সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
সাধারণ মানুষের মুখে মুখে যেসব কথা প্রচলিত থাকে, তা-ই জনশ্রুতি। তবে সব জনশ্রুতিই সত্য হয় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে গুজবও জনশ্রুতি পায়। অনেক ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় জনশ্রুতি বা গুজবের। জনশ্রুতিতে যে বাস্তবতা থাকে না তা নয়, বরং যে সত্য জনশ্রুতি পায় তা অনেকটা অপ্রতিরোধ্য। অসত্য জনশ্রুতি বা গুজব কখনো স্থায়িত্ব পায় না। কিন্তু তার সাময়িক প্রভাব ভোগায় মানুষকে। এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু যখন সত্য প্রকাশিত হয়, তখন তা শুধরে নেয়ার মতো সময় থাকে না। বরং সংশ্লিষ্টদের এর পরিণাম ভোগ করতে হয়।
ইদানীং দেশে গুজব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কান দেয়ার বিষয়ে প্রাজ্ঞজনেরা নিষেধ করলেও গুজবকে আমলি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করা হয়েছে সম্প্রতি। গুজব সৃষ্টিকারীদের দণ্ডবিধির আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহণ, মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ডের ঘটনাও ঘটেছে। গুজব নামের উৎপাত সৃষ্টির জন্য আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বলা যায়, গুজব সৃষ্টিকারীরা এখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিরোধের সম্মুখীন। কিন্তু বিপত্তিটা সৃষ্টি হয়েছে গুজবের সংজ্ঞা নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে মহল বিশেষ সুবিধাজনক ব্যাখ্যা, আইন ও দণ্ডবিধির অপপ্রয়োগ করছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। কথিত গুজব আসলে গুজব না বাস্তবতা এটা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক।
জনশ্রুতি বা গুজব অতীতে ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে এর গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে। জানা যায়, ১৭৫০ সালে প্যারিসের রাজপথ থেকে শিশুদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, রাজা লুই (পঞ্চদশ) কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই রাজার রোগ মুক্তির জন্য শিশুদের অপহরণ করা হচ্ছে। জনশ্রুতি ছিল, শিশুদের রক্তে গোসল করাই হচ্ছে কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তির অদ্বিতীয় উপায়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ছিল ভিন্ন। রাস্তায় অনাথ শিশুদের পাওয়া গেলে তাদের রাজকীয় ব্যবস্থায় সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন রাজা। এই মহতী কাজকেও গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে বিতর্কিত করা হয়েছিল।
তবে রাজার বিরুদ্ধে এমন গুজব ছড়ানোর পরও গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কারণ, গুজব সৃষ্টি নিন্দনীয় হলেও কোনো কালেই এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। তবে আমাদের দেশে গুজবকে শুধু শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে না, বরং ‘সত্য ঘটনাকে গুজব’ তকমা লাগিয়ে প্রতিপক্ষদের হেনস্তার অভিযোগও বেশ জোরালো।
সম্প্রতি আমাদের দেশে বহুল আলোচিত-সমালোচিত একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বিরোধী দলগুলো অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এতে অংশগ্রহণ করায় নির্বাচন অর্থবহ হওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্নাতীত হয়নি, বরং বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি আগের রাতে সরকারদলীয় প্রার্থীর অনুকূলে ব্যালট বাক্স ভর্তির অভিযোগও পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগে বিরোধী দলগুলো এক হলেও ক্ষমতাসীনেরা তা অস্বীকার করছেন এবং এসব অভিযোগকে ‘গুজব’ বলেই নিজেদের দায়মুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন।
নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে সরকারের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীনেরাও অন্যদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তাই নির্বাচন নামের প্রতিযোগিতার ফলাফল ভালো করার জন্য সবাই সব চেষ্টাই করাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনিয়মগুলোর দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দায়িত্ব শুধুই সরকারের হতো, তাহলে নির্বাচনের কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হতো না। তাই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি’ মার্কা নির্বাচন কমিশনকে দায়মুক্তি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সংবিধানে নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাদের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কমিশন সে ক্ষমতা প্রয়োগের মতো সাহস ও যোগ্যতা দেখাতে পারেনি।
প্রতিষ্ঠানটি অতীত বৃত্তেই আটকা পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে যে নির্বাচনকে ‘নির্বাচন’ বলেই স্বীকৃতি দেয়া হয়নি, বর্তমান কমিশন সেটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে দাবি করে আসছে। দেশে যে প্রকৃত গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূলবোধ্যের চর্চা হচ্ছে না, তা এখন তেমন বিতর্কিত বিষয় নয়। এবারের নির্বাচনে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতাহীনতা, দুর্বলতা, নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বহীনতা ও দলীয় মনোবৃত্তি পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অভিযোগ আন্তর্জাতিক বলয়েও স্থান করে নিয়েছে। অভিযোগ আছে, বিগত রকীব কমিশনই আমাদের দেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মূল্যবোধকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে।
এরপর হুদা কমিশন গঠিত হলে মনে করা হয়েছিল, হয়তো মন্দের ভালো কিছু একটা হবে। কিন্তু সে আশায়ও গুড়ে বালি পড়তে সময় লাগেনি। হুদা কমিশন তাদের পূর্বসূরিদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে বেশ করিৎকর্মা বলেই মনে হয়েছে।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন করার পর কমিশন যেভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিল, এবার সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো মহলেই গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও কমিশন সে নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য বলেই দাবি করছে। তবে এর বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধা, অব্যাহত সন্ত্রাস ও ভোট কারচুপির সুষ্ঠু তদন্ত এবং এর সুরাহার তাগাদা দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় মার্কিন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি। প্রভাবশালী গণমাধ্যম রয়টার্স তাদের এক প্রতিবেদনে ৩০ জানুয়ারির নির্বাচনে কারচুপি ও সংহিসতার তথ্য তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে কোনো সঠিক নির্বাচন হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ইতিবাচক দিক বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর সংলাপে বসার গুরুত্বের কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। গুতেরেস বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন সঠিক হয়নি, এ বিষয়টা এখন স্পষ্ট’। এটা নির্বাচন কমিশনের দাবিকে অসার ও হাস্যকর প্রমাণ করেছে।
সংসদ নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকা সিটি উত্তরের উপ-নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ডামাডোল শুরু হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগে এবং নির্বাচন কমিশনের উপর্যুপরি ব্যর্থতায় বিরোধী দলগুলো এসব নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বর্জনের কারণ অনুসন্ধান এবং তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সিটি করপোরেশন ও উপজেলা নির্বাচন এবারো একতরফা হতে যাচ্ছে। এটা একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য মোটেই গ্রহণীয় নয়।
সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একটি বক্তব্য নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও অবাধ ও নিরপেক্ষ করা হবে। যে নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো মহলই গ্রহণযোগ্য মনে করছে না, সে নির্বাচনী মানদণ্ডে আবার নির্বাচন করার ঘোষণা কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে জনমনে নেতিবাচক ধারণা আরো জোরালো করে দিচ্ছে।
কমিশন সম্পর্কে শ্লেষাত্মক মন্তব্য এখন সবার মুখে মুখে। শুরুর দিকে নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে একতরফা সরকারকে দায়ী করা হলেও এখন অভিযোগের তীরটা নির্বাচন কমিশনের দিকে। কেউ কেউ বর্তমান কমিশনকে ‘প্রসহন কমিশন’ আখ্যা দিতে শুরু করেছেন। তাদের এ দাবি আরো জোরালো ভিত্তি পাচ্ছে সিইসির বক্তব্যে। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন রেকর্ডে রাখার মতো সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে হয়েছে। এটা আমি দাবি করতে পারি প্রকাশ্যে’।
নির্বাচন নিয়ে জনমত নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল যে, নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। পক্ষান্তরে কমিশন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের দাবি এবং জনমতের ৯৮ শতাংশকেই গুজব হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। তাই নির্বাচনে অনিয়মবিষয়ক অভিযোগগুলো গুজব, না নির্বাচন কমিশনের দাবিই গুজব, তা এখন বিচার্য। ইতিহাসের মূল্যায়ন বড়ই নির্মম!
- নয়াদিগন্ত / ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯।