে কান্না


গোলাম মর্তুজা

বাঁকা হয়ে যাওয়া দুটো চাকা আর একটা কাঠামো দেখে বোঝা যায়, এটা একটা পুড়ে যাওয়া রিকশা। তার ওপরে ভেজা সুতি কাপড় দিয়ে পুড়ে যাওয়া মানুষের দেহাবশেষ ঢেকে রেখেছেন স্থানীয় লোকজন। একজন জানালেন, রিকশাটিতে এক দম্পতি ও একটি শিশু ছিল। তিনজনই রিকশার সঙ্গে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছেন।
চুড়িহাট্টার পুড়ে যাওয়া বাড়িটির সামনে ও পাশের সড়কটিতে এক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ নিমতলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০১০ সালের ৩ জুনের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় রাসায়নিকের আগুনে জ্বলে উঠেছিল নিমতলী, যাতে প্রাণ হারান ১২৪ জন। মুহূর্তেই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চারদিকে পড়ে ছিল লাশগুলো। ঘিঞ্জি অলিগলির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক ব্যবসা বা শিল্পকারখানা কতটা বিপজ্জনক, আট বছর আগে তা দেখেছে মানুষ। কিন্তু শিক্ষা হয়নি। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত কাজটি আর হয়নি।

সেই নিমতলীর পুনরাবৃত্তি যেন চুড়িহাট্টায়। রাস্তাজুড়ে ১৫ থেকে ২০টি পুড়ে যাওয়া রিকশার কাঠামো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। দুটি পিকআপ ভ্যান, দুটি প্রাইভেট কার, কয়েকটি মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার কাঠামোও দেখা যায়। কোথাও কোথাও ধোঁয়া উঠছে। এগুলোর মধ্যেই মানবদেহের অবশিষ্টাংশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। স্থানীয় লোকজন আগেই কয়েকটি দেহাবশেষ দেখে মসজিদ থেকে সুতি কাপড় ভিজিয়ে এনে ঢেকে দিয়েছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে লাশের সারি। ছবি: দীপু মালাকার

এত মৃত্যু সবাইকে নির্বাক করে দিয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও বেঁচে থাকতে পেরে সৃষ্টিকর্তাকে বারে বারে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন বেঁচে যাওয়া লোকজন। রাত তখন শেষের পথে। তখন বিকট দুম দুম শব্দ করে বিস্ফোরণ ঘটছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানালেন, সুগন্ধির ক্যানিস্টারগুলো সশব্দে বিস্ফোরিত হচ্ছে। বাজছে পুলিশ আর ফায়ারকর্মীদের বাঁশি। ফায়ার ইঞ্জিনগুলোর ঘরঘর শব্দ চলছেই। সেসব ইঞ্জিনের পোড়া ডিজেল আর সদ্য পুড়ে যাওয়া জনপদের ধোঁয়ায় একাকার পুরো এলাকা।

চকবাজারের এই এলাকাটি মূলত প্রসাধনী ও প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কাঁচামাল বেচাকেনার কেন্দ্র। এই এলাকায় প্রচুর নকল প্রসাধনী বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। সারা দেশ থেকেই ব্যবসায়ীরা এখানে পাইকারি দরে প্রসাধনী কিনতে আসেন।

চুড়িহাট্টা মসজিদের উল্টো দিকের বাড়িটির ভূগর্ভস্থ তলাসহ একতলা ও দোতলায় গড়ে তোলা হয়েছিল সুগন্ধির বিশাল মজুত। ওই বাড়ির সামনে এসে মিলেছে চারটি সরু গলি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগুন লাগার সময় ওই গলির মোড়টি ছিল মানুষ, গাড়ি, মোটরসাইকেল আর রিকশা দিয়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যানজটের কারণে থমকে ছিল সব। সুগন্ধির ক্যানভর্তি বাড়ি থেকে আগুনটা রাস্তায় ছড়িয়েছে, নাকি রাস্তার কোনো গাড়িতে লাগা আগুন ওই বাড়িকে গ্রাস করেছে, তা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।

একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, একটি প্রাইভেট কারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে দুটি গাড়ির একটির সিলিন্ডার অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। আরেকটি গাড়ি হাইব্রিড (টয়োটা অ্যাকুয়া), যেটাতে কোনো সিলিন্ডার ছিল না।

চুড়িহাট্টা মসজিদ–লাগোয়া গলিতে প্লাস্টিকের গুটির দোকানদার রেজাউল করিম তখন দুই কর্মচারীকে নিয়ে দিনের বেচাকেনার হিসাব মেলাচ্ছিলেন। হঠাৎই বিকট বিস্ফোরণের শব্দে তাকিয়ে দেখেন থমকে থাকা রাস্তায় একটি গাড়িতে আগুন লেগে তা কয়েক ফুট শূন্যে উঠে গেছে। মুহূর্তেই আগুনের ঢেউ যেন গোটা রাস্তাকে গ্রাস করে। দুই কর্মচারীকে নিয়ে দৌড়ে বের হয়ে যান, দোকানের ঝাঁপ ফেলারও চিন্তা করেননি।

আবার ওই পথ ধরে তখন মোটরসাইকেলে যাওয়া ফারুক হোসেন বলেন, চার গলির ওই মোড়ের দুটি বড় রেস্তোরাঁ। সেগুলোর চুলার গরমে জায়গাটা এমনিতেই একটু গরম হয়ে থাকে। রাতে যাওয়ার সময় তিনি ওখানে রেস্তোরাঁর খাবারের গন্ধ ছাড়াও সুগন্ধির গন্ধ পান। ৫০ গজ এগোতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পান। পরে ঘুরে ওই বাড়ি থেকে আগুন জ্বলতে দেখেন।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, আগুন লাগার পর মুহূর্তের মধ্যেই তা ঢেউয়ের মতো করে চারপাশের রাস্তায় থাকা মানুষ ও যানবাহনগুলোকে গ্রাস করেছে। আশপাশে অনেক ভাসমান ফল বিক্রেতা, পান-সিগারেট বিক্রেতাও ছিলেন। আগুনে এই লোকগুলোর অনেকেই রাস্তার ওপরেই জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়েছেন।

আগুন লাগার পরে পুড়ে যাওয়া এসব যানবাহনের কাঠামোগুলো রাস্তার ওপরই ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে ছিল। কোনো কোনোটির তলায় মানুষের দেহাবশেষ।

এখানে এমন কোনো বাড়ি নেই, যার নিচতলায় দোকান বা কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়নি। দোকানগুলোর মধ্যে প্রসাধনী ছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্লাস্টিকের গুটির (চিপস) দোকান। স্থানীয় লোকজন বলছেন, যে কয়টা বাড়িতে আগুন লেগেছে, তার মধ্যে দুটির নিচে গুটির দোকান ছিল। এগুলো দ্রুত জ্বলে আগুন বাড়িয়েছে।

এত ব্যস্ত ব্যবসায়িক এলাকা হলেও এখানে ঢোকার সড়কগুলো একেবারেই সরু। কোনো সড়কেই দুটি গাড়ি পাশ কাটানোর জায়গা নেই। ফায়ার সার্ভিসের বড় পানিবাহী গাড়ি এখানে ঢুকতে না পারায় প্রচণ্ড সমস্যায় পড়তে হয়েছে। পাম্প দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের পুরোনো কারাগারের পুকুর থেকে পানি আনা হয়। যার কারণে পানির গতি ছিল কম। আর মানুষের পায়ের চাপে পাইপগুলো মাঝেমধ্যেই পানিশূন্য হয়ে পড়ছিল। ফায়ার সার্ভিসের লোকদের মাইক নিয়ে বারবারই বলতে হচ্ছিল, ‘পাইপগুলো পাড়াবেন না।’ এ ছাড়া চুড়িহাট্টা মসজিদ এবং আশপাশের কয়েকটি বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংক থেকেও পানি সংগ্রহ করে ফায়ার সার্ভিস।

চুড়িহাট্টা মসজিদের অজুখানায় বসে কাঁদছিলেন আবদুল আজিজ ও তাঁর মেয়ে। আজিজ জানান, তাঁর ১৮ বছরের ছেলে ইয়াসিন রনি এখানে ছিলেন। আগুন লাগার পর থেকে ইয়াসিনের ফোন বন্ধ, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মো. রায়হান খুঁজছেন তাঁর বোন সোনিয়া, দুলাভাই মিঠু ও দুই বছরের ভাগনে শাহীদকে। আগুন লাগার সময় ওই পরিবার এই রাস্তা দিয়ে রিকশায় করে যাচ্ছিল।

ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ছবি মোবাইলে বের করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাইনুল হোসেন। পুরে যাওয়া বাড়িটির উল্টো দিকে হায়দার মেডিকো বলে একটি ওষুধের দোকান চালাতেন আনোয়ার। ঘটনার সময় সেখানে আনোয়ারের তিন বন্ধু নাসির, হীরা ও আরেক আনোয়ার ছিলেন। এঁদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

দিবাগত রাত তিনটার পর থেকে ঘটনাস্থলে পাওয়া মৃতদেহগুলো একের পর এক ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি মো. ইউসুফসহ কয়েকজন লাশ উদ্ধারের কাজ করছিলেন। হাত দুটো দেখিয়ে ইউসুফ বলেন, ‘দেখছেন, লাশ তুলতে তুলতে কেমন হয়ে গেছে।’

সকাল আটটা নাগাদ ঢাকা মেডিকেলে জমা হয়ে গেছে ৬৫টি লাশ। নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে হাসপাতাল চত্বরে জমা হয়েছেন হাজারো মানুষ। কিন্তু অঙ্গার হয়ে যাওয়া এ লাশ তাঁরা চিনবেন কী করে? লাশ দেখে অসহায় মানুষগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ারও কেউ নেই। 


কার্টসি — প্রথম আলো। 

Wednesday, February 20, 2019

বিশ্বায়ন এবং আমাদের মাতৃভাষা


এমাজউদ্দীন আহমদ
আজকের বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতধারায় শুধু জাতি-রাষ্ট্র, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য, জাতীয়তাবোধ যে নীরবে-নিঃশব্দে ক্ষয়ে যাচ্ছে তাই নয়, জাতীয় ভাবধারার মাধ্যমে যে ভাষা তাও ক্রমে ক্রমে ক্ষয়িষুষ্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়নের একালে বহুজাতিক করপোরেশনের স্বার্থে বিশ্বব্যাপী এককেন্দ্রিক সংস্কৃতির বিজয় নিশ্চিত করতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। যেহেতু সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা, তাই ভাষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। বেশ কিছু ভাষার অপমৃত্যু ঘটেছে এরই মধ্যে। প্রায় এক দশক আগের হিসাবে দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় ৪০ কোটি জনসমষ্টি ইংরেজিকে ব্যবহার করছে তাদের প্রথম ভাষা হিসেবে। আরও ২৫ কোটি মানুষের কাছে ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এ মুহূর্তে ইংরেজি শিক্ষায় গভীরভাবে মনোযোগী। অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী, ২০৫০ সালে বিশ্বের প্রায় অধিক লোকের ভাষা হবে ইংরেজি। বিশ্বায়নের এ যুদ্ধে বিশ্বময় যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছে ইংরেজি। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজিতে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ভাষা হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে ইংরেজি। তাই আজ ইংরেজি শুধু একটি ভাষা নয়, এটি এখন এক নব্য সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে আজকের এককেন্দ্রিক বিশ্বে একদিকে যেমন বিশ্বের একক ভাষা হিসেবে ইংরেজির অবস্থান ক্রমে ক্রমে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বের প্রায় ৭০০০ ভাষার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে দুটি এবং প্রতি বছরে শতাধিক ভাষা অপমৃত্যুর কবলে পড়ছে। অনেক বিজ্ঞজনের ধারণা, এই শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বিশ্বের শতকরা ৬০ থেকে ৯০ ভাগ ভাষার ভাগ্য বিড়ম্বনা ঘটতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত সংস্থা ইউনেস্কোর অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাই ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে (বর্তমানে এই সংখ্যা ১৯১) ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট অর্জন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল এবং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায়টি বিশ্ব ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ে পরিণত হলো। 

২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯০টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত পূর্ববাংলার দামাল ছেলেদের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেসব তরুণের আত্মদানের কথা। স্মরণ করা হচ্ছে রফিকউদ্দিন, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিকুর রহমান, ওয়ালিউল্লাহসহ নাম না-জানা আরও অনেক শহীদের, পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে, গর্বের সঙ্গে। ঢাকার শহীদ মিনার এখন শুধু ঢাকার নয়, এই শহীদ মিনার এখন সারাবিশ্বের। হয়ে উঠেছে নতুন নতুন সংগ্রামের পবিত্র স্মারক, বিজয়ের প্রতীক, অনুপ্রেরণার উৎস। এই শহীদ মিনার এখন কম্পিত হচ্ছে। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ জনের পদচারণায়। আজও যারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত রয়েছেন, বিশ্বায়নের অশুভ প্রক্রিয়ায় নিজেদের ভাষাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর সংগ্রামে রত রয়েছেন, তারা বারবার স্মরণ করবেন পূর্ববাংলার ছাত্র-জনতার সংগ্রামী চেতনাকে। উদ্বুদ্ধ হবেন রক্তদানের মধ্য দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। তাই এখন রফিক, বরকত, সালাম, জব্বাররা শুধু বাংলাদেশের কৃতী সন্তান নন, তারা আজ সমগ্র বিশ্বের, যেমন ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো নগরীর হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমকালের দাবিতে আত্মদানকারী শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত শুধু শিকাগো নগরীর থাকেননি। তারাও বিশ্বময় শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিত্বে রূপান্তরিত হন। এদিক থেকে বলতে কোনো দ্বিধা নেই, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য এখন বিশ্বময় বিস্তৃত। তা শুধু বিশ্বের কোটি কোটি বাংলাভাষীর অমূল্য সম্পদ নয়, এখন একুশে ফেব্রুয়ারি নিজেদের ভাষার মর্যাদা সংরক্ষণের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ প্রায় দুইশ' কোটি মানুষের আস্থার প্রতীক, সংগ্রামী চেতনার স্মারক। 

ভাষা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহন। শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। ভাষার ওপর তাই কোনো আঘাত এলে সমগ্র জাতি শঙ্কিত হয়ে ওঠে। হয় আতঙ্কিত। উদ্যোগ গ্রহণ করে সেই আঘাত প্রতিহত করতে। যুক্তি-বুদ্ধির সহায়তায় তা সম্ভব হলে ভালো। তা না হলে অগ্রসর হয় রক্তাক্ত পথে। এগিয়ে যায় আত্মদানের পথে। পূর্ববাংলায় যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে তার মধ্যে এই জাতির সংকল্পই প্রতিফলিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি তারই চূড়ান্ত রূপ। একুশে ফেব্রুয়ারির জন্ম একদিনে হয়নি, হয়নি এক যুগেও। তা ছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা সংরক্ষণের আন্দোলন ছিল না। ভাষার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট জীবনবোধ, সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য, জাতির আধ্যাত্মিক সত্তা সংরক্ষণের সংগ্রামের মূর্ত রূপ ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাই এদিনের গুরুত্ব এমন হৃদয়গ্রাহী। একুশের সংগ্রাম একদিকে যেমন এই 'জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, তেমনি তার স্বপ্নসাধ পূর্ণ করার নির্দেশকও। 

বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতে যখন একটি একটি করে ভাষার অপমৃত্যু ঘটছে, তখন ওইসব ভাষাভাষী বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে। বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন তাদের শিল্প-সংস্কৃতির মূল গ্রন্থি থেকে। সাম্প্রতিককালে মাতৃভাষার সারিতে এলো ম্যাসাচুসেটসের ক্যাটওয়া। আলাস্কার এয়াক, লাটভিয়ার লিভেনিয়ান প্রভৃতি। এসব ভাষা ব্যবহারকারী দেশজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের যাযাবর গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছেন। কেননা তারা না পারবেন বিদেশি আচার-অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি আত্মীকরণ করতে। তাই নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণের দাবি অনেকটা সহজাত, মৌলিক, আদিম। এ দাবি যতদিন শক্তিশালী থাকবে, একুশের প্রেরণা ততদিন থাকবে চিরঞ্জীব এবং তাও সমগ্র বিশ্বে।

বাংলা ভাষা সম্পর্কে অবশ্য নেই তেমন কোনো হতাশা। কেননা, বিশ্বায়নের একালে বাংলাভাষীদের বাংলা ছাড়াও শিখতে হবে অন্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি। ইংরেজি শিখেই তীব্র প্রতিযোগিতার এ সময়ে শুধু টিকে থাকতে হবে তাই নয়, বিজয়ী হতে হবে। সমান তালে পা মিলিয়ে দ্রুতগতিতে চলতে হবে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। তাই বাংলাদেশেও ইংরেজি শেখার গতি ত্বরান্বিত হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজনের আকর্ষণ ইংরেজির প্রতি বৃদ্ধি পাবে ভীষণভাবে। কিন্তু সেই ঝড়ে অথবা টর্নেডোতে বাংলা ভাষা উড়ে যাবে না। একশ' বছর পরেও বাংলা ভাষা এ দেশে প্রথম ভাষা হিসেবে টিকে না থাকলেও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এর স্ট্যাটাসের কোনো হেরফের হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারী অনূ্যন ৫৭টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর যে স্বতন্ত্র শব্দাবলি রয়েছে এবং এসব শব্দের পেছনে যে ইতিহাস রয়েছে, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানের জীবন্ত কাহিনী রয়েছে, তার ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়ে যেতে পারে ইংরেজির ব্যাপক প্রভাবে। অথচ এই শব্দাবলি বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যতেও সমৃদ্ধ করবে ভয়ঙ্করভাবে। এ বিষয়ে এ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের ভেবে দেখতে হবে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাস পরে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাসেমের তিন নিবন্ধের সমন্বয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। 'পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা :বাংলা- না উর্দু' শীর্ষক এই পুস্তিকায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ড. মুহম্মদ এনামুল হক 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন-'উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানিদের মরণ- রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।' ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রমুখ পণ্ডিত পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যথার্থতা সম্পর্কে লিখেছেন জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তাদের সবার লেখায় জাতীয় মানস তৈরি হয় নতুন সৃষ্টির জন্য। প্রস্তুত হয় ভাষা সংগ্রামের উর্বর ক্ষেত্র। বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি-বিচার মাথায় নিয়ে তারুণ্য উদ্দীপ্ত হয়। তারুণ্য প্রস্তুত হয় ঐক্যবদ্ধ, সংহত, অজেয় প্রাণপ্রাচুর্যের ভাণ্ডার নিয়ে সংগ্রামের জন্য। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের কলমের সরু খোঁচায় যে স্বপ্নের সূচনা, পঞ্চম দশকের প্রথম ভাগেই সংগ্রামী তরুণদের তাজা রক্তের স্পর্শে তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। 

একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখনও যেসব জনপদে মাতৃভাষার দাবিতে সংখ্যাহীন তরুণ-তরুণী সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন, বিশেষ করে বিশ্বায়নের একালে, একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাভাষীদের অহঙ্কার হয়ে না থেকে প্রতিবাদী একুশ শুধু কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানোর প্রত্যয়রূপে জাগ্রত থাকতে পারবে কি? একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এই ইতিহাসের নায়ক অথবা মহানায়ক তারাই।

কোনো দল অথবা দলীয় নেতার নেতৃত্বে এর জন্ম হয়নি। দেশের চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা তাদের যুক্তিবাদী সৃজনশীল লেখনীর দ্বারা সমাজজীবনে এর ক্ষেত্র রচনা করেন। দেশের স্বাধীনচেতা মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণরা সেই উর্বর ক্ষেত্রে রক্তবীজ বপন করেন। ফলে এই সোনালি ফসল। এই তরুণদের সংগ্রামী চেতনা সমগ্র সমাজব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে গড়ে তোলে এক অজেয় শক্তি। তাই পরে রাজনীতিকে দান করে নতুন দ্যোতনা। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় এক নতুন চিৎশক্তি। সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস।

নিকট অতীতে পশ্চিম আফ্রিকার আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশের তরুণরা আর একটি ঐতিহাসিক অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। ১৯৬১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেও এই দেশটি এখনও শান্তিপূর্ণ সমাজ জীবনের আশীর্বাদ লাভ করেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ওই অশান্ত দেশটিতে ২০টি দেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী কর্মরত। বাংলাদেশ থেকেও একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী যোগদান করে ২০০০ সালের মে মাসে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রমে খুশি হয়ে ২০০২ সালের ২৭ ডিসেম্বর সেই দেশের সরকার সিয়েরা লিওনে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। সে দেশেও রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারদের কীর্তিগাথা প্রচারিত হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারিতে। তাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ওইসব শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাকে- যাদের রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এই স্মরণীয় দিবসটি লাভ করেছি। এদিনের সৃষ্টিতে এ দেশের তরুণরা রক্তাক্ত অবদান রাখলেও এখন তা বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। বিশ্বময় এর ব্যাপ্তি এবং সুখদ তুষ্টির কারণ হোক তাই আমাদের কামনা।

  • রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • সমকাল/ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

গায়েবি মামলার শেষ কোথায়


  • গত আড়াই মাসে বহু মানুষ জামিন পেতে হাইকোর্টে
  • গায়েবি মামলায় আগাম জামিন চাইতে আসেন তাঁরা
  • তাঁদের কেউ পঙ্গু, কেউ বয়োবৃদ্ধ, কেউ চোখে কম দেখেন
  • আসামিদের মধ্যে আছেন স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা
  • সাধারণ কৃষক, দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও আছেন প্রচুর




লালন অনুসারী জিন্দার ফকিরের এক চোখ নষ্ট। নির্বাচনের আগে তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মিছিলে হামলার অভিযোগে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানায় মামলা হয়। গতকাল হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে।

লালন অনুসারী জিন্দার ফকিরের (৫২) সঙ্গে দেখা হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে। এক চোখে দেখেন না, ছোটবেলাতেই সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। গান, সাধুসঙ্গ আর গরুর দেখভাল নিয়েই থাকেন। ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই জানলেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দৌলতপুর থানায়। অভিযোগ, ১৯ ডিসেম্বর নৌকার মিছিলে ককটেল ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা। এরপর কিছুদিন পালিয়ে থাকা।

ফেরারজীবন থেকে রেহাই পেতে গতকাল মঙ্গলবার অন্যদের সঙ্গে আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে এসেছিলেন জিন্দার ফকির। তাঁর ভাষ্য, ‘সারা দ্যাশে যেমন দিছে, আমাগের ওইহানেও দিছে। এগুলি গায়েবি মামলা, বুঝছেন? বংশের লোকেরা পার্টি করে তাগেরে দিল। কিন্তু আমারে ক্যান দিল, তা কতি পারি না।’

গত আড়াই মাসে জিন্দারের মতো সহস্র মানুষ এ রকম রাজধানীর হাইকোর্টে এসেছেন গায়েবি মামলায় আগাম জামিন চাইতে। তাঁদের কেউ পঙ্গু, কেউ বয়োবৃদ্ধ, কেউ চোখে কম দেখেন। মামলার আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছেন স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এর বাইরেও খুব সাধারণ কৃষক, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণির লোকজনও আছেন প্রচুর। লুঙ্গি বা মলিন পোশাকের পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে দল ধরে এই লোকগুলোর বসে থাকার দৃশ্য এখন প্রতিদিনকার।

আর বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিনই এসব গায়েবি মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর খবর আসছে। গত এক মাসে আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর কেবল চট্টগ্রামেই ৩০৪ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সারা দেশে কত গায়েবি মামলা হয়েছে, তার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তবে গত নভেম্বরে বিএনপি দুই দফায় ২ হাজার ৪৮টি গায়েবি মামলায় প্রায় দেড় লাখ আসামির তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়। ওই সব মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে আরও আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪ লাখ লোককে। কেবল সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানীতে ৫৭৮টি গায়েবি মামলার তথ্য পাওয়া যায়। এই ভোগান্তির শেষ কোথায়, কীভাবে—সেটিই জানতে চান আসামিরা।

যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গায়েবি মামলাগুলোকে ‘সফটলি হ্যান্ডেল’ করতে বলা হয়েছে থানাগুলোকে। মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় যেন নিরীহ লোকজনকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি)।

পিরোজপুরের নেছারাবাদ থানার ওসি তারিকুল ইসলাম ১৩ ফেব্রুয়ারি গায়েবি মামলার এক আসামি প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, বুঝছি, পলিটিক্যাল মামলা তো। ওগুলো এখন শেষ হয়ে যাবে, চিন্তা করতে মানা করেন।’ ঢাকার বাইরের আরও চারটি থানার ওসিরা জানান, গায়েবি মামলায় নিরীহ লোকদের হয়রানি না করার নির্দেশনা পেয়েছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা বলেন, তিনি ‘গায়েবি মামলা’ প্রত্যয়টির সঙ্গে একমত নন। প্রতিটি মামলা গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। তিনি বলেন, ‘কোনো মামলা নিয়ে যদি কারও কোনো অভিযোগ থাকে যে তাঁকে অহেতুক হয়রানি করা হয়েছে বা কাউকে ভুলভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মামলা রুজুর সময়কার ভুলত্রুটি সংশোধনের সুযোগ রয়েছে এবং আমরা সেদিকেই যাচ্ছি।’

মামলার ধাওয়া

গত আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পর সেপ্টেম্বরে দেশের বিভিন্ন থানায় ঘটনা না ঘটলেও বেশ কিছু মামলা করে রাখে পুলিশ। গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। এখন পুলিশ মামলাগুলো সফটলি হ্যান্ডেল করার কথা বললেও বাস্তবচিত্র কিছুটা ভিন্ন। পুলিশের ধাওয়ায় এসব মামলার আসামিদের অনেকেই বাড়ি যান না বহুদিন। পালিয়ে থাকতে থাকতে ক্ষুদ্র চালের ব্যবসার পুঁজি নিঃশেষ হয়ে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের নজরুল ইসলামের। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের দিনমজুর সবুজ মিয়া দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন। এলাকার লোকজন টাকা দিয়ে তাঁকে জামিনের জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছেন।

আর জামিন না নিলে কী হয়। তা বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের চিলারং ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, যে নাশকতার অভিযোগে মামলাটি দিয়েছে, এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের পুলিশ অনেক মারধর করেছে বলে তিনি শুনেছেন। আর তিনি নিজেও ৪০ দিন বাড়ির বাইরে খড়ের গাদা, মেশিনঘর এমনকি কবরস্থানে পর্যন্ত থেকেছেন। তাঁদের খুঁজতে পুলিশ একাধিকবার বাড়িতে এসেছে।

পিরোজপুরের নেছারাবাদের আবদুল হামেদ চোখের ছানি কাটানোর টাকা খরচ করে জামিন করাতে এসেছেন কেবল পুলিশের ধাওয়া খেয়ে। তিনি জানান, তিনি যেখানে লুকিয়ে ছিলেন, তিন দিনের মাথায় সেখানে পৌঁছে যায় পুলিশ।

আর সিলেটের গোয়াইনঘাটের পাথরশ্রমিক মোহাম্মদ আলীর ভাষ্য, একই মামলায় পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁদের ‘মারিয়া চ্যাফটা করিয়ালাইছে’ বলে তিনি শুনেছেন।

এক মাসে ৩০৪ জন কারাগারে

গতকাল চট্টগ্রামে বিএনপির আরও ২৬ নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গত বছরের অক্টোবর মাসে নাশকতার অভিযোগে পুলিশের করা গায়েবি মামলায় আত্মসমর্পণ করেন তাঁরা। ঘটনার দিন বিদেশে থাকার পরও মামলার আসামি হওয়ায় দুজনের জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। এর আগে গত সোমবার ৫৭ নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন একই আদালত। জাতীয় নির্বাচনের পর চট্টগ্রামে পুলিশের ধরপাকড় বন্ধ হলেও গত এক মাসে এভাবে কারাবন্দী হলেন বিএনপির ৩০৪ নেতা-কর্মী।

হাইকোর্টের জামিনের মেয়াদ শেষে কারাগারে

সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল ও হামলার অভিযোগের চার মামলায় গত ২০ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন পান বিএনপির নেতা জি কে গউছসহ কয়েকজন। এই জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় গতকাল তাঁরা হবিগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হলে আদালত গউছসহ ১৪ নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। তিনি হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে ছিলেন। সংসদ নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করে হবিগঞ্জ-৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হন। এখন কারাগারে।

৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পরদিন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতারা বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় চারটি মামলা করেন।

একইভাবে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা বিএনপির সাত নেতা-কর্মীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, নির্বাচনের আগে দায়ের হওয়া ওই গায়েবি মামলায় তাঁরা হাইকোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন নিয়েছিলেন। জেলা জজ আদালতে গতকাল তাঁরা জামিনের আবেদন করলে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়।

টাঙ্গাইলের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) এস আকবর খান বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে নাশকতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় আদালত তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করেছেন।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপির ২০ নেতাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী রুহুল আমিন বলেন, ‘নির্বাচনের আগে মাঠছাড়া করতে আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এই গায়েবি মামলা দিয়েছিল পুলিশ।’

মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম মামলার একটি অস্ত্র যখন পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখন সেটিকে তাদের অনেকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সারা দেশে কয়েক লাখ মানুষ এ ধরনের মামলার শিকার হয়েছে। সাম্প্রতিককালে যে ছবিগুলো গণমাধ্যমে দেখেছি, সেটি একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। সারা দেশের পরিবেশ আরও ভয়াবহ। তিনি বলেন, এই ধরনের মামলাগুলোর তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এক্ষুনি প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। না হলে সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হবে, স্বাভাবিক গতি থমকে যাবে।

নূর খান বলেন, ‘প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। এই মামলার প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যতে কী হতে পারে, সেটি আমি ভাবতেও পারি না।’
  • কার্টসি — প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯। 

Tuesday, February 19, 2019

একটি ইয়াবা পরিবার

গোলাম মোর্তোজা


গ্লাস অর্ধেক ভরা, না অর্ধেক খালি? যুক্তি-তর্কের জন্যে এটা খুব ভালো বিষয়। যেহেতু গ্লাসের অর্ধেক অংশে পানি আছে, সেহেতু প্রথমে ‘ভরা’ প্রসঙ্গে আসি। কথা বলছি ইয়াবা চোরাচালানিদের নিয়ে। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় মাথায় ঘুরছে। সেটা হলো কোনো কোনো গণমাধ্যম লিখছে ‘ইয়াবা কারবারি’ বা ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’। ব্যকরণবিদ নই, সেই বিবেচনায় ভুল বা শুদ্ধ বিচার করছি না। সাধারণ ধারণার বিষয় নিয়ে কথা বলছি।

ইয়াবা একটি ভয়ঙ্কর মাদক। মিয়ানমার থেকে অবৈধ উপায়ে ইয়াবা বাংলাদেশে আনা হয়। সহজ বাংলায় চোরাচালানের মাধ্যমে ইয়াবা বাংলাদেশে আনা হয়। যারা আনে তারা চোরাচালানি। কোনো বৈধ পণ্য বৈধভাবে আমদানি বা কেনা-বেচা যারা করেন, তারা ব্যবসায়ী। চোরাচালানি আর ব্যবসায়ী এক বিষয় নয়। সুতরাং ইয়াবা কারবারি লিখলে, চোরাচালানিদের ব্যবসায়ী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হয়। যা প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্যে অসম্মানজনক। ১০২ জন ইয়াবা চোরাচালানি বা চোরা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছে, ইয়াবা কারবারি বা ব্যবসায়ী নয়।

এবার অর্ধেক ভরা গ্লাস প্রসঙ্গে ফিরে আসি।

তালিকাভুক্ত প্রায় দুই হাজারের মধ্যে ১০২ জন ইয়াবা চোরাকারবারি অন্তত আত্মসমর্পণ করেছে। দীর্ঘ বছর ধরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। টেকনাফ-কক্সবাজারে অবাধে বিচরণ করেছে এসব চোরাকারবারি। শুধু মাদক বা ইয়াবা চোরাকারবারি নয়, এরা আরও নানারকমের সামাজিক অপকর্ম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ১০২ জনের মধ্যে ১২ জন আছে একটি পরিবারের সদস্য। 


সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ইয়াবা চোরাকারবারিদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এক ও দুই নম্বরে নাম ছিল আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি ও তার আপন ভাই মৌলভি মজিবুর রহমানের। বাংলাদেশকে যে ইয়াবায় পরিপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, তার একক অবদান সাবেক এমপি বদির পরিবারের। সেই প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পরিবারের ১২ জন ইয়াবা চোরাকারবারিকে আত্মসমর্পণ করাতে পারা, একটা বড় অগ্রগতি।

এবার আসি গ্লাসের অর্ধেক খালি প্রসঙ্গে।

সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি সব সময় বলেছে, তিনি বা তার পরিবার ইয়াবা চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত নয়। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে বদির এক বিয়াই নিহত হয়। সেই নিহত ব্যক্তি যে বিয়াই, বদি তাও স্বীকার করেনি।

সরকারের তালিকা অনুযায়ী বড় ইয়াবা চোরাকারবারি আছে ৭৩ জন। তাদের ৩০ জন আত্মসমর্পণ করেছে। এই ৩০ জনের মধ্যে আছে সাবেক এমপি বদির চার ভাই আবদুল শুক্কুর, আবদুল আমিন, মো. শফিক ও মো. ফয়সাল, বদির ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল, ভাগনে সাহেদুর রহমান নিপুসহ ১২ জন। যদিও কোনো কোনো সংবাদে এই সংখ্যা ১৪ বা ১৬ উল্লেখ করা হয়েছে।

তালিকার এক নম্বরে থাকা বদিকে ইয়াবা চোরাকারবারিদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার অঘোষিত সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বদি নিজে আত্মসমর্পণ করেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার দুই নম্বরে থাকা বদির আপন ভাই মৌলভি মজিবুর রহমানও আত্মসমর্পণ করেনি।

বদি, তার ভাই-ভাগ্নেসহ পরিবারের এসব সদস্য যে ইয়াবা চোরাকারবারি, তা সুনির্দিষ্ট করে বহুবার গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে।

একথা অজানা নয় যে, টেকনাফের প্রশাসন চলে বদির নির্দেশনা অনুযায়ী। সেই প্রশাসনের করা ইয়াবা চোরাকারবারিদের তালিকায় বারবার উঠে এসেছে বদি, তার ভাই-ভাগ্নেসহ পরিবারের সদস্যদের নাম। সব সময়ই বদি সরকারের উচ্চ মহলের সহায়তা পেয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মাদকবিরোধী সপ্তাহ উদ্বোধন করেছেন বদিকে সঙ্গে নিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে তালিকা করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই তালিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আরও সতর্কভাবে তালিকা করার নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন ‘বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে প্রমাণ নেই’। প্রায় একই রকমের কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। 

টেকনাফ-কক্সবাজার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটা অংশ বারবার অভিযোগ করে বলেছেন, উচ্চমহলের পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগে বদি তো বটেই, বদির ভাই-ভাগ্নেসহ আত্মীয় স্বজনরা অবাধে ইয়াবা চোরাকারবারিদের নেতৃত্ব দিয়েছে। প্রকাশ্যে অবস্থান করেছে। প্রশাসন তাদের প্রতিপক্ষ হয়নি বা প্রশাসনের সহায়তায়ই চোরাকারবার চালিয়ে গেছে। এমপি বদির ক্ষমতায় তারা ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মঞ্চেও সেই দাপটের প্রমাণ মিলেছে। বদির  ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল গণমাধ্যমকর্মীদের হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘আত্মসমর্পণের পর তোদের মজা দেখাব। ইয়াবা ব্যবসায়ীর হাত অনেক লম্বা।’

একথা অনুষ্ঠানস্থলের সামনের দিকে থাকা সবাই শুনেছেন। মঞ্চে থাকা মন্ত্রী, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তা না শোনার কথা নয়। একজন ইয়াবা চোরাকারবারির এমন দাম্ভিকতার বিষয়ে তারা সবাই চুপ থেকেছেন।

যেহেতু বদির পূর্বপুরুষ মিয়ানমার থেকে এসেছে, সেকারণে মিয়ানমারে বদির আত্মীয়-স্বজন আছে। বলা হয় তাদের পরিবারের ইয়াবা তৈরির কারখানা আছে মিয়ানমারে। মিয়ানমারে কোনো সমস্যা হলে, বদির ইয়াবা চোরাকারবারি স্বজনরা বাংলাদেশে চলে আসে। বাংলাদেশে সমস্যা হলে বদির স্বজনরা মিয়ানমারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ইয়াবা চোরাকারবারে কখনো তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও দুই দেশের সম্মিলিত ইয়াবা সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষক। বাংলাদেশ থেকে বড় ইয়াবা চোরাকারবারিরা সহজেই মিয়ানমারে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে।

মাদক বিরোধী অভিযানের সময় বদি চলে গিয়েছিল ওমরাহ করতে সৌদি আরব। তার ইয়াবা চোরাকারবারি স্বজনরা আশ্রয় নিয়েছিল মিয়ানমারে। এতোদিনের যে অভিযোগ, তা প্রমাণ হলো আত্মসমর্পণের ঘটনায়। দৃশ্যমান হলো, একটি ইয়াবা চোরাকারবারি পরিবার। যে পরিবারের অধিকাংশ সদস্য প্রত্যক্ষভাবে ইয়াবা চোরাকারবারি। সেই পরিবারের প্রধান ব্যক্তি বা মুরব্বি সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি। যিনি আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সমন্বয়কারী।

এখন প্রশ্ন দু’টি।

এক. তারা কেন আত্মসমর্পণ করল?

দুই. এর মধ্য দিয়ে ইয়াবা চোরাকারবার বন্ধ হবে কিনা?

মাদকবিরোধী অভিযানে ছোট ইয়াবা চোরাকারবারিরা নিহত হওয়ার ঘটনায় কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে বড় চোরাকারবারিরা। প্রশাসনের একটা অংশ যেমন তাদের পক্ষে, বিপক্ষেও একটি অংশ আছে। অভিযানের মুখে যে যেখানে পারে পালিয়ে যায়। ইয়াবা চোরাকারবার করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে, বিশাল বিশাল বাড়ি তৈরি করেছে টেকনাফে। কিন্তু, সেই বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না। সম্পদ হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আত্মসমর্পণ করলে সম্পদ রক্ষা করা যাবে, এটা একটা কারণ হতে পারে। আত্মসমর্পণ করলেও গোপনে ইয়াবা চোরাকারবার চালিয়ে যাওয়া যাবে তেমন কোনো সমস্যা হবে না, তাও হয়ত বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পরামর্শও হয়ত এক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে। আবার মানুষ জানবে, তারা এখন আর ইয়াবা চোরাকারবারি নয়। ভালো হয়ে গেছে।

বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে বদির পরিবার। কিন্তু এমপি হওয়ার পরও পরিচিতি ‘ইয়াবা চোরাকারবারি পরিবার’। এবার নিজে মনোনয়নও পায়নি, স্ত্রী এমপি হয়েছে। সামনে সম্ভবত আরও অনেক প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হতে পারে। বিশেষ করে তাকে ও তার পরিবার নিয়ে গণমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশ বন্ধ করা যাবে না। ইয়াবা চোরাকারবারি পরিচয় ঘোচানোর জন্যে অন্যদেরসহ নিজের পরিবারের সদস্যের আত্মসমর্পণ করানোর উদ্যোগ নিয়েছে বদি। তবে, সতর্কতার সঙ্গে নিজে এবং আপন ভাই আত্মসমর্পণের বাইরে থেকেছে। এখন হয়ত বলতে পারবে, আমি বা আমার আপন ভাই ইয়াবা চোরাকারবারি নই।

ইয়াবা চোরাকারবারের সঙ্গে শত বা হাজার কোটি টাকার হিসাব। এর অংশীজন সীমান্ত পাহারা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ কক্সবাজার-টেকনাফ প্রশাসনের বড় একটি অংশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের ইয়াবা চোরাকারবারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার সংবাদও জানা গেছে বিভিন্ন সময়।

প্রশাসনের সম্পৃক্তদের সনাক্ত বা ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তালিকার প্রধান দুইজন বদি ও তার আপন ভাই আত্মসমর্পণ করেনি। তালিকাভুক্ত আরও প্রায় দের হাজার ইয়াবা চোরাকারবারি রয়ে গেছে। এর বাইরেও আরও অনেক ইয়াবা চোরাকারবারি আছে। মিয়ানমারে অবস্থানরত সিন্ডিকেট তো আছেই। আজকেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, ইয়াবা আসছেই। ফলে আর যাই হোক একথা বলা যাচ্ছে না যে, আংশিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ইয়াবা চোরাকারবারের অবসান ঘটছে বা ঘটবে।

  • কার্টসি — দি ডেইলি স্টার/ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯। 

দুদককে মানুষ আর বিশ্বাস করছে না বিশ্লেষকদের অভিমত

শামছুল ইসলাম

সম্প্রতি দুর্নীতিবাজদের লোভের জিহবা কেটে ফেলার হুমকি দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এখন মানুষের আর অভাব নেই। লোভের কারণেই দুর্নীতি করে। আমরা লোভের জিহবা কেটে দিতে চাই। অলরেডি সেটা আমরা শুরু করেছি। দুর্নীতি করলে এখন ডেফেনিটলি শাস্তি হয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আসলে দুদক নাগরিকদের ধোঁকা দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন যেসব কথা বলছে তা মানুষ বিশ্বাস করছে না। তারা যে অভিযান চালাচ্ছে তা লোক দেখানো। প্রাইমারি শিক্ষক স্কুলে এলো নাকি এলো না, কোন কর্মচারী কী করল, ডাক্তার কী করল এগুলো দেখার জন্য আরো বহু প্রতিষ্ঠান আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন একটা দেশে তখনই প্রশংসিত হয় বা নাগরিকরা বিশ্বাস করে যখন দেখে যে, তারা ক্ষমতাসীন সরকারের বড় বড় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার কথা, ব্যাংক, শেয়ারমার্কেট লুট হওয়ার কথা, বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতির কথা পত্রিকায় দেখি। এসব ক্ষেত্রে যদি দুদক কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বড় বড় বুলি ছাড়ে তাহলে মনে হবে দুদক আসলে মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে। দুদক সম্পর্কে এখনই অনেক কথা বলা হয়, কেউ কেউ বলে দুদকের কাজ হচ্ছে বিএনপির দুর্নীতি দমন কমিটি বা বিরোধী দল দমন কমিটি।

আমি মনে করি এখন দুদক যা করছে তা হচ্ছে, বিএনপিসহ ছোট ছোট দুর্নীতিবাজের দুর্নীতি সাড়ম্বরে প্রচার করছে। এর আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে, যে দুর্নীতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধস নামিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্রের কোষাগারকে ধরে টান দিয়েছে, রাষ্ট্রের খরচ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে সেসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই।


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি এম হাফিজ উদ্দীন খান বলেন, দুর্নীতি কারো একার পক্ষে দমন করা সম্ভব নয়। আরো অনেক এলিমেন্টস রয়েছে যেগুলো দুর্নীতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য আমাদের আইনের সংস্কার, বিচার বিভাগের সংস্কার প্রয়োজন।আমার ধারণা দুদক হয়তো দুর্নীতি দমনের জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু সমস্যাতো তাদের থাকতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রভাব দুর্নীতি দমনে একটা বড় ফ্যাক্টর। সেটা দুদক কতটুকু ওভারকাম করতে পারে সেটা আমি বলতে পারব না।

ব্যাংক, শেয়ারবাজার দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুদকের তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। এমনকি সরকারই এ ক্ষেত্রে সহনশীল নীতি গ্রহণ করেছে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ক্ষেত্রে কার্যকর করতে পারে। দুদকও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি রুখতে সরকার এ ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। কিন্তু দুর্নীতি দমনে সরকার নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক বলেন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালে সবাই হাজির হচ্ছে কি না এটা দেখা ন্যায়পালের কাজ। এটা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ নয়। দেশে অনেক বড় বড় অনিয়ম, দুর্নীতি হচ্ছে সেখানে দুদকের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলোতে সব লেনদেনের কাগজ থাকে। এটার দুর্নীতি বের করা কঠিন কাজ না। অর্থটি যেদিকে যাওয়ার কথা সেদিকে না গিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছে। এটি বের করতে না পারা কতটা অদক্ষতা আর কতটা রাজনৈতিক চাল সেটা তারাই ভালো জানেন।

  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯। 

ভাল নেই সংবাদপত্র


চরম দুঃসময় পার করছে দেশের সংবাদপত্র। প্রতিনিয়ত এই সমস্যা বাড়ছে। সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হল পত্রিকার নিউজের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চাইলেও সবকিছু লেখা যায় না। পুরো মিডিয়াতে এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। আর প্রকৃত ঘটনা প্রকাশিত না হওয়ায় মানুষ পত্রিকা পড়তে চায় না। যা পত্রিকার সার্কুলেশন ও আয়ে প্রভাব ফেলছে। আশির দশকে সংবাদপত্র এভাবে চাপের মুখে থাকায় বিবিসি রেডিও বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে সংবাদপত্রের বিকল্প হিসাবে ফেসবুক ও টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এর সুযোগ নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে একটি মহল।  

আরেকটি সমস্যা হল বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের (জনসংখ্যার বোনাসকাল) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। প্রায় ৩ কোটি মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। বিশাল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠির বেশিরভাগই কাগজে ছাপা সংবাদপত্র পড়ে না। তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইনের উপর নির্ভরশীল। ফলে কাগজের পত্রিকার সার্কুলেশনে এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।   


সংবাদপত্রে সংকটের আরেকটি কারণ হল গত ৫ বছরে এখাতে টেকসই কোনো বিনিয়োগ আসেনি। এর অন্যতম কারণ হল অদক্ষ ও অপেশাদার লোকজন বাজারে সংবাদপত্র নিয়ে এসেছে। শুরুতে এরা উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করার জন্য অবাস্তব কিছু স্বপ্ন দেখায়। ধারনা দেয়, সার্কুলেশনে অমুক পত্রিকাকে টপকে যাবে। ৬ মাস কিম্বা এক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠান লাভজনক করে দেয়া নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা দেয়। বিভিন্ন পত্রিকা থেকে বেশি টাকা বেতন দিয়ে ভাল ও পেশাদার কিছু সাংবাদিকও নিয়ে আসে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পরে কথা আর কাজের মিল না পাওয়ায় মালিক পক্ষ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। এতে আগে থেকে পত্রিকার সম্পাদকসহ কর্তা ব্যক্তিরা মালিক পক্ষের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা হাতিয়ে নিলেও পেশাদার সাংবাদিকদের জীবনে দীর্ঘ বেকারত্ব ও দুর্বিসহ কষ্ট নেমে আসে। এভাবে কয়েকটি প্রজেক্ট ব্যর্থ হওয়ায় ভাল কোনো উদ্যোক্তা এখানে বিনিয়োগে আসছে না। সামগ্রিকভাবে যা শিল্পে আভ্যান্তরীণ প্রতিযোগিতা কমেছে। যা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন, প্রমোশন ও বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।  অন্যদিকে গত দশ বছরে সবচেয়ে বেশি তেল মেরেছে ও অথচ সবচেয়ে কম সুবিধা পেয়েছে সাংবাদিকরা। সব পেশার লোকজন নিজস্বভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স, আবাসনসহ সরকারের কাছ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা লুফে নিয়েছে। খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকরা ব্যাংক ঋণের জন্য গেলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে পেশার পরিচয়ে ঋণ পাওয়া কঠিন। 

সংবাদপত্রের দুর্দিনের অন্যতম আরেক কারণ  হল পত্রিকার প্রচার সংখ্যা নিয়ে সীমাহীন মিথ্যাচার ও নজিরবিহীন দুর্নীতি। গত ১১ ফেব্র“য়ারি সংসদে তথ্যমন্ত্রীর দেয়া হিসাব অনুসারে সারাদেশে ১ হাজার ২৪৮টি দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৫০২ এবং সারা দেশে ৭৪৬টি। এছাড়া সারাদেশে সাপ্তাহিক পত্রিকা রয়েছে ১ হাজার ১৯২টি, মাসিক ৪১৪টি ও অন্যান্য ৪১টি। এর বাইরে দুই হাজার ২১৭টি অনলাইন মিডিয়া রয়েছে। যার মধ্যে অনলাইন পত্রিকা ১ হাজার ৮৭৪টি ও ইন্টারনেট টেলিভিশন ২৫৭টি, অনলাইন রেডিও ৪৫টি এবং ই- পেপার ৪১টি। কিন্তু দৈনিক পত্রিকার প্রচার সংখ্যার ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা ডিএফপি সীমাহীন মিথ্যাচার করছে। ডিএফপির তথ্যে দেয়াল পত্রিকাগুলোরও লাখ লাখ সার্কুলেশন দেখানো হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানীর ফকিরাপুলও বিভিন্ন জায়গা থেকে শুধু মাস্টহেড পরিবর্তন করে অন্যান্য সব সংবাদ ঠিক রেখে একেকটি প্রেস থেকে একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় এই সব ভুইঁফোর পত্রিকার মালিক পক্ষ একদিকে সরকারি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, অপরদিকে সংবাদপত্রের নামে কম শুল্কে নিউজ প্রিন্ট আমদানি করে বেশি দামে বাজারে বিক্রি করছে। এছাড়াও গাড়িতে সংবাদপত্র, প্রেস, সাংবাদিক জাতীয় স্টিকার ব্যবহার এবং মানুষকে ব্লাকমেইল করে টাকায় আদায়ের ঘটনাতো সবার জানা।  সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও ভোট ব্যাংক তৈরির জন্য এসব পত্রিকার লোকজনকে সংগঠনের মেম্বাররশিপ দিচ্ছে। 

সংবাদপত্রের আরেকটি সমস্যা হল বেসরকারি বিজ্ঞাপন আয় কমে যাওয়া। দেশে ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির থাকায় বিজ্ঞাপন কমেছে। এছাড়া যত বেশি গণমাধ্যমের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, ওই হারে বিজ্ঞাপনের বাজার বাড়েনি। ফলে বিদ্যমান বিজ্ঞাপন নিয়ে এখানে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। ফলে খুব কম রেটেই গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে। স্বাভাবিক কথা হল, কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্রান্ডিং ও প্রচারণার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞাপন পেতে হলে তদ্বিরতো লাগেই। এরপর কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করতে হচ্ছে। এসব কারণে আগামীতে সংবাদপত্রের জন্য হয়তো অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে।  


  •  লেখক সিনিয়র রিপোর্টার, যুগান্তর। 


মতপ্রকাশে বাধা আইন, ভয় ও চাপ

টিপু সুলতান

  • দেশে গণমাধ্যমের যাত্রা কখনোই নির্বিঘ্ন ছিল না
  • এখন বড় হুমকি হয়ে উঠেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন 
  • মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে পারেনি সরকার
  • সরকার অবশ্য তেমনটা মোটেই মনে করে না
  • সব মিলিয়ে বিষয়টি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

দমনমূলক এক আইন দেশে মতপ্রকাশ ও সংবাদ–মাধ্যমের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। চাপা ভয়ের কারণে সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকদের মধ্যে ‘স্ব-আরোপিত’ নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। এর পাশাপাশি কিছু গোষ্ঠীর চাপ, হামলা এবং হুমকিও রয়েছে।

এ পর্যবেক্ষণ দেশের সাংবাদিক আর সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষকদের। মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এমন অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও একই কথা বলছে। সরকার অবশ্য এমনটা মোটেই মনে করে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মান সংবাদমাধ্যম ডচে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে (১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত) বলেছেন, তিনি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মুক্তচিন্তাকে শতভাগ সমর্থন করেন।

তবে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, গণমাধ্যমসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে গত বছর পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আরও যে বিষয়গুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ঝুঁকিতে ফেলছে, তার মধ্যে আছে: সবল বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া; গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি বা ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা; এবং সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে গোয়েন্দা নজরদারি।

আছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, উগ্রবাদী সংগঠন আর অর্থ-প্রতিপত্তিতে ক্ষমতাশালী দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীর হুমকি-ধমকি থেকে শুরু করে দমন-পীড়ন-নির্যাতন এমনকি হত্যার ঝুঁকি। অসহিষ্ণুতা ও ভিন্নমতের ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণ সামাজিক পরিসরে বড় সমস্যা।


অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে বলেছে, বাংলাদেশে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে পারেনি সরকার। সব মিলিয়ে এটা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ‘মানবাধিকার ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের আলোচনায়ও মতপ্রকাশ এবং নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য এ স্বাধীনতা জরুরি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় জাতিসংঘের দপ্তর আয়োজিত এ সেমিনারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে যাঁরা ভিন্নমত প্রকাশ করতে আগ্রহী, তাঁদের সুরক্ষা দিতে হবে।

অবশ্য বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করে থাকে। বর্তমান সরকারও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারবে না।

স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে গণমাধ্যমের যাত্রা কখনোই নির্বিঘ্ন ছিল না। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি পত্রিকা বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসনামলে ছিল নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি। আক্রমণ এসেছে কথিত বাম চরমপন্থী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের কাছ থেকে।

নব্বইয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারও বিজ্ঞাপন বন্ধ করাসহ নানা চাপ জারি রেখেছিল। সংবাদমাধ্যম বা সংবাদকর্মীরা ধারাবাহিকভাবে বাধা বা আক্রমণ মোকাবিলা করেই এগিয়েছেন। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

গত নির্বাচনের আগে ১৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা ভয়ের পরিবেশের মধ্যে আছেন। এ জন্য অনেকে ‘স্ব-আরোপিত’ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কাজ করছেন।

আইনি খড়্গ ও উদ্বেগ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন। এ আইনে সরকারি সংস্থার গোপনীয় তথ্য কেউ কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করলে তা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি বলে সাব্যস্ত হবে। শাস্তির বিধানটি কঠোর। অর্থাৎ, যে বিষয়টি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জনগণকে জানাচ্ছে না, তা নিয়ে খবর প্রকাশ করলে শাস্তি পেতে হতে পারে। পুলিশের সন্দেহ হলেই যেকোনো গণমাধ্যমের কম্পিউটার-ব্যবস্থা জব্দ করতে পারবে। মতপ্রকাশের অন্তরায় হিসেবে এমন নয়টি ধারাকে চিহ্নিত করে আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে সম্পাদক পরিষদ।

আইনটি পাস হওয়ার পর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানায়। এর মধ্যে ছিল সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা প্যারিসভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), নিউইয়র্কভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) ও ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে)। এই আইনের ‘নিবর্তনমূলক’ সব ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছিল টিআইবি।

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফলের ভুল তথ্য প্রকাশের অভিযোগে এই আইনে খুলনার একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় ভুলটা রিটার্নিং কর্মকর্তাই করেছিলেন।

অবশ্য নতুন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎ​কারে বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে বাংলাদেশের সব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। এখানে কিছু ধারার ব্যাপারে সাংবাদিকদের উদ্বেগ আছে। সেই উৎকণ্ঠা দূর করার জন্য কাজ করছি, যাতে কোনো ধারার অপপ্রয়োগ না হয়।’ তিনি বলেন, সম্প্রচার আইন দ্রুত পাস করার জন্য কাজ করছেন।

গত বছর ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিসভা সম্প্রচার আইন এবং গণমাধ্যম কর্মী (চাকরি শর্তাবলি) আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। সম্প্রচার আইনে সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। এই আইনের মতো প্রস্তাবিত গণমাধ্যম কর্মী (চাকরি শর্তাবলি) আইনেরও একাধিক ধারা অপব্যবহারের সুযোগ থাকছে।

সাংবাদিকতায় ঝুঁকিপূর্ণ

বিশ্বে সাংবাদিকতায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে পাঁচ বছর আগেই অন্তর্ভুক্ত করেছে সিপিজে। বাংলাদেশ এ তালিকায় উঠেছে সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন, গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ এবং বন্ধ করে দেওয়াসহ বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

আরএসএফের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। গত বছর সংস্থাটির প্রকাশিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম। এর আগের বছর বাংলাদেশ একই অবস্থানে থাকলেও নেতিবাচক সূচকে পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ। চলতি বছরের সূচক এখনো প্রকাশিত হয়নি।

দেশীয় বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে ১২২ জন সাংবাদিক শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা বা হুমকি-হয়রানির শিকার হয়েছেন। নিপীড়কের তালিকায় আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘাতের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সমকালের প্রতিনিধি আবদুল হাকিম।

আর ২০১৮ সালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০৭টি। এর মধ্যে খুন হয়েছেন ৩ জন। ২০১৬ সালে নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১১৭টি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও

স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ফেসবুক এখন জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গত আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের সময় দেশে-বিদেশে সুপরিচিত আলোকচিত্রী শহীদুল আলম গ্রেপ্তার হন আল-জাজিরায় তাঁর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে (আইসিটি) মামলা হয়। এরপর ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা কমে গেছে।

ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মন্তব্য, কটাক্ষ বা ছবি বিকৃত করার অভিযোগে এ পর্যন্ত অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্যদিকে ফেসবুকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ভুয়া বা বিদ্বেষপূর্ণ খবর ছড়ানোর ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ দিয়ে, গত ডিসেম্বরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ভুয়া খবর প্রচারের জন্য বাংলাদেশের নয়টি পেজ ও ছয়টি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলেছে, এগুলোতে ‘বাংলাদেশের সরকারের সমর্থনে বিভিন্ন কনটেন্ট পোস্ট করা হচ্ছিল’ এবং ‘এর সঙ্গে সরকার-সংশ্লিষ্ট কিছু লোকের সম্পর্ক আছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র আমার মনে হয়, এখন সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে।’ তাঁর মতে, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারবিরোধী কিছু লেখা যায় না। এটা কেবল আইনের কারণে নয়; সব দিক থেকেই চাপগুলো আসছে। সরকারপন্থী কিছু ‘যোদ্ধা’ আছেন, যাঁরা সরকারবিরোধী মতপ্রকাশকারীদের চরিত্র হনন করেন, তাঁদের জামায়াত-শিবিরের দোসর বলেন। কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা মিলিয়ে একধরনের কলঙ্ক আরোপের চেষ্টা চলে।

ফোন আলাপেও ভয়

টেলিফোনেও মানুষ এখন মন খুলে কথা বলতে ভয় পান। বিভিন্ন সময়ে অনেক বিরোধী রাজনীতিকের টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়েছে। অনেককে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ফোন আলাপের কারণে জেল খেটেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। কিন্তু কারা এসব টেলিফোন আলাপে আড়ি পাতছেন, তা ফাঁস করছেন, সেটা জানা যায়নি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, ভয়ের সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতির অধ্যাপক আলী রিয়াজের মতে, ভয়ের সংস্কৃতি আতঙ্ক, সন্ত্রাস ও বল প্রয়োগকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে। এটা শাসন পরিচালনার একটি ধরনও বটে। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি প্রবলভাবে বিরাজমান। (ভয়ের সংস্কৃতি, প্রকাশ; ২০১৪)

কমছে ভিন্নমতের প্রকাশনা

ভিন্নমতের বই প্রকাশে এখন নানা বাধা বা চাপ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী অন্যতম। জঙ্গিরা ২০১৩ সাল থেকে তারা একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যা ঘটিয়ে চলেছে। গত বছরও মুন্সিগঞ্জে গুলি করে মারা হয়েছে প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে। জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু ঝুঁকি কাটেনি।

বরং যে ধরনের লেখালেখির জন্য লেখক, প্রকাশকেরা খুনের শিকার হয়েছেন, কয়েক বছর ধরে তেমন লেখা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকারও। লেখক, প্রকাশক আটকের ঘটনাও ঘটেছে। এবারের একুশের বইমেলা শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত করতে পারে—মেলায় প্রকাশকেরা এমন বই আনতে পারবেন না। আনলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলা একাডেমি নতুন বই যাচাই-বাছাই করে মেলায় ঢোকাবে। পুলিশও নজরদারি করবে।

এ ছাড়া ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক অনেক রাজনৈতিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বসহ স্পর্শকাতর আরও কিছু বিষয়ে লেখালেখি বা বই প্রকাশে লেখক ও প্রকাশকদের অনেক ভাবতে হচ্ছে। অনেকে ভয় পান বলেও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

ভয়-চাপের এই নানামাত্রিক বাস্তবতার কথা স্বীকার করা এবং দীর্ঘমেয়াদি এই কুফলের কথা অনুধাবন করাটা হচ্ছে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা এই সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। গত নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বলেছে, ইতিমধ্যে দেশে গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে তথ্যের অবাধ চলাচল অব্যাহত আছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকারসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব বা সংকুচিত করার মতো পরিস্থিতি প্রকট। সার্বিকভাবে এটা দূর করাটা বড় চ্যালেঞ্জ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নানাভাবেই খর্ব হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা তুলে তিনি বলেন, এমন আইনের অপপ্রয়োগ যদি নাও হয়, খড়্গ ঝোলানোর একটা ব্যাপার থাকে। মানুষ নিজেই মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রিত করে ফেলে। ভয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এটা সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিচায়ক না।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

সব আলাপ পরে হবে ভোটকেন্দ্র বাইরে হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির প্রধান সূতিকাগার। গত ১০০ বছরে বাংলাদেশের ( বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল সহ)  রাজনীতির নানা ঘটনা প্রবাহের সূত্রপাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ১ কিলোমিটারের মধ্যে থেকেই। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ শুধু দেশের মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতি নিয়ে যারা  আগ্রহী তাদের মাঝেও  ছড়িয়ে পড়বে তা ধারণা করা যায়।  দীর্ঘ ২৮ বছর যাবৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায়  নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সকল ছাত্রসংগঠনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে খুব স্বাভাবিকভাবেই  বিশেষ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে ডাকসু নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে।  এর মধ্যে প্রধান আলাপ হচ্ছে ১। ভোট কেন্দ্র হলের বাইরে না ভিতরে  ২।  নির্বাচনে ভোটার হওয়ার বয়স ৩০ বছর নির্ধারণ এবং ৩। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাস ও হলে সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি। 

এর বাইরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের আলাদা আলাদা দাবীতো রয়েছেই।  তাই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে  আশাংকা, আতংক ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার পারদও  সমান তালে বেড়ে চলছে।  

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আলোচিত বিভিন্ন দাবীর মধ্যে সবাই মোটামুটি একটি দাবির  বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন, সেটা হচ্ছে ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে হতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে , ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত সকল  ডাকসু নির্বাচনেইতো হল গুলোতে ভোটকেন্দ্র ছিলো।  তাহলে হঠাৎ করে এবারে  হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি কেন?  এ বিষয়ে বেশিরভাগের অভিমত  হচ্ছে, হলে  ভোট দেয়ার ন্যূনতম পরিবেশ নাই। পুরো হল ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রিত হয় সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নির্দেশ বা পরামর্শে। যা গত প্রায় ১২ বছর যাবৎ বিদ্যমান। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলে ভোটকেন্দ্র  যতই নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চয়তা দিন না কেন, এটা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে আর একটি পরিসংখ্যান হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনকারী সংগঠন বা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন। তা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন  সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের যে ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে মোট ভোটার প্রায় ৪৩ হাজার। যার প্রায় ৬৫ শতাংশ হলের বাইরে থাকে। অর্থ্যাৎ প্রায় ২৮ হাজার ভোটার হলের বাইরে থাকেন। তাই এই বিপুল সংখ্যক ভোটার যারা হলেই থাকেন না, তাদের নিরাপত্তা ও অস্বস্তির বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।  তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সত্যিকার অর্থেই দীর্ঘ ২৮ বছর পরে একটি ক্রিয়াশীল ‘ডাকসু’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উপহার দিতে চান, তাহলে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করার দাবীর প্রতি সচেতন হবেন।
  
অন্যথ্যায় ধরে নিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনকেও গত  ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সীমাহীন ভোট জালিয়াতি হয়েছে , যার পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন সিইসি কেএম নুরুল হুদা, যেখানে ১০ কোটি নাগরিকের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে,  যার মাঝে দেড় কোটি ছিলো নতুন ভোটার, যারা জীবনের প্রথম ভোটটি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন,হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের  ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার সেরকমই একটি নিয়ন্ত্রিত ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন চলছে। 

পূণশ্চঃ ডাকসু নির্বাচনে হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি  যে এই প্রথম উত্থাপিত হয়েছে তা নয়।  ১৯৯৪ সালে তফসিল ঘোষণার পরও ডাকুস নির্বাচন করতে পারেনি তৎকালীন প্রশাসন  তার কারণ ছিলো  এই ভোটকেন্দ্র। সে সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা ছাত্রলীগ  ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছিল ।  সে সময় ভোটকেন্দ্র সমস্যা  সুরাহা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হয়নি ডাকসু নির্বাচন।

অথচ  আজ ছাত্রসংগঠন হিসেবে একমাত্র ছাত্রলীগই  ভোটকেন্দ্র হলে রাখার বিষয়ে অনড়, জেদী এবং সরব।


পুনরায় ‘অর্থবহ’ নির্বাচনের দাবি বিশিষ্টজনদের


একাদশ জাতীয় সংসদ গ্রহণযোগ্য হয়নি দাবি করে পুনরায় ‘অর্থবহ’ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বিশিষ্টজনেরা। সোমবার, ১৮ জানুয়ারি, বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত একাদশ জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচন’: পরবর্তী করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারা এ দাবি জানান।

আলোচনা সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শাহদিন মালিক বলেন, ‘এক ব্যক্তি ১৫ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করছেন, এ রকম দেশের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। এই ৫০টি দেশের মধ্যে দু-একটা ধ্বংসের পথে চলে গেছে। এ ধরনের নির্বাচনে দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে দেশের অর্থ বাইরে চলে যাবে, দেশে বিনিয়োগ হবে না। আমরা অর্থনৈতিকভাবে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হচ্ছি। এখন এখান থেকে বের হওয়ার প্রধান উপায় একটা অর্থপূর্ণ নির্বাচন দেওয়া।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশনের ওপর কারও আস্থা নেই এবং তা প্রহসনের কমিশনে পরিণত হয়েছে। এই কমিশনের অধীনে কোনও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না; তারা তা বিগত দুই বছরের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করেছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশে কখনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। কোনও উদাহরণ বাংলাদেশে নেই। কিন্তু সরকারি দলের অধীনে নির্বাচনের একটা ধরণ আমরা দেখি, আবার এর বাইরে বের হয়ে নির্বাচনটাকে গ্রহণযোগ্য করার একটা চেষ্টাও দেখি। ১৯৮৮ সালে ও ১৯৯৬ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছিল, ২০১৪ সালেও একটি নির্বাচন দেখেছি, কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।’

আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘আমি জামিনে আছি, এটা কিন্তু মুক্তি না। কিন্তু তার বাইরে একটা জিনিস রয়েছে। আমি যে দেশে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি না, তাহলে আমি মুক্ত না। আমি না হয় হাজত থেকে বেরিয়েছি কিন্তু এই ঘরে কেউই মুক্ত না। আরেকটি বিষয় হলো, যারা সরকার কিংবা সরকারের পক্ষে কথা বলে, তারা পরিষ্কারভাবে সবকিছু অস্বীকার করে যায়। যার লজ্জা নেই, স্বীকার করার প্রয়োজন মনে করে না, তাকে তো দেখানোর কিছু নেই। আমার মনে হয় আমাদের স্ট্রাটেজিগুলো দাঁড় করাতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘নির্বাচনে এতো বড় একটা অনিয়ম ঘটে গেছে, এটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। আপনারা ভাবতে পারেন যে আপনারা নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু জনগণ জানে কী ঘটেছিল সেই রাতে। কাজেই সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে জনগণের প্রতিনিধিরা এবং সামাজিক চুক্তি বলে যে চুক্তি আছে তার নবায়ন ঘটাতে হবে। সেই সামাজিক চুক্তি চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। নাগরিক হিসেবে আমরা মনে করি, এটা জাতিকে বড় ধরনের বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক আসিফ নজরুল কমিটির নিবন্ধ পাঠ করেন। তিনি বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজরদারি ও পর্যবেক্ষণের অপ্রতুল সুযোগের মধ্যেও এতো কারচুপির যে গুরুতর আলামত রয়েছে এবং নির্বাচনের প্রচারণাকালে নজিরবিহীন যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে অসম্ভব করে তুলেছে। এমতাবস্থায় সংবিধান, গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য দেশে অবিলম্বে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনও বিকল্প নেই। দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।’

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন— কমিটির সদস্য শিরীন হক, মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, জাকির হোসেন প্রমুখ।
  • বাংলা ট্রিবিউন/  ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯ 

Monday, February 18, 2019

ঢাকার বাতাসে বিষ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ



অপরিকল্পিত নগরায়ন, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে রাজধানীর বাতাসে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। জ্বালানির দহন, বনভূমি উজাড় প্রভৃতি কারণে বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। কলকারখানা, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযানের অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়া বাতাসে সবচেয়ে বেশি কার্বন-মনোক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাসের বিস্তার ঘটায়। 

এসব উৎস থেকে সৃষ্ট মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণিদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এসবেস্টস আঁশ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে ধুলাবালি, সিগারেটের ধোঁয়া ও কীটনাশক স্প্রের কণা বাতাসকে দূষিত করে মানবদেহে ক্যান্সারসহ অ্যালার্জিজনিত নানা জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটায়। শুধু ধুলার মতো কঠিন পদার্থ ছাড়াও দূষিত তরল বর্জ্য থেকে বাতাস অধিকতর দূষিত হয়ে থাকে। চামড়া শিল্প, রঙ কারখানা, রাসায়নিক গবেষণাগার, পয়ঃশোধনাগার থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইড জীবজগতের অস্তিত্বের ওপর হুমকিস্বরূপ।

শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, প্লাস্টিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য প্রস্তুত কারখানা থেকে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বেরিয়ে এবং পানিতে মিশ্রিত হয়ে বিষাক্ত নাইট্রিক এসিডে পরিণত হয় ও নিকটবর্তী এলাকার বাতাসকে দূষিত করে। এছাড়া ধাতু গলানো কারখানা, কয়লা-পেট্রোল-কেরোসিনের মতো জ্বালানির সালফার বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে সালফার ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি করে, যা প্রাণঘাতী এসিড বৃষ্টির কারণ। 

সুপার-ফসফেট কারখানা থেকে নির্গত হাইড্রোজেন-ক্লোরাইড বাতাসে মিশে প্রাণিদেহের হাড়ের ক্ষতিসাধন করে। এ ছাড়া ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টগুলো বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বৃষ্টিপাতে বিঘ্ন ঘটায় এবং বাতাসের তাপমাত্রা কমিয়ে উদ্ভিদ জগতের বিকাশে বাধা দেয়, যা মানবদেহে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। 






ঢাকার বাতাসে সিসাজনিত দূষণ জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কমপক্ষে হাজার গুণ হওয়ায় ঢাকায় বসবাসকারী মানুষ শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যার শিকার হয় এই বায়ুদূষণে। 

ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে, যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী ৬ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বাধা, স্নায়বিক ক্ষতি এবং গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। 

ঢাকার অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, পারিপার্শ্বিক বায়ুদূষণের কারণে বছরে মারা যায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষ এবং আবাসিক দূষণের কারণে বছরে সাড়ে চার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ঢাকার বাতাসে সিসাজনিত দূষণ জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কমপক্ষে হাজার গুণ বেশি। রাজধানী শহর আজ যেন একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে।

বাতাসকে দূষণমুক্ত রেখে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য জরুরি নির্মাণাধীন নতুন ভবন ও রাস্তাঘাট থেকে উৎপন্ন ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করা। শিল্প কারখানাকে শহর থেকে দূরে স্থাপন, কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণসহ শিল্পবর্জ্যের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। 

ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাসহ সিসামুক্ত জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। ইটভাটা স্থাপন ও ভাটায় চিমনি ব্যবহারের মাধ্যমে কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে যথাযথ নিয়ম মেনে চলার নিশ্চয়তা বিধান অত্যাবশ্যক। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ডাস্টবিন স্থাপন বন্ধ করতে হবে। 

নদীর পানি দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে ওয়াসার স্যুয়ারেজ নিগর্মনসহ নদ-নদীর পানিতে সব রকমের কঠিন, গৃহস্থালি, শিল্প ও স্যানিটারি বর্জ্যের মিশ্রণ রোধ করতে হবে। মাটিকে রাখতে হবে দূষণমুক্ত। নদীর পাড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণ ও মেরামতকালে নদীর পানিতে তেলাক্ত বর্জ্যের মিশ্রণ প্রতিহত করতে পারলে নদী থেকে বায়ুদূষণ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। 

কৃষিক্ষেতে ব্যবহূত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে এসে মিশতে না পারে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কেমিক্যাল ও ট্যানারির মতো যে কোনো শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য অপসারণের আগে পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা ছাড়া পানি দূষণজনিত বায়ুদূষণ রোধ অসম্ভব। 
  • কার্টসিঃ সমকাল /ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৯।