Search

Monday, December 2, 2019

খেলাপি ঋণ বাড়ছে না কমছে?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

আমার মনে আছে, নতুন অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পরপরই বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। কিছুদিন পর তিনি আবারও বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো সুযোগই নেই। আরও কিছুদিন পর সাংবাদিকরা যখন জানালেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে; অর্থমন্ত্রী তখন বললেন, তিনি বিশ্বাস করেন না। খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান পরিবেশন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মন্ত্রী যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও বিশ্বাস না করেন, তাহলে তার বিশ্বাসের ভিত্তি কোথায়? এখন পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা যাক।

অর্থমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাসের মূলে ছিল তার কিছু ধারণা এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রথমেই তিনি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে এক যুগ আগের সংজ্ঞায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিন মাস অচল থাকার পরিবর্তে এখন ছয় মাস অচল থাকলে তাহলেই হিসাবটি খেলাপি হবে। এটি আন্তর্জাতিক খেলাপি ঋণ নীতিমালার স্খলন। তবে অর্থমন্ত্রী মনে করেছিলেন, শিথিলকরণের কারণে অনেক খেলাপিই খেলাপমুক্ত হবেন। অতএব, খেলাপি ঋণ কমে যাবে। অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি ছিল, দুই শতাংশ টাকা জমা দিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব খেলাপি ঋণকে ১০ বছরের জন্য মাত্র ৯ শতাংশ সুদে খেলাপমুক্ত করা যাবে। ভেবেছিলেন, সব খেলাপি যদি খেলাপমুক্ত হয়ে যান, তাহলে তো দেশে আর খেলাপি ঋণ থাকবে না। কিন্তু তার এই ধারণা যে কতটা সরলীকৃত ছিল, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ


বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর প্রতিটি কোয়ার্টারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এবং বৃদ্ধির পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে এই হিসাবে একমত হয়নি আইএমএফ। বিশ্ব সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে, তাও খেলাপি। আবার অনেক ঋণ খেলাপির যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সব মিলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ হবে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী অবলোপনের নীতিমালাতেও শিথিলতা এনেছেন। আগে পাঁচ বছর থাকার পর অবলোপন করা যেত। সেটিকে সম্প্রতি তিন বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন ব্যাংক মালিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রস্তাব রেখেছেন, সময় ব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গেই অবলোপন করার বিধান করা হোক। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে চাপে আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা গোড়া থেকেই বলে এসেছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে শিথিলতা প্রদর্শন করলে খেলাপিরা উৎসাহিত হবেন। এ প্রক্রিয়ায় আদায় ব্যাহত হবে। যে কাজে উৎসাহ দেওয়া হয়, তা বেড়ে যায়। আর যে কাজে শাস্তি প্রদান করা হয়, সে কাজ কমে যায়। এ কারণে ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং মন্দ কাজে শাস্তি দেওয়া হয়। পৃথিবীর সর্বত্রই ব্যাংকের খেলাপিদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। কারণ, ঋণের টাকা ব্যাংক মালিকদের নয়। বরং এ সম্পূর্ণ টাকাই জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত আমানত; যা আইন অনুযায়ী 'চাহিবা মাত্র ফেরত প্রদান' করতে হবে। কাজেই জনগণের টাকা ট্রাস্টি হিসেবে ব্যাংকারদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে; যাতে বিনিয়োগকৃত টাকা মুনাফাসহ সময়মতো ফেরত আসে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে সম্প্রতি পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন উপায়ে খেলাপিদের উৎসাহ প্রদান করার ফলে তারা শাস্তি থেকে শুধু মুক্তিই পাচ্ছেন না, বরং পুরস্কৃত হচ্ছেন। এতে দ্বিগুণ উৎসাহে তারা ঋণ ফেরত না দেওয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছেন।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে কমবেশি ১০ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে; এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকাই নিয়মিত ঋণ। এক লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। এটি অবশ্য বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার আগের চিত্র। এই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। ৯ লাখ কোটি টাকা নিয়মিত ঋণের যারা গ্রাহক ছিলেন, তাদের প্রদেয় সুদের হার এখনও ১০ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। অথচ খেলাপি ঋণগ্রহীতারা সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধের। ফলে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীরা ৯ শতাংশ সুদের আওতায় আসার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং খেলাপি হয়েছেন। ফলে প্রতি প্রান্তিকে নতুন খেলাপিদের কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎসাহ দিলে যে মন্দ কাজের বৃদ্ধি ঘটে, এটি তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

আমরা এখানে চীনের ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করার পর অনভ্যাসজনিত কারণে চীনের খেলাপি ঋণ অনেক বৃদ্ধি পায়। তখন সরকার খেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনের বাইরেও কঠোর শাস্তির বিধান প্রচলন করে। যার মধ্যে ছিল খেলাপি হওয়া মাত্রই কোনো বিলম্ব না করে তার পাসপোর্ট বাতিল। বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা। বিমানের টিকিট ক্রয়ে বাধানিষেধ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কমিটিতে সদস্যপদ লাভে অযোগ্যতা এবং ভিআইপি বা সিআইপি হিসেবে গণ্য হওয়ার অযোগ্যতা। এছাড়া দীর্ঘ সময়ের খেলাপি হলে সরাসরি জেলে নিয়ে যাওয়া হতো। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ফলাফল দ্রুতই পাওয়া গেল। কমবেশি তিন বছরের মধ্যে খেলাপির হার সর্বনিল্ফেম্ন নেমে গেল।

অর্থমন্ত্রী ও তার সমর্থক মহল থেকে এখন বলতে চেষ্টা করা হচ্ছে যে, দুই শতাংশ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপিমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি সম্পন্ন হলে দেশ আর খেলাপি থাকবে না। কিন্তু খেলাপির চেয়ে অখেলাপিরা এখন ৯ গুণ বেশি। এখন ধীরে ধীরে অখেলাপিদের সংখ্যা যদি আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকত, তাহলে মন্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী যাই হোক না কেন, ব্যাংকগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সেইসঙ্গে জনগণের সঞ্চিত অর্থ আটকা পড়লে বড় রকমের ভীতির সঞ্চার হতে পারে। এমনকি সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরেও প্রচণ্ড আঘাত আসতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এই সাক্ষ্যই প্রদান করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের খেলাপি ঋণও কমবেশি ১০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এত বড় দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে প্রচণ্ড আঘাত এসেছে। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আমরা অবাক হই, যখন মন্ত্রীর মুখে শুনি, ভারতের খেলাপি ঋণও আমাদের মতোই বেশি। কিন্তু তিনি বলেন না যে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির থেকে প্রতি কোয়ার্টারেই কমে আসছে। অর্থমন্ত্রী কি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা শ্রীলংকার খেলাপি ঋণ হারের উদাহরণ দিতে পারেন না? এসব দেশে খেলাপির হার ১ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে। চোখ থাকতে অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হবে কি?

কেন এমনটি ঘটছে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত এ দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, ড. এআর মল্লিক, সাইফুর রহমান, এসএএমএস কিবরিয়া, এএমএ মুহিত। তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু কেউই ব্যবসায়ী ছিলেন না। এমনকি তারা কেউ সেই অর্থে ধনাঢ্য ব্যক্তিও ছিলেন না। ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রী হলে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। তারা চাইবেন নিজের এবং ব্যবসায়ী স্বজনদের আয়-উন্নতির দিকে খেয়াল রাখতে। এতে জনগণ বঞ্চিত হতে পারে। এ কারণেই বর্তমান সমস্যার সৃষ্টি।

আমরা মনে করি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকা উচিত পূর্বসূরিদের মতো অব্যবসায়ীর হাতে। অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয় প্রকৃত রাজনীতিকদের হাতে। রাজনীতিকরা ব্যবসা করতে পারবেন না- তা নয়। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীর দৃষ্টি থাকে আরও বড় হওয়ার দিকে এবং নিজ গোষ্ঠীকেও ওপরে টেনে তুলতে। এই স্বার্থের সংঘাত পরিহারযোগ্য।

ভারতের মতো ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগেই বিষয়টির প্রতি সত্যিকার রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি বিশ্নেষণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি এ ব্যাপারে পেশাগত সহায়তা দেওয়ার জন্য দেশের অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ শুনে দেখতে পারেন। উল্লেখ্য, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নিজে একজন স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও এসব ব্যাপারে পাঁচজন দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদকে নিয়ে একটি পরামর্শক কমিটি করেছিলেন। আমাদের দেশেও এ উদাহরণ অনুসরণ করা যেতে পারে।

  • খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
  • কার্টসি — সমকাল/ ডিসেম্বর ২, ২০১৯ 

No comments:

Post a Comment