কাদির কল্লোল
বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নিখোঁজ নেতাকর্মীদের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠাটিতে তাদের কথা বলেন।
"আমার মেয়েটা ভুলে গেছে তার বাবার কথা। এখন তাদের কাছে তাদের বাবা একটা গল্প । আগে যেমন আমরা ছোটবেলায় দাদি-নানীদের কাছে গল্প শুনতাম, এখন ওরা দু'জন ওদের বাবার গল্প শোনে।"
কথাগুলো ঢাকার বংশাল এলাকার একজন নিখোঁজ বিএনপি নেতার স্ত্রী ফারজানা আকতারের।
তার অভিযোগ, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে তার স্বামীকে গুম করা হয়েছে।
দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ফারজানা আকতার বুধবার উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকায় বিএনপির মানবাধিকার সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে।
"আমার স্বামী ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বরে গুম হয় ঢাকা শাহবাগ এলাকা থেকে। আমি তখন গর্ভবতী ছিলাম। আমার সেই ছেলে এখন স্কুলে যায়, সে তার বাবাকে দেখেনি। আর আমার মেয়েটারও বয়স তখন ছিল দুই বছর।"
ফারজানা আকতার বলছিলেন, তার দুই শিশু এখন বাবার গল্প শুনে শুনে বড় হচ্ছে - এই বাস্তবতা তার মেনে নিতে কষ্ট হয়।
"এই এখন আমাদের জীবন, বড় কষ্টের" - বলেন ফারজানা আকতার।
'কোন সাহায্য পাই নি'
নিখোঁজ হওয়া আরেক বিএনপি নেতা খালিদ হাসানের স্ত্রী সৈয়দা শাম্মী সুলতানাও এসেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে, তার ৭ বছর বয়সী শিশু সন্তানকে নিয়ে।
তার স্বামী ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার একটি ওয়ার্ড বিএনপির একজন নেতা ছিলেন। সৈয়দা শাম্মী সুলতানার অভিযোগ, সাত বছর আগে তার স্বামী খালিদ হাসান গুম হয়েছেন।
একটি মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন খালিদ হাসান। যেদিন তার জামিনে মুক্তি মেলে, সেদিনই কারাগারের সামনে থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হয়েছিল।
সৈয়দা শাম্মী সুলতানা বলেছেন, তার স্বামীর গুম হওয়ার অভিযোগ নিয়ে তিনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীগুলোর কাছে বার বার গেছেন, কিন্তু সেভাবে সাহায্য পাননি।
"কারাগারের সামনে থেকে গুম হলো, সেখানে সিসিটিভির ফুটেজ দেখলে হয়তো বের করা যেতো। কিন্তু কোনো সাহায্য পাই নি।"
বিএনপি দাবি করছে, গত ১০ বছরে তাদের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, ৩০০'র বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে।
বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নিখোঁজ নেতাকর্মীদের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠাটিতে তাদের কথা বলেন। তাদের অনেকেই প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন।
আবার অনেকে এখনও আশা নিয়ে থাকতে চান।
বিএনপির এই প্রতিবেদনের ভিত্তি কী
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি দাবি করছে, গত ১০ বছরে তাদের অন্তত ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, এবং এই সময়ে তাদের ৩০০'র বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দলটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে।
গত দশ বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকারের চিত্র তুলে ধরে বিএনপি তাদের একটি প্রতিবেদন বই আকারে প্রকাশ করে।
বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে এই প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে গুম বা নিখোঁজ হওয়া বিএনপির নেতা কর্মীদের পরিবারের সদস্যরা তাদের কথা তুলে ধরেন।
তারা বলেছেন, তাদের অনেকের শিশু সন্তানরা গুম হওয়া বাবার গল্প শুনে বড় হচ্ছে এবং এই বাস্তবতাকে তারা জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময় হিসেবে দেখছেন।
এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই বিএনপি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের অধিকার খর্ব হওয়া এবং নারী-শিশুদের অধিকারসহ সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার লংঘনের চিত্রও দলটি তুলে ধরে।
এই প্রতিবেদন যারা তৈরি করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী শামা ওবায়েদ । তিনি বলছিলেন, তারা সংবাদমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছ থেকেও তথ্য নিয়েছেন।
বিএনপির প্রতিবেদনে বলা হয়,গত ১০ বছরে রাজনৈতিক কারণে তাদের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ মামলা করা হয়েছে।
"রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানবাধিকার লংঘন করা হচ্ছে"
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানবাধিকার লংঘন করে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। সেই চিত্রই তারা তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
"দেশে যখন ৩৫ লাখ মানুষ আসামী হয়, তখন পরিস্থিতিটা কি তা বোঝা যায়। আজকে মানবাধিকার, কথা বলার স্বাধীনতা না থাকা বা সামগ্রিকভাবে যে পরিস্থিতি ১০ বছরে আমরা দেখছি, এর মুল কারণই হচ্ছে আমরা একটা অর্থবহ নির্বাচন করতে পারছি না" - বলেন মি.আলমগীর।
তিনি বলেন, "আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থাও পাল্টিয়ে ফেলেছে"
বিএনপির এই অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের ঢাকায় কর্মরত অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
- বিবিসি বাংলা/ ১১ ডিসেম্বর ২০১৯
No comments:
Post a Comment