Search

Wednesday, February 27, 2019

যে বাড়িতে কেউ হাসে না


আলতাফ পারভেজ



মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন ২০১৮-এ ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে ৭৩২টি। ‘অধিকার’-এর নথিতে পাওয়া গেল ৬৩৫টির কথা। এগুলোর কতটিতে মামলা হয়েছে এবং কতটির অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, সে তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ঘটনাটিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি, হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটেছিল নোয়াখালীর সুবর্ণচরে। ধর্ষণের শিকার চার সন্তানের একজন মা। গত ৩০ ডিসেম্বরের ওই ঘটনা দেশবাসীকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। তাই মানুষ এর বিচারের অপেক্ষায় আছে।

দেশ-বিদেশে নোয়াখালীর সবচেয়ে পরিচিত জনপদ চৌমুহনী। সেখান থেকে সুবর্ণচরের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। সেখানে জুবলি ইউনিয়নের সিরাজ ড্রাইভারের বাড়িতে গেলে প্রথমেই নজরে আসে, কেউ যেন চিরতরে হাসি কেড়ে নিয়েছে বাড়ির মানুষদের। বাইরে থেকে কোনো আগন্তুকের আসা মানে এই বাড়ির গভীর ক্ষতে যন্ত্রণার বাড়তি আলোড়ন।

বাংলাদেশে ধর্ষণের আধিক্য গা-সওয়া হয়ে গেছে। এটা সমাজের গভীর এক নির্মমতার দিক। তবে সমাজের আরেক নির্মমতা টের পাওয়া যায় ধর্ষণের শিকার মানুষটির বেঁচে থাকার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে। জুবলি ইউনিয়নের মধ্য বাগ্‌গায় রাতারাতি আলোচিত হয়ে পড়া পরিবারটি এখন সেই অসহ্য অবস্থায় বেঁচে আছে।

শিশু-কিশোর বয়সী চার সন্তান রয়েছে এই পরিবারে। সবচেয়ে ছোট দুজনের বয়স ১৩ ও ১০। চারজনই মায়ের বিষণ্নতায় প্রায় নির্বাক। বাড়ির বাইরে বের হলেই নানা রকম ফিসফাস আর মন্তব্যে ওরা টের পাচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজের জান্তব রূপ। আছে মামলা সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন হুমকিও। কিছু করার নেই ওদের, বাড়িতে এসে মন খারাপ করে বসে থাকা ছাড়া। ঢাকা থেকে সিরাজ ড্রাইভারের বাড়ি অনেক অনেক দূর। না হলে এই পরিবারের ক্ষোভ আর হতাশার আগুনে বহু আগেই উদাসীন রাজধানী পুড়ে যেত। পরিবারের বড় ছেলেটির একটা চাকরির সন্ধান মিললেও মাকে রেখে সে এখন যেতে চাইছে না। অন্যরাও ১৮ বছর বয়সী বড় ভাইটিকে ছাড়তে চাইছে না আর।
চর জব্বার থানায় এই ঘটনায় যে মামলা হয়েছে (নম্বর ১২; ৩১-১২-১৮; জিআর ২৬৪৫/১৮) তার চার্জশিট না হওয়ায় শুনানিও শুরু হয়নি। অভিযোগের শুনানি, অভিযোগপত্র গঠন, রাষ্ট্রপক্ষের শুনানির পর শুরু হবে ‘আসল অধ্যায়’ আসামিপক্ষের জেরা। সেসব পর্যায়ে গৃহবধূ ও তাঁর স্বামীকে আরেক দফা মানসিক হেনস্তার মুখে পড়তে হবে বলেই শঙ্কা চলছে। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কল্যাণে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যেন লক্ষ্যই থাকে ভিকটিমকে ‘দুশ্চরিত্রা’ প্রমাণ করা। ৩০ ডিসেম্বর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এই নারীকেও অন্য সব ধর্ষিতার মতোই অপ্রীতিকর সেসব জেরার মধ্য দিয়েই যেতে হবে। বহু আরজি সত্ত্বেও ১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের এই ধারার সংশোধন হয়নি আজও স্বাধীন বাংলাদেশে।

এ রকম প্রায় অনিবার্য মানসিক অত্যাচার পেরোতে গিয়েই নিপীড়িত পরিবারগুলো আইনি যুদ্ধের মনোবল হারিয়ে ফেলে। তারপর যদিও-বা আসামিদের সাজা হয়, ৩৫ বছর বয়সী এই নারী কি পুরোনো স্বস্তির জীবন ফিরে পাবেন? উপরন্তু রয়েছে হাইকোর্ট পর্যায়। এখনই তিনি নির্যাতন ও সামাজিক চাপে গভীর স্নায়ুরোগে ভুগছেন। স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে। ব্যাপক কাউন্সেলিং দরকার তাঁর। বাড়ি থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের নোয়াখালী সদর হাসপাতালে যেতে যেতে ইতিমধ্যে তিনি ক্লান্ত। ১৭ দিন পর যখন তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখনো পুরো সুস্থ ছিলেন না।

লাঞ্ছনার ক্ষতিপূরণ একখণ্ড জমি

বিশ্বব্যাপী নারী অধিকারকর্মীরা প্রায়ই বলেন, ‘ধর্ষণ হলো যুদ্ধাস্ত্র’, যা রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংঘাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুবর্ণচরের ঘটনার ৮৫ দিন আগে ২০১৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ধর্ষণ-যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা ইরাকের নাদিয়া মুরাদ এবং কঙ্গোর ডেনিস মুকওয়েজকে। ৮ অক্টোবর ওই পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশেও নাদিয়া ও ডেনিসকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভাষায় অনেক প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, এই রকম প্রচারণা স্থানীয় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনমতের লক্ষণ। কিন্তু কার্যত তা নয়।

নাদিয়া মুরাদের মতোই সুবর্ণচরের মধ্য বাগ্‌গার ওই নারীও রাজনৈতিক সংঘাতের অংশ হিসেবেই যৌন সহিংসতার শিকার। সে কাহিনি ইতিমধ্যে দেশবাসীর জানা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে ওই মুহূর্তের ভোটযুদ্ধের নিরীহ এক বলি। তবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য সুবর্ণচর এখন অনেক দূরের জনপদ। হয়তো রাজনৈতিকভাবেও এই মোকদ্দমা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জন্য অস্বস্তিকর। ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় কিছু ‘রিপোর্ট’ হলেও পরিবারটির চলমান বিষণ্নতার প্রতি ইতিমধ্যে মনোযোগ হারিয়ে গেছে অনেকের।

হাসপাতালে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণস্বরূপ রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে এক একর খাসজমি দিতে চাওয়া হয়েছে। হয়তো এতে শুভ ইচ্ছাই কাজ করেছে। 

তবে কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ নিগ্রহের পুনর্বাসন উপায় হিসেবে এক একর জমি সাব্যস্ত করতে পারলেন, সেটা গভীর বিস্ময় হয়েই থাকছে।

দলবদ্ধ ধর্ষণের ব্যাপকতা

ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দ্বারা যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে নোবেল পাওয়া ইরাকের নাদিয়া মুরাদের সংগ্রাম বিশ্বজুড়ে নারী অধিকারকর্মীদের কাছে সাহসের প্রতীক। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাংলাদেশে নারী আন্দোলনকর্মীদের সুবর্ণচরের এই জননীকে সামনে রেখে ধর্ষণ-যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত করতে দেখা যায়নি। মধ্য বাগ্‌গায় জানা গেল, কেবল ‘নিজেরা করি’ নামের একটি সংগঠন থেকে নেতারা দেখতে গিয়েছিলেন ভিকটিমকে। পাংখা বাজারে সমাবেশও করেছেন তাঁরা। সেই সমাবেশে ধর্ষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিকটাত্মীয়রাও ঘটনার বিচার চেয়েছেন। এই সমাবেশকালেই জানা গেল, পারুলের ধর্ষণকারীদের এটাই এ রকম প্রথম অপরাধ নয়। ক্ষমতার দাপটেই তারা অপরাধ করে বেড়াতে পারছিল এবং অনেক ভিকটিম অভয় পেলে মুখ খুলতে চান এখন।

তবে ৩০ ডিসেম্বরের এই গণধর্ষণের পরও আশপাশের আরও তিনটি দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়ে গেছে। ধর্ষিতাদের মধ্যে আছেন তিন সন্তানের জননী থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশু। অত্র অঞ্চলে ক্ষমতাবানদের ধর্ষণ-প্রবণতার লাগাম যে টেনে ধরা যায়নি তা স্পষ্ট।
শুধু আইনের শাসন ধর্ষণ রুখতে পারে না

বহু বছর শুধু কঠোর আইনকে ধর্ষণের প্রতিকার ভাবা হয়েছে। এ–ও বলা হয়েছে, আইনের শাসন এ সংকটের সমাধান দেবে। কিন্তু ধর্ষণসহ নানা সামাজিক অপরাধের সঙ্গে রাজনীতি ও ক্ষমতার যোগ ছিন্ন না হলে শুধু আইনি পথে যে এসবের ব্যাপকতা থামানো যাবে না, নোয়াখালীর ধর্ষণ-আতঙ্কিত সমাজ তার সাক্ষী। সুবর্ণচরের ধর্ষণ মামলায় একজন আসামির নাম ‘কুড়াইল্যা’ বাসু। এই তথ্যটিই হয়তো এই ধর্ষণের সঙ্গে ক্ষমতা সম্পর্কের প্রবল ইঙ্গিত দেয়।  একে শুধু বিচার দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না।

এখন সামগ্রিক বিচারহীনতার সংস্কৃতিই ধর্ষকদের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠাকে উৎসাহিত করছে। যদিও টক শোগুলোতে একে স্রেফ ‘নৈতিক অবক্ষয়’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও জারি আছে। সুবর্ণচরের ওই নারীর সৌভাগ্য যে মেডিকেল রিপোর্ট তাঁর অভিযোগ সমর্থন করেছে।

স্থানীয় আইনজীবী রবিউল হাসান পলাশের কাছে জানা গেল, নয়জন আসামির দুজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু আশপাশের পরের 

দলবদ্ধ ধর্ষণগুলোর ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। এর কারণ স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয়ের সঙ্গে ক্ষমতার যোগাযোগ। তারপরও বাংলাদেশের প্রচার সাম্রাজ্যের মুরব্বিরা ধর্ষণকে ক্ষমতার বিকার আকারে দেখতে অনিচ্ছুক। ফলে আরও বহুকাল ধর্ষণের আলামত শুধু কাপড়চোপড় ও হাসপাতালেই খোঁজা হবে।

  • আলতাফ পারভেজ : গবেষক


কার্টসি — প্রথম আলো/ বুধবার, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৯। 
লিঙ্ক —  https://bit.ly/2EA2y3g 

No comments:

Post a Comment