আমিরুল আলম খান
গত কয়েক দিনে ঢাকার আকাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা। হেমন্ত, শীতে কুয়াশা থাকে। তাই তেমন বিচলিত হইনি। কিন্তু নাক-চোখ জ্বলছিল, শ্বাস নিতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল। ভাবছিলাম, বয়স বেড়েছে, তাই এসব লক্ষণ। কিন্তু প্রথম আলো (২৫ নভেম্বর, ২০১৯) প্রথম পাতায় একই সঙ্গে দুটি খবর আর ভেতরে সম্পাদকীয় লিখে জানিয়ে দিল আসল সমস্যা অনেক গভীর এবং তা খুবই মারাত্মক। ইফতেখার মাহমুদের রিপোর্ট, ‘ঢাকা কাল ছিল সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর’ এবং রাজীব হাসানের ‘ঢাকার গাছপালাও বড় বিপদে’, সঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্য ‘কারও কি কোনো দায়িত্ব নেই? বায়ুদূষণের বাড়াবাড়ি’ পড়ে রীতিমতো ভড়কে গেলাম। রিপোর্ট দুটির শিরোনামই উদ্বেগ তৈরির জন্য যথেষ্ট।
এদিনের রিপোর্ট ঢাকার বাতাস কতটা দূষিত তার ওপর। দুনিয়াব্যাপী বাতাসে দূষণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল। নভেম্বর মাসের আট দিনের বেশির ভাগ সময় ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে দূষিত। এই তালিকায় আরও আছে কলকাতা, দিল্লি, করাচি, বেইজিং, উলানবাটোর। এসব শহরের দূষণের মাত্রা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায় প্রায়ই।
কিন্তু দুশ্চিন্তার আরও কারণ আছে। শুধু ঢাকা নয়, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সাভার, ময়মনসিংহ, রংপুরের বাতাসের মানও খুব খারাপ ছিল এদিন। বোঝা যাচ্ছে, সারা দেশের বাতাস মাত্রাতিরিক্ত দূষিত। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের বাতাসের মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। ঢাকায় এদিন বাতাসের গড় মান ছিল ২২০; কিন্তু কারওয়ান বাজারে তা ছিল ভয়াবহ মাত্রায় বেশি, ২৯৮! আন্তর্জাতিক হিসাবে বাতাসে দূষণের মানের এই সূচক ২০০ ছাড়ালে ঘরের জানালা বন্ধ রাখা, সাইকেল না চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মাস্ক ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়। খুব জরুরি না হলে শিশু ও বৃদ্ধদের বাইরে যেতেই নিষেধ করা হয়।
দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯-এর তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শুধু দূষিত বাতাসের কারণে অন্তত ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা গেছে! অন্য এক তথ্য বলছে, বাতাসের দূষণে মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীতে পঞ্চম। ঢাকা শহরে বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি!
ঢাকার বাতাসদূষণের জন্য মূলত শহরের আশপাশের ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলা দায়ী। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই বলাই ভালো। বিপর্যয় মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষের যে উদ্যোগ আয়োজন থাকা দরকার, তা তেমনভাবে নেই। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশও তামিল হয় না এ দেশে। প্রথম দরকার শহরে এবং সারা দেশে প্রচুর পরিমাণ বৃক্ষের সমারোহ এবং বিস্তৃত জলাশয়। তাহলে এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে মোট বন এলাকা দেশের ভূ-ভাগের ৬-৭ শতাংশ মাত্র, যা হওয়া উচিত অন্তত ২৫ শতাংশ। আর নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন পানির বড়ই অভাব। ঢাকা শহরে সামান্য কিছু লেক আছে বটে; কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি নগণ্য। তা ছাড়া এসব লেকের পানিও এমন দূষিত যে সেদিকে তাকাতেও ভয় হয়।
ধানমন্ডি, গুলশান, এমনকি এত ঢোল পেটানো হাতিরঝিলের পানিও ভীষণ দুর্গন্ধ, চরম দূষিত। দূষিত ঢাকা শহরের চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের পানি। এত দূষিত যে কোনো জলজ প্রাণীও এসব নদ-নদীতে বাঁচতে পারে না। আলকাতরার মতো কালো রং সেই পানির। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ভরাট করা হচ্ছে অন্যান্য জলাশয়, নিচু ভূমি, খাল, নদী। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স তথ্য দিচ্ছে, ২০১০ সালের ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) নির্ধারিত জলাভূমির ২২ শতাংশই ২০১৯ সালের মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। তথ্য আরও বলছে, ঢাকার বাতাসে ইটভাটা থেকে ৫৮ শতাংশ, রাস্তা ও মাটির ধুলা এবং মোটরগাড়ির কালো ধোঁয়ায় প্রায় ২৬ শতাংশ দূষণ ঘটে। বাকিটা অন্যান্য বর্জ্য সূত্রে দূষিত হয়।
অন্যদিকে সবুজ গাছের বেষ্টনী কমতে কমতে প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। গত কয়েক বছরে বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত এলাকায় লাখ লাখ বৃক্ষ সাবাড় করা হয়েছে উন্নয়নের নামে। অন্যত্রও একই চিত্র। কিন্তু এই নির্বিচার বৃক্ষ নিধনযজ্ঞের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কেবল লুটপাটের। সবকিছুই হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে। কিন্তু বিকল্প কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। দূষণের মাত্রা কত ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। ঢাকায় এখন সুস্থ সবল কোনো গাছ খুঁজে পাওয়া কঠিন। শুধু ঢাকার কথাই বা বলি কেন, গোটা দেশের অবস্থা কমবেশি একই রকম।
গাছের এমন বিবর্ণ দশা শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে থেকেই। এ নিয়ে প্রচুর রিপোর্ট কাগজে ছাপা হয়েছে, টিভিতে দেখানো হয়েছে। কিন্তু টনক নড়েনি কারও। ঢাকা শহরে এবং দেশের জাতীয় সড়কগুলোর পাশের গাছগুলোর মরণদশার শুরু অনেক আগে থেকেই। পাতার ওপর ধুলা জমে প্রথমে তার খাবার তৈরিতে বাধার সৃষ্টি করে। এরপর পানির অভাবে তার খাবারে টান পড়ে আরও বেশি বেশি। এরপর নানা টক্সিক উপাদান গাছের জীবন বিপন্ন করে তোলে।
গাছ কমে গেলে অক্সিজেন তৈরিও কমে যায়। ফলে জীবনদায়িনী অক্সিজেনের অভাবে বিপন্ন হয় অন্য সব প্রাণীও। শিল্পবিপ্লবের পর পৃথিবী এত দূষিত হয়ে উঠেছে যে তার অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে এই গ্রহের তাপমাত্রা। মানুষ তাই শঙ্কিত। জীবের জন্য পানি অপরিহার্য। পানির নিয়মিত সরবরাহ বিঘ্নিত হলে প্রাণ বিপন্ন হবেই। নগর পরিকল্পনায় তাই জলাশয় ও সবুজ গাছের বেষ্টনী অতি আবশ্যকীয় শর্ত। গাছের নিয়মিত পরিচর্যাও। বৃষ্টির পানি ছাড়াও তাই জলসিঞ্চন নগরকর্তাদের নিয়মিত দায়িত্ব। উপযুক্ত বৃক্ষ নির্বাচন, পরিকল্পিত বৃক্ষায়ণ এবং পরিচর্যা ছাড়া কোনো নগর টিকে থাকতে পারে না। আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কাল থেকে শাসকদের অন্যতম কাজ ছিল জলাশয় সংরক্ষণ ও বৃক্ষ পরিচর্যা। মোগল সম্রাটেরা হিন্দুস্তানে বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যায় দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল। বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাউড লককে। তিনি ছিলেন লন্ডনের কিউ গার্ডেন এবং কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের কিউরেটর। এখনো রমনা এলাকায় মিন্টো ও হেয়ার রোডে প্রাউড লকের বৃক্ষসজ্জা কিছুটা টিকে আছে।
নিয়মিত জলসিঞ্চনের জন্য মাটির তল দিয়ে পাইপ বসিয়ে ফোয়ারায় গাছের পাতার ওপর পানি দিয়ে ধুয়ে দেওয়া সারা দুনিয়ায় এক সাধারণ দৃশ্য। এর ফলে একই সঙ্গে অনেক কাজ হয়। ধুলো ধুয়ে যায়, গাছপালা দরকারি পানি পায়, শহরের তাপমাত্রাও কমে। কিন্তু আমাদের নগরপিতারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন বলেই মনে হয়। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা, শুধু ঠিকাদার দিয়ে কাজ চলে না। আর ঠিকাদার যদি অসৎ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নগরবৃক্ষের তালিকা তৈরি করা উচিত বিশেষজ্ঞ দিয়ে। তাঁরাই নকশা করে দেবেন, কোথায় কোন কোন গাছ কেমনভাবে লাগাতে ও পরিচর্যা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নগর বৃক্ষায়ণ ও পরিচর্যা একটি বিজ্ঞান। আমলা, ঠিকাদার দিয়ে এ কাজ হয় না।
- আমিরুল আলম খান: যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
- কার্টসি — প্রথম আলো /৩০ নভেম্বর ২০১৯
No comments:
Post a Comment