Search

Sunday, December 1, 2019

ধানের দাম না বাড়লে চালের দাম বাড়বে কেন?

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

গত ২০ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে চালকল মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। দেশে প্রায় ২ কোটি ৮৪ লাখ ১৬ হাজার ৭১০ টন চালের বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৩ কোটি ৪৪ লাখ টন। এ মুহূর্তে সরকারের বিভিন্ন গুদামে মজুদ রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৭০৭ টন, যার মধ্যে চালের পরিমাণ ১১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৩ টন। তাই পণ্যটির দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তিনি আরো বলেছেন, ধানের দাম বাড়েনি। তাই চালের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। ধানের দাম বাড়লে কৃষক কিছুটা লাভবান হতেন, কিন্তু তা হয়নি। কৃষক লাভ পাবেন না, কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা সব লাভ নিয়ে যাবে, সেটা চলতে দেয়া যাবে না। 

উল্লেখ্য, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে হঠাৎ করে মোটা ও চিকন চালের দাম বেড়ে যায়। কেজিতে সব ধরনের মোটা চালের দাম ৬ টাকা পর্যন্ত এবং চিকন চালের দাম ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। আর বস্তাপ্রতি বিভিন্ন জাতের চালের দাম ৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। দেশে চালের ‘পর্যাপ্ত মজুদ’ থাকা অবস্থায় আমনের ভরা মৌসুমে চালের দামে ঊর্ধ্বগতির জন্য কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), ধান-চালের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিসহ পাইকারি চালের আড়তদাররা চালকল মালিকদের দায়ী করেন।
মো. আবদুল লতিফ মন্ডল


গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সরকার চলতি আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ধান-চাল সংগ্রহের নীতিমালা ঘোষণা করে। এতে ১০ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহ করার ঘোষণা দেয়া হয়; যার মধ্যে ছয় লাখ টন ধান, সাড়ে তিন লাখ টন সিদ্ধ ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল। প্রতি কেজি ধানের দাম নির্ধারিত হয় ২৬ টাকা, আর সিদ্ধ ও আতপ চালের কেজিপ্রতি দাম ধরা হয় যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৫ টাকা। ২০ নভেম্বর থেকে ধান এবং ১ ডিসেম্বর থেকে চাল কেনা শুরু হয়ে এ কার্যক্রম ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ নভেম্বর ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এবার আমন ধান ও চাল সংগ্রহে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে ব্যতিক্রমধর্মী বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। এর কারণ এক. বেশ কয়েক বছর পর এবার আমন মৌসুমে সরকার ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিল। কৃষকদের কাছ থেকে সংগৃহীত ধান সরকার চুক্তিবদ্ধ মিলারদের দেবে নির্ধারিত দামে খাদ্য অধিদপ্তরকে চাল সরবরাহের জন্য। দুই. সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত মোট ১০ লাখ টন চাল তৈরির জন্য যে ধান ক্রয় করা প্রয়োজন হবে, তার বেশির ভাগ কেনা হবে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। আর সরকার নির্ধারিত দামে খাদ্য অধিদপ্তরকে চাল সরবরাহ করতে যেসব চালকল মালিক দপ্তরটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন, তারা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় অবশিষ্টাংশ ধান কিনবেন।

অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য হলো ধান কাটা এবং ঘরে তোলার মৌসুমে বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা, যাতে ধানচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং অধিক পরিমাণে ধান উৎপাদনে উৎসাহিত হন। অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে সরকারি গুদামে চালের নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা, বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে দাম স্থিতিশীল রাখা এবং সরকারের লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা।

২০ নভেম্বর চালকল মালিকদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠিত বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা পুরোপুরি গণমাধ্যমে আসেনি। বৈঠক শেষে খাদ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের যা বলেছেন, শুধু তা-ই গণমাধ্যমে এসেছে। চালকল মালিকরা বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রীর কাছে কী প্রস্তাব রেখেছেন, তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। তবে বৈঠকে চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে চালের সংগ্রহ মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ চালকল মালিকদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার দু-একদিন আগে দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চালের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে ধানের দাম বৃদ্ধি ও চাহিদা অনুযায়ী হাটবাজারে ধানের সরবরাহ না থাকাকে দায়ী করা হয়েছে। তবে চালের দাম বাড়ার পেছনে তাদের এ  যুক্তি যে সঠিক নয়, তা খাদ্যমন্ত্রীর ‘ধানের দাম বাড়েনি’ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

চলতি শতকের শুরুতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালনকালে আমি লক্ষ করেছি চালকল মালিকরা কীভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। চালকল মালিকরা শুধু সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা লুটেন না, তারা অভ্যন্তরীণ ধান-চাল (আমন ও বোরো) সংগ্রহে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তারা অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহে চালের উচ্চমূল্য দাবি করেন এবং ধান কেনায় সরকারকে নিরুৎসাহিত করেন অথবা ধানের দাম কম রাখার জন্য সরকারকে চাপ দেন। কারণ সরকার ধান না কিনলে ধানের দাম কম থাকে এবং তারা কম দামে ধান কিনে বিপুল মজুদ গড়তে পারেন। ধান কাটার মৌসুম শেষে যখন দেশের মোট চাষীর প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীর কাছে ধান মজুদ থাকে না, তখন তারা মজুদ ধান চালে রূপান্তর করে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চমূল্যে পণ্যটি বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেন। চলমান আমন মৌসুমে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ৬ লাখ টন ধান কেনার সরকারি সিদ্ধান্তটি চালকল মালিকরা যে ভালোভাবে নেননি, তা বোধ হয় অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। 

কয়েকদিন আগে একটি দৈনিকে (যুগান্তর) প্রকাশিত আমার এক নিবন্ধে বলেছিলাম, ‘গত বছরের মতো এ বছরও চালকল মালিকদের কাছ থেকে সংগৃহীতব্য আমন চালের কেজিপ্রতি দাম ৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পার্থক্য হলো, এবার চালকল মালিকদের কাছ থেকে সংগৃহীতব্য অধিকাংশ চালের জন্য সরকার ধান কিনে তাদের সরবরাহ করবে। গত কয়েক বছর সরকার আমন ধান না কেনায় এবং ধানের দাম নির্ধারণ করে না দেয়ায় চালকল মালিকরা কম দামে ধান কেনার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, এবার তা থেকে তারা কিছুটা হলেও বঞ্চিত হবেন। তাই এবার কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা দরে সরকারকে চাল সরবরাহে তারা কতটা সহযোগিতা করবেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’ সরকারকে আমন চাল সরবরাহের সময়সূচি এখনো শুরু না হলেও চালের দাম বাড়িয়ে তারা এরই মধ্যে তাদের মনোভাব কিছুটা প্রকাশ করেছেন। ধান কাটা-মাড়ার মৌসুম শেষে যখন চুক্তিবদ্ধ চাল সরবরাহের সময় ঘনিয়ে আসবে, তখন তারা আগের মতো চালের দাম বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। চালের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যাবে না বলে খাদ্যমন্ত্রী যে যুক্তিসংগত অবস্থান নিয়েছেন, তিনি তাতে কতদিন অনড় থাকতে পারেন তা এখন দেখার বিষয়।   

তাছাড়া চলমান অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালায় সরকার চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চলমান নীতিমালায় অভ্যন্তরীণভাবে চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উৎস নেই। ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্যনীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার নির্দেশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চালকল মালিকরা এ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে আসছেন। এ সুযোগের অংশ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকরা এর আগে একাধিকবার ধানের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে চাল সংগ্রহ মৌসুমে সরকারকে চাল সরবরাহে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং সরকার সংগৃহীতব্য চালের দাম বাড়ানোর পরই তারা চাল সরবরাহ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। ২০১০ সালে বোরো মৌসুমে চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারিত হয় প্রতি কেজি ২৫ টাকা। তদানুযায়ী চাল সরবরাহের জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চালকল মালিকদের চুক্তি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের অল্পদিনের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা বাজারে ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে নির্ধারিত দামে চাল সরবরাহে অস্বীকৃতি জানান এবং চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। সরকার তাদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে কেজিতে চালের দাম ৩ টাকা বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ কেজিপ্রতি চালের সংগ্রহ মূল্য পুনর্নির্ধারিত হয় ২৮ টাকা। বিষয়টি নিয়ে তখন বাজারে নানা রকম গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। আমন চাল সংগ্রহের চলতি মৌসুমেও তারা অনুরূপ একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারেন।

যেহেতু ধানের দাম বাড়েনি, সেহেতু সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকদের মাধ্যমে সংগৃহীতব্য চালের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। মনে রাখতে হবে সরকারের সংগৃহীতব্য চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খোলাবাজারে বাড়বে চালের দাম। তাছাড়া ভোক্তার দিকটাও দেখতে হবে। চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় শক্তির ৭০ শতাংশ জোগান আসে ভাত থেকে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন শ্রমিক, মজুর, ধান কাটার মৌসুম শেষে চাল-ক্রেতায় পরিণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীসহ ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চাল কিনে খায়। চালের মূল্যবৃদ্ধিতে চালকল মালিক, আড়তদার, চাল ব্যবসায়ী এবং বড় কৃষক ছাড়া অন্য সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

  • আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব
  • কার্টসি — বণিক বার্তা/  ডিসেম্বর ০১, ২০১৯

No comments:

Post a Comment