গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ টাকা লোপাট হয়েছে তা প্রায় দেশের দুটি বাজেটের সমান। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টগ্রিটি (জিএফআই), বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। গত ১০ বছরে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অন্যান্য মিলে খেলাপি ঋণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। আর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গত ১০ বছরে জালিয়াতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃত হিসাবে এটি আরো বেশি। সবমিলিয়ে প্রায় বাংলাদেশের দুটি বাজেটের মতো টাকা উধাও হয়েছে। বাংলাদেশের চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট যার পরিমাণ ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
এদিকে গত বছরের জুনে প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) পানামা এবং প্যারাডাইস পেপার্সে এ পর্যন্ত অর্থ পাচারকারী হিসেবে ৮২ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন।
এদিকে আদালতও গত ২০ বছরের ব্যাংকের ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে তা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে বগত বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে কী পরিমাণ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা নির্ণয়ে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠনের জন্য কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন।
আদালত যে নিদের্শনা দিয়েছে তা আগে থেকেই সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতকেই দায়িত্ব নিতে হলো। আর এটি আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ক্যানসারের মতো, একবার দেখা দিলে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা অর্থনীতিতে।
প্রতি বছর দেশ থেকে টাকা পাচার হলেও টাকা উদ্ধারের তেমন কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। কারা টাকা পাচার করছেন, কেন করছেন, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করার কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ায় দেশ বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে আরো ৫৯০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত ১১ বছরে মোট পাচার হয়েছে ৮ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে এর মূল্যমান ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৬ সালে পাচার দেখিয়েছিল, গত ১০ বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছিল।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, অর্থ পাচার নিয়ে জিএফআই ও সুইস ব্যাংকের তথ্যে পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থ পাচার নিয়ে সুইস ব্যাংক যে তথ্য প্রকাশ করে, তার ৯২ শতাংশ বৈধ পথে যাওয়া অর্থ। আর জিএফআইয়ের অর্থ পাচারসংক্রান্ত তথ্যের পদ্ধতিগত ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। জিএফআইয়ের তথ্যের বড় অংশই ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
এদিকে ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে। বর্তমানে দেশে ৫৯টি ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ৪১টি বেসরকারি খাতের ও ৯টি বিদেশি ব্যাংক। রাষ্ট্র খাতের ব্যাংক ৯টি।
ব্যাংক খাত সূত্রগুলো বলছে, গত ১০ বছরে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এ ছাড়া বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি, জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সবার আগে ব্যাংক খাত ঠিক করতে হবে। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে সবার মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা দোষী, তাদের দ্রুত দৃশ্যমান বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, গত ১০ বছরে সরকারের বড় ব্যর্থতা ব্যাংক খাতের অরাজকতা। এসব দূর করতে তেমন জোরালো উদ্যোগ ছিল না। এ জন্য ঘটনা থেমে থাকেনি।
অন্যদিকে নিয়ম না মেনে ঋণ বিতরণ, বেনামি ঋণ, সুশাসনের অভাব, এসবই ব্যাংক খাতের সামগ্রিক চিত্র। এর ফলে গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে জালিয়াতি হয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ। গত ১০ বছরে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে, বেসিক ব্যাংক থেকে চলে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা, নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে আরো ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, ব্যাংক খাতে অনেক ধরনের সমস্যা চলছে। সুদের হার ও খেলাপি ঋণ অনেক বেশি, মূলধনে ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকের সংখ্যাও বেশি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণেও দুর্বলতা রয়েছে। বড় যে সমস্যা পুরো খাতে সংকট বাড়াচ্ছে, তাহলো খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ একটা ক্যানসারের মতো। এটা যেন না ছড়ায়, তার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
- কার্টসিঃ মানবজমিন/ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
No comments:
Post a Comment