Search

Wednesday, February 13, 2019

বেগম খালেদা জিয়া কেন মুক্ত হতে পারছেন না


 
 ড. মাহবুব উল্লাহ্
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃসঙ্গ কারাবরণের ১ বছর কেটে গেল। ইংরেজি ভাষায় যাকে বলা হয় Solitary confinement, সেভাবেই কারারুদ্ধ আছেন তিনি। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পাশে অবস্থিত পরিত্যক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে বন্দি রাখা হয়েছে।

কারাজীবনে তার একমাত্র সঙ্গী গৃহকর্মী ফাতেমা। বার্ধক্যে একটু সেবা-যত্ন করার জন্য ফাতেমার সাহায্য না পেলে তার কারাবাস হতো অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণায় জর্জরিত। তিনি খুবই অসুস্থ।

তিনি একজন নারী বটে, পুরুষ হলেও এ ধরনের কারাবাস সাধারণ কারাবাসের চেয়ে হাজারগুণ বেশি কষ্টের। তিনি অনেক রোগে আক্রান্ত, বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিসের রোগী।

এজন্য তার হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ সত্ত্বেও রোগ যন্ত্রণা একটুও কমেনি। এছাড়াও রয়েছে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের উপসর্গ। দিন দিন তিনি ক্ষীণকায় হয়ে পড়ছেন। তার বর্তমান ছবি দেখে বোঝা যায় না, এই মানুষটি একদিন এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে মাইলের পর মাইল জনতার মিছিল নিয়ে হেঁটেছেন।

স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার এই অক্লান্ত সংগ্রাম জনতার কাছে তার পরিচিতি দিয়েছে আপসহীন নেত্রীর। তিনি যখন রাজনীতিতে নামার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তার বছর দুই আগে যৌবনেই তিনি হারিয়েছেন স্বামীকে অত্যন্ত হৃদয়বিদারকভাবে।

কোথা থেকে তিনি এত সাহস পেলেন, ভাবতেও বিস্মিত হতে হয়। বয়স বাড়লেও রাজনীতির চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে তিনি সাহস হারাননি।

শোনা যায়, কারাগারে তাকে নানা ধরনের আপস প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা-মোকদ্দমা থাকবে না, এমনটাই ধারণা দেয়া হয়েছে। অবশ্য আমার পক্ষে হলফ করে বলা সম্ভব নয় এসব শোনা কথার সত্যতা কতটুকু।

খালেদা জিয়া রাজবন্দি কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তার বিরুদ্ধে যে ৩০-৩৫টি মামলা চলছে, তার সবই ফৌজদারি মামলা। ফৌজদারি মামলার আসামি রাজবন্দি হতে পারে না, এমনটাই বলছেন শাসক দলের নেতারা।

এই শাসক দল একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আছে। তাদের বক্তব্যের যথার্থতা বিশ্লেষণ না করেও আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বা Criminal offence-এ মামলা হলেও তার চরিত্রটি মূলত হয় রাজনৈতিক।


খালেদা জিয়া যদি একজন অত্যন্ত শক্তিশালী ও জনপ্রিয় নেত্রী না হতেন এবং অতীতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে না থাকতেন, তাহলে তাকে এই বৃদ্ধ বয়সে কারাবাস করতে হতো না। পাকিস্তান আমলে রাজনীতিকদের এভাবে হয়রানি করার ঘটনা সংখ্যায় অনেক কম হলেও খুব অনুল্লেখ্য ছিল না। আমাদের রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা হয়েছিল।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত এসব মামলা আদালতের বিচারে টেকেনি। মরহুম আবুল মনসুর আহমেদ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। তবে পাকিস্তান আমলে কারাবাসের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হতে হয়েছে বামপন্থী কমিউনিস্টদের। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও তাদের বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক থাকতে হতো।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আটক রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইন, প্রাদেশিক নিরাপত্তা আইন ও ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে বিনা বিচারে আটক শত শত রাজবন্দি মুক্তি লাভ করেছিলেন।

তাদের মধ্যে সর্বাধিক সময় জেল খেটেছেন বামপন্থী নেতা আশু ভরদ্বাজ। সেই যে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর তাকে বন্দি করা হল, তারপর ১০ বছরেরও বেশি কারা জীবনযাপনের পর তিনি মুক্তি পেলেন ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে। ১৯৬৯-এর ১১ দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল রাজবন্দিদের মুক্তি।

আন্দোলনের তীব্রতা, ব্যাপকতা এবং প্রচণ্ডতা এতই বাঁধভাঙা ছিল যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক শেখ মুজিবসহ অন্যদের মামলা চলা অবস্থাতেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিঃশর্তভাবে এদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন। অথচ এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ সিভিল না ক্রিমিনাল তা বলতে পারব না। কারণ আমি আইনজ্ঞ নই।

তবে এদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলো আমার কাছে ক্রিমিনাল বলেই মনে হয়। আইয়ুব খান কেন তাদের মুক্তি দিলেন, তা-ও একটি বিচার্য বিষয়।

আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য শক্তির কাছে আইয়ুব খানের এভাবে নতিস্বীকার শুধু একভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় এবং সেটি হলো ডকট্রিন অব নেসেসিটি। রাষ্ট্র রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আইনকেও উপেক্ষা করা যায়।
আপাতদৃষ্টিতে ডকট্রিন অব নেসেসিটির প্রয়োগ প্রচলিত আইনে গণ্ডির মধ্যে না থাকলেও এটা আইনি ব্যাখ্যা থেকেই উদ্ভূত।

খালেদা জিয়ার কারাবাসের এক বছর পেরিয়ে গেলেও আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তার মুক্তি সম্ভব এমনটি একজন রাখাল বালকও মনে করে না। আমাদের মতো দেশে প্রবাদতুল্য একটি কথা প্রচলিত আছে। তা হল, ক্ষমতার সিংহাসন থেকে কারাগার বেশি দূরে নয়।

এরকম অভিজ্ঞতা ১৯৪৭-এর পর অনেক রাজনীতিকেরই হয়েছে। খালেদা জিয়া তার ব্যতিক্রম নন। এর আগেও সেনাসমর্থিত অসাংবিধানিক সরকারের আমলেও তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। তবে এখনকার তুলনায় বেশ কিছুটা সুখকর অবস্থায় সেই সময়েও তার কাছে আপস প্রস্তাব এসেছিল।

কিন্তু জেদি খালেদা জিয়া সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সরকারের পক্ষে শেষ পর্যন্ত দুই নেত্রীকে মুক্তি দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। একটি নির্বাচন করে তারা ক্ষমতা ছাড়লেন।

তবে এ যাত্রায় সংসদে বিএনপির অবস্থান খুবই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। খালেদা জিয়া যদি আপস করতেন, তাহলে তার এই দুর্গতি হতো না। এখন শাসক দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘পারলে খালেদা জিয়াকে আন্দোলন করে মুক্ত করে নেন।’

এ রকম দম্ভোক্তি যারা করছেন তারা কি জানেন, এর পরিণতি কী হবে? অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আন্দোলনের মাধ্যমে যদি খালেদা জিয়া মুক্তি লাভ করেন তাহলে শাসক দলকেও ক্ষমতা হারাতে হবে, অথবা হারাতে হতে পারে।

খালেদা জিয়ার মতো একজন জনপ্রিয় নেত্রীকে কারারুদ্ধ করা যাবে কিংবা দণ্ডিত করা যাবে, এমনটি হয়তো কেউ ভাবেননি। না শাসক দল, না তাদের বিরোধী দল। কিন্তু বাস্তবে সবই হয়েছে। শাসক দল নিরুপদ্রবভাবে ক্ষমতায় আসীন আছে। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হয়, তাদেরকে আর নড়ানো যাবে না। গণআন্দোলনেরও কোনো সম্ভাবনা দিগন্ত রেখায় দৃশ্যমান নয়। কারণ একটিই।

যে বাংলাদেশ কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘করো কাছে মাথা নোয়াবার নয়’, সেই বাংলাদেশে প্রচণ্ড এক ভয়ের সংস্কৃতি ভর করেছে। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অসন্তুষ্ট মানুষকে ভয়ে গুটিশুটি করে ফেলেছে।

এত ভয় এদেশে আজ, যার ফলে গুটি খুলে প্রজাপতিও পাখা মেলে না। আকাশের ঘনমেঘ বারি বর্ষণ করে না। এসবের অনেক নজির আছে। রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান যাচ্ছিলেন বিমানবন্দরের দিকে তার বিদেশ থেকে আগত কন্যাকে ঘরে নিয়ে আসতে।

কিন্তু তার কপালে সেই সুযোগ ঘটেনি। পথিমধ্যে তাকে তুলে নেয়া হয়। তারপর থেকে তার আর কোনো হদিস মেলেনি।

এ ঘটনা সংবাদপত্রে এসেছে। দেশবাসীও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছে। এদেশের খুব কম লোকই জানত মারুফ জামান নামে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি কোনো মানুষই জানত না রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব ছিল। হতে পারে কূটনৈতিক মহলের লোকরা তাকে চিনত। আজ অবধি তার কোনো হদিস নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো রা’ করা হয়নি।
একজন রাষ্ট্রদূতের যদি এমন পরিণতি হতে পারে, তাহলে আমাদের মতো আমজনতার পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে, তা ভাবাই মুশকিল। শাসক দলের লোকজন বলবেন, এসব কথা তো আমার মতো একজন সামান্য ব্যক্তি খবরের কাগজের পাতায় প্রকাশ করতে পারছি, তাহলে এদেশে গণতন্ত্র নেই- এমন কথা কীভাবে বলা যায়? রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানের উদাহরণ এখানে দেয়া হয়েছে।


কিন্তু এছাড়াও একই ধরনের আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বছরের একটি দিনে প্রেস ক্লাবে সমবেত হয়ে এভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষের পিতামাতা, সন্তান ও স্ত্রীরা করুণ নয়নপাত করেন। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটি আর ফিরে আসে না।

প্রতীক্ষার অবসান হয় না। জানা যায় না ওরা বেঁচে আছেন কি না, কিংবা কেমন অবস্থায় আছেন। হ্যাঁ, সংবাদপত্রে বা গণমাধ্যমে এসব কথা কিছু করে হলেও প্রকাশ করা যায় বলে দেশটি গণতন্ত্রের লেশমাত্রহীন হয়ে পড়েছে- এমন কথা বলা যায় না। দ্য ইকোনমিস্টের ভাষায় এটা হল, হাইব্রিড গণতন্ত্র। সভা-সমিতি করা বা সমাবেশ করা সবকিছুই এখন পুলিশের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।

ভয়ের আবহ যখন ঘন কুয়াশার মতো দেশকে ছেয়ে ফেলে, তখন গণআন্দোলনই বা হবে কীভাবে? তারপরও আশা রাখি কুয়াশার চাদর ভেদ করে আলোর পথযাত্রীরা মশাল হাতে নিয়ে কোনো এক অজানা দিনে রাজপথে বেরিয়ে পড়বে। সে রকম মুহূর্ত এলে খালেদা জিয়া কেন, অন্যসব রাজবন্দিও মামলার জাল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসবেন। এদেশে মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়।

সেই তুলনায় গণবিরোধী সরকারের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। আমার আরও আশা থাকবে যদি কোনো অলৌকিক কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি হয়, তাহলে মুক্ত বাতাসে আমাদের নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ যেন অবারিত এবং অসীম হয়। কেউ যেন কোনো প্রতিশোধের স্পৃহায় আক্রান্ত না হয়। অন্যথায়, মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়াটাও ভারি হয় যাবে।

  • ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
  • যুগান্তর/ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯। 


No comments:

Post a Comment