Search

Tuesday, December 17, 2019

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই প্রশাসনিক ও প্রায়োগিক হতে হবে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ


ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

একটি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ভীষণ তাত্পর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে এর নিবিড় সংযোগ বিদ্যমান এবং অন্যান্য খাত যেমন—ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, রফতানি, আমদানির পাশাপাশি অধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রভাব এড়াতে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অধীনস্থ ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকারিতা সরাসরি সংস্থাটির স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

বিষয়টি প্রশাসনিক সমস্যাকে ঘনীভূত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার আধুনিক ধারণাটি বিকশিত হয়। ১৯২৯-৩৯ সালের মহামন্দার পর আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নির্ধারণ এবং আর্থিক নীতি সম্পাদনের ক্ষমতা দেয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মূল্যস্ফীতির জোয়ারের ফলে বেশির ভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতিগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে সফল হয়। তবে সে সময় প্রেসিডেন্ট রিগানের চিফ অব স্টাফ ডোনাল্ড রেগান যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পল ভলকারকে ১৯৮৪ সালের নির্বাচনের আগে নীতিমালার হার না বাড়ানোর পরামর্শ দেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে সেদিনের মিটিং থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ভলকার, তবে সে পরামর্শ মোতাবেক নীতি গ্রহণ পরবর্তী সময়ে স্বল্প মূল্যস্ফীতি ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণ হয়। ফলস্বরূপ অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার ওপর জোর দেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রথমটি স্বাধীনতার লক্ষ্য, দ্বিতীয়টি কার্যসম্পাদনে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোয়, বিশেষ করে সরকারের অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে। প্রধান লক্ষ্যগুলো, বিশেষ করে মূল্য স্তর (মূল্যস্ফীতি) ও প্রবৃদ্ধির রক্ষণাবেক্ষণকে সাধারণত প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা-ই হোক, প্রবৃদ্ধি হার এবং মূল্যস্ফীতির হার আর্থিক স্থিতিশীলতা ও দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারের বিস্তৃত নীতি পরামর্শ দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (ফেড) সম্ভবত সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড রাজস্ব দপ্তরের মন্ত্রীদের দ্বারা প্রভাবিত থাকায় পুরোপুরিভাবে স্বাধীন ছিল না। ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলোর হয়ে সুদের হার পর্যবেক্ষণ করে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। তবে বর্তমানে আমেরিকা সরকার সুদের হার কমানোর জন্য ফেডের ওপর যারপরনাই চাপ প্রয়োগ করছে, যা ফেডকে ঘিরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের লক্ষণ। ব্যাংক অব জাপান ২০১৩ সালে সরকারের সঙ্গে নীতি সমন্বয় করতে রাজি হয়, পদক্ষেপটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা হ্রাস করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিষয়টি বিতর্কযোগ্য, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা-ই হোক না কেন, ব্যাংকের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নত আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। তাই ব্যাংককে তার সব কার্যকরী ও সিদ্ধান্তগত কার্যক্রমে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হতে হবে।

পারস্পরিক নির্ভরতাবিষয়ক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে কৃতিত্ব দেয়া থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হবে; এটি সরকারের ওপর নির্ভর না করেই তার ব্যয় নির্বাহ করতে পারে কিনা; গভর্নর কিংবা পরিচালক পর্ষদ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কিনা; মুদ্রানীতি অনুসরণে গভর্নর স্বাধীন কিনা; আর্থিক সরঞ্জাম নির্বাচনে এটি কতটা স্বাধীন, সর্বোপরি এটি ব্যাংকিং নীতি ও ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত কিনা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং অর্থ সংক্রান্ত—এ তিনটি বিষয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ততা মূল্যের স্থিতিশীলতা, স্বাধীন পরিচালক পর্ষদ যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্বাচিত হবেন, যাদের অন্যদের থেকে পৃথক করা হবে, সংসদ ও আইনসভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের জবাবদিহিতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি লক্ষ্যকে ধারণ করবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি গঠনের ইঙ্গিত দেয়। আর্থিক স্বাধীনতা জোর দেয় হিসাবের স্বচ্ছতা, বিচক্ষণতার নীতি অনুসরণ, আর্থিক ভর্তুকি যেমন পছন্দসই সুদের হার, বিনিময় হারের গ্যারান্টি, নগদ অলাভজনক বিতরণ ও লোকসানের সংযোগ সীমাবদ্ধকরণ এবং ব্যাংকের নিট সম্পদ। সুতরাং স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই প্রশাসনিক ও প্রায়োগিক হতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে আর্থিক নীতি সম্পাদন, ব্যাংকারদের ব্যাংক, সরকারের ব্যাংকার ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধান। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (বিওই) মূলত মুদ্রানীতিমূলক কার্যাদি নিয়ে কাজ করে, এছাড়া অন্যান্য কার্য প্রুডেনশিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (পিআরএ) এবং ফিন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়; যারা সার্বিকভাবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নির্দেশনা অনুসারিত এ দুটি স্বতন্ত্র সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই দ্বৈত কার্যাদি সম্পাদন করতে হয়। সুতরাং এর কাজের পরিধি বিশাল। অন্য সেক্টরগুলোর পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্ষমতা নিবিড়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পারফরম্যান্সের সঙ্গে সংযুক্ত।

নিচে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো উল্লেখ করা হলো, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজগুলোকে বর্ণনা করে।

লক্ষ্য: কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ক্রমাগত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ নৈতিক মানসম্পন্ন দক্ষতা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পেশাদারিত্ব অর্জন, মূল্য স্থিতিশীলতা ও আর্থিক ব্যবস্থার দৃঢ়তা বজায় রাখতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক খাতে তদারকি, দ্রুত ও বিস্তৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন, কর্মসংস্থান তৈরি এবং বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন।

উদ্দেশ্য: দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্য অনুসারে নিম্নে উল্লিখিত কার্য সম্পাদন করে চলেছে:

১. আর্থিক ও ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন; ২. মুদ্রা পরিচালনা ও পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ; ৩. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিচালনা করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ৪. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, অর্থ, মুদ্রা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতিসম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ ও প্রভাব সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো যথাযথ হলেও এগুলোকে কার্যে পরিণত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রসঙ্গে মূল তর্কটা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিতর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ছাড়াই আর্থিক নীতি বাস্তবায়িত করতে পারে কিনা। বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্বগত সীমাবদ্ধতা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নন-পারফর্মিং লোন বৃদ্ধি, সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার পরিণতি হিসেবে ব্যাংকের ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমেছে। অবস্থা বিশ্লেষণে মনে হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত অভ্যন্তরীণ (ব্যাংকের মধ্যকার সমস্যা) এবং বাহ্যিক (ব্যাংকের পরিধির বাইরে) উভয় ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যাংকিং খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন বলে মনে হচ্ছে। চাপ প্রদানকারী সংগঠনগুলো যেমন ব্যাংক মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার (বিএবি), ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোয়িসেশন অব ব্যাংকার, বাংলাদেশ (এবিবি) ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি ব্যাংকের স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির বিষয়টি চিহ্নিত করা জরুরি। যার মানে ব্যাংককে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ কিংবা পুরোপুরি তাদের হাতে স্বাধীনতা ছেড়ে দেয়া উচিত নয়, যা প্রায়ই ব্যাংকিং বিপর্যয়ের কারণ হয়। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ফরাসি অর্থনীতিবিদ জাঁ তিহল তার সহকর্মীকে নিয়ে যৌথভাবে লেখা একটি বইয়ে বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আর্থিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে যাচ্ছি, তা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমানতকারী, বিনিয়োগকারী, সাধারণ জনগণ এবং প্রকৃত অর্থনীতিকে (প্রকৃত পণ্য ও পরিষেবা) সুরক্ষিত করা। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মতান্ত্রিক ঝুঁকির ডমিনো ইফেক্ট (ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকা প্রভাব) হ্রাস করা, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি নষ্ট করে প্রকৃত আউটপুট, নিম্ন প্রবৃদ্ধি, উচ্চ বেকারত্ব এবং মানবকল্যাণ কার্যক্রম হ্রাসের পরিণতি ডেকে আনে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির সবচেয়ে যথাযথ উদাহরণটি হচ্ছে সোনালী ও বেসিক ব্যাংকে কেলেঙ্কারি; যেখানে ঋণগ্রহীতা এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের আঁতাতে অস্বচ্ছ পন্থায় জনসাধারণের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এ ধরনের জালিয়াতির জন্য যারা দায়ী, তাদের এখন পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপের আওতায় আনা হয়নি, বরং তাদের ‘বিকৃত প্রণোদনা’ দেয়া হয় এবং ওই ব্যাংক কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সৎ কর্মীদের প্রান্তিকীকরণ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ‘দ্বৈত’ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক যেমন সোনালী, রুপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যাংক লিমিটেড), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) এবং কয়েকটি সংবিধিবদ্ধ ব্যাংক যেমন আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক আর কর্মসংস্থান ব্যাংকগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংক, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ন্ত্রণের এ দ্বৈততার ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর জন্য অসমন্বয়সাধিত ও প্রায়ই দুর্বল নীতিগত পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ওই ব্যাংকগুলোয় বিচক্ষণ ও পরিচালনা মান কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা ‘ডমিনো ইফেক্ট’-এর মাধ্যমে গোটা ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল ও অরক্ষিত করে তুলছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতি কোনোভাবেই বিশ্বব্যাপী মন্দা অথবা বৃহত্তর অর্থনীতির নেতিবাচক নীতি থেকে প্রভাবমুক্ত নয়, সুতরাং বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বিকাশের একটি শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। 

জি২০-এর মতো ফোরামে বাংলাদেশের সমপর্যায়ের রাষ্ট্রগুলোকে পুনরুদ্ধারের মতো স্থিতিশীলতায় একই ধরনের অগ্রাধিকার প্রাপ্তির পাশাপাশি লক্ষণ মোকাবেলার বাইরে স্থিতিশীল কাজের এজেন্ডার জন্য (যেমন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির অপ্রতুলতা) অন্তর্নিহিত কারণগুলো সম্বোধন করতে (যেমন শিথিল নীতি, বিচক্ষণতা ও পরিচালনার মান না মেনে চলা, দুর্বল আর্থিক প্রতিবেদন, নিরবচ্ছিন্ন তারল্য প্রসারণ, যা বুদ্বুদগুলোকে সঞ্চারিত করে) জোরালো যুক্তি প্রদান করতে হবে। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের নেপথ্য কারণ ছিল বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতা, ধসটি নিয়ন্ত্রণের মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে বিচক্ষণতা ও পরিচালনা মান বাস্তবায়নের বাইরে চলেছে। একটি স্বাধীন ও কার্যকর বাংলাদেশ ব্যাংক রাখার জন্য তিনটি বড় পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজনীয়: (১) ব্যাংকিংয়ের মূল বিষয়গুলোকে আরো বেশি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে একটি শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক, (২) বহিরাগত রাজনৈতিক/ প্রশাসনিক চাপের কারণে ঘন ঘন পরিবর্তনের সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচক্ষণ ও পরিচালনার মানদণ্ডগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং (৩) সংকট তৈরির জন্য এবং একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকে বা গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি/ প্রশাসনিক পদক্ষেপের জন্য তাত্ক্ষণিক সংশোধনমূলক ব্যবস্থা।

বাস্তববিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন সহজেই অর্জিত হয় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উচিত রাজনৈতিক ও অন্যান্য বাহ্যিক চাপ কমাতে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং নিজেদের কর্মকাণ্ড ঘিরে জনসমর্থন অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। ভালো বা খারাপ সময় যা-ই হোক না কেন, তত্ত্বাবধায়করা সর্বদা লবিস্ট ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা চাপের মুখোমুখি হন, যা আর্থিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বকে দুর্বল করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক ও বাস্তববাদী নীতি, বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা বিধি থাকতে হবে এবং তা নিশ্চিত করতে হবে, সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তা অনুসরণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন রক্ষার জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা ক্ষমতা’ বা ‘অ্যাড-হক’ ব্যবস্থা এড়ানো উচিত। ‘নীতি’ বনাম ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে দৃঢ়তার সঙ্গে সমাধান করতে হবে, যেখানে নীতি ও বিধিগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে—কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার অযৌক্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ চলবে না। উচ্চ প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংস্কারের বিপদ এড়াতে যথাযথ পেশাদারি অবস্থান প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারসাম্য বজায় রাখার সময় এসেছে।

  • ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক/বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
  • কার্টসি  —  বণিক বার্তা/ ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯

No comments:

Post a Comment