রুমিন ফারহানা
রুমিন ফারহানা |
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর, গত ১৬ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো ‘রাজাকারের তালিকা’–যা ইতোমধ্যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেওয়ায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে মনে হতেই পারে, এই তালিকা নিয়ে কথা বলার তেমন আর কিছু নেই। আমরা জানি, ক্ষমতাসীন দল ২০০৯ সাল থেকে ভোটে এবং ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আছে যে নিয়ামকগুলোর ওপর ভিত্তি করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবতাবিরোধীদের বিচার। মজার বিষয় হলো, এই দু’টি বিষয়কে উপজীব্য করে কাজ করতে গেলে যে বিষয়গুলো প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তা হলো– ১) রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের তালিকা, ২) মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা, ৩) শহীদদের তালিকা, ৪) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য যুদ্ধাহতের তালিকা, ৫) মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা।
সম্প্রতি ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সারাদেশ যখন প্রতিবাদমুখর, তখন প্রখ্যাত লেখক খুশবন্ত সিংয়ের লেখার একটি অংশ নিজের ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করে আলোচনায় এসেছেন সৌরভকন্যা সানা গাঙ্গুলী। খুশবন্ত সিংয়ের বিখ্যাত বই ‘দ্য ইন্ড অব ইন্ডিয়া’র একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘প্রতিটি ফ্যাসিস্ট সরকারের একটি দল বা গোষ্ঠীর প্রয়োজন হয়। নিজেদের স্বার্থে তারা ওই দল বা গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে গিয়ে সেগুলোকে অশুভ শক্তিতে পরিণত করে। দুই-একটি দল দিয়ে এটা শুরু হয়। কিন্তু তা কখনোই সেখানে শেষ হয় না। ঘৃণার ওপর নির্ভর করে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনে নিজেকে ধরে রাখতে তারা প্রতিনিয়ত ভয় বা দ্বন্দ্বের আবরণ তৈরি করে।’
জানা কথাগুলোই আবার আমাদের সামনে এলো।
ফ্যাসিজমের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে মূল যে লক্ষণগুলোর কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সেগুলো হলো—শক্তিশালী জাতীয়তাবাদ, যেখানে শাসন ব্যবস্থায় বারবার উঠে আসে দেশাত্মবোধক নীতিকথা, স্লোগান, গান ইত্যাদি; মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিতে অবজ্ঞা, যে কারণে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্যিক সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়; ঘৃণার চাষ—যেখানে দেশাত্মবোধকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে একটি নির্দিষ্ট বিপদের ব্যাপারে ঘৃণা করতে উৎসাহিত করা হয়; চরম পুরুষতান্ত্রিকতা; নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম; জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ; করপোরেট শক্তির সুরক্ষা; চরম ক্রান্তীয়করণ ও দুর্নীতি এবং প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশে বর্তমানে এই সবক’টি লক্ষণ খুব স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। বিশেষ করে গত কয়েক বছর জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়িয়ে যেভাবে জাতিকে বিভাজিত করা হয়েছে, সেটি মেরামতের কাজ আজ শুরু করলেও কত বছরে শেষ হবে কিংবা আদৌ মেরামতযোগ্য কিনা, সেগুলো বড় প্রশ্ন। লাখো শহীদের রক্ত আর লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের মূল্যে কেনা যে স্বাধীনতা তার ইতিহাস এখন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটা জাতির জন্য এর চেয়ে বড় পরাধীনতা আর কী হতে পারে? ইতিহাস তো কোনও বদ্ধ বিষয় না, এটা নিয়ে গবেষণা হবে, লেখা হবে, মানুষের মধ্যে তর্কবিতর্ক হবে, ন্যারেটিভ-কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি হবে। খোদ ভারতে যেমন গান্ধীকে একজন ‘ঈশ্বর’ বানানোর চেষ্টা আছে, তেমনি আবার একজন ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা আছে। আবার ভারত ভাগের জন্য জিন্নাহকে দায়ী করার প্রচলিত ন্যারেটিভের বিপরীতে নেহরু আর বল্লবভাই প্যাটেলকে দায়ী করার ন্যারেটিভও আছে। এসব প্রচণ্ড বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক তৈরি করে। ভারতীয় সমাজে কিন্তু আইন করে এসব আলোচনা বন্ধ করে দেওয়ার কোনও চেষ্টা হয় না। অথচ যে জাতি তার দেশের জন্য যুদ্ধ করা মানুষের একটা তালিকা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সঠিকভাবে তৈরি করতে পারে না, কিংবা কে জানে তৈরির ইচ্ছাও রাখে কিনা, যে কারণে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও বদলাতে থাকে, সেক্টর কমান্ডার, বীর উত্তমকেও রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয়ে রাজাকার খেতাব পেতে হয়, সেই জাতির ইতিহাসের ভাগ্যে যে দুর্ভোগ আছে, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।
ইতিহাস নিয়ে এই ‘তাইরে-নাইরে’র মধ্যে গত ১৫ ডিসেম্বর মহা সাড়ম্বরে ঘোষিত হলো ‘রাজাকারের তালিকা’। সেখানে ৩৮ জন নারী, ৯২ জন হিন্দু এবং বর্তমান সরকারের তালিকাভুক্ত বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে। মজার বিষয় হলো, যে মানবতাবিরোধী বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগে এত শোরগোল এবং যাকে পুঁজি করে সরকারের বিনা ভোটে এই টিকে থাকা, সেই স্বাধীনতাবিরোধীদের একজনের নামও এই তালিকায় নেই। এটি এই তালিকাকে কেবল প্রশ্নবিদ্ধই করে না বরং সরকারের উদ্দেশ্য নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগায়। এই তালিকা প্রকাশের মাত্র ১ দিন আগে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ‘সম্প্রীতি, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির বিজয়’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের ভেতরে জামায়াতের লোকও আছে। আওয়ামী লীগে কত রাজাকার আছে। বিপদের সময় এরা ভয়ানকভাবে আসে। রাজাকারদের লিস্ট করার আগে এই রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘... এখনও রাজাকার আছে। অনেক রাজাকার আছে। এখনও আছে। এমনকি আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার আশপাশেও আছে।...তাদের নাম বললে আমার আর ঢাকায় আসা হবে না। তাই আমি নাম বলতে চাই না। এই হচ্ছে অবস্থা।’ এই যদি হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বাদানকারী দলটির অবস্থা, তাহলে আমাদের মতো আমজনতাদের উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় কী? আর খোদ আওয়ামী লীগের একজন আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু, একজন ট্রাস্টেড অ্যান্ড টেস্টড ফ্রেন্ড, যখন স্পষ্টভাবে বলেন আওয়ামী লীগে রাজাকার আছে, তখন তা অবিশ্বাস করি কী করে?
‘রাজাকারের তালিকা’ প্রকাশের পর যখন তুমুল বিতর্ক চারপাশে, তখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জানালেন তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানালেন, তালিকার সঙ্গে একটি নোট ছিল, যা আমলে নিলে এত বিতর্কের জন্ম হতো না। জানা যায়, অতি গোপনীয় এই নোটে বলা হয়েছিল, তালিকাভুক্ত ১ হাজার ২৫৪টি নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নথি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা ১০ হাজার ৭৮৫ জন। তবে তালিকাভুক্ত ১ হাজার ২৫৪টি নথির মধ্যে ৩৫২টি নথি দালাল আইন সংশ্লিষ্ট না হওয়ায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম-সংবলিত নথির সংখ্যা পাওয়া গেছে ৯০২টি। আর তালিকাভুক্ত ১০ হাজার ৭৮৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ৯৯৬ জন সরকারের সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন বা আবেদন করে আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
রাজাকারের তালিকা নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড কতগুলো অনিবার্য প্রশ্ন তুলে দেয় আমাদের মনে-
১) ৯৯৬ জনের মধ্যে কতজন আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন?
২) যাদের নাম অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাদের নাম কি সে অব্যাহতিপ্রাপ্তদের তালিকায় আছে? যদি না থাকে তাহলে তো তাদের নাম নিশ্চিতভাবেই অভিযুক্তদের তালিকায় আছে।
৩) আদালত থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তদের বাদ দিলে যে কয়জন সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন, তারা তো নিশ্চিতভাবে অভিযুক্ত, নয় কি? তাদের সংখ্যা কত?
৪) এই ৯৯৬ বাদে তালিকার বাকি ৯৭৮৯ জন কি তাহলে দালাল আইনে দালাল হিসেবে অভিযুক্ত?
৫) স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যাদের নাম এই দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত, যাদের কয়েকজনের এরমধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ে ফাঁসি হয়েছে, তাদের নাম এই তালিকায় এলো না কী করে?
৬) যেখানে মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা নিয়ে খুব বড় প্রশ্ন আছে, সেখানে কারো নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছে, এটা কারও রাজাকার না হওয়ার পক্ষে কোনও যুক্তি হতে পারে কিনা?
৭) আইনি প্রক্রিয়া শেষ না করে শুধু দালাল আইনে অভিযুক্ত কাউকে ‘রাজাকার’-এর মতো ভয়াবহ অভিযোগ দেওয়া কি আইনগত বা নৈতিকভাবে সঠিক?
অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকায় জন্য যে দলটি মুক্তিযুদ্ধকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, সেই দলটি এর আগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করতে গিয়েও নানা রকম প্রতারণাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ঠিক একইভাবে রাজাকারের তালিকা তৈরিতেও এই সরকার শুরুতেই ভীষণ রকম বিতর্কের জন্ম দিলো। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার ঠিক যেভাবে তাদের পছন্দমতো একটা ন্যারেটিভ তৈরি করে মানুষের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে জাতিকে বিভাজিত করে ক্ষমতায় থাকবার চেষ্টা করে, তার চমৎকার উদাহরণ হলো আওয়ামী সরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধ’।
এই সরকার মূলত মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার—তার কোনোটাই ২০ বছরের শাসন আমলে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা প্রতিষ্ঠা করার কথা বাদই দিলাম, যদি সত্যিকার অর্থে ন্যূনতম কোনও শ্রদ্ধাবোধ থাকতো মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, তাহলে অন্তত এই দেশ প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান আছে কিংবা যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করেছে, তাদের নামের তালিকাটুকু তৈরিতে অন্তত কিছুটা মনোযোগী হতো। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে কেবল যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার হাতিয়ার হতো না।
- লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য
- কার্টসি - বাংলা ট্রিবিউন/ ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯
No comments:
Post a Comment