মরিয়ম চম্পা
ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের মল্লিকপুর এলাকায় বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে বাবা-মেয়ে আর পুলিশের এক কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন। গত সোমবার ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসটি বোয়ালমারী থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। মামুন পরিবহনের বাসটি যাচ্ছিল ঢাকা থেকে মাগুরায়। মল্লিকপুর এলাকায় গাড়ি দু’টির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় নিহত ছয়জনই মাইক্রোবাসের যাত্রী।
সম্প্রতি চট্রগ্রামে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বেড়ানোর আনন্দকে বিষাদে ভরিয়ে দিয়েছে। গোটা পরিবারকে তছনছ করে ফেলেছে।
এই দুর্ঘটনায় পরিবারের বাবা ও দুই মেয়ে মারা গেছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে লরির সঙ্গে প্রাইভেটকারের সংঘর্ষে তছনছ হয়ে গেল গোটা পরিবার। সকাল আটটার দিকে ফৌজদারহাট-বন্দর বাইপাস সংযোগ সড়ক এলাকার এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান মিন্টু ও তার দুই মেয়ে। নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বান্দরবান বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে তাঁদের বহনকারী প্রাইভেটকারটি।
গত বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ হাজার ২’শ ২৭ জন। দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৭০২টি। নিরাপদ সড়ক চাই-এর (নিসচা) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। নিরাপদ সড়ক চাই্থএর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই হচ্ছে মহাসড়কে। আর দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারির অভাব। অনেক নির্দেশনা, আইন মানা হয় না এবং সেগুলো নজরদারির আওতায়ও থাকে না। মূল শহরের রাস্তায় বা মহাসড়কে কম গতির যানবাহনগুলো না চলার বিষয়ে যে নির্দেশনা ছিল, তা অনেকাংশেই মানা হয় না। গত এক বছরে দেশের সড়কে যানবাহন বেড়েছে ১০ লাখেরও বেশি। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্তৃপক্ষের নজরদারি না বাড়ার কারণে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাসড়কে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা সহ কম গতির বহু যানবাহন চলাচল করে। এছাড়া একটু পর পর দেখা যায় রিক্সা স্ট্যান্ডের মত জায়গায় মানুষ জমায়েত হয়ে থাকে। চার লেন হওয়ার পর রাস্তায় যানবাহনের গতি বেড়েছে, কিন্তু একইসাথে রাস্তায় কম গতির যানবাহন চলাচল করতে দেয়ায় দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে। আর এই কম গতির যানবাহনের চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তারা। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পুলিশের পাশাপাশি যানবাহন চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য বিনিয়োগ করে বর্তমান লোকবলের দক্ষতা বাড়ালেই অনেকাংশে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।
হাইওয়ে পুলিশের মতে, কার্যপরিধি ও জনবল কম থাকার কারণে মহাসড়কের সব অংশে নজরদারি নিশ্চিত করতে পারে না পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশের মোট ৭৬টি আউটপোস্ট আছে, কিন্তু সেগুলো সকল মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক কাভার করে না। কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে তারা।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সারা দেশের গণপরিবহনকে নিয়ন্ত্রণ এবং মনিটরিং করার সক্ষমতা বিআরটিএর নেই। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজির মাত্রাটা অনেক বেড়েছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এটা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এবং চাঁদাবাজির কারনে গণ পরিবহনের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং বেপরোয়া হয়ে গেছে। যে শর্তগুলো সড়ক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সেগুলো দেয়া হয় নি। ফলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। আইনকে হতে হয় নমনীয় এবং বাস্তবায়ন কঠোর হতে হয়। আমাদের এখানে আইন কঠোর কিন্তু বাস্তবায়ন নমনীয়। এটা থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে আইনকে সহনশীল করতে হবে। বাস্তবায়ন কঠোর করতে হবে। এটা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে সড়ক নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য কোনো মাধ্যম নেই। গাড়ির চালক যখন বেপরোয়া চালায় অথবা যাত্রীদেরকে যখন চলন্ত গাড়ি থেকে উঠতে নামতে বাধ্য করে এখানে যাত্রীদের চেয়ে চালকদের সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যাত্রীদের সচেতনতা কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। তবে পথচারি দুর্ঘটনার হার কিছুটা বেড়েছে। এজন্য সচেতনতা প্রয়োজন। এখানে আমি মনে করি, ট্রাফিক আইন শতভাগ নিশ্চিত করা জরুরী। এবং ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও অব্যবস্থাপনা গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার জন্য অন্যতম দায়ী। সুতারং ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে কাঙ্খিত সাফল্য পাওয়া অনেক কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের বিষয়।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক ডিএমপি মো: মফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেমন আইনের প্রয়োগের বিষয় আছে একইভাবে অন্যান্য কিছু বিষয় এটার সঙ্গে যুক্ত। পথচারি, চালক, মালিক সবার সচেতন হওয়ার বিষয় আছে। সব বিষয় সমন্বিতভাবে এটা প্রতিরোধে আমরা কাজ করছি। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এবং সেই কমিটি থেকে ১শ ১১ দফার একটি সুপরিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কাজ করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর এলাকায় গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি দুর্ঘটনা ঘটে। সেগুলো নিয়ে আমরা গবেষণা করি। এবং কার কি করনীয় সেগুলো চিহ্নিত করা হয়।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, দুর্ঘটনা রোধে গণ পরিবহণে শৃঙ্খলা আনতে হবে। রিকশাগুলোকে ক্রমান্বয়ে মূল সড়ক থেকে তুলে দিতে হবে। রিকশার পরিবর্তে কি আসবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। মোটরসাইকেলের বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ সড়ককে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি মহাসড়কে মিনিবাস বা ছোট ছোট গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।
- কার্টসি — মানবজমিন/ জানুয়ারি ১১, ২০২০