Search

Tuesday, December 24, 2019

ঢাবিতে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় বাড়ছে ছিনতাই

তাওসিফুল ইসলাম/ঢাবি প্রতিনিধি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে স্বাধীন বাংলার সূত্রপাত সেখানেই স্বাধীনভাবে চলাচলের সময় আতঙ্কে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ঢাবির মত জায়গায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। যা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ক্যাম্পাসের সুনাম নষ্ট করছে তেমনি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায়ও বিঘ্ন ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জড়িত থাকেন সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। কখনো কখনো শাস্তির আওতায় আসলেও প্রায় ঘটনাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন তারা।

তবে শিক্ষার্থীদের দাবি তারা ঘটনা ঘটার পরে শুধু প্রতিবাদ করতে চাননা, বরং তার আগেই এর প্রতিরোধ চান তারা। ঘটনা ঘটার আগেই এর বিরুদ্ধে সতর্কতা এবং চৌকিদারিত্বমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে রাত আর দিন একই রকম। অনেকে রাতে না ঘুমিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়। টিএসসি, ফুলার রোড, পলাশি, কার্জন হল, মলচত্বর, বটতলা, শহিদ মিনার, স্বাধীনতা চত্বর, জগন্নাথ হলের মোড়, শিববাড়ী, ভিসি চত্বর—এসব আড্ডার জায়গা হিসেবে পরিচিত শিক্ষার্থীদের কাছে। ইদানীং এসব জায়গায় রাতে আড্ডা দিতে আতঙ্কে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এমনকি চলাচলের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের জন্য। কারণ, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব স্থানে ছিনতাইয়ের পরিমাণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এছাড়া, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি ও চারুকলা অনুষদ এলাকায় মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বেড়েছে।

গত এক বছরে এসব জায়গায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩০টিরও বেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, সব ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কারণ মামলা করলেও এসবের কোন ফল নেই। বড় ধরণের ছিনতাই হলে সবাই জেনে যায়, তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হলে জানাজানি কম হয়।

এসব অসাধু কার্যকলাপের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জড়িত বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে ছিনতাইয়ের। হয়েছে মামলাও। অনেককে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তারপরও হলে থেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছিনতাইকারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী। আবার কখনো কখনো দুয়েকজনকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ।

ছিনতাইয়ের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম ও রবিন আহমেদকে শাহবাগ থানা আটক করা হয়। গত ১২ ডিসেম্বর তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাত ১০টায় আটক করা হয়। জানা যায় আজিমপুর এলাকা থেকে ঘুরতে আসা শামস ও শুভ নামে দুই ব্যক্তিকে মারধর করে এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নিয়ে টাকা উত্তোলন করে তারা। আটকের বিষয়টি স্বীকার করে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান। নাহিদ এবং শুভ মহসিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তারা মহসিন হলের পরিচিত ছাত্রলীগ কর্মী।

গত শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় শহীদ মিনার এলাকায় ক্যামেরা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়রি করেছেন ক্যামেরার মালিক বিশ্বজিৎ সরকার মিল্টন। শহীদ মিনার এলাকায় শুক্রবার সকালে শুটিং করছিলেন তাদের ইউনিট। উক্ত এলাকার শুটিং শেষে স্পট পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় যাবার জন্য শুটিং ইউনিটের ৩ জন রিকশায় রওয়ানা হোন। রওয়ানা হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি বাইকে করে দু’জন ছিনতাইকারী রিকশায় থাকা ক্যামেরাম্যানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ক্যামেরাবাহী ব্যাগ নিয়ে দ্রুত চলে যায়।

গত ২৩শে সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের উপর ছাত্রদলের মোবাইল এবং বাইক ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠে। ঢাবি শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিজবুল্লাহ। অভিযোগ রয়েছে, হিজবুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিনতাই চক্রের প্রধান। তার নেতৃত্বাধীন চক্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে ছিনতাই করে বেড়ায়। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের মামলায় পুলিশ তাকে আটক করে।

২০১৯ সালের শুরুতেই পলাশী এলাকায় এক পথচারীর মোবাইল ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র ও হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আমির হামজার বিরুদ্ধে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করে ভুক্তভোগীরা। এ ঘটনায় তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। 

২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ মিনার এলাকায় থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের শিক্ষানবিশ টেকনিশিয়ান সাইফুদ্দিন সিফাত ও ‘স্বপ্ন’ সুপারশপের বিপণন কর্মী রিয়জুল ইসলাকে তুলে নিয়ে এসে তাদের পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ ওঠে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র ও হল শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আখতারুজ্জামান (তৃতীয় বর্ষ, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ) ও একই হলের ছাত্রলীগ কর্মী রাজিউর রহমানসহ (তৃতীয় বর্ষ, সংগীত বিভাগ) পাঁচ জনের বিরুদ্ধে। 

এছাড়া, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকার বুয়েট হাইস্কুলের পাশে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের এক নারী কর্মীর গাড়ি আটকানোর অভিযোগে বিজয় একাত্তর হলের ছাত্র ও হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিবের (অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম) বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন ভুক্তভোগী ওই নারী।

ফুলার রোড এলাকায় অবস্থিত স্বাধীনতা চত্বরে প্রতাপ আদিত্য নামে একজনকে ছিনতাইকারীরা শরীরে তিনটি স্থানে ছুরিকাঘাত করেছে ছিনতাইকারীরা। তার সুস্থ হতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল। এ ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়িত বলে অভিযোগ করেন তিনি। 

ছিনতাইয়ের ঘটনা কমিয়ে আনতে ক্যাম্পাসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় সিসি টিভি ক্যামেরা ও প্রশাসনিক চৌকি বসানোর দাবি জানিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অবস্থান ও ঘোরাফেরা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রশাসন। রাতে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবস্থান কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ছিনতাই বন্ধ হওয়ার মত এখনো প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এলাকায় অহরহ এমন ছিনতাইয়ের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা অভিযোগ করে বলেন, নিজ ক্যাম্পাসে যদি জানমালের নিরাপত্তা না থাকে তাহলে আর কোথায় নিরাপত্তা পাব? সন্ধ্যার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বর ও রাস্তাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে যায়। তারা আরো বলেন, প্রশাসনের গাফলতির জন্য এখনো কোন চৌকিদারিত্বমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আইন শৃঙ্খলা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ১১৩টি সিসি ক্যামেরা আমরা লাগিয়েছি। কিছু ক্যামেরা অকার্যকর হলেও বাকিগুলো কাজ করছে। ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আসছে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। যেহেতু ক্যাম্পাস উন্মুক্ত এখানে ক্যাম্পাসের বা বহিরাগত অনেকেই সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রক্টরিয়াল টিমের কারণে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে এখন। তিনি আরো বলেন, এরকম অসাধু কাজের সাথে যারা জড়িত তাদের তালিকা আমাকে শিক্ষার্থীরা দিলে আমরা ব্যবস্থা নিব।

কার্টসি - The Daily Campus / dec 24, 2019 
https://bit.ly/34OPxwU

No comments:

Post a Comment