জসিম উদ্দিন
যুক্তরাজ্যের পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হয়। নাগরিকরা রাস্তাঘাট, হাটবাজার, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশকে মুশকিল আহসানকারী হিসেবে পায়। শুধু যুক্তরাজ্য কেন, পুরো ইউরোপে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসেবে জনগণের সেবার দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে পুলিশ জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দেশগুলোতে পুলিশের ভূমিকা ব্যাপক বিতর্কিত। আমাদের দেশে পুলিশবাহিনী মানে অনেক ক্ষেত্রে জনগণের মনে ভীতিজাগানিয়া একদল অস্ত্রসজ্জিত লোক। তারা আইনি সুরক্ষা নিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এর বিপরীত চিত্রও সামান্য কিছু পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবাদানকারী ৯৯৯ সার্ভিস একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে। ছিনতাই, ধর্ষণসহ অনেক সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ পুলিশবাহিনীর কিছু সদস্য করেছে, আর এ সার্ভিসটিকে ঠিক এর বিপরীত উন্নতমানের একটি সেবা বলা যায়। উন্নত বিশ্বের পুলিশের যে সেবা, তার ছোঁয়া এই সার্ভিসে পাওয়া যাচ্ছে।
এ সেবার আওতায় জরুরি ভিত্তিতে জীবনাশঙ্কায় পড়া মানুষ উদ্ধার পাচ্ছে, রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স পাচ্ছে, দ্রুত ফেরি পারাপারের সহযোগিতা পাচ্ছে রোগীরা। ধর্ষণ, গৃহকর্মী নির্যাতন ও মুক্তিপণের জন্য পণবন্দীরা সহযোগিতা পাচ্ছেন। লিফটে আটকে পড়া, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডে সাহায্য মিলছে। পারিবারিক সমস্যায়ও এ সার্ভিসের আওতায় সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মধ্যেও একদল আক্রান্ত লোক ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে উদ্ধার পেয়েছেন।
মেঘনার মিয়ারচরে বিআইডব্লিউটিএ খননকাজ চলছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের পর খননকাজে ব্যবহৃত ছয়টি পন্টুন কিনারে নোঙর করে প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা অবস্থান করছিলেন। রোববার দুপুরে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে একটি পন্টুনের নোঙর ছিঁড়ে যায়। ৩০ জন শ্রমিকসহ পন্টুনটি মেঘনায় ভেসে যায়। আসন্ন বিপদে শ্রমিকরা আতঙ্কিত হন। উত্তাল নদীতে ডুবে যাওয়াই তাদের পরিণতি মনে হচ্ছিল। ঘোর বিপদের সময় এক শ্রমিক ফোন করেন ৯৯৯ নাম্বারে। ৩টার সময় এ আকুতি জানানোর ২ ঘণ্টার মধ্যে কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় উদ্ধার পাওয়ার আশা যখন প্রায় সবাই ছেড়ে দিয়েছে, সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছে পুলিশের ৯৯৯ নাম্বার।
এ নাম্বারে ফোন করতে কোনো খরচ হয় না। ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এ সেবা। বিপদগ্রস্তরা এ সার্ভিসের মাধ্যমে সমস্যার সমধান পান। পুলিশের প্রতি সাধারণ যে ধারণা, তাতে আক্রান্ত ব্যক্তি থানা পুলিশের সহযোগিতা পাবেন, এমনটি সাধারণত কেউ প্রত্যাশা করে না। কিন্তু এই নাম্বারে ফোন করার পর নিকটবর্তী থানার দায়িত্বশীল পুলিশের সাথে কথা বলিয়ে দেয়া হয়। তখন পুলিশ আর তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ডিজিটাল পদ্ধতির এ একটা ইতিবাচক সুযোগ। কেউ চাইলে দায়িত্ব এড়াতে পারে না, কিংবা অন্যায় করতে পারে না। মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনায় এর মাধ্যমে সেবা পাওয়া গেছে। এমনটি আমাদের দেশে সাধারণত অবিশ্বাস্য।
রাজধানীর আবদুল গনি রোডের পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে এ সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দুটো ফ্লোরে সাড়ে ৪০০-এর বেশি কর্মী কয়েকজন পুলিশ অফিসারের তত্ত্বাবধানে রাতদিন এ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ৯৯৯ নাম্বারটি প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিচ্ছে। যেখানে মানুষ পুলিশবাহিনীকে এড়িয়ে চলে। একান্ত বাধ্য না হলে তারা পুলিশের ধারকাছ মাড়ায় না। সেখানে এই সার্ভিস শুরু হওয়ার পর বিগত ২০ মাসে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ কল এসেছে এ নাম্বারে। সেবা নিয়েছে প্রায় ২৬ লাখ লোক।
বিপরীত চিত্র ভয়াবহ। বাংলাদেশে পুলিশের সেবা তো দূরের কথা, কিছু ক্ষেত্রে নৈতিকতার এমন অবনতি ঘটেছে এবং কিছু পুলিশ নিজেরা আইন ভঙ্গ করছে। অন্যায় অপকর্ম করছে লাগামহীন। পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের পরিবারের সদস্যদের তুলে নেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার ‘অপরাধ’ পুলিশ সুপার হারুন আর রশিদকে তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করে আসছিলেন। ঘটনার দিন রাসেলকে না পেয়ে তার স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। গুলশানের বাসা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও রাসেল তার ফেসবুকে শেয়ার করেন। এরপর ব্যবসায়ীদের তরফে প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ের নজরে এলে এসপি হারুনকে প্রত্যাহার করা হয়। এই ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে করা পুলিশ সুপারের অপরাধের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা নজিরবিহীন। সাধারণ ব্যাপার হচ্ছে, আইনের রক্ষক হিসেবে ব্যবসায়ীরা পুলিশের কাছে নিরাপত্তা পাবেন। উল্টো পুলিশ নিজেই তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। হারুনকে প্রত্যাহার করার পর সংবাদমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে এখন অনেকে মুখ খুলছেন। ভুক্তভোগীরা বিপদে পড়ে যাওয়ার ভয়ে এত দিন তাদের বিরুদ্ধে করা অপরাধ চেপে গেছেন।
এসপি হারুনের চাঁদাবাজি নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে রাসেল একটি লিখিত অভিযোগ করেন। ওই চিঠিতে তিনি হারুনের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ আনেন। বিস্তারিত বিবরণে তিনি জানান, হারুনের পক্ষে উপপরিদর্শক আজহারুল ইসলাম আম্বার ডেনিমের স্টোর ম্যানেজার ইয়াহিয়া বাবুকে ফোন করে টাকা দাবি করেন। এর আগেও রেস্তোরাঁয় হারুন তাকে ডেকে নিয়ে পাঁচ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঠিকানায় পাঠাতে বলেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিমের ৪৫ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গাজীপুর থানায় ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়। এসব যখন ঘটছে, তার প্রতিকার চেয়ে রাসেল পাত্তা পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে অপরাধীদের আশকারা কোন পর্যায়ে রয়েছে, এ ঘটনা তার দৃষ্টান্ত।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, একজন দুই কোটি টাকা দিয়ে নারায়ণগঞ্জে জায়গা কেনেন। তাকে ডেকে নিয়ে ওই জায়গা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন এসপি হারুন। এ সময় তিনি জায়গার ক্রেতাকে অকথ্য গালিগালাজ করেন। পরে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে ক্রেতাকে জমির দখল নিতে হয়। পত্রিকা লিখেছে, কয়েক মাস আগে এসপির আদালতে ডাক পড়ে গার্মেন্টের অতিরিক্ত সুতা বা বন্ড ব্যবসায়ীদের। এসপি জানিয়ে দেন ডিবির পরিদর্শক এনামুল যা বলে তাই শুনতে হবে। তারপর ব্যবসায়ীদের গোডাউনে হানা দেয় এনামসহ পুলিশ সদস্যরা। বাধ্য হয়েই চার থেকে সাত লাখ করে টাকা দেন একেক ব্যবসায়ী। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই আটক করে নিয়ে যাওয়া হতো থানাহাজতে। এমন অনেক ঘটনার মধ্যে একটির শিকার সিদ্ধিরগঞ্জের বালু ব্যবসায়ী শাহজাহান। দুই মাস আগে এক সন্ধ্যায় ঘটে ঘটনাটি। এসপি হারুনের ছক অনুসারে নাসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলী হোসেন আলার কার্যালয়ে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশের এসআই আলমগীরের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী শাহজাহানকে আটক করে নিয়ে যায়।
কাউন্সিলর আলা জানান, পরে কাউন্সিলর আলাকেও ডেকে নেয় ডিবি। ডিবি অফিসে নিয়ে শাহজাহানের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে হারুন। এ সময় তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। মাদক মামলায় ফাঁসানো থেকে শুরু করে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখানো হয়। একপর্যায়ে ২০ লাখ টাকা দিতে সম্মত হন ওই ব্যবসায়ী। কাউন্সিলর আলার উপস্থিতিতে নগদ ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েও সে দিন মুক্তি পাননি শাহজাহান। পরদিন সকালে আরো ২২ লাখ টাকা (মোট ৩৯ লাখ ৫০ হাজার) দিয়ে মুক্তি মেলে শাহজাহানের। এ ঘটনার পর থেকে ব্যবসায়ী শাহজাহান অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।
নারায়ণগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনকে ডেকে নিয়ে ৪৫ লাখ টাকা আদায় করেন এসপি হারুন। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তিনি নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি জিডি করতে গেলে এই অভিযোগটিকে ২২ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মামলায় রূপ দেন এসপি হারুন। এই অভিযোগে জয়নালকে নারায়ণগঞ্জ থানায় ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করেন তৎকালীন ওসি কামরুল। এ সময় তার কাছে এসপির নির্দেশের কথা বলে এক কোটি টাকা দাবি করা হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে আরো মামলার হুমকি দেয়া হয়। পরে ২০ লাখ টাকা দিতে রাজি হন জয়নাল। তাতে কাজ হয়নি, আরো তিনটি মামলা করানো হয়। অবশেষে মামলা ও রিমান্ড নিয়ে নির্যাতন করার ভয় দেখানোর পর ৪৫ লাখ টাকা দেন জয়নাল। জয়নাল আবেদীন বলেন, আমি নিজ হাতে তিন বারে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি এসপি হারুনের কাছে। বাকি টাকা দেয়া হয়েছে আমার স্ত্রী ও অন্যদের মাধ্যমে। এ ছাড়া তিনি জানান, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অস্ত্র জমা দিতে যান তিনি। এ সময় থানায় ফ্লোরে একটি গুলি পড়ে যায়। পরে এসপি হারুনের নির্দেশে তাকে আটকে রেখে অভিযোগ করা হয় জয়নাল পুলিশকে গুলি করেছেন। এ ঘটনায় ১৫ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন জয়নাল আবেদীন।
পত্রিকা আরো লিখেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডের উৎসব পরিবহনের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। প্রায় ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে এসপি হারুন একটি পক্ষকে সমর্থন দেন। এ বিষয়ে উৎসব পরিবহনের চেয়ারম্যান কামাল মৃধা বলেন, আমি বৃদ্ধ বয়সে গত ২০ মে থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত কমপক্ষে ৭০ বার এসপি অফিসে গিয়েছি। তিনটি লিখিত অভিযোগ করেছি, কিন্তু আমি আইনি সহযোগিতা পাইনি।
এগুলো এসপি হারুনের সর্বসাম্প্রতিক ক্রিয়াকাণ্ড। তার অপরাধী হয়ে ওঠার একটি দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা কিভাবে অপরাধী হন তার ঘটনাটি একটা কেসস্টাডি হতে পারে। বর্তমান সরকারের একেবারে প্রথম মেয়াদের ঘটনা। ২০১১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃস্থাপনের দাবিতে বিএনপি জোট হরতাল ডেকেছে। তৎকালীন সংসদে বিরোধী দলের চিপ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুকের নেতৃত্বে সংসদ ভবনের পাশে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। ফারুকের সাথে পুলিশ সদস্যদের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার হারুন আর রশিদ তার ওপর চড়াও হন। হারুন তাকে ঘুষি ও লাথি মারেন। ফারুক দৌড়ে পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে চান। কয়েকবারই তাকে ধরে এনে মারধর করেন হারুন। হারুনের উপর্যুপরি মারধরে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাথায় তাকে ১১টি সেলাই দিতে হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের আজকের অব্যাহতি পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা হারুন আর রশিদই অপরাধটি করেছিলেন।
ওই ঘটনায় লুকোছাপা কিছু ছিল না। সব কিছু একেবারে প্রকাশ্যে ঘটেছিল। মারধরের পুরো ঘটনাটি পরে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এসেছে। স্পষ্ট দেখা গেছে, একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে কিভাবে পেটানো হচ্ছে। তারপর সাধারণভাবে মনে হয়েছিল, এ ঘটনার বিচার হবে। দেখা গেল উল্টো জয়নাল আবদিনের বিরুদ্ধে পুলিশি মামলা হয়েছে। তিনি মার খেয়ে মামলার হয়রানিতে পড়ে গেলেন। হাসপাতাল থেকে তিনি এ হয়রানির শিকার হতে লাগলেন। অপরাধী পুলিশ অফিসার হারুনের বিচারের পরিবর্তে অপরাধের শিকার সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিনের বিরুদ্ধে হয়রানির এমন চিত্র বাংলাদেশের পুলিশের জন্য একটা বার্তা বহন করেছে। এই ঘটনা এই বার্তাই দিয়েছে ‘অপরাধ’ যা সংঘটিত হয়েছে সেটা নয়। অপরাধ হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা যা ‘অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করছে। অন্ততপক্ষে সংসদ জয়নাল আবদিনের সহকর্মীরা নিজেদের মানসম্মান রক্ষার স্বার্থে সে দিন এগিয়ে আসতে পারতেন। তারা কেউই সে দিন এগিয়ে আসেননি। এরপর পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের উন্নতি এবং পুরস্কার পেতে দেখা গেছে। তিনি সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পেয়েছেন। তারপর আজ জন্ম নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তা হারুন।
হারুনের বিরুদ্ধে উপস্থিত সব অভিযোগ নারায়ণগঞ্জের। তিনি এর আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন ও গাজীপুরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময়ে তিনি একেবারে নিয়মকানুন ও আইনের রক্ষক হয়েছেন সেই খবর নেই, বরং এই তিনিই একই অপরাধের কাজ করে থাকতে পারেন একই সময়ে। সুযোগ পেলে ভুক্তভোগীরা নিশ্চয়ই তা প্রকাশ করবেন। ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের অপরাধের জন্য অবশ্যই একা হারুন দায়বান নন। তাকে এভাবে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। কারণ, অপরাধ সংঘটনের জন্য তিনি কোনোভাবে শস্তি পাচ্ছিলেন না। এ অবস্থায় এটাই স্বাভাবিক যে, অপরাধী তার অপরাধের মাত্রা বাড়াবে।
অপরাধ একটা সংক্রামক ব্যাধি। সংঘটিত একটি অপরাধ সংবাদমাধ্যমের খবরে ছড়িয়ে পড়লে সেই অপরাধ আরো বেশি করে সংঘটিত হয়। নতুন অপরাধ চালু হওয়ার ক্ষেত্রে একজন থাকেন এর সূচনাকারী। এর পরে এর অনুসারী হয়ে যান আরো অনেকে। হারুন যখন রাজনৈতিক নেতাদের পেটানোর এমন ব্লাংক চেক পেলেন, সেটা অনেকের জন্য ছিল সবুজ সঙ্কেত। এ সুযোগের অসৎ ব্যবহার অনেকে করেছেন। সরকার এর মাধ্যমে বিরোধীদের ন্যায্য দাবিগুলো দমন করার সুযোগ নিয়েছে। এখন তো আর রাজনৈতিক বিরোধিতা নেই। অপরাধী মন তো কখনো বসে থাকবে না। তারা এখন অন্যান্য অপরাধে বেশি করে জড়িয়ে পড়ছেন। সেগুলো হচ্ছে আর্থসামাজিক অপরাধ।
অপরাধকে ঘৃণা করতে চাই, অপরাধীকে নয়। যারা ঘৃণ্য কর্মে জড়িয়ে পড়েন, তারা ফিরেও আসতে পারেন। প্রতিটি মানুষের জন্য পরিশুদ্ধ হওয়ার নিশ্চয়ই একটি সময় রয়েছে। বারবার সুযোগ পেয়েও যারা সঠিক শুদ্ধ হতে চান না, তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। মানুষের সমাজে ভালোর জন্য পুরস্কার এবং মন্দের জন্য তিরস্কারের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই অর্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ইনসাফপূর্ণ বলা যায় না। এখানে যার শক্তি আছে, আইন ও প্রশাসন তার পক্ষে কথা বলে।
- কার্টসি — নয়াদিগন্ত/ নভেম্বর ১৩, ২০১৯
No comments:
Post a Comment