মইনুল হোসেন
ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট বিচারাধীন আসামিকে জেলে রাখার বাধ্যতামূলক বিধান বাতিল করে দিয়েছে। ফলে সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলাসহ হাজার হাজার বন্দী উপকৃত হবে।
শেষ আপিলে সাজাপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অপরাধীদের জেলে পাঠানোর আইন ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট গত নভেম্বর মাসে পরিবর্তন করে দেয়ার ফলে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে কারাবন্দী ব্রাজিলের সাবেক বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাশিও লুলা দ্য সিলভা মুক্তিলাভ করেছেন।
আলজাজিরার রিপোর্ট মতে, ব্রাজিলের পেনাল কোডের এই নতুন ব্যাখ্যা অনুযায়ী যেসব সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর আপিল এখনো শেষ হয়নি এরকম কয়েক ডজন বড়মাপের আসামি উপকৃত হবেন যাদেরকে গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল।
স্মরণীয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয় অনুকূলে থাকার পরও ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকারী প্রধান বামপন্থী নেতা, যার বয়স এখন ৭৪ বছর, নির্বাচনে লড়তে পারেননি কারাদণ্ড ভোগের কারণে।
একাধিক প্রকৌশলী সংস্থাকে সরকারি কাজ দেয়ার বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট লুলাকে আট বছর ১০ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের মতো আরো অনেকে এখন কারাগারের বাইরে মুক্ত জীবনের স্বাদ পাবেন।
ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের এই যুগান্তকারী রায় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের মধ্যে যুক্তি ও চিন্তার খোরাক জোগাবে। এই রায়ের পেছনে যে যুক্তি রয়েছে সেটা অনস্বীকার্য। শেষ বিচারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারো কারাদণ্ড ভোগ করার অর্থ চূড়ান্ত বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই অন্যায়ভাবে শাস্তি ভোগ করা। আদালতের শেষ বিচারে যদি দেখা যায় তিনি কোনো অপরাধ করেননি এবং তিনি নির্দোষ তাহলে তার কারাগারে বন্দী জীবন কাটানোর সময়ের জন্য কী করা হবে? জীবনের হারানো অংশ ফেরত দেয়ার কোনো পথ নেই।
কারাজীবনের ক্ষতি কিংবা পরিবার-পরিজনের ভোগান্তি পুষিয়ে দেয়ার কোনো উপায় নেই। আর্থিক ক্ষতিপূরণও যথেষ্ট হতে পারে না।
শেষ বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিচারাধীন বন্দীকে জামিনে মুক্ত থাকার অর্থই তো সে জামিনের শর্ত অনুযায়ী সদাচরণ করবে এবং শেষ বিচারে শাস্তি হলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত থাকবে। এটাই তো হবে ন্যায়বিচারের কথা।
অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ চূড়ান্ত বিচারে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে সাজা ভোগে বাধ্য করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। কিন্তু তারপরও নানা সমস্যার কথা তোলা হয় যাতে পুলিশি গ্রেফতারকে জেলে রাখার জন্য চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হয়।
অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয় কেননা শাস্তি প্রদানের এক ধরনের নিষ্ঠুর মানসিকতায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বন্দী থাকতে গিয়ে তার যে মৌলিক অধিকারগুলো এবং বন্দিজীবনের অবমাননাসহ আরো কতভাবে যে তার ক্ষতি হচ্ছে তা ভাবা হয় না। তার জীবিকা অর্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সমগ্র সমাজের কাছে তাকে এবং তার ঘনিষ্ঠদের হেয় হয়ে থাকতে হয়।
এসব হতভাগ্যদের নিয়ে সমাজের উচ্চাসনে যারা বসে আছেন তারা মনে করেন আইনের ঊর্ধেŸ থাকার ভাগ্য নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করেছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য কোর্টে হাজির করলেই মনে করা হয় তারা অপরাধ করা লোক।
নিন্ম আদালতের সাথে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে মন-মানসিকতার এক বিরাট ব্যবধান রয়েছে। বিচার ব্যবস্থা বিচার ব্যবস্থাই। অসহায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পক্ষে জজ-বিচারকদের তো থাকতেই হবে। এটাই তো সুবিচারের কথা যে অভিযুক্তকে নির্দোষ হিসেবে দেখতে হবে।
শেষ বিচারিক আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নিরপরাধ বলে গণ্য করতে হবে এবং আইন ও বিচারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবে না। শেষ কথা বলা যাবে চূড়ান্ত বিচার শেষ হওয়ার পর। চূড়ান্ত বিচার শেষ হওয়ার আগে কেন অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে দেখা হবে? কেন তার ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হবে? চিন্তা-ভাবনা করে এসব বিচারসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে জজ-বিচারকদের।
এদিক থেকে দেখলে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যুগান্তকারী রায় বলতে হবে। বিচারকে ন্যায্য ও মানবিক করার চিন্তা-ভাবনা চলছে পৃথিবীর সর্বত্র। সাজার জন্য সাজা; নির্দোষ প্রমাণ করার কথা ভাবা হয় না- এটা তো পুলিশি রাষ্ট্রের মানসিকতা।
চূড়ান্ত বিচারে সাজা যদি বহাল না থাকে তাহলে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জীবন কেন জেলে পচবে, কেন তিনি পরিবারের পরিচর্যা ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য হবেন, কেন তার সব অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, এ বিষয়ে যে কেউ যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করতে পারেন, বোঝাতে পারেন। অধিকার হিসেবে এসব বিষয়কে আমরা যদি স্বীকার করে নিই তাহলে শেষ আপিলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে অবশ্যই অভিযুক্তকে জেলে বন্দী রাখা অন্যায়। আপিলের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিন্ম আদালতের রায়ের কারণে কাউকে বন্দী রেখে সাজাপ্রাপ্ত হিসেবে দেখলে আপিল পর্যন্ত চলমান প্রক্রিয়াকে বিচার প্রক্রিয়া বলার সুযোগ থাকে না।
বিখ্যাত জুরিস্ট লর্ড ডেনিং বলেছেন, তিনি বিচার করতে গিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও বিচারকের মানবতাবোধ মনে রাখেন।
প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর অপরাধীদের তুলনায় অনেক বেশি নিরপরাধ লোক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বছরের পর বছর কারাদণ্ড ভোগ করার কারণে বহু নারী-পুরুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে আপিল শেষ হতে না হতে। ইতোমধ্যে তাদের সুখ্যাতি বিনষ্ট হয়েছে। যৌবন হারিয়ে গেছে এবং পরিবার ভেঙে গেছে। তাই দীর্ঘ কারাজীবনের পর আপিলে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার কি আর তেমন অর্থ থাকে!
প্রতিহিংসার মনোভাবদুষ্ট বিচারিক ধারণার ঐতিহ্য ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারকগণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে অনেক বিচারক এবং আইনবিজ্ঞানী বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থায় মানবিক দিকের ওপর জোর দিচ্ছেন।
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের জামিনসংক্রান্ত আইন মেনে চলছি এবং পুলিশি শক্তির বাহাদুরি দেখানোর জন্য সেই আইনের প্রয়োগে অনেক বেশি কঠোরতা অবলম্বন করছি। শাসনতন্ত্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো বা জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মানবাধিকারগুলো তেমন কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ জন্যই গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে হরদম জেলে পাঠানো হচ্ছে।
পুলিশি শক্তির এত বেশি অপব্যবহার করা হচ্ছে যে, রাজনীতি পুলিশি মামলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং এ জন্য আদালত জামিন প্রদানে অনীহা দেখাচ্ছে। জামিন দানে অস্বীকৃতি কিংবা জামিন বাতিল করার ব্যাপারটি এখন নি¤œ আদালতের ক্ষমতা প্রদর্শনের সহজ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে যাদের খরচ বহনের ক্ষমতা আছে তারা জামিনের কোনো সুযোগ আছে কি না, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টে এসে ভিড় করছে।
আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়া নিরপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার করার ব্যাপারটি এতটাই সহজ করে দিয়েছে যে, যেদিন থেকে কাউকে গ্রেফতার দেখানো হবে সেদিন থেকেই সে অপরাধী। পুলিশের ইচ্ছায়ই তাকে বন্দী জীবন যাপন করতে হবে। সুতরাং এই সময়ে পুলিশের হাতে থাকবে সব ক্ষমতা এবং জনগণ থাকবে সর্বতোভাবে অসহায়।
এ ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার রক্ষায় যে নিশ্চয়তা শাসনতন্ত্রে দেয়া হয়েছ তার কতটুকু মূল্য থাকে। জামিন পাওয়ার অধিকারের ক্ষেত্রে আমরা বলতে গেলে ঔপনিবেশিক আমলের চেয়েও নিকৃষ্ট অবস্থায় রয়েছি। তখন বিচার ব্যবস্থায় রাজনীতি ছিল না।
আস্থা করার মতো নেতৃত্বের অভাবে জনগণ সংগ্রাম করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে এমন ধারণা ক্ষমতাসীনদের যে কেউ পোষণ করতে পারেন। জনগণ তাদের মৌলিক ভোটাধিকার হারানোর ফলে সব অধিকারই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের মতো লোকেরা তাদের জন্য দুঃখ অনুভব করি, সেই সাথে নিজেদের জন্যও।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ চূড়ান্তভাবে সত্য বলে প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত তিনি আইন ও আদালত প্রদত্ত জামিনের শর্ত অনুযায়ী অবশ্যই মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার ভোগ করতে পারবেন। এটাই হবে মানবিক বিচার ব্যবস্থা। জামিনের আবেদন মঞ্জুর না করে পুলিশি বিচারে কাউকে জেলে আটক রাখা বিচার ব্যবস্থার জন্যও অপরাধ।
এ বিষয়ে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের চেয়ে আমাদের দেশের আইনজীবী ও বিচারকগণ সুবিচারের সৈনিকসুলভ চিন্তা-ভাবনা এখনই শুরু করতে পারেন।
- লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
- কার্টসি — নয়াদিগন্ত / ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
No comments:
Post a Comment