Search

Monday, December 30, 2019

একাদশ সংসদ নির্বাচন — ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তীব্র সমালোচনা

জমির হোসেন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নামে পাতানো নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, বিরোধী প্রার্থীর উপর হামলা, কর্মী সমর্থকদের উপর হামলা, ভোটের আগের দিন ও ভোটের দিন ২১ জন হত্যার প্রতিবাদে মানবাধিকার সংগঠন ভয়েস ফর বাংলাদেশ এর উদ্যোগে ৫ ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ হাউস অব লর্ডসে এক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

হাউস অব লর্ডের প্রভাবশালী লর্ড সদস্য এ্যান্ড্রু স্টানেলের সভাপতিত্বে ভয়েস ফর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আতাউল্যাহ ফারুকের পরিচালনায় আলোচনা করে ব্রিটিশ এমপি, হাউজ অব লর্ডস সদস্য, ইউরোপিয়ান কমিশন প্রতিনিধি, অ্যামোনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক আইনজীবী সহ অনেকেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

বক্তারা একাদশ সংসদ নির্বাচন একতরফা হয়েছে বলে এর তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করেন। তারা বলেন বিবিসি, সিএনএন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে নির্বাচন কারচুপি স্পষ্টতা ফুটে উঠেছে। বিবিসির রিপোর্টে দেখা যায় আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। একটা দেশের জাতীয় নির্বাচনে এটা হতে পারে না। এসব কারচুপি আন্তর্জাতিক মহল অবশ্যই অবলোকন করছে।

ইউরোপীয়ান কমিশন লন্ডন শাখা রাজনীতিক বিভাগের প্রধান ইয়ান ক্রুশ বলেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইউরোপিয় ইউনিয়ন গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এধরনের নির্বাচনের পক্ষে না।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর সাবেক দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক প্রধান আব্বাস ফাইজ বলেন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করার জন্য জোর করে ক্ষমতায় আছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের দাওয়াত দেবেন এবং এ নির্বাচনকে বৈধ করবেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করার চেষ্টা করবেন। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট চুরির সত্যিকারের দৃশ্য আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক আইনজীবী ব্যারিস্টার টোবি ক্যাডম্যান বলেন- বাংলাদেশে আইনের শাসন ১০ বছর যাবৎ নেই তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়। তিনি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অন্যায়ভাবে বন্দী রাখায় বর্তমান সরকারের সমালোচনা করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে হাউস অব লর্ডের সিনিয়র লর্ড সদস্য এন্ড্রু স্টানেল বলেন- রাজনৈতিক মামলায় আটককৃত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি অবিচার এবং অন্যায় করা হচ্ছে। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। বক্তব্য রাখেন পল স্কোলী এমপি, লর্ড হোসাইন, মানবাধিকার কর্মী স্টীব জন, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এর আহ্বায়ক এস এইচ সোহাগ, ভয়েস ফর বাংলাদেশের যুক্তরাজ্য শাখার আহ্বায়ক ফয়সাল জামিল প্রমুখ।

আয়োজক কমিটির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কানিজ ফাতিমা, আব্দুর রাহিম, নূর হোসেন, আকলিমা ইসলাম, মনোয়ার মোহাম্মদ, আবুল হোসেন নিজাম, লুৎফর রহমান লিঙ্কন, ফরহাদ হোসেন, জাহাঙ্গীর শিকদার, অঞ্জনা আলাম, লুনা সাবিরা, আবদুল্লাহ আল মামুন, পারভেজ আজম, আবদুল্লাহ আল নোমান, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, সোহরাওয়ার্দি শুভ, নাজিয়া আকবর, কাওছার হোসেন, আব্দুল ওয়াহাব রুবেল, কামরুল হাসান, ফয়সাল আহমেদ, মোহাম্মদ আলামিন, আল কবির আব্দুল ওয়াহাব, একলিমুর রাজা চৌধুরী মান্না, ফজলে রহমান পিনাক, মো. সাদেকুল ইসলাম, মোহাম্মদ সালেকিন মিয়া, আবদুল কাদের জিলানী, মোহাম্মদ জে এস চৌধুরী হীরা, এইচ এম আলফি সানি রাতুল, মো. শামসুল ইসলাম, রুবেল আহমদ, মো. কামরুল হাসান, মো. মারুফ আদনান চৌধুরী, আব্দুস শুক্কুর, এম আই হোসাইন রাসেল, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুরাদ, মোহাম্মদ আসাদ তুসার, নাজমুল আহসান, মো. মহিন উদ্দিন (ফয়সাল), মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান জনি, মো. আসাদ প্রমুখ।

  • কার্টসি - যুগান্তর/ ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Sunday, December 29, 2019

নিত্যপণ্যের অসহনীয় মূল্য

বেসামাল বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে


নিত্যপণ্যের বাজার ক্রেতা সাধারণের অনুকূলে আসছেই না। এমনিতেই গত সাড়ে তিন মাস ধরে বাজারে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা; এর অতিরিক্ত হিসেবে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।

গত এক মাস ধরে ভোজ্যতেলের দাম ভোক্তার সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে আর চলতি অর্থবছরে বাজেটে কর বাড়ানোর অজুহাতে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিতে সাত-আট টাকা। টিসিবি বলছে, গত এক মাসে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ আর খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা একাধিক ভোক্তা যুগান্তরকে বলেছেন, একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা ছক করে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। তারা ভোক্তাদের পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা, অথচ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে মাথাব্যথা নেই।

বস্তুত, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। ক্যাব বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে এদেশে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। আসলে পুরোটাই কারসাজি। এ কারসাজির মাধ্যমে একদিকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অতি মুনাফা করছে, অন্যদিকে তারা বিব্রত করছে সরকারকেও। ক্যাব সভাপতি নিত্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে কতগুলো পরামর্শ দিয়েছেন, যা প্রণিধানযোগ্য। বলা হয়েছে, প্যাকেটজাত ও বস্তাজাত পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে তা গায়ে লেখা বাধ্যাতমূলক করা হলে ভোক্তারা উপকৃত হবেন। ক্যাব ভোক্তা স্বার্থ-অধিকার রক্ষায় স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় অথবা বাণিজ মন্ত্রণালয়ে পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছে। সরকারকে এ দাবি বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রমও দৃশ্যমান হওয়া দরকার।

পেঁয়াজের আকাশছোঁয়া মূল্যের কারণে ভোক্তারা ভুগেছে মাসের পর মাস। এখন যদি অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে, তাহলে নিু ও স্বল্প আয়ের মানুষদের ভোগান্তির সীমা থাকবে না। সমাজের একটি বড় অংশ হল নিু আয়ের মানুষ। নিত্যপণ্যের মূল্য যখন বাড়ে, তখন কিন্তু তাদের আয় বাড়ে না। স্বল্প আয় দিয়েই তাদের মোকাবেলা করতে হয় পরিস্থিতি এবং তা করতে গিয়ে তাদেরকে পড়তে হয় অসহনীয় বিড়ম্বনায়। এ অবস্থা থেকে তাদের পরিত্রাণ দিতে হলে সরকারকে অবশ্যই বাজার ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে যেসব সিন্ডিকেট, সেগুলো ভাঙতে হবে।
  • যুগান্তর /২৯ ডিসেম্বর ২০১৯

একাদশ সংসদ নির্বাচন- পুলিশ ও প্রশাসনের 'পক্ষপাতমূলক' ভূমিকার প্রমাণ পেয়েছে টিআইবি


বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ৫০টি আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।

সংস্থার বাংলাদেশ শাখার নির্বাহী পরিচালক ড ইফতেখারুজ্জামান বিবিসিকে বলেছেন, তাদের পর্যবেক্ষণের এবং বিশ্লেষণের পেছনে যথাযথ তথ্যপ্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে।

"নির্বাচন আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং একধরনের অভূতপূর্ব নির্বাচন হয়েছে যার ফলে এই নির্বাচন অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হিসাবে আলোচিত হচ্ছে।"

বিচার-বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে টিআইবি।

তবে টিআইবির এই রিপোর্ট সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরি বিবিসিকে বলেন, সুনির্দিষ্ট আইনের ভেতরেই নির্বাচন হয়েছে, এবং নির্বাচন নিয়ে যে কোনো অভিযোগের প্রতিকারের আইনি কাঠামো রয়েছে।

নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিবীক্ষনের জন্য র‍্যানডম স্যাম্পলিং বা দৈব-চয়নের ভিত্তিতে এই ৫০টি আসন নির্ধারিত করে টিআইবি। শিডিউল ঘোষণার পরপরই সংস্থার কর্মীরা তাদের কাজ শুরু করেছিলেন। পরিবীক্ষণের প্রাথমিক রিপোর্ট আজ (মঙ্গলবার) প্রকাশ করা হয়েছে।

বড় কী কী অনিয়ম তারা দেখেছেন? বিবিসির এই প্রশ্নে ড ইফতেখারুজ্জামান একটি তালিকা তুলে ধরেন -

-নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

-প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

-অনেক ভোটার ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেননি

-বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারার দৃষ্টান্ত রয়েছে

-জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে

-ভোট শুরুর আগে ব্যালট ভর্তি বাক্স দেখা যায়

-ভোট শেষের আগে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়

-গণমাধ্যমের জন্য 'অভূতপূর্ব' কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল

-নির্বাচন কমিশন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসন প্রতিপক্ষকে দমন করার ব্যাপারে সরকারের সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে ড জামান বলেন, "নির্বাচন কমিশন যে যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। পুলিশ ও প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে নির্বিকার ছিল, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাও এই লঙ্ঘনের অংশীদার ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।"

প্রমাণ কী রয়েছে তাদের কাছে,- এই প্রশ্নে ড জামান বলেন, "অভিযোগগুলো ব্যাপক এবং এসব অভিযোগের যথার্থতা এবং গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়েছে...আমাদের প্রতিটি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।"

ইফতেখার জামান বলেন, ৫০টি আসনের ওপর পরিবীক্ষণের ফলাফল দিয়ে সারা দেশের নির্বাচনের পরিবেশ বিবেচনা করা যাবেনা।

"তবে এটি (নির্বাচনের) সার্বিক চিত্রের বহি:প্রকাশ বলে মনে করি।"

কী বলছে নির্বাচন কমিশন

টিআইবির এই রিপোর্ট সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরি বিবিসিকে বলেন, সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর ভেতরেই নির্বাচন হয়েছে, এবং নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে যে কোনো অভিযোগের প্রতিকারের আইনি ব্যবস্থা রয়েছে।

তিনি বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হয়েছিল, বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে এবং ইলেকটোরাল তদন্ত কমিটিও রয়েছে।

"নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পর এমনকি ভোটাররাও এই তিনটি হাতিয়ারের যে কোনোটির শরণাপন্ন হতে পারেন। তাতে না হলে, সুপ্রিম কোর্টের ট্রাইব্যুনালও রয়েছে।"
  • বিবিসি বাংলা/১৫ জানুয়ারি ২০১৯

একাদশ সংসদ নির্বাচন- ৫০ আসনের মধ্যে ৪৭টিতে অনিয়ম — টিআইবি


সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০ আসনের মধ্যে ৪৭টিতে অনিয়ম হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

১৫ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) জানান, সংসদীয় নির্বাচনে ৫০টি আসন নিয়ে সার্ভে করা হয়। এগুলোর মধ্যে ৪৭টিতে অনিয়ম পাওয়া গেছে।

টিআইবি’র গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টি আসনে নির্বাচনের দিন সংঘটিত অনিয়মের মধ্যে রয়েছে: প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা, জাল ভোট দেওয়া, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট, পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো, ব্যালট বাক্স আগে থেকে ভরে রাখা এবং প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মারধর করা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল বা জোট ও প্রার্থী, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন অংশীজন নির্বাচনী প্রক্রিয়া কতটুকু আইনানুগভাবে অনুসরণ করেছেন তা পর্যালোচনা করতে গিয়ে সংস্থাটি এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে জানায়। তবে তা সবার জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩০০টি আসনের মধ্য থেকে ৫০টি আসন নির্বাচন করে প্রত্যেক আসনে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রধান দুটি দল/ জোটের প্রার্থী বাছাই করে প্রার্থী ও তাদের কার্যক্রমের ওপর তথ্য সংগ্রহ; কোনো আসনে তৃতীয় কোনো শক্তিশালী প্রার্থী থাকলে তাকেও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

টিআইবি’র গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৪৭টি আসনে কোনো না কোনো নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ বা অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: 

নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্স, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া এবং প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া।

সংস্থাটির প্রতিবেদনের ‘সার্বিক পর্যবেক্ষণ’ অংশে বলা হয় যে, “নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ অনেকক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়নি”। টিআইবি’র মতে, নির্বাচন কমিশন যেসব কাজে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া, সব দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, বিরোধীদের দমনে সরকারের ভূমিকার প্রেক্ষিতে অবস্থান নেওয়া - নির্বাচন কমিশনের নীরবতা বা ক্ষেত্রবিশেষে অস্বীকার, সব দল ও প্রার্থীর প্রচারণার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, সব দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা, নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিশেষকরে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

এছাড়াও, নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করতে পারেনি উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে কী না তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।

  • কার্টসি- The Daily Star/ জানুয়ারী ১৫, ২০১৯

৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন - কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে অস্বাভাবিক ভোট

১৯৭ কেন্দ্রে শতভাগ, হাজারো কেন্দ্রে ৯৫-৯৯% ভোট! 



বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পর প্রকাশিত কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে অস্বাভাবিক ভোট পড়ার চিত্র উঠে এসেছে।

ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কমপক্ষে ১৯৭টি কেন্দ্রে ১০০% ভোট পড়েছে। আর অন্তত ১ হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৫% থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স'র (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেন, বিষয়টি উদ্বেগের।
কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে এই অস্বাভাবিক ভোট পড়ার চিত্র উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোথাও ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লেই সেখানে কমিশনের আলাদা নজর দেয়া উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, "এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। যেটা হয় না পৃথিবীতে কোথাও, সেটা চলতে পারে না। আমরা শুধু এটা দেখেছি মিলিটারি আমলে ডিক্টেটরদের সময়।"

"যখন তারা গণভোট নিয়েছে তখন আমরা দেখেছি হান্ড্রেড পার্সেন্ট, নাইনটি পার্সেন্ট অনেক সময় একশভাগেরও বেশ ভোট পড়ার নজির আছে। এটা হয় একটা অটোক্রেটিক রুলের সময়।"
কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে এই অস্বাভাবিক ভোট পড়ার চিত্র উঠে এসেছে।

"কিন্তু এখন তো আমাদের ডেমোক্রেসি। এখানে তো যে ভোট দিতে যাবে যাবে, ইচ্ছা হলে যাবে না। তাদের ওপরে তো কারো কোনো হাত নেই। সেখানে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কিভাবে ভোট পড়লো এটা ইলেকশন কমিশনের নিজেদেরকেই বের করতে হবে," বলেন তিনি।

৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বেশিরভাগ আসনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করেছে। আর বিরোধী ২০ দলীয় জোটে নেতৃত্বে থাকা বিএনপি এবং তাদের নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ৭টি আসনে জয় নিয়ে এখন সংসদে।

ভোটের ফলাফল ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক নৌকা মার্কা ও বিরোধী দল বিএনপির প্রতীক ধানের শীষের মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের তারতম্য ছিল চোখে পড়ার মতো।

কারণ অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর তুলনায় বিএনপির প্রার্থী মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ ভোট পেয়েছে।

কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায় বহু কেন্দ্রে বিএনপি কোনো ভোটই পায়নি।

নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্রে শতভাগ প্রদত্ত ভোটকে অস্বাভাবিক বলে স্বীকার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারও।

কিন্তু গেজেট প্রকাশের পর এ নিয়ে কিছু করার নেই বলেও মনে করে কমিশন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নির্বাচন কমিশনারদের কেউই মন্তব্য করতে রাজী হননি।

তবে কমিশন সচিব মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, "প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয় কিন্তু অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন যে এটা যদি কোনো নির্বাচনকালীন অথবা গেজেট প্রকাশের আগে কেউ অভিযোগ করতো, সুনির্দিষ্টভাবে, তাহলে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে দেখতে পারতো। যেহেতু এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি বা কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসেনি, গেজেট নোটিফিকেশন করার পরে আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু কেউ যদি এটা নিয়ে এখন কথা বলতে চান তাহলে উপযুক্ত আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।"

এদিকে জাতীয় নির্বাচনের এত ভোট পড়ার তথ্য থাকলেও অনেকে ভোট দিতে পারেননি এমন অভিযোগও ছিল। ভোটের দিন এমন কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে বিবিসির সাংবাদিকদের চোখে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি ৫০টি আসন পর্যবেক্ষণ করে ৪৭টিতে বুথ দখল করে জাল ভোট, এমনকি ভোটের আগে ব্যালটে সিল মারার মতো অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছে।

কিন্তু ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হার এত বেশি কেন সেটা নির্বাচন কমিশনকেই তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন।

"অনেকেই জানে। অনেকেই অনেক থিওরি দিতে পারে। কিন্তু সেই থিওরি-তো লিগ্যাল হবে না। একে বৈধতা দেয়ার জন্য ইলেকশন কমিশন যদি প্রতিটা আসনে একটা কমিটি করেন এবং তাদের যদি সদিচ্ছা থাকে তারা বের করতে পারবে যে এই ঘটনাটা কী করে হলো।"

তিনি বলেন, "আমি মনে করি এটা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে। ইলেকশন ঠিকমতো হওয়াটা কিন্তু গণতন্ত্রের একটা বড় স্তম্ভ। সেই স্তম্ভ যদি নড়বড়ে হয়ে যায় তাহলে গণতন্ত্রের বাকি স্তম্ভগুলোও কিন্তু নড়বড়ে হতে থাকবে।"

নির্বাচন কমিশন সচিব জানান, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা বা এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত কমিশন এখন পর্যন্ত নেয়নি।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে নির্বাচনকে বিতর্ক ও অনিয়মের ঊর্ধ্বে রাখতে সবক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনার করছে।

যদিও নির্বাচনে ইভিএম নিয়েও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এবং সাধারণ ভোটারদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।

  • আবুল কালাম আজাদ
  • বিবিসি বাংলা/ ৪ জুলাই ২০১৯

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ছিল একপেশে — যুক্তরাষ্ট্র


বাংলাদেশে একপেশে সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র৷ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১৮’-তে এমন মন্তব্য করা হয়েছে৷ 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত হয়নি৷ ভরা ব্যালট বাক্স, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে৷ নির্বাচন পূর্ববর্তী পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘নির্বাচনের আগে হয়রানি, হুমকি, গণ গ্রেপ্তারও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ যার কারণে অনেক বিরোধী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের জন্য বৈঠক, জনসভা, কিংবা স্বাধীনভাবে প্রচার চালানো কঠিন ছিল৷’’

নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীদের প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে অনুমতি ও ভিসা প্রদান করা হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে৷ ‘‘২২টি ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ এনজিওর মধ্যে মাত্র সাতটিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেয়া হয়,’’ দাবি করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর৷ এনজিও ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান দিয়ে তারা বলছে, নির্বাচনের মাসে বিএনপি ও তার রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে মোট ১৩২৪ টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ যেখানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা ঘটেছে ২১১ টি৷ ‘‘নির্বাচনকালীন সময়ে প্রায় ৪,৩৫,০০০ বিএনপি সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ৷ যাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এসব মামলার অনেকগুলোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হিসেবে অভিহিত করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো৷’’ বলা হয়েছে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা দায়ের করেছে সরকার৷

গেল সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে জামায়াতের কর্মকাণ্ডে রাশ টানার প্রস্তাব উঠলেও পররাষ্ট্র বিভাগের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে জামায়াতের নেতা কর্মীদের মত প্রকাশের সাংবিধানিক স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে দেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করা হয়েছে৷ ‘‘রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নিবন্ধনের সুযোগ না দেয়া, জামায়াতের নামে অফিস খুলতে না দেয়া সেই সঙ্গে নেতা ও সদস্যদের মত প্রকাশ ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার ক্রমাগত হরণ করা হচ্ছে৷’’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, যেসব গণমাধ্যম সরকার ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে তাদেরকে হয়রানি করছে সরকার৷ বিজ্ঞাপন থেকে তাদের আয়ের পথ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ গণমাধ্যমগুলো সরকারের প্রতিক্রিয়া এড়াতে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করছে বলেও উল্লেখ করা হয়৷

সরকারি বাহিনীর হত্যা, গুম, নির্যাতন, গণগ্রেপ্তার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, দুর্নীতি, সমকামীদের প্রতি সহিংসতা, শ্রমিক ইউনিয়নে বাধা দেয়া ও শ্রমিক অধিকার সহ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগ৷ বলা হয়েছে, ‘‘নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে৷ কিন্তু সরকার মাত্র অল্প কয়েকটি নির্যাতন ও হত্যার ঘটনার তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে৷’’

  • কার্টসি - ডয়চে ভেলে/  মার্চ ১৪, ২০১৯ 

অসঙ্গতি, অনিয়ম ও জালিয়াতির নির্বাচন ৩০শে ডিসেম্বর - সুজন

আকবর হোসেন

বাংলাদেশে ৩০শে ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের মাত্রা কতটা ব্যাপক ছিল তার কিছু খণ্ড চিত্র উঠে এসেছে বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে।

নির্বাচনের ছয় মাস পরে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র-ভিত্তিক যে ফলাফল প্রকাশ করেছে সেটি পর্যালোচনা করেই এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

সংস্থাটি বলছে, ৭৫টি আসনের ৫৮৬টি কেন্দ্রে যতগুলো বৈধ ভোট পড়েছে, তার সবগুলোই পেয়েছে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা।এসব কেন্দ্রে ধানের শীষ কিংবা অন্য প্রার্থী কোন ভোটই পাননি।

তবে মাগুরা ২ আসনের একটি কেন্দ্রে সব ভোট পেয়েছে ধানের শীষ। যদিও সে আসনটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করেছে।

নির্বাচনে অনিয়মের আরেকটি দিক হচ্ছে, অন্তত পাঁচটি কেন্দ্রে ভোট গণনার পরে রিটার্নিং অফিসার তাৎক্ষণিকভাবে যে ফলাফল প্রকাশ করেছে, তার সাথে সর্বশেষ প্রকাশিত কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলের কোন মিল নেই।


সুজনের প্রতিবেদন বলছে, ৭৫টি আসনের ৫৮৬টি কেন্দ্রে যতগুলো বৈধ ভোট পড়েছে, তার সবগুলোই পেয়েছে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা।

উদাহরণ হিসেবে সুজন তুলে ধরেছে, চট্টগ্রাম-১০ আসনের কথা। এই আসনে গণ-সংহতি আন্দোলনের সৈয়দ মারুফ হাসান রুমী কোন ভোট পাননি। অর্থাৎ তিনি শূন্য ভোট পেয়েছেন। এমনটাই জানিয়েছিলেন রিটার্নিং অফিসার। কিন্তু কয়েকদিন আগে প্রকাশিত কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, তিনি ২৪৩ ভোট পেয়েছেন- জানাচ্ছে সুজন।

সুজনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , ১০৩টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এ বিষয়টি কোনক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেও তারা উল্লেখ করেছে।

সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ফলাফল পর্যালোচনা করে চরম অসঙ্গতি এবং কারচুপি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

মি. মজুমদার বলেন, "সুষ্ঠু নির্বাচন তো হয় নাই। এর মধ্যে অনেক অসঙ্গতি, অনিয়ম এবং জালিয়াতি আছে। এ ব্যাপারে অনেকেরই দায় আছে। তবে সবচেয়ে বড় দায় আছে নির্বাচন কমিশনের।"

সুজনের এই পর্যালোচনা প্রতিবেদন নিয়ে নতুন করে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। তবে কয়েকদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরো বলেন, নির্বাচন-কালীন অথবা গেজেট প্রকাশের আগে কেউ যদি অভিযোগ করতো সুনির্দিষ্টভাবে, তাহলে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে দেখতে পারতো। যেহেতু এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি বা কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসেনি, গেজেট নোটিফিকেশন করার পরে আর কিছু করার থাকে না।

কিন্তু বদিউল আলম মজুমদার এ ধরনের বক্তব্যের সাথে একমত নন। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারতো। এমনকি নির্বাচন কমিশনের ফলাফল বাতিল করারও ক্ষমতা রয়েছে বলে মি: মজুমদার উল্লেখ করেন।

  • বিবিসি বাংলা/৯ জুলাই ২০১৯

'আমার ছেলেমেয়েদের কাছে বাবা মানে একটা গল্প'

কাদির কল্লোল

বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নিখোঁজ নেতাকর্মীদের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠাটিতে তাদের কথা বলেন।

"আমার মেয়েটা ভুলে গেছে তার বাবার কথা। এখন তাদের কাছে তাদের বাবা একটা গল্প । আগে যেমন আমরা ছোটবেলায় দাদি-নানীদের কাছে গল্প শুনতাম, এখন ওরা দু'জন ওদের বাবার গল্প শোনে।"

কথাগুলো ঢাকার বংশাল এলাকার একজন নিখোঁজ বিএনপি নেতার স্ত্রী ফারজানা আকতারের।

তার অভিযোগ, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে তার স্বামীকে গুম করা হয়েছে।

দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ফারজানা আকতার বুধবার উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকায় বিএনপির মানবাধিকার সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে।

"আমার স্বামী ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বরে গুম হয় ঢাকা শাহবাগ এলাকা থেকে। আমি তখন গর্ভবতী ছিলাম। আমার সেই ছেলে এখন স্কুলে যায়, সে তার বাবাকে দেখেনি। আর আমার মেয়েটারও বয়স তখন ছিল দুই বছর।"

ফারজানা আকতার বলছিলেন, তার দুই শিশু এখন বাবার গল্প শুনে শুনে বড় হচ্ছে - এই বাস্তবতা তার মেনে নিতে কষ্ট হয়।

"এই এখন আমাদের জীবন, বড় কষ্টের" - বলেন ফারজানা আকতার।

'কোন সাহায্য পাই নি'

নিখোঁজ হওয়া আরেক বিএনপি নেতা খালিদ হাসানের স্ত্রী সৈয়দা শাম্মী সুলতানাও এসেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে, তার ৭ বছর বয়সী শিশু সন্তানকে নিয়ে।

তার স্বামী ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার একটি ওয়ার্ড বিএনপির একজন নেতা ছিলেন। সৈয়দা শাম্মী সুলতানার অভিযোগ, সাত বছর আগে তার স্বামী খালিদ হাসান গুম হয়েছেন।

একটি মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন খালিদ হাসান। যেদিন তার জামিনে মুক্তি মেলে, সেদিনই কারাগারের সামনে থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হয়েছিল।

সৈয়দা শাম্মী সুলতানা বলেছেন, তার স্বামীর গুম হওয়ার অভিযোগ নিয়ে তিনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীগুলোর কাছে বার বার গেছেন, কিন্তু সেভাবে সাহায্য পাননি।

"কারাগারের সামনে থেকে গুম হলো, সেখানে সিসিটিভির ফুটেজ দেখলে হয়তো বের করা যেতো। কিন্তু কোনো সাহায্য পাই নি।"

বিএনপি দাবি করছে, গত ১০ বছরে তাদের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, ৩০০'র বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে।

বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নিখোঁজ নেতাকর্মীদের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠাটিতে তাদের কথা বলেন। তাদের অনেকেই প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন।

আবার অনেকে এখনও আশা নিয়ে থাকতে চান।

বিএনপির এই প্রতিবেদনের ভিত্তি কী

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি দাবি করছে, গত ১০ বছরে তাদের অন্তত ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, এবং এই সময়ে তাদের ৩০০'র বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দলটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে।

গত দশ বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকারের চিত্র তুলে ধরে বিএনপি তাদের একটি প্রতিবেদন বই আকারে প্রকাশ করে।

বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে এই প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে গুম বা নিখোঁজ হওয়া বিএনপির নেতা কর্মীদের পরিবারের সদস্যরা তাদের কথা তুলে ধরেন।

তারা বলেছেন, তাদের অনেকের শিশু সন্তানরা গুম হওয়া বাবার গল্প শুনে বড় হচ্ছে এবং এই বাস্তবতাকে তারা জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময় হিসেবে দেখছেন।

এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই বিএনপি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের অধিকার খর্ব হওয়া এবং নারী-শিশুদের অধিকারসহ সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার লংঘনের চিত্রও দলটি তুলে ধরে।

এই প্রতিবেদন যারা তৈরি করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী শামা ওবায়েদ । তিনি বলছিলেন, তারা সংবাদমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছ থেকেও তথ্য নিয়েছেন।

বিএনপির প্রতিবেদনে বলা হয়,গত ১০ বছরে রাজনৈতিক কারণে তাদের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ মামলা করা হয়েছে।

"রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানবাধিকার লংঘন করা হচ্ছে"

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানবাধিকার লংঘন করে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। সেই চিত্রই তারা তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

"দেশে যখন ৩৫ লাখ মানুষ আসামী হয়, তখন পরিস্থিতিটা কি তা বোঝা যায়। আজকে মানবাধিকার, কথা বলার স্বাধীনতা না থাকা বা সামগ্রিকভাবে যে পরিস্থিতি ১০ বছরে আমরা দেখছি, এর মুল কারণই হচ্ছে আমরা একটা অর্থবহ নির্বাচন করতে পারছি না" - বলেন মি.আলমগীর।

তিনি বলেন, "আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থাও পাল্টিয়ে ফেলেছে"

বিএনপির এই অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের ঢাকায় কর্মরত অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

  • বিবিসি বাংলা/ ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের মতোই নাজুক

শেখ সাবিহা আলম
গুম-খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পেতে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের আয়োজনে মানববন্ধন। ২০১৯ সালের মে মাসে।  ফাইল ছবি

‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ নানা কারণে দেশের মানবা​ধিকার পরিস্থিতি অনেক বছর ধরেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এসবের অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায়​ আসার পর মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এমনটা বলেছিলেন। এরপর গত এক বছরে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হলো? বছর শেষের পরিসংখ্যান বলছে, পরিস্থিতি সেই আগের মতোই নাজুক রয়ে গেছে।

বেসরকা​রি মানবা​ধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, চলতি বছর প্রতিদিন গড়ে একজন ব্যক্তি ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। চলতি বছর নতুন করে গুমের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন আরও আটজন। যৌন হয়রানি ও সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যাও অনেক। নারী নির্যাতনকারী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নামও এসেছে। এ ছাড়া সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, মতপ্রকাশে বাধার অভিযোগ ছিল বছরজুড়ে, অব্যাহত ছিল সীমান্ত হত্যা।

এর মধ্যে ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে সরকারি দলের হাজির হওয়া ও প্রতিবেদন পেশ করা। কুড়ি বছর আগে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছিল ঠিকই, কখনো কোনো অধিবেশনে উপস্থিত হয়নি, প্রতিবেদন তো দূরের কথা।

যদিও স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নিষ্ঠুর, অমানবিক, অবমাননাকর ব্যবহার ও শাস্তি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিয়মিত কমিটির কাছে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বছর কমিটিতে উপস্থিত হয়ে সরকারি প্রতিনিধিদল সংবিধান কীভাবে মানুষকে সুরক্ষা দিয়েছে এবং মানবাধিকার রক্ষায় কী কী আইন করেছে, সে সম্পর্কে জানিয়েছে। তবে ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের হাতের সাত খুনের ঘটনা ছাড়া বাকি সব বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যদিও ওই কমিটিকে দেওয়া বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বয়ান ছিল আলাদা। তারা মোটাদাগে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, মতপ্রকাশে বাধাসহ কিছু বিষয়ের ওপর পর্যবেক্ষণ দেয়।

এই বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে আমাদের উপস্থিতিই প্রমাণ করে, মানবাধিকার বিষয়টি আমরা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যাঁরা করছেন, তাঁরা দেশবিরোধী প্রচার চালাতে চান।’ তিনি দাবি করেন, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হয়, তখন কিছু এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। গুম করে কাউকে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয় না। দু-একটি ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, এতে যাদের যুক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

মানবাধিকার ২০১৯: ফিরে দেখা। চলতি বছর প্রতিদিন গড়ে একজন ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ১৯৯৮ সালে ডিবি হেফাজতে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র রুবেল খুন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা ​দিয়েছিলেন। যার আলোকে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন (নিবারণ) আইনও পাস করে সংসদ। তারপরও হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছর ঢাকার উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে একজনকে পিটিয়ে হত্যা এবং আরেকজনকে পায়ে গুলি করে আহত করার অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

গুম, খুন, হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ

আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ৩৬২ জন। এঁদের মধ্যে ১৭৯ জনই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে বা জিম্মায় থাকাকালীন। এর বাইরে ৯৭ জন র‍্যাবের, ৩১ জন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি), ৫৩ জন বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

রাজনৈতিক নেতা, মাদ্রাসাশিক্ষক, সাবেক সেনাসদস্যসহ এ বছর গুম হয়েছেন ১৩ জন। গুম হওয়ার পর ফিরে এসেছেন চারজন, পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে একজনকে। বাকি আটজন কোথায়, কেমন আছেন কেউ জানেন না। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সবশেষ ব্যক্তি সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। গুম হওয়ার ৪৬৭ দিন পর তিনি এ বছরের ১৬ মার্চ ফিরে আসেন। মারুফ জামান বা তাঁর আগে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁরা কেউ আজ পর্যন্ত মুখ খোলেননি।

আসকসহ দেশি–বিদে​শি মানবা​ধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, এক দশকে দেশে গুমের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। মা, স্ত্রী, সন্তানসহ স্বজনেরা প্রিয়জনকে ফিরে পেতে প্রতিবছর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হন। সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান, কাকুতি–মিনতি করেন। কিন্তু তাঁদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ

প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) গত এপ্রিলে সর্বশেষ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করেছে। তাতে আগের বছরের তুলনায় চার ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা সরকারের কঠোর অবস্থানের শিকার হচ্ছেন। আসকের হিসাবে এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৩৪ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হুমকি, হয়রানি ও হামলার শিকার হয়েছেন।

বছরের প্রথম দিনেই নির্বাচনের ত্রুটিপূর্ণ ফল ঘোষণার অভিযোগে খুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন উপজেলা প্রশাসন। এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তারও করা হয়।

নারী, শিশু নির্যাতনে ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশ

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় ধর্ষণের শিকার হন সুবর্ণচরের এক নারী। ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে গণধর্ষণের। এরপর এপ্রিলে সুবর্ণচরেই আরেক নারী ধর্ষণের অভিযোগ করেন। বছরজুড়ে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত ছিল।

পুলিশ সদর দপ্তরনারীর প্রতি সহিংসতার পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। প্রথম আলোকে মাত্র তিন মাসের তথ্য দিতে সমর্থ হয়েছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে ধর্ষণের অভিযোগে সারা দেশে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৩২১টি। এগুলোর মধ্যে পুলিশ তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিয়েছে ৮১৩টি মামলায়, আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ১৪৮টিতে।

মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

এ পরিস্থিতিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অবস্থান ছিল নড়বড়ে। মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয় এই কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন অনেক। গত ২৮ নভেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিষয়ে আসক আয়োজিত এক সংলাপে বলা হয়, কমিশনের চেয়ার ও সদস্য নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। কমিশন গঠনে আমলাতন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব, আর সার্বক্ষণিক সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব কামাল উদ্দীন।

এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানা যায়নি। তিনি ছেলের অসুস্থতার কারণে কথা বলতে অপারগতা জানান।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভূমিকাও যে খুব জোরালো ছিল, তা বলা যাবে না। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে তিন শর বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও মানবা​ধিকার সংগঠনগুলো সভা-সেমিনার ও বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সেরেছে।

তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগর অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা কেউ প্রকাশ করলেই তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী তকমা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে সত্য, কিন্তু মানুষের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে একজন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন, এটা খুব উদ্বেগের কথা। কিন্তু এই উদ্বেগ কি যথাস্থানে পৌঁছাচ্ছে?

  • কার্টসি - প্রথম আলো/২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ 

সংকটকালে পাশে দাঁড়ায়নি পরীক্ষিত বন্ধুরা

মো. তৌহিদ হোসেন

বিদায় নিচ্ছে ২০১৯। পররাষ্ট্র ও কূটনীতির ক্ষেত্রে কেমন গেল বছরটি? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো কী কী ছিল? এসব নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারত আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধু। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারতের চাওয়ার জায়গাগুলো অনেকটাই পূরণ করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের চাহিদাসমূহ পূরণে ভারতের প্রতিশ্রুতি কোনোটাই বাস্তব রূপ লাভ করেনি। তবু বছর শুরু হয়েছিল দুই দেশেরই সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এই উচ্চারণে যে বাংলাদেশ এবং ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’।

অনেকে আশা করছিলেন যে এপ্রিল-মে মাসে লোকসভা নির্বাচনের পর এ ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি সম্ভব হবে। অন্তত তিস্তার বিষয়ে বারবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি হয়তো পালন করবে ভারত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। শোনা যাচ্ছে ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ দখলের আশা করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সুবিধা দিয়ে উত্তরবঙ্গের ভোট হারানোর ঝুঁকি নেবে না দলটি। বরাবরের মতোই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বলি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বার্থ।

এর মধ্যে জুলাই মাসে আসামের নাগরিক তালিকার দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশিত হলো, যাতে ৪০ লাখ মানুষকে সম্ভাব্য বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। ৩১ আগস্ট বের হলো চূড়ান্ত তালিকা, যাতে ১৯ লাখ মানুষকে বলা হলো বিদেশি। ভারত আশ্বস্ত করল যে এটা নিতান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের এতে উদ্বেগের কিছু নেই। আমাদের সরকারও তাদের এই আশ্বাসে বিশ্বাস ব্যক্ত করেছে। বাংলাভাষী এই মানুষগুলো যদি ভারতে বিদেশি বলে গণ্য হয়, তবে তারা কোন দেশ থেকে এসেছে, ভারতের আশ্বাস বা আমাদের বিশ্বাসে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ৩ থেকে ৬ অক্টোবর চার দিনের ভারত সফরে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তখনো তাঁকে একই আশ্বাস দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

সর্বোচ্চ পর্যায়ের এ সফরকালে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয় দুই দেশের মধ্যে। তার একটির সুবাদে ত্রিপুরার সাবরুম শহরের খাবার পানির সমস্যা মেটাতে ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করবে ভারত। এ পানির পরিমাণ খুব বেশি নয়, তবে তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ভারতের বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে এই ছোট সুবিধাও ক্ষোভের কারণ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে।

সাতটি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে সপ্তমটির শিরোনাম ‘এমওইউ অন প্রভাইডিং কোস্টাল সার্ভিলেন্স সিস্টেম’ (উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম প্রদানসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক)। এ স্মারকের শর্তাবলি বিষয়ে সরকারিভাবে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে ভারতীয় পত্রিকার খবরে জানা যায়, এই সমঝোতা স্মারকের ফলে দিল্লি বাংলাদেশে একটি উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম স্থাপনের সুযোগ পাবে এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দিল্লির রণকৌশলগত অবস্থান এতে শক্তিশালী হবে। সাগরপথে সন্ত্রাসী হুমকি এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এটা হবে (ভারতের জন্য) খুবই উপকারী।

এই চুক্তি বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসবে এমন কোনো কথা কোনো পক্ষ থেকেই শোনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সুসম্পর্কের আলোকে এ নিয়ে চীন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেবে, তা নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় এই স্মারক কোনো বিনিময় ছাড়াই ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে প্রতীয়মান হয়। সরকারের একজন উপদেষ্টা অবশ্য এর পক্ষে একটি খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন যে এরূপ একটি নজরদারি ব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এটা করা হতো সময়সাপেক্ষ, তাই ভারতকে তা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে কেন এটা এত জরুরি হয়ে পড়ল তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি। উদ্ভূত তথ্যের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন ছাড়াও আমাদের বিদেশনীতিতে যে একধরনের ভারত-চীন ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা আছে, এই স্মারক তাতে আরও জটিলতাই সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে সর্বশেষ প্রভাবক ঘটনাটি ঘটেছে এই ডিসেম্বর মাসেই। অনেক হই–হট্টগোল আর তুমুল বিতর্কের পর ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল,২০১৯ পাস হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী মুসলমানদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে নির্যাতিত হয়ে ভারতে চলে আসা হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে। বিলের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোসহ সারা ভারতেই। বিক্ষোভ-সহিংসতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণহানিও ঘটেছে।

ভারতের পার্লামেন্টে পাস করা একটি আইন আপাতদৃষ্টিতে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দুটো কারণে এটিকে পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। প্রথমত, আইনে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একই ব্রাকেটভুক্ত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, আইনে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে (পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেও) নির্যাতনের শিকার হয়ে সংখ্যালঘুরা ভারতে প্রবেশ করছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দুটি দেশ সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’, তার একটি অপরটিকে আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে, এটা একদিকে যেমন অভূতপূর্ব, তেমনি অন্যদিকে বেদনাদায়ক। সাম্প্রতিক কালে ভারত থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের পুশ ইন তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগত কারণেই বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকার ভারতের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছে, আর বহুদিন পর, সংযতভাবে যদিও সরকার সেই ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্ধারিত সরকারি সফর বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ককে তাহলে কীভাবে মূল্যায়ন করব? ভারতের কিছু অর্জন আছে, কিন্তু এক বছরে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অর্জন দৃশ্যমান নয়। তিস্তা, সীমান্ত হত্যা রয়ে গেছে যথারীতি। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের অবস্থানও হতাশার কারণ। উদ্বেগের তালিকায় বরং যুক্ত হলো আসামের নাগরিক তালিকা আর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। হিন্দু রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে ভারতের অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। আর বছর শেষ হলো বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর সফর বাতিলের মধ্য দিয়ে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’, ২০১৯-এর শেষে এসে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে এই কথাগুলো বলতে থাকা মনে হয় বেশ কঠিন হয়ে গেছে। গত কিছুদিন এই বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলি শোনাও যায়নি কোনো নেতা-মন্ত্রীর মুখে।

চীন সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন

১৯৭৫–পরবর্তী প্রতিটি সরকারের সঙ্গেই চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। (ব্যতিক্রম ২০০৭-০৮-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এ সময়ে খানিকটা আড়ষ্টতা ছিল সম্পর্কে।) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যুসমূহে বা বহুপক্ষীয় নির্বাচনে দুই দেশ পরস্পরকে সমর্থন দিয়েছে। যেসব বিষয়ে চীন স্পর্শকাতর, বাংলাদেশ সেসব ক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে চীনকে। উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া মৈত্রী সেতু এবং সম্মেলন কেন্দ্র দৃশ্যমান করেছে সুসম্পর্ককে।

তবে সে সময়টা পেরিয়ে এসেছি আমরা বেশ আগেই। এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদার এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চীন। এর সবকিছুই অবশ্য নিরেট আশীর্বাদ নয়। চীন থেকে প্রকল্প অর্থায়ন আসে বাণিজ্যিক সুদে, জাপান বা ইইউর মতো স্বল্প সুদে নয়। চীনা কোম্পানিগুলো কাজ পাওয়ার পর দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেয়। এক প্রকল্পের কাজ আটকে রেখে চাপ দিয়ে আরেক প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। দুর্নীতি, অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি এসব তো আছেই। কোম্পানিগুলো তাদের এসব কাজে চীন সরকারের পরোক্ষ মদদও লাভ করে বলে বিশ্বাস করা হয়। তবু ‘সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু’ এই শব্দগুচ্ছে নন্দিত হয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক।

বাংলাদেশ–চীন সম্পর্কে প্রথম বড় ধাক্কা ২০১৭ সালে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারকে চীনের অকুণ্ঠ সমর্থন। দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্কের সুবাদে চীনের সুযোগ ছিল এ ক্ষেত্রে ‘অনেস্ট ব্রোকার’-এর ভূমিকা নেওয়া। তা না করে চীন ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারকে বেছে নিয়ে মিয়ানমার সৃষ্ট সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করেছে। বাংলাদেশের প্রতি চীনের অসন্তোষের একটি সম্ভাব্য কারণ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতের চাপে সরে আসা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফর–পরবর্তী চার বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি ছিল। তিন বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রতিশ্রুতির শতকরা ৫-৭ ভাগের বেশি নয়। এ বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করেছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সই হয়েছে কিছু সমঝোতা স্মারক। কিন্তু সম্পর্কের মেঘ কেটে গেছে, তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা বিষয়ে নতুন উপলব্ধি

দুই বছর ধরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা না করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের নিন্দা করছে বা জাতিসংঘের মহাসচিব যখন জাতিগত নিধন বলেছেন, তখনো বাংলাদেশ অনেকটাই নীরব থেকেছে।

২০১৯ সালে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। দেরিতে হলেও সম্ভবত এ উপলব্ধিটা এসেছে যে শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের একমাত্র পথ পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা জাতিসংঘে স্পষ্টভাবে বলেছেন। পাশাপাশি এর পুনরাবৃত্তি রোধে মিয়ানমারে যারা জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি ২০১৯ সালে। তবে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একটি মামলা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে, তবে রোম চুক্তির পক্ষভুক্ত না হওয়ায় মিয়ানমারের ওপর এর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর্জেন্টিনার আদালতেও চালু হয়েছে একটি মামলা। তৃতীয় মামলাটি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে, গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করে মামলাটি করেছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।

নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে এই গণহত্যা মামলার তিন দিনব্যাপী শুনানি অনুষ্ঠিত হয় ১০-১২ ডিসেম্বর ২০১৯। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন সে দেশের আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তাম্বাদু। মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন সে দেশের প্রকৃত সরকারপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি।

প্রত্যাশিতভাবেই অং সান সু চি তাঁর বক্তব্যে গণহত্যার সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উত্তর রাখাইনের সীমান্তবর্তী এলাকায় ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ সময় কিছু সেনাসদস্য ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ করেছিলেন বলে তিনি স্বীকার করেন। যুক্তিতর্ক চলাকালে মিয়ানমার পক্ষের আইনজীবী এমনকি এ কথাও বলেন যে সেখানে হয়তো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তবে গণহত্যা হয়নি।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তবে মামলায় চলমান গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা জারির আরজি আছে। এ আরজিটির নিষ্পত্তি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে। এরূপ নির্দেশনা যদি আসে, তবে সেটা হবে গাম্বিয়া এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে একটা নৈতিক বিজয়। আর চূড়ান্ত রায়ে মিয়ানমার যদি একটি গণহত্যাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে যেসব দেশ মিয়ানমারকে সমর্থন করছে, তাদের ওপরও নৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের। শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অপরাধের স্বীকৃতিও একটি অর্জন।

বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল মামলার শুনানি পর্যবেক্ষণের জন্য হেগে উপস্থিত ছিল। মামলা পরিচালনায় বাংলাদেশ তথ্য–উপাত্ত দিয়েও সহযোগিতা করবে গাম্বিয়াকে। স্পষ্টতই বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সমাধানের ইলিউশন থেকে বের হয়ে আসছে।

আলোচিত তিনটি বিষয় ছাড়াও বৈদেশিক সম্পর্কের ইস্যু আছে আরও অনেক। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক, শ্রমবাজার, মানবাধিকার, বাণিজ্য সম্পর্ক, বৈদেশিক বিনিয়োগ ইত্যাদি। এসব নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। ২০১৯ সালে এর কোনোটিতেই বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। বছরটি পার হয়েছে গতানুগতিক ধারায়।

আসন্ন বছরের চিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট এবং ২০১৯ সালের ঘটনাপ্রবাহ পুরোনো প্রবাদকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে রাষ্ট্রের জন্য কেবল স্বার্থই হচ্ছে স্থায়ী, বন্ধু বা শত্রু নয়। সংকটকালে ‘পরীক্ষিত বন্ধুরা’ পাশে দাঁড়ায়নি, এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই আগামী সময়ের রণকৌশল নির্ধারণ করতে হবে আমাদের। কাউকে শত্রু না বানিয়ে খুঁজতে হবে নতুন বন্ধু, নতুন সমীকরণ, যা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে। নতুন বছরে এটাই হবে বৈদেশিক সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ।

  • মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
  • কার্টসি - প্রথম আলো/২৯ ডিসেম্বর ২০১৯