Search

Sunday, December 8, 2019

ব্যাংক খাতে অশনিসংকেত

মুঈদ রহমান


শিরোনামটি গত ২৯ নভেম্বরের যুগান্তর থেকে ধার নিয়েছি। ধার করায় আমার লজ্জা লাগেনি। কেননা ব্যাংকিং খাতের যে ভয়ংকর চিত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তাতে লাজলজ্জার বিপরীতে আতঙ্ক আর ভয়াবহতাই বেশি কাজ করছে। খেলাপি ঋণ, ফোর্সড লোন আর ঋণ জালিয়াতিতে ভেঙে পড়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আমরা সবাই জানি, আর্থিক লেনদেন হচ্ছে একটা আস্থা ও বিশ্বাস। এখানে সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো সুযোগ নেই। আপনি যদি বছর চারেক আগের কথা আমলে নেন তাহলে দেখবেন, ‘পৃথিবীতে মোট অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু বিশ্বের সব মুদ্রা আর ব্যাংক নোটের মূল্যমান ৬ ট্রিলিয়ন ডলারেরও কম।

অর্থাৎ আমাদের ৯০ শতাংশের বেশি অর্থ বা আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রদর্শিত ৫০ ট্রিলিয়নেরও অধিক অর্থের অস্তিত্ব আছে শুধু কম্পিউটার সার্ভারে। ফলে, বেশিরভাগ ব্যবসায়িক লেনদেন এক কম্পিউটার থেকে অন্যটিতে ইলেক্ট্রনিক তথ্য স্থানান্তরের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়, বাস্তবিক কোনো ক্যাশ বিনিময় ছাড়াই’ (ইয়ুভাল নোভাল হারারি, স্যাপিয়েন্স; পৃষ্ঠা : ১৯৪)। এটা এক ধরনের বিশ্বাস ও আস্থার ওপর স্থাপিত। তাই মাঝে-মধ্যে আমেরিকার অর্থনীতিতে অস্বাভাবিক পতন ঘটলে ডলারের দাম পড়ে যায়, মানুষ তখন ইউরো খোঁজে। আস্থাহীনতাই মানুষকে বিকল্প পথে যেতে বাধ্য করে। আমরা আশা করব সরকার যেন আর্থিক খাতে মানুষের আস্থাকে সমুন্নত রাখে।

সরকারের ভুল নীতির কারণে ব্যাংগুলোতে খেলাপি ঋণের মাত্রা লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর, এ ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। হিসাবমতে, মোট প্রদত্ত ঋণের প্রায় ১২ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অবলোপিত প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা হিসাবের বাইরেই রাখা হয়েছে। বর্তমান সরকারের দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নেয়ার শুরুতে অর্থাৎ ২০০৯ সালে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। কী করা যায়। সে সময়েও খেলাপিদের সুবিধা দিয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা জারি করে। ১১টি শিল্প গ্রুপের মোট ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল।

কিন্তু দুঃখজনক এবং খুব স্বাভাবিক দৃশ্য হল ১১টির মধ্যে মাত্র ২টি শিল্প গ্রুপ ছাড়া বাকি ৯টি গ্রুপ টাকা পরিশোধ করছে না। এত সুবিধা দেয়ার পরও ২০১৮ সাল নাগাদ খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এ তো হিসাবের কথা। অবলোপন ঋণ, যেটা কিনা আলাদা লেজারে স্থিতি অবস্থায় আছে, কোনোদিন সম্ভব হলে সুদসহ আদায় হবে, তার পরিমাণ ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। তাহলে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়াল ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরিমাণটা আমাদের ২০১৮-১৯ সালের বাজেটের প্রায় ৩৫ শতাংশ। ভাবা যায়! আর্থিক খাতের এমন দুর্দশা মেনে নেয়া যায় না। একের পর এক সুবিধা দিয়েও কোনো ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

এমনটি আয়করের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। শত সুবিধা সত্ত্বেও খুব কম লোকই কালো টাকা সাদা করেছেন। এমন হওয়ার কারণ হল কোনো যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ার সংস্কৃতি। ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেন, এ খেলাপিদের তোয়াজ না করে তাদের গতি নেই। তাহলে কি তাদের প্রতি ওপর মহল কোনো অশুভ দায়ে দায়বদ্ধ! এমন আশঙ্কা দূরে রাখার মতো কোনো স্বচ্ছ উদাহরণ তো আমরা দেখিনি। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইউজিসি প্রফেসর মইনুল ইসলামের বক্তব্য পরিষ্কার- ‘ঋণখেলাপিদের অন্যায্য সুবিধা দেয়ার জন্য এসব খামখেয়ালিপনা হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী হিসেবে খেলাপিদের এসব সুবিধা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। মনে হচ্ছে সময়টা ঋণখেলাপিদের। নতুন সিদ্ধান্ত খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রভাব ফেলবে না, বরং একে খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত বলা যায়। ঋণখেলাপিদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। উচ্চ আদালতে যেন বেশিদিন সুবিধা না পায়, তারও উদ্যোগ নিতে হবে’ (প্রথম আলো, ২৬.০৩.২০১৯)। আমরাও তার সঙ্গে একমত। কারণ এ টাকা সাধারণ মানুষের টাকা। আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় ভোগ অসম্পূর্ণ রেখে টাকা ব্যাংকে রাখি। সেই টাকার নিশ্চয়তা আমরা চাইবই। সরকারের দুর্বল আচরণের সুযোগে বেড়ে উঠছে খেলাপি ঋণের পাহাড়।

আরেকটি শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ফোর্সড লোন’। ‘পণ্য আমদানির (ঋণপত্র বা এলসি) বিপরীতে বিদেশি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়ে থাকে দেশি ব্যাংক। দেশে আমদানি পণ্য আসার পর শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক টাকা পরিশোধ করলে ওই অর্থ বিদেশি ব্যাংককে দেশি ব্যাংক পরিশোধ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক কোনো কারণে অর্থ পরিশোধ না করলে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী গ্রাহকের নামে ব্যাংক ফোর্সড বা বাধ্যতামূলকভাবে সমপরিমাণ ঋণ সৃষ্টি করে। ওই অর্থে ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের দেনা শোধ করে। এভাবে ব্যাংক গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে। মূলত আমদানির বিপরীতেই এসব ফোর্সড লোন সৃষ্টি করা হয়েছে’ (যুগান্তর, ০১.১২.২০১৯)।

রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকে গত জুন পর্যন্ত ফোর্সড লোন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ফোর্সড লোন দিয়েছে জনতা ব্যাংক, ৫ হাজার ৬৮০ কেটি টাকা। ডিসেম্বর ’১৮ থেকে জুন ’১৯- এই ৬ মাসে জনতা ব্যাংকের ফোর্সড লোন বেড়েছে ৪৬৭ কোটি টাকা। এ নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘ফোর্সড লোন বেশিরভাগই হচ্ছে ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে। এ ধরনের ঋণ যাতে আর না বাড়ে সেজন্য ব্যাংকগুলোর আরও যাচাই-বাছাই করে এলসি খোলা উচিত। ফোর্সড লোন বেড়ে যাওয়া কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়।’

ব্যাংক খাতে তৃতীয় অভিশাপটি হল ‘ঋণ জালিয়াতি’। সম্প্রতি বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক এ অপকর্মটি করেছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা নাফ ট্রেডিংয়ের নামে ৬৫০ কোটি টাকা এবং একই ব্যাংকের মহাখালী শাখা হাসান টেলিকমের নামে ৩৩৫ কেটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে। অবাক কাণ্ড হল ওভার ভেল্যুয়েশনের কথা বাদ দিলেও ‘নাফ ট্রেডিং’ নামের কোনো কোম্পানির অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণের টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

অপর কোম্পানি হাসান টেলিকম পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণ মঞ্জুর করালেও কোনো পণ্য আমদানি না করেই ঋণের টাকা ছাড় করিয়ে নিয়েছে। এমন জালিয়াতি বিরল বলে দাবি করেছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের ওপর একটি তদন্ত পরিচালনা করে। সেখান থেকেই এ ধরনের জালিয়াতির তথ্য প্রকাশিত হয়। সাধারণ মানুষের ঘামঝরা আয়ের আমানত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কোনো ব্যাংকের নেই। এ ধরনের খবর আমাদের মনে হতাশার জন্ম দেয় বৈকি!

ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের অব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে- ঋণের উচ্চ সুদের কারণে খেলাপি হচ্ছে, নাকি খেলাপিদের কারণে উচ্চ সুদ কমানো যাচ্ছে না? এ প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী ও ব্যাংকারদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে এবং তা বলতে পারেন সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থমন্ত্রী সরাসরিই বলেছেন, আমাদের দেশে ঋণখেলাপি হওয়ার প্রধান কারণ হল ডাবল ডিজিট সুদ। ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে এ মাত্রায় সুদহারের পরিবর্তে আগামী জানুয়ারি থেকে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার পক্ষে রায় দেয়।

অপরদিকে এফবিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেছেন, ‘এক অঙ্কের সুদের হারের কথা এক-দেড় বছর ধরে শুনছি। কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। একেকবার একেক কথা বলা হচ্ছে।’ যিনি উদ্যোক্তা তিনি তো চাইবেনই স্বল্প মাত্রার সুদ। কিন্তু তারপরও উদ্যোক্তারা মনে করেন, খেলাপি হওয়াটা অনেকটাই ইচ্ছাকৃত এবং রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত।

ব্যাংকারদের কথাও আমলে নিতে হবে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি এম শহীদুল ইসলামের বক্তব্য হল, ‘তহবিল ও পরিচালনা খরচ মিলেই ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের টাকা খেলাপি হয়ে পড়লে বড় সমস্যায় পড়তে হয়। ওই টাকার জন্য অন্য আয় থেকে সঞ্চিতি রাখতে হয়। আমানতকারীদেরও টাকা দিতে হয়। এসব কারণে সুদহার বেড়ে যায়। খেলাপি ঋণ কমে এলে সুদহার কমে আসবে।’

তাহলে আমাদের মতো সাধারণ আমানতকারীদের অদৃষ্টে কী লেখা আছে? অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে থেকে সার্বিক অর্থনীতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। তা না হলে আমরা হতাশার মধ্যেই ডুবে থাকব।

  • মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসি - যুগান্তর/ ডিসেম্বর ৮, ২০১৯ 

No comments:

Post a Comment