সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ |
‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে শহীদ হয়েছেন। অথচ এত বছর পর রাষ্ট্র আমাকে ও আমার মাকে রাজাকারের খেতাব দিল। এই লজ্জা, এই দুঃখ কোথায় রাখব? এখন আর বেঁচে থেকে কী লাভ?’ একজন মুক্তিযোদ্ধার এই যে আক্ষেপ, এই যে বেদনা, তার রচয়িতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার আওয়ামী লীগ।
কিছুদিন আগেই ‘যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত করেছে, পেটে লাথি মেরেছে, শেষযাত্রার কফিনে তাদের সালাম, স্যালুট আমি চাই না’ চিরকুট লিখে বুকভরা অভিমান নিয়ে, রাষ্ট্রীয় সম্মান না নিয়েই চিরবিদায় নিয়েছেন দিনাজপুরের মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। এমনি বহু জানা-অজানা অপমানের বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে বা হচ্ছে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল বরিশালের আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে। তার ছেলে আইনজীবী তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে তপন কুমার একজন রাজাকার! একই তালিকায় রাজাকার বানানো হয়েছে তার মা প্রয়াত ঊষা চক্রবর্তীকেও। এ তালিকায় এমন সব ব্যক্তির নামও আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত। এসেছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নামও (প্রথম আলো, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯)।
তপন কুমার চক্রবর্তীর মেয়ে মনীষা চক্রবর্তী পেশায় চিকিৎসক এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল জেলা শাখার সদস্যসচিব। তিনি বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধমক ও মাস্তানি উপেক্ষা করেও মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। তার বাপ-দাদাকে আওয়ামী লীগ রাজাকার বানাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে তাদের মতের বাইরে সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। কাদের সিদ্দিকী, ডক্টর কামাল হোসেনকে পর্যন্ত যেখানে রাজাকার বলা হয়, একজন সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত যেখানে পাকিস্তানের চর বলা হয়, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাজাকার তকমা দেওয়া হয় অবলীলায়, সেখানে মনীষার বাবা বা দাদি বাদ যাবেন কেন! তবে এই যে যা খুশি তাই করতে পারছে আওয়ামী লীগ, সে জন্য আমরাও কম দায়ী নই। আমরা যদি ওই ব্যক্তিদের বিষয়ে মানহানিকর কথা বলার সময় একযোগে সঠিক প্রতিবাদটা করতাম, তাহলে হয়তো এ অবস্থা তৈরি হতো না।
কিন্তু বরিশালের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মিহির লাল দত্ত এবং তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জিতেন্দ্র লাল দত্তের নামও কেন এসেছে তালিকায়, সে এক রহস্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নামইবা কেন এলো সেটাও আরেক রহস্য।
রাজাকারের তালিকায় বাবা ও দাদার নাম আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মিহির লাল দত্তের ছেলে শুভব্রত দত্ত বলেন, ‘আমার বাবা একজন ভাষাসৈনিক এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমার দাদা ও এক কাকা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমার বাবা ও শহীদ দাদার নাম কীভাবে রাজাকারের তালিকায় এসেছে, সেটা আমার বোধগম্য নয়।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নিজের নাম দেখে হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমানিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। তিনি বলেছেন, সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ সীমাহীন অযতœ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে যে তালিকা প্রচার ও প্রকাশ করেছে, তা প্রমাণিত। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তিনি তালিকাভুক্ত ভাতাপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। মন্ত্রণালয় তাকে সনদও দিয়েছে। বর্তমান সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্বটি পালনের জন্য যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ করেছে। আর এত দিন পর জানা গেল সেই লোক রাজাকার!
কিন্তু এত্তো বড় ব্লান্ডার করার পর যখন সবাই সমালোচনামুখর, তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলে দিলেন, আমরা না, রাজাকারের এই তালিকা পাকিস্তানিরা করেছে। আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে, আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি। সেখানে কার নাম আছে আর কার নাম নেই, সেটা আমরা বলতে পারব না।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও এসে একাধারে এগারো বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও যদি পাকিস্তানের করা রাজাকারের তালিকা কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করতে হয়, তাহলে এটা বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, এ দলটি মুক্তিযুদ্ধেও প্রকৃত ইতিহাস রক্ষণাবেক্ষণ না করে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল।
আসলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আওয়ামী লীগের প্রকৃত দরদ কতটা আর তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর কৌশল কতটা, সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন। ১৯৭১ থেকে ৭৫ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল ক্ষমতায় থেকেও এই দলটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় করার কথাও ভাবেনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণ তহবিল পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর এই মন্ত্রণালয়টিও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারই গঠন করেছিল। জিয়াউর রহমান যুদ্ধের যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, তা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণেই জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠনের পর তার সঙ্গেই শামিল হয়েছিলেন ব্যাপকসংখ্যক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যারা তাস খেলে আরাম আয়েশে থেকে সার্টিফিকেট নেননি। যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন।
রাজাকারের তালিকা ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করার প্রেক্ষাপটে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগের কারা কারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের তালিকা প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আজকে আওয়ামী লীগের হাতেই গণতন্ত্র নিহত হয়েছে, যারা দাবি করে তারাই স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র ধারক-বাহক।
আওয়ামী লীগের এই যে চেতনার দোহাই, এই যে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় সম্পদ বানিয়ে কুক্ষিগত করা, তার পেছনে যে আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সেটা পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তো সংবিধানেই আছে। ‘... আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;।’ ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্র্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ এই তো সংবিধানে সন্নিবেশিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এগুলো কি রক্ষা করছে আওয়ামী লীগ সরকার? এ দেশে তাদের সমর্থকরা ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে। আবার অন্যদিকে সাধারণ জনগোষ্ঠী আরও গরিব হচ্ছে। বিশ্বের অতিদরিদ্র পাঁচটি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ একটি হচ্ছে। তাহলে কীসের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলো? এই দেশে কি আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে? এই দেশ কি জনগণের হয়েছে? বরং এসব কিছু লাঞ্ছিত হয়েছে আওয়ামী লীগের হাতে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ায় দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে একটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। আর সেই দেশে সেই দল আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিল! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসকারী এর থেকে বড় কাজ আর কী হতে পারে?
এই দেশ স্বাধীন করতে যে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হলেন, তাদের পরিবারের খোঁজ কি রাখে এই সরকার? ত্রিশ লাখের মধ্যে ঠিক কতটা পরিবার পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় সুবিধা? সেটা মোট শহীদের কত শতাংশ? কেন এত বছরেও মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত শহীদের তালিকাটি করা গেল না? জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কম? তাহলে জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা যে সম্মান ও সুবিধা পাচ্ছেন, তেমনি তালিকা করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদেরও কেন সম্মান ও সুবিধা দেওয়া হবে না? একসময় সে তালিকা করা হয়তো আরও দুরূহ হয়ে পড়বে। এখনো সময় আছে। প্রত্যেক ইউনিয়নভিত্তিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা করে তাদের নামফলক দেওয়া যেতে পারে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে। শত বছর, সহস্র বছর পরও যাতে ওই এলাকার মানুষ জানতে পারে এই দেশটি স্বাধীন করতে তাদের কোন কোন বীর স্বজন জীবন দিয়েছেন। এদিকে হয়তো যাবে না এ সরকার। কারণ এখানে চেতনার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনাকে ভুলভাবে বহুল ব্যবহার করে এটাকে রীতিমতো হাস্যকর করে ছেড়েছে। এই যে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করল, এটা তো সরকারি দলিল। এর মাধ্যমে কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি করা হয়নি? শুধু ভুল স্বীকার করে তালিকা প্রত্যাহারই কী যথেষ্ট?
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্টে ভেজাল নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল ২০১৪ সালে। তখন একটি জাতীয় দৈনিকে লেখক কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছিলেন, ‘পৌনে তেরো আনাই খাদ’। আসলে শুধু ক্রেস্টের সোনায় নয়, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একক মালিকানার দাবির অন্তত পৌনে তেরো আনাই খাদ।
- লেখক, চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
- কার্টসি - দেশ রূপান্তর / ডিসেম্বর ১৯ , ২০১৯
No comments:
Post a Comment