Search

Wednesday, February 19, 2020

প্যারোলের রাজনীতি ও আইনের প্রশ্ন

কামাল আহমেদ

কান্ডারিহীন বিএনপি এবার প্যারোল রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা, প্যারোল অনুমোদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো আইন নেই এবং তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছাধীন ও পরিবর্তনশীল নীতিমালায় অনুশীলন করা হয়। অতএব, একজন সত্তরোর্ধ্ব ও অসুস্থ রাজনীতিকের প্যারোল নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরাও মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এমনকি, ১২ বছর একটানা ক্ষমতা ধরে রাখার সুবাদে অভ্যাসসূচক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে চলেছেন। অবস্থাদৃষ্টে তাই প্রশ্ন উঠছে, আন্দোলন ও নির্বাচনের মতোই প্যারোলের রাজনীতিতেও কি বিএনপি বিভ্রান্তির কবলে পড়তে চলেছে?

প্যারোল কথাটা রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে অতীতে দুটো কারণে প্যারোলের কথা শোনা গেছে। একটি হচ্ছে মানবিক এবং অপরটি রাজনৈতিক। মানবিক কারণে প্যারোল বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া এর আগেও পেয়েছেন। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে বছরখানেক সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি একই ভবনে একই ধরনের কারাজীবন পার করছিলেন, সে সময়ে তাঁর মায়ের মৃত্যুতে তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন। আর, রাজনৈতিক কারণে যাঁরা প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত পূরণে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এঁদের প্যারোলের ব্যবস্থা করে। রাজনীতির অন্দরমহলের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে এসব প্যারোলের জন্য কাউকে মাঠে বক্তৃতা দিতে হয়নি এবং রাজনৈতিক চাপ অনুভব করার কারণেই তখন সরকার এগিয়ে এসে তার ব্যবস্থা করেছিল। স্বাধীনতার আগের ইতিহাসে না গেলেও পরের ইতিহাসে সুপরিচিত রাজনীতিকদের চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলের দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবের জার্মানিতে চিকিৎসার কথা এখানে স্মরণ করা যায়।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পুত্র চিকিৎসাজনিত প্যারোল পেয়েছিলেন যত সহজে, মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্যারোল ততটাই কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। পুত্রের প্যারোলের বিষয়ে তখন সরকার চাপ অনুভব করেছিল, আর এখন সরকার একেবারেই চাপমুক্ত। তখন প্যারোলের ফয়সালা হয়েছিল নেপথ্যে, আর এখন প্রকাশ্য দেন-দরবারেও সাড়া মেলার কোনো লক্ষণ নেই। তবে, যতটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়া কারাজীবনে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে ততটা চিন্তিত নন। তবে, তাঁর দলের অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাঁরা রাজনীতিতে ক্রমেই তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন বলেন অপরাধ স্বীকার করেই প্যারোলের আবেদন করতে হবে, তখন বোঝা যায় বিষয়টি মানবিক নাকি রাজনৈতিক। প্রশ্ন হচ্ছে, প্যারোল সম্পর্কে আইনের বিধান কী? প্যারোলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার? সরকারের না আদালতের? বিস্ময়কর হলেও সত্য, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, যার আলোকে প্যারোল সম্পর্কে সরকার বা বিরোধী দল বিএনপির পরস্পরবিরোধী দাবির নিষ্পত্তি হতে পারে। অবশ্য প্যারোলের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ২০১০ সালে তৈরি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন এবং ২০১৬-এর কোস্টগার্ড আইনে, যা শুধু ওই দুই বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য। প্যারোলের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় বিষয়টির প্রয়োগের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা মেলে অন্য দুটো আইনে—যার একটি হচ্ছে, দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এবং অন্যটি হচ্ছে দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, ১৮৯৪। তবে, সরকারের যে হালনাগাদ করা প্যারোল নীতিমালার সন্ধান মেলে, সেটি জারি হয়েছিল ২০১৬ সালের ১ জুন। হালনাগাদ নীতিমালায় অতীতের যেগুলোর উল্লেখ (রেফারেন্স) পাওয়া যায় তার একটি হচ্ছে ২০১০ সালের ৩ মার্চের এবং অন্য আরেকটি ২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের। তবে, নীতিমালা কোন আইনের অধীনে তৈরি হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ এতে নেই।

সরকারের সর্বসাম্প্রতিক প্যারোল নীতিতে বলা হয়েছে বন্দীদের নিকটাত্মীয়দের কেউ মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে, এই নির্দেশনায় আরও বলা আছে ‘নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ বা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দীকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে।’ এতে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় এই সময় বেঁধে দেওয়ার এবং বন্দীকে সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশ প্রহরাধীন থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালার আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না বলার পরই তাতে লেখা হয়েছে, তবে ‘বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস/বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।’ এই নীতিমালায় প্যারোলের মেয়াদ নির্ধারণের এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হলেও বন্দীর দোষ স্বীকারের কোনো শর্ত নেই। সুতরাং মন্ত্রীদের মধ্যে যাঁরা অপরাধ স্বীকার করে প্যারোলের আবেদন করতে হবে বলে দাবি করছেন, তাঁদের বক্তব্যে যদি কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করার উদ্দেশ্য খুঁজে পান, তা নাকচ করা সহজ নয়।

প্রবেশন অর্ডিন্যান্স অনুসরণ করা হলে দণ্ডিত ব্যক্তির শর্তাধীন মুক্তির আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আদালতের, সরকারের নয়। এই আইনে মামলার রায় ঘোষণার সময়ে বিচারিক আদালত অথবা আপিল দায়েরের সময়ে উচ্চ আদালত দণ্ডিত ব্যক্তিকে শর্তাধীন মুক্তি দিতে পারেন। মুক্ত থাকার সময়ে তাঁকে ওই সব শর্ত পালন করতে হয় এবং সেগুলো দেখার জন্য প্রবেশন কর্মকর্তা থাকেন। একমাত্র মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত না হলে যেকোনো নারী এই আইনে শর্তাধীন মুক্তিলাভের অধিকার রাখেন। মামলার রাজনৈতিক চরিত্রের কারণে বিচারিক আদালতে তেমনটি যে সম্ভব ছিল না, তা মোটামুটি সবারই জানা। তবে, উচ্চ আদালতে আপিলের পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সেই আবেদনের সুযোগ এখনো থাকার কথা। প্রবেশনের সিদ্ধান্তটি একান্তই বিচারকদের, সরকারের নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপি বিভিন্ন সময়ে যেসব অভিযোগ করে এসেছে, বিশেষ করে খালেদার জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পটভূমিতে, তাতে অবশ্য আদালতের প্রতি আস্থার প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।

তা ছাড়া, এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদালতে প্রবেশন আইন প্রয়োগের প্রবণতা নেই বললেই চলে। বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ইমান আলীর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও পেনাল রিফর্ম ইন্টারন্যাশনাল (পিআরআই) প্রকাশনা ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইউজ অব দ্য প্রবেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ’-এ। বিচারপতি ইমান আলীর কথায় ‘সম্ভবত বিজ্ঞ বিচারকদের শাস্তি প্রদানমূলক মনোভাবের কারণে আমাদের বিচারিক আদালতে প্রবেশনের ব্যবহার অত্যন্ত বিরল এবং এই অবস্থা দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে।’

অন্য আইন, যেটি সোয়া শ বছরের পুরোনো দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, তাতে অন্তত তিনটি ধারায় সরকারকে বন্দীদের সাজা কমানো ও আগাম মুক্তির বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে মন্ত্রীদের কেউ কেউ হয়তো এই আইনের আলোকে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ক্ষমতাটি সরকারের হাতে থাকলে এ রকম হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এবং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করাটাও অপ্রত্যাশিত নয়। প্রিজন্স অ্যাক্টের ৫৯ ধারার ৫,৭ এবং ৯ উপধারায় বন্দীদের আচরণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন এবং সাজা কমানো, বন্দীর মৃত্যুঝুঁকি বিবেচনায় মুক্তিদান এবং দণ্ডের সময় এবং শ্রেণি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা পুরোপুরি সরকারের। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেই যে বিকাশের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধীরা সাজার মেয়াদ শেষ করার আগেই সরকারের কৃপায় মুক্তি পেয়েছেন, সন্দেহ নেই।

সরকারের এখতিয়ার এবং কর্তৃত্ব বিবেচনায় প্যারোল প্রশ্নে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমতাসীন দল সহানুভূতিশীল হবে বিএনপির মধ্যে যাঁরা এমনটি ভাবছেন, তাঁদের ভাবনার ভিত্তি কী, তা-ও স্পষ্ট নয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে হঠকারিতার ফাঁদে পা দিয়ে দলটির যে দুর্গতির শুরু, তা আরও প্রকট হয়েছে নির্বাচন প্রশ্নে অসংলগ্ন অস্থিরতায়। যে কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কখন অর্থপূর্ণ আর কখন নয়, সেই ভেদবোধও তাদের লোপ পাওয়ার আলামত দৃশ্যমান। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা যখন ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরি ছিল, তখন কোনো ধরনের ছাড় আদায় করতে না পারলেও উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনকে বৈধতা দিতে দলটির উৎসাহে কোনো ঘাটতি নেই। এখন প্যারোলের রাজনীতিতেও দলটির ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে।

  • কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০  

প্যারোলে মুক্তি ‘দোষ স্বীকার’ ও বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গ

গোলাম মোর্তোজা

কিছুদিন পরপর প্রায় নিয়ম করে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গটি সামনে আসে। সেই আলোচনায় এখনকার প্রসঙ্গ ‘প্যারোল’। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের মুখ থেকে ‘প্যারোল’ শব্দটি বেশি শোনা যাচ্ছে।

বিএনপির নেতা-আইনজীবীরা বলছেন ‘প্যারোলে’ মুক্তি নয়, খালেদা জিয়াকে জামিন দিতে হবে। তাদের বক্তব্য, যেহেতু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক, ফলে সরকারের সদিচ্ছায় চিকিৎসাজনিত কারণে জামিন হতে পারে। জামিন পেলে তিনি উন্নততর চিকিৎসার জন্যে ইংল্যান্ডে যাবেন।

বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাচ্ছেন না। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করছেন তার আত্মীয়-স্বজন। বিএনপি মহাসচিব খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও মনোভাব সম্পর্কে জানছেন, দেখা করে আসা আত্মীয়দের থেকে।

খালেদা জিয়ার মুক্তিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রসঙ্গে সামনে আসছে। আইনগতভাবে খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন কিনা বা জামিন পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা? ‘প্যারোল’র আওতায় মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? ‘প্যারোলে’ মুক্তি পেলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা?

প্রথমে আসি ‘প্যারোল’ প্রসঙ্গে।

‘প্যারোল’ বিষয়ে সংসদ প্রণীত কোনো আইন নেই। প্যারোল সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। ২০১৬ সালের ১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালা অনুযায়ী প্যারোলে ‘শর্তাধীনে সাময়িক সময়’র জন্যে মুক্তির সুযোগ আছে। গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যান্য শ্রেণির হাজতি বন্দিদের কাছের কেউ মারা গেলে সাধারণত প্যারোলে মুক্তি পেয়ে থাকেন।

‘সাময়িক সময়’ ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না, নীতিমালায় বলা হয়েছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় সরকার সময় কমাতে বা বাড়াতে পারে। কতদিন, মাস বা বছর বাড়াতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই।

‘সাময়িক সময়’ কমবেশি যাই হোক পুরো সময় তাকে পুলিশি প্রহরা বা নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, প্যারোলে মুক্ত বন্দিকে পুলিশ কারাগারের ফটক থেকে বুঝে নিবে এবং নির্দেশিত সময়সীমার মধ্যে আবার কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “প্যারোলে মুক্ত কোনো বন্দি বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিবেচনায় বিদেশে যেতে পারবেন না। এছাড়া প্যারোলে মুক্তির সঙ্গে বন্দির দোষ স্বীকার করা বা না করার কোনো সম্পর্ক নেই।”

“প্যারোলে মুক্তি পাওয়া বন্দির বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে”-দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমান মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, “বিদেশে গিয়ে সেই বন্দিকে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসকে বিষয়টি জানাতে হবে। তিনি কোথায় থাকছেন, কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সবকিছু দূতাবাসকে জানিয়ে রাখতে হবে।”

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল জলিল প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন।

প্যারোলে মুক্তির পর বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই, আবদুল জলিলকে কীভাবে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো? তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি।

২০০৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আট সপ্তাহের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন।

এবার আসি জামিন প্রসঙ্গে।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা চলমান এবং দুটি মামলায় তিনি দণ্ড পেয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত দুটি মামলা অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলার পুরো কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এই দুটি মামলার সম্পূর্ণ কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ায় জামিনের কোনো সুযোগ নেই। কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যাওয়া মামলায় আদালত জামিন দিতে পারেন না। খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন চলমান মামলাগুলোতে। চলমান সবকয়টি মামলায় যদি খালেদা জিয়া জামিন পান, তবুও তার কারামুক্তির সুযোগ নেই।

‘প্যারোলে’ মুক্তির বাইরে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দোষ স্বীকার করে নিয়েই ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেন। বিবেচনায় নিয়ে সম্পূর্ণ দণ্ড মাফ করে দিতে পারেন। দণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে দিতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে দণ্ড স্থগিত রেখে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন খালেদা জিয়া কী চাইছেন? কয়েক মাস আগে বিএনপির সংসদ সদস্যরা কারাগারে দেখা করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। বিএনপির একজন সংসদ সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি প্যারোল বা মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ‘কোনো লাভ নেই’-বলে খালেদা জিয়া তাকে আলোচনা করতে না করে দিয়েছিলেন।

তার মতে, তখনই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না।

কয়েক দিন আগে খালেদা জিয়ার বোনসহ আত্মীয়রা দেখা করেছেন। বিএনপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আত্মীয়রা দেখা করে এসে বলেছেন খালেদা জিয়ার অবস্থা খারাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তার দুই হাত বাঁকা হয়ে গেছে। খেতে পারছেন না। জামিন বা প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে এই প্রথম তিনি বলেছেন ‘যা ভালো মনে করো’ করতে পারো। ধারণা করছি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই হয়তো তিনি একথা বলেছেন। তবে বেগম খালেদা জিয়া কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না। কারণ তিনি কোনো অপরাধ করেননি।

একটি সূত্র অনুযায়ী, বিএনপি দলীয়ভাবে প্যারোলে মুক্তি চাইবে না। পরিবার সরকারের থেকে নিশ্চয়তা পেলে প্যারোলে মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। তখন বিএনপি বলবে, আত্মীয়রা মানবিক কারণে প্যারোল চেয়েছে। রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএনপি নেতাদের প্রায় সবাই এখন মনে করছেন, অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে খালেদা জিয়ার সুস্থ থাকা বা বেঁচে থাকা জরুরি। প্যারোলে মুক্তি চাইলে বা পেলে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তারা মনে করছেন না। সরকার এমন প্রচারণা চালালেও, বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারের কথা দেশের মানুষ বিশ্বাস করবেন না। মানবিক বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পেলে বিএনপির রাজনীতির জন্যে তা মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু তাদের ভেতরে একটি সংশয় বা সন্দেহ তীব্রভাবে বিরাজ করছে, সরকারপ্রধান কী ভাবছেন তা তারা জানেন না। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলে মির্জা ফখরুলের সংশয় বা সন্দেহ কাটেনি। আদালত নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। এবং সেই সিদ্ধান্ত মূলত সরকার প্রধানের।

  • কার্টসি - ডেইলি স্টার/ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০ 

খালেদা জিয়ার মুক্তি কীভাবে

মিজানুর রহমান খান

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ ও পন্থা নিয়ে কথা উঠেছে রাজনীতিতে। যে অভিযোগে তাঁকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তর্কের খাতিরে কেউ সেটা যথার্থ মেনে নিতে পারেন। মেনে নিয়েই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই ভূখণ্ডে অভিন্ন বা সমচরিত্রের অভিযোগে অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কে কোথায়? কারও জন্য আইনের দোহাই, কারও ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ নেই। যদি একজন এরশাদ ও নাজমুল হুদারও জামিন পাওয়া নিয়ে একই রকম আইনের প্রয়োগ দেখা যেত, তাহলে কথা কম উঠত। যেহেতু এক যাত্রায় ভিন্ন ফল পাওয়ার মূল কারণটা রাজনীতিতে, তাই রাজনৈতিকভাবেই এর প্রতিকার প্রতীয়মান হয়। যদি রাজনৈতিক কারণেই খালেদা জিয়া দণ্ডিত হয়ে থাকেন, তাহলে রাজনীতিই হবে তার প্রতিষেধক। এই রকম ব্যাখ্যা যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে ‘শুধু আদালতই পারেন’, এই যুক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

কাউকে মুক্তিদান প্রশ্নে আদালত অপেক্ষাকৃত কম এখতিয়ার ভোগ করেন। যে আদালত দণ্ড দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে সেটা ওল্টানো যাবে না। আদালত কোনো রায়ই বাতিল করতে পারেন না। আদালত সব সময় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিজের রায়ের ত্রুটি বদলাতে পারেন না, সুযোগ থাকে না। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা প্রায় অপরিসীম। তাদের হস্তক্ষেপে মুক্তি পাওয়ার নানা নজির আছে। কিছুকাল আগে একজন দণ্ডিত ব্যক্তির রাষ্ট্রপতির ক্ষমার দরকার পড়ল না। তিনি মুক্ত মানুষ হলেন। অথচ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় তিনি দরখাস্ত দেননি। তিনি দণ্ডিত, তারপরও সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে পেরেছে।

রাষ্ট্র ও সরকারের আছে অনেক ক্ষমতা। সরকার রাজনৈতিকভাবে কিছু একটা করতে চাইছে, কিন্তু আইনে মানা আছে বলে করতে পারছে না, এমন একটা অবস্থা বাংলাদেশে কমই হয়। সুতরাং নানা উপায় আছে। আইন বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে আদালত যেকোনো কার্যধারা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। এটা মামলার যেকোনো পর্যায়েই—রায়ের আগে হতে পারে, রায়ের পরেও হতে পারে। অবশ্য রায়ের আগে ও পরে সমান কথা নয়। রায়ের পরে হলে শুধু দণ্ড বিরাম বা মওকুফ করা যাবে। কিন্তু তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়া মুছে ফেলা যাবে না। তিনি আইনের চোখে অপরাধী থাকবেন। ‘এতিমের তিন কোটি টাকা মেরে খাওয়া’র সুবিচার আর ‘ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে খাওয়ার’ অবিচারের মধ্যে কোনটি জনস্বার্থের বেশি বা কম ভালো, সেটা জ্বলন্ত প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলছেন, তাঁরা খালেদা জিয়ার প্যারোলের দরখাস্ত পাননি। এ কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে যে দরখাস্ত করা হলে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হতে পারে। আবার এটাও ধরে নেওয়ার উপায় নেই যে তাঁরা প্যারোলের দরখাস্তের অপেক্ষায় নেই এবং সেটা পাওয়ামাত্রই সেটা ছুড়ে ফেলে দেবেন। তবে অনুমান করি, সরকার চাইতে পারে যে দরখাস্ত আসুক। এতে তাদের রাজনৈতিক জিত হয়। সুতরাং বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারের সামনেও আইন নানা বিকল্প রেখেছে।

দরখাস্ত হোক জামিনের বা প্যারোলের—মোটকথা একটি জীবনকে প্রলম্বিত করার জন্য যেখানে কারামুক্তি পেতেই হবে, সেখানে কার্যপ্রণালি বড় নয়। তবে বিদ্যমান আইন বলছে, নারী, বিশেষ করে তিনি যদি প্রবীণ নাগরিক হন এবং তাঁর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে তিনি জামিন পেতে বিশেষ বিবেচনার হকদার।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়ে স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হওয়ার সামান্য কোনো ঝুঁকি নেবে না। তাই খালেদা জিয়াকে তারা মুক্তি দেবে না। পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে, তাঁকে এভাবে রেখে দেওয়াটাই স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি, কে সেটা হলফ করে বলবেন?

জীবন ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার অধিকার মৌলিক। রাষ্ট্রের একটি অঙ্গের কাছে আমি মানবিক কারণে দরখাস্ত করতে পারি, কিন্তু একই রাষ্ট্রের আরেকটি অঙ্গের কাছে আমি মানবিক কারণে প্যারোল চাইতে দ্বিধান্বিত—বিএনপির তরফে এই দুই অবস্থা দ্বন্দ্বমূলক। বিএনপির কিছু নীতিনির্ধারক এর আগে প্যারোল চাইতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বাধা দিয়েছেন। তাঁরা এখনো সক্রিয়। বিএনপি রাজনৈতিক আবেগকে পাথেয় ভাবছে, কিন্তু তা অকার্যকর প্রমাণিত। এই আবেগ একান্তভাবে বিএনপির গোষ্ঠীগত।

বিএনপির প্রতিনিধিদলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাওয়াও একদম মূল্যহীন ছিল না। একটা সংলাপ সেখানে হয়েছে, সেটা মুছে যায়নি। বিশ্বাস করার কারণ আছে যে মির্জা ফখরুলের মতো প্রবীণ নেতারা আফসোস করতে পারেন এই ভেবে যে কট্টর নেতাদের কারণে প্যারোলের সুযোগটা হাতছাড়া হলো। গত নির্বাচনের পর গণভবনে গিয়ে, শপথ নিয়ে বিএনপি যে ‘কার্যকর রাজনৈতিক বৈধতা’ সরকারকে দিল, তার বিনিময়ে বিএনপি কিছু চেয়েছে কিংবা আওয়ামী লীগ কিছু দিতে রাজি ছিল, এমন কোনো ধারণা আমরা কোথাও থেকে পাই না।

দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে মুঠোফোনে আলোচনায় কয়েকটি ধারণা জন্মাল। প্রথমত, এর আগে শেখ হাসিনা, তারেক রহমান, খালেদা জিয়া প্যারোল নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁরা কেউ দণ্ডিত ছিলেন না। তাঁর প্রশ্ন, দণ্ডিত ব্যক্তিদের প্যারোল–প্রক্রিয়া কী হবে। তাঁর আরও প্রশ্ন, খালেদা জিয়া দুদকের মামলায় দণ্ডিত। দুদক আইনের মামলা সরকার নয়, তুলতে পারে দুদক। কিন্তু আইনে মামলা তুলে নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই। সুতরাং সিআরপিসির ৪০১ ধারার আওতায় দণ্ডিতের সংশ্লিষ্ট মামলা তুলে নিতে সরকার বা দুদকেরও এখতিয়ার আছে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। এক-এগারোতে হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহারে ৪০১ ধারা প্রয়োগের চিন্তা ছিল। কিন্তু দুদক রাজি না হওয়ায় এই ধারার আওতায় প্রত্যাহার ঘটেনি। যা প্রত্যাহার হয়েছে, সেটা সিআরপিসির ৪৯৪ ধারার আওতায়। দণ্ড ঘোষণার আগের অবস্থায় মামলা প্রত্যাহারে এই বিধানের প্রয়োগ ঘটে।

ওপরের যুক্তির সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করি। ২০১৬ সালের ১ জুন প্যারোল নীতিমালা হালনাগাদ করেছে সরকার। এতে বলা আছে, প্যারোলের সিদ্ধান্ত আদালতের আদেশ ছাড়াও সরকার তার বিশেষ সিদ্ধান্তে নিতে পারবে। এটি সব শ্রেণির হাজতি ও কয়েদির জন্য প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে সাজা মার্জনা, স্থগিত ও হ্রাস ছাড়াও রাষ্ট্রপতি (কার্যত প্রধানমন্ত্রী) কারও দণ্ড বিরাম (রেসপাইট) করতেও পারেন। রাষ্ট্রপতি যা যা পারেন, তার সব কটি বাস্তবায়নের উদাহরণ সম্ভবত তৈরি হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি, যা মানিয়া লয়, সেইরূপ শর্তে যে দণ্ডে সে দণ্ডিত হইয়াছে, সেই দণ্ডের কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করিতে পারিবে।’

৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাবাসের দুই বছর পূর্তিতে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবুল আলম জানামতে সবচেয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির (দেখুন সমকাল প্রতিবেদন, ৮/৮/২০) বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁরা উভয়ে বলেছেন, উক্ত ৪০১(১) ধারাটি খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খুরশীদ আলমের সঙ্গে তাই একমত নই। কারণ, দুদক আইনটি সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের অধীনে। দুদকের মামলা বা পেইন্ডিং মামলা বলে প্রাচীর তোলা যাবে না।

ধরে নিই যে বিএনপির পক্ষে ক্ষমা চাওয়া বা প্যারোলের দরখাস্ত করা কঠিন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘সাজা কমানো যেতে পারে। কিন্তু তেমন আবেদন সরকার না পেলে তা নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না, সিদ্ধান্ত তো পরের বিষয়।’ আইনমন্ত্রীর এই একটি মন্তব্য ধরেই সমাধান সূত্র বের করা সম্ভব। ১২ ফেব্রুয়ারি খবর ছিল, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মুক্তির সিদ্ধান্ত সরকারই নেবে। এখন আশার বিষয় যে ১৮ ফেব্রুয়ারিতে এসে মির্জা ফখরুল বললেন, প্যারোল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে খালেদার পরিবার। তাঁর পরিবার কোনো ধারার উল্লেখ করে বা না করে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি মানবিক আবেদন করতে পারে। যদিও আপিল বিভাগ দুই মাস আগেই জামিনের দরখাস্ত নামঞ্জুর করেছেন। কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের ১২ ডিসেম্বরের পূর্ণাঙ্গ রায় আরও বড় ইতিবাচক অগ্রগতি। যদিও বিএনপি শুধু জামিন নামঞ্জুর না হওয়া নিয়ে হাপিত্যেশ করছে।

সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণটি রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এটি মানবিক আবেদনে সাড়া দেওয়ার পথ সুগম করেছে। আপিল বিভাগের জামিন নামঞ্জুরের চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ তার পর্যবেক্ষণ। আপিল বিভাগ বলেছে, ‘যদি আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) প্রয়োজনীয় সম্মতি দেন, তাহলে মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তাঁর অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য পদক্ষেপ নেবে।’ আপিল বিভাগের ১২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ আদেশটি পড়ে প্রতীয়মান হয় যে দরকারে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসারও একটি ভিত্তি হতে পারে রায়টি। মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার হাইপারটেনশন ও হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তাঁর রিউমিউটয়েড আর্থ্রাইটিস ‘হাইলি অ্যাকটিভ’ এবং তার অবস্থাকে ‘অ্যাট আ ক্রিপলড স্টেট’ বলে উল্লেখ করেছে। বোর্ড এরপর বলেছে, ‘অন্যান্য যোগ্যতাসম্পন্ন রিউমেটোলজিস্টদের সুপারিশ গ্রহণে তারা প্রস্তুত।’ আপিল বিভাগ এ অংশটিতে গুরুত্বারোপ করেছে। মেডিকেল বোর্ড সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সুপারিশ অনুযায়ী, খালেদার চিকিৎসায় একটি বায়োলজিক থেরাপির প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল। কিন্তু তাতে দরখাস্তকারীর সম্মতি মেলেনি।

কেউ বলবেন, সরকারের কিছুটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখছি। কারণ, কারাগারের বাইরে খালেদা জিয়া অব্যাহতভাবে হাসপাতালে থাকছেন। উপরন্তু একজন সত্তর পেরোনো নারীর স্বাস্থ্যগত অবস্থাটি যে অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের পর্যায়ের, সেটা আপিল বিভাগের রায়ে দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকৃত। সুতরাং বিএনপি ক্ষমা না চেয়ে দণ্ড কমানোর দরখাস্ত করতেই পারে। দরকার হলে তাঁর পরিবার প্যারোল বা যা সমীচীন, তেমন দরখাস্ত করতে পারে। আলোচ্য ক্ষেত্রে দণ্ড ও প্যারোল যদি রাজনীতির অপর নাম হয়, তাহলে প্যারোলই শেষ কথা নয়। তাই জিয়া পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, যদি নিরঙ্কুশভাবে তাঁর সুচিকিৎসাকেই তারা একমাত্র বিবেচ্য ভাবতে পারে। সরকারের কাছে কোনো ধরনের আবেদন ছাড়াই প্যারোল বা মুক্তি দেওয়া হলে, সেটা সরকারের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখা হবে। বিধ্বস্ত বিএনপি তখন বলে বসবে, তারা সরকারকে নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে।

খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে একটি সমঝোতা হলে তা দেশের বর্তমান রাজনীতে নতুন মাত্রা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট’ তাঁর মৌলিক অধিকার। এটা রাষ্ট্রের অনুকম্পার বিষয় নয়। এটাই সেই পথ, যেখানে সরকার, আদালত ও বিএনপি—সবাই স্বস্তি পেতে পারে। জিয়া পরিবার রাষ্ট্রপতির কাছে দরখাস্ত পাঠাতে পারে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুর্নীতির দায়ে আদালতের বিচারে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কেবল আদালতে জামিন বা খালাস পাওয়া ছাড়া বেগম জিয়ার মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই।’ ওপরের আলোচনা এই যুক্তিকে সমর্থন করে না।

  • মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০ 

Sunday, February 16, 2020

টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকার

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ


অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশি টাকা প্রতিবেশী দেশের মুদ্রার তুলনায় অতিমূল্যায়িত। চীন, ভারত, পাকিস্তান তাদের মুদ্রামান কমিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার টাকার মান না কমিয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, টাকার মান কমিয়ে দিলে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই নীতি কত দিন কার্যকর থাকবে। দীর্ঘ মেয়াদে এই টাকা কোথা থেকে আসবে? রপ্তানি–প্রণোদনাও তো রপ্তানি–ধস ঠেকাতে পারছে না। প্রণোদনার কারণে রেমিট্যান্স ও তথ্যপ্রযুক্তি আয় বেড়েছে, তবে বৈদেশিক মুদ্রা এই মুহূর্তে সংকটে নেই বলে নগদ প্রণোদনা খুব বেশি জরুরি নয়। টাকার মান সামান্য কিছু অবমূল্যায়ন করেও একই টার্গেট অর্জন সম্ভব।

সঞ্চয়পত্র সুদ বনাম এক অঙ্কের সুদ

ডাকঘরে আমানতের সুদের হার এক ধাক্কায় সরকার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। আগে যা ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন তা ৬ শতাংশ। এর আগে সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে সরকার। ব্যাংকের সুদ ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৬ বা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংকে রাখাও যা, না রাখাও তা, সঞ্চয়পত্রে সুদও তা। সরকার কেন এটা করল? অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের কথায়, ‘রাজস্ব কমে যাওয়ায় সরকার প্রথমে হাত দিল ব্যাংকে। ছয় মাসের মধ্যে এক বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করল। তারপর নতুন আইন করে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর অর্থে হাত দিল। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শেয়ার পুঁজিবাজারে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের হারানো তহবিলের ঘাটতি কমাতে। অথচ ব্যাংকের টাকা যারা নিয়ে গেল, তাদের ধরছে না। এখন সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোয় জনগণের দুর্বল অংশ যে পেনশনভোগী, তাঁদের আয়ে হাত পড়ল। তাঁদের সুদ বাবদ রাষ্ট্রের খরচ কমল। ওদিকে ইউএনওদের ৯৪ লাখ টাকার গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

সরকারের ঋণ বনাম ব্যক্তি খাতের ঋণ

যেখানে সরকার নিজেই অতি উচ্চ পরিমাণে ব্যাংকঋণ করছে, সেখানে বেসরকারি খাতে এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে কীভাবে? ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশে স্থবির হয়েছে। সরকারের অতি উচ্চ ঋণের প্রভাবে ১১ বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।

স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নেওয়ার বিপদ

স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থের স্থিতি ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বিরোধী দলের তীব্র বিরোধিতা, এমনকি ওয়াকআউটের মধ্যেই সরকার স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার আইন পাস করেছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রমবর্ধনশীল রাজস্বঘাটতির বিপরীতে সরকার তার অতি উচ্চ ব্যয় নির্বাহের নতুন জোগান পেলেও এর মাধ্যমে তৈরি হতে পারে বেশ কয়েকটি গুরুতর সমস্যা। উদ্বৃত্ত অর্থ যাতে একেবারেই না থাকে, সে জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়াতে পারে, এতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী উৎসাহ পাবে। নিজস্ব তহবিলের স্থিতি ও তার বিপরীতে আয় না আসায় সরকারের ওপর অতি নির্ভরশীল হবে সেবা, গবেষণা ও পরিকল্পনা। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের সিদ্ধান্ত আর্থিক কারণে নিতে পারবে না বিধায় স্বায়ত্তশাসিত কাঠামো বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না বলে আশঙ্কা হয়। মারাত্মক আর্থিক বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনায় এবং তহবিলের নিশ্চয়তা না থাকায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো গতি হারাতে পারে। মোটকথা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্পৃহা ধ্বংস হয়ে যাবে। তা–ই যদি হয়, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের পথে এটা একটা কালো অধ্যায় হয়েই থাকবে।

নিম্নপর্যায়ে আমানত সুরক্ষার ঝুঁকি

আমানত সুরক্ষার খসড়া আইনে বলা হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ মাত্র এক লাখ টাকা। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লালবাতি জ্বললে মাঝারি ও বড় আমানতকারীদের সুরক্ষাহীন হয়ে ভীত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এক অঙ্কের সুদনীতির সঙ্গে এটা সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। কেননা, ৬ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতির সমান বা তারও কম সুদের ফলে লোকে যখন ব্যাংকে টাকা রাখতেই উৎসাহ হারাচ্ছে, তখন দরকার ছিল গ্রহণযোগ্য শতাংশ হারে আমানতের বিমা নিশ্চয়তা দেওয়া। ২০০০ সালের আইনেও এক লাখ টাকার সুরক্ষা থাকলেও ২০ বছর পরে এসেও তা মূল্যস্ফীতি যোগ করে পুর্নির্ধারণ করা হয়নি—যেমনটা ভারতে করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। নতুন আইনে টাকার অঙ্ক বদলায়নি, সংযোজন শুধু নন–ব্যাংকিং আর্থিক খাত। আমানত সুরক্ষার অঙ্ক বাড়ালে বিমা খরচ কিছুটা বাড়লেও নতুন আমানত উৎসাহ পেত। কিন্তু তা না করায় লোকে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দেবে। এতে ঋণপ্রবাহে দীর্ঘতর নেতিবাচক ধারা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী, ব্যাংক মালিক, পরিচালক ও ব্যবসায়ী—এই চার পক্ষ বোঝাপড়ায় একের পর এক জালিয়াতির মুখে আর্থিক খাত যখন টালমাটাল, তখন এমন আইন বৈধ এবং অবৈধ উভয় ধরনের পাচার বাড়াতেই উৎসাহ দেবে। আশঙ্কা হয়, উদ্দেশ্যমূলক ব্যাংক লোপাট করে, আইনি কাঠামোয় দায়মুক্তি দেওয়ার ফন্দি এটা নয় তো! এর মাধ্যমে আমরা কি এই সংকেত পাচ্ছি যে, ব্যাংকগুলো আবারও লুটের কবলে পড়তে যাচ্ছে? বড় ধরনের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে, নতুন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত কমে ঋণপ্রবাহে আরও বেশি নেতিবাচক ধারা সৃষ্টি করতে পারে।

ভারতের অনুকরণ!

সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিযুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, ভারতেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত নিজেই অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে। তথাপি ভারত মূল্যস্ফীতি ও অন্য বিষয়াদি আমলে নিয়ে আমানত সুরক্ষা স্থিতি এক লাখ রুপি থেকে পাঁচ লাখ করেছে। উপরন্তু, প্রতিটি অর্থনীতি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আলাদা। ভারতে বাংলাদেশের মতো এত বিশাল খেলাপি ঋণ এবং সরকারি ঋণের সংস্কৃতি নেই। তাই ভারতের পলিসি বাংলাদেশে নকল করা বেমানান। ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম পরিষ্কার করে দুটো বিষয় উপস্থাপনা করেছেন, যার ভাবানুবাদ এমন: ‘ভারতীয় অর্থনীতির সমস্যা সাপ্লাই সাইডে নয়, বরং ডিমান্ড সাইডে। অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিক ক্রয়ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার, এমনকি করপোরেট করে ছাড় বা বড় ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিলে এ সময় কাজ হবে না। বরং এই সময়ে পণ্য কীভাবে বেশি বিক্রি হবে, তার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন কৃষকের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বর্তমান বিজেপি সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারতীয় মেধাবীদের সমন্বয় করে অর্থনীতি পরিচালনা করছে না বলে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে ভুল হচ্ছে।’

বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি ও করপোরেট পণ্য বিক্রিতে ভাটা এসেছে। গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়লেও কর্মসংস্থানে দেখা দিয়েছে নেতিবাচকতা। ২০১০ সালের পর কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমে নেমেছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশে। কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অর্থবছরের শুরুতে। পণ্যবাজারে বিক্রয় হ্রাস, কর্মসংস্থানে ভাটা, ব্যক্তি ও বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যহীনতায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমতাবস্থায় টাকার খোঁজে দিশেহারা হয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা আছে। অর্থ ব্যবস্থাপনায় দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের সমন্বিত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সৎ, সতর্ক, প্রজ্ঞাবান না হলে চোখের পলকেই বদলে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র!

  • ফাইজ তাইয়েব আহমেদ: নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০ 

বায়ু ও শব্দদূষণ - ঢাকার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে, বাঁচান


‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’—এই কথা রবীন্দ্রনাথ রূপকার্থে লিখেছিলেন, বায়ুদূষণের কথা ভেবে লেখেননি। কারণ, বায়ুদূষণ কিংবা শব্দদূষণ বলতে এখন যা বোঝায়, রবীন্দ্রনাথের কালে অন্তত এই অঞ্চলে তা ছিল না। এখন ভারী কারখানা, ইটের ভাটা, রাসায়নিক প্ল্যান্ট, হাইড্রোলিক হর্ন, মাইকের উচ্চ শব্দ, ইত্যাদির উৎপাতে কুবাতাস ও কুশব্দ এতটাই বেড়েছে যে বিশেষত ঢাকাবাসী শ্বাসরোধকর অবস্থায় পড়ে গেছে।

পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রিন পিস তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে যে তথ্য দিয়েছে তা ভয়াবহ। তারা বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার শিশুর অকালমৃত্যু হয়েছে। বছরে ৪০ লাখ মানুষ অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসছে চিকিৎসা নিতে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবে, গত বুধবার ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল, দূষণের দিক থেকে যা বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ।

এর পাশাপাশি আছে শব্দদূষণ। গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দের সহনীয় মাথা ৫০ ডেসিবেল হলেও ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ৯০ ডেসিবেলের বেশি মাত্রায় শব্দ হয়। কোথাও কোথাও তা ১২০ ডেসিবেলও ছাড়িয়ে যায়। ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন শব্দদূষণে আক্রান্ত। এভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে। এদের একটি অংশ পুরোপুরি বধির হয়ে যাবে।

এ কথা ঠিক যে বায়ুদূষণ হঠাৎ করে ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে আনা কঠিন। কারণ, এর জন্য দূষণ ঘটানো বহু ইটের ভাটা, কারখানা, যানবাহন ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। গত দেড় বছরে অবৈধ ইটভাটাগুলোর ৬২ শতাংশ বন্ধ করা গেছে। কিন্তু কিছু কিছু উদ্যোগ আছে, যা দ্রুত নেওয়া যায়। শহরে যখন-তখন যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টিকে পরিকল্পনার আওতায় আনা এবং দূষণ ঠেকাতে কিছু নিয়মকানুন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ আছে। বিশ্বের বড় শহরগুলোতে পাকা রাস্তার বাইরের সব জায়গায় ঘাসের আচ্ছাদনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার ক্ষেত্রে সে উদাহরণ অনুসরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সড়ক বিভাজকে গাছ লাগানো হয়। কিন্তু সেই বিভাজকের মাটি ঘাস দিয়ে ঢাকা থাকে না, এর ধুলা বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে। গাছ লাগানোর পাশাপাশি গাছে নিয়মিত পানি দেওয়া এবং ঢাকার সব ফাঁকা জায়গা ঘাসের আচ্ছাদনে ঢেকে দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।

অন্যদিকে শব্দদূষণ তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও কিছু উদ্যোগ যথেষ্ট। বিশেষ করে গাড়ির হর্ন এবং মাইকের যথেচ্ছ ব্যবহার প্রশাসন চাইলেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। যেহেতু এর সঙ্গে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্পর্ক নেই বললেই চলে, সেহেতু এটি করতে গেলে প্রশাসনকে বড় ধরনের কোনো চাপের মুখেও পড়তে হবে না।

মোদ্দা কথা, ঢাকা শহরকে বায়ু ও শব্দদূষণের হাত থেকে বাঁচাতে প্রথম দরকার নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার পরিবর্তন। দূষণাসুরকে বধ করতেই হবে, এই লক্ষ্যে অটল থেকে যদি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলেই শ্বাসরোধকর অবস্থা থেকে ঢাকা বেরিয়ে আসবে।

  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০ 

Monday, February 10, 2020

অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে — সালেহ উদ্দিন আহমেদ

তামান্না মোমিন খান

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সার্বিক দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবগুলো সূচক নিম্নমূখী। শুধু রেমিট্যান্স একটু ভালো। বাকি আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আয় ও ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতির একটা চাপ আছে। অর্থমন্ত্রী এটা অনুভব করেছে। তার মানে এটা একটা চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, আমার মতে এইসব নিয়ে বলার কিছু নেই।

সদিচ্ছা থাকলে সিরিয়াসলি নিলে সমস্যা উত্তরণ করা সম্ভব। শুধুমাত্র কথাবার্তা বলে বা বক্তব্য দিয়ে কোন লাভ হবে না। সমস্যা উত্তরণের জন্য শক্ত হাতে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং ব্যাংকগুলোকে ঠিকমত শৃঙ্খলা এবং তাদের যে নিয়ম-কানুন তা পরিপালনে শক্ত হতে হবে। কোনরকম ছাড় দেয়া যাবে না। যারা রপ্তানিকারক তাদের অনেক ঝামেলা আছে। ফরেন একচেঞ্জ- এখানেও ঝামেলা আছে। সেটার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ

সাবেক এই গভর্নর বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে তো এখন চায়নার বিষয়টি আছে। অর্থনীতির বহুমাত্রিক বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। উনারা জানেন সমস্যাগুলো কোথায়। প্রয়োজন হলে আরও ভালোভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু বললেই হবে না ভালো করছি, ভালো চলছে। অন্যায় সুবিধা, ছাড় দেয়া এগুলো সব বন্ধ করতে হবে। সদিচ্ছা থাকলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এখনই অ্যাকশন নিতে হবে, যেহেতু অর্থমন্ত্রী উপলব্ধি করেছেন।  

সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো বহুমাত্রিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থপনা। ব্যাংকিং খাততো আছেই। ব্যাংক, বীমা, পুঁজিবাজারও বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যহীনতা, ঋণ ঘাটতি এগুলো ঠিক করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থপনা যদি সঠিক না হয় দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং দেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০ 

খালেদা জিয়াকে নিয়ে খোলা চিঠি

রুমিন ফারহানা

‘কেমন আছেন?’ আর সব চিঠির মতো এই প্রশ্নটা করছি না শুরুতেই। কারণ আপনার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা ভীষণ অবান্তর। ছয় মাসের মতো হয়ে গেল শেষবার আপনাকে দেখেছি সামনা সামনি, হাসপাতালের প্রিজন সেলে। কষ্টে ব্যথায় যন্ত্রণায় বারবার কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন আপনি। খবর পাই আপনার অবস্থা প্রতিদিন আরো খারাপের দিকে যায়। আপনি খারাপ আছেন, ভীষণ খারাপ আছেন।

মনে পড়ছে প্রায় ১০ বছর আগের একটা দিনের কথা। আপনার সঙ্গে বহু বছর পর আবার আমার দেখা হয়েছিল আপনার অফিসে। কী গভীর মমতার দৃষ্টি নিয়ে সেদিন আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন! কী অসাধারণ মায়াভরা কণ্ঠে কুশল জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার, বাবা-মার।

একজন আইনজীবী হিসেবে আমি পেশাগতভাবে ভালো করছি সেটা আপনি জানতেন উল্লেখ করে পরামর্শ দিয়েছিলেন মন দিয়ে যেন প্র্যাকটিস করে যাই। কিন্তু আমার লক্ষ্য সরে গেল আপনার অকুণ্ঠ স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসার কারণেই।

আমার বাবা অলি আহাদ ইন্তেকাল করেন ২০১২ সালের ২০শে অক্টোবর। বাবা যেদিন চলে যান, ঠিক সেদিনই আপনি চীনে দীর্ঘ রাজনৈতিক ভ্রমণ শেষ করে মাত্রই দেশে ফিরেছেন। কোনো শারীরিক, মানসিক ক্লান্তির তোয়াক্কা না করে বিমানবন্দর থেকে আপনি সরাসরি চলে এসেছিলেন হাসপাতালে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। আজীবন আদর্শবাদী রাজনীতি করা একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদের প্রতি আপনার গভীর শ্রদ্ধা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম সেদিন। যদিও এর আগে পরে বহুবারই এই শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ আমি দেখেছি। গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। সেই স্পর্শ আমাকে সাহস দিয়েছিল জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াবার। এর কিছুদিন পরই ২০১৩ সালে আমাকে না জানিয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন যাবার প্রতিনিধি দলে আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন। তার কিছুদিন পরই আমাকে স্থান দিয়েছিলেন ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে। নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সব বিশাল নাম সেই কমিটিতে তখন। তার কিছুদিন পর আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক বানালেন আপনি। কতটা পেরেছি জানি না, আমার ওপর অর্পিত প্রতিটি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি সর্বান্তকরণে। বহুবার কানে এসেছে অনেকের অনেক কথাকে দু’পায়ে ঠেলে শক্তভাবে আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন আপনি। এত ভালোবাসা, স্নেহ আর বিশ্বাসের ঋণ কি দিয়ে চুকাবো আমি?

এমন গল্প শুধু আমার না, এমন ব্যক্তিগত গল্প আছে এই দলের অসংখ্য মানুষের- যাদের আপনি ‘কিছু না’ থেকে পরিণত করেছিলেন ‘অনেক কিছু’তে।
রুমিন ফারহানা

যখন বেড়ে উঠছিলাম একটু একটু করে, বুঝতে শুরু করেছি সমাজ-রাজনীতি তখন থেকেই দেখেছি আপসহীন শব্দটা এই দেশে আপনার নামের একটা প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। সেটার এক অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ চাক্ষুষ করেছিলাম যেদিন সর্বশেষ আপনাকে দেখতে যাই হাসপাতালে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ম্যাডাম অনেক সাংবাদিক তো প্যারোলের কথা জানতে চায়, কি বলবো? অসুস্থতায়, দুর্বলতায় আপনার ক্ষীণ কণ্ঠটি চকিতে কঠোর হয়ে উঠলো, জানালেন, আপনি প্যারোল চাইবেন না, কারণ আপনি জামিনের হকদার।

দেশের এক রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্ন, এক-এগারোর পর সেই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনজীবীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলাম। সেই সময় আপনার মামলার মতো মামলায় কত মানুষের জামিন করিয়েছি আমরা। আইনের একেবারে প্রাথমিক পাঠ এর ছাত্ররা, এমনকি সাধারণ সচেতন মানুষও জানে বেশি বয়স, নারী, শারীরিক অসুস্থতা, সামাজিক অবস্থানের যেকোনো একটি গ্রাউন্ডেই একজন মানুষ জামিন পেতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে এর সবগুলো আছে, কিন্তু জামিন পান না আপনি। একটা সরকার এই রাষ্ট্রের প্রশাসন, বিচার সবকিছু একত্র করে সর্বশক্তিতে নেমেছে আপনাকে জেলে আটকে রাখার জন্য। কারণ আপনাকে বন্দি করা গেলে বন্দি হয় গণতন্ত্র, বন্দি হয় দেশের ১৭ কোটি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন।

এটা অনুমিতই ছিল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া ছাড়া একটার পর একটা মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পথে এই সরকারের প্রধান বাধা আপনি। সেই স্বৈরাচারী এরশাদের সময় থেকেই আপনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন এই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক আপনি। ক্ষমতাসীন দলটি এরশাদের সঙ্গে আপস করে তার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে সাহায্য করেছিল, শুধু আপনার দৃঢ়তার কারণেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেনি এরশাদ। এরপর এক এগারোর সরকার আপনাকে জোর করে দেশ থেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আপনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, যাননি, যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও জুগিয়েছিল দেশে ফিরে আসার সাহস।

আপনার গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস বলে আপনাকে ভয় পাবারই কথা যেকোনো স্বৈরশাসকের। পাচ্ছে বর্তমান স্বৈরাচারটিও।

যে অভিযোগে আপনার ওপর এই বিপর্যয় নেমে এসেছে, কি বীভৎস মিথ্যা সেটা। একটি পয়সাও এদিক-সেদিক হয়নি বরং বেড়েছে সেটা অনেক। আপনাকে নিয়ে এই ঘটনাগুলো ঘটছে এমন একটা দেশে যে দেশ এই মুহূর্তে বিশ্বের লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়, বিদেশে পাচার হয় প্রতিবছর। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের দ্বিতীয় তৃতীয় সারির নেতারাও এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। সর্বোচ্চ পর্যায়ের অঙ্কের কথা কল্পনায় আনতেও ভয় লাগে।

আমি জানি দীর্ঘ ১১ বছর বীভৎস সব নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের নেতাকর্মীরা। জানেন ম্যাডাম, এখন আমাদের মধ্যে দেখা হলে প্রাথমিক কুশলের পর অনিবার্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে কার বিরুদ্ধে কয়টা মামলা। অসংখ্য কর্মী মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেল খেটেছে, বহু কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্রসফায়ারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে, অনেক কর্মী এখনো গুম হয়ে আছে। তাদের সবার কষ্ট বুকে ধারণ করেই তো আজ আপনি কারাগারে। আপনি চাইলে, একটু ইশারা করলে কি না হতে পারত? আরাম আয়েশ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের চেয়ে ১৭ কোটি মানুষের জীবন বড় হয়ে উঠলো যে আপনার কাছে। আপনি যে বেগম খালেদা জিয়া, ইতিহাসে রাষ্ট্রনায়ক হবার জন্য যার জন্ম।

এই দেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করা একজন আইনজীবী, বিচারাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতি এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই জানি বিচার প্রক্রিয়ায় আপনার মুক্তি হয়তো সম্ভব না। বাকি থাকে নানামুখী প্রতিবাদ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। সংসদ, টকশো, কিংবা পত্রিকার কলাম যখন যেখানে পেরেছি আপনার ওপর বীভৎস নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। রাস্তায়ও আমাদের কর্মীরা নেমেছে। কিন্তু সরকারের মামলার খড়গও নেমে এসেছে সবার ওপর, আমার বিরুদ্ধেও কয়েকটি মামলা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে।

এটা যেমন সত্যি, পরিস্থিতি ভীষণ প্রতিকূল, তেমনি এটাও সত্যি এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমাদের পথ বের করতে হবে। মা, পারছি কি আমরা?

এতবড় দল আপনার, কিন্তু দুই বছরের বেশি জেলে থাকার পরও সেই বিশাল দল সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি আপনাকে মুক্তি দিতে, এটা ভেবে কি আপনার মনে কষ্ট হয় খুব? আগেই বলেছি অনেকে ‘কিছু না’ থেকে ‘অনেক কিছু’তে পরিণত হয়েছে আপনার আশীর্বাদে। আপনার এই দুর্দিনে আমাদের দায়িত্ব আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি- এই অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে বেড়ায় প্রতিটা মুহূর্তে।

মা’গো, আমরা লজ্জিত, আপনার কাছে অপরাধী। আপনার যোগ্য সন্তান হতে পারিনি আমরা। কিন্তু মা দেশের মানুষ মুক্তির যে স্বপ্ন দেখে- গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদাপূর্ণ সমাজের যে আশা আজও বুকে ধারণ করে তা আপনাকে ঘিরেই। তারা বিশ্বাস করে আপনার হাতে দেশ নিরাপদ, নিরাপদ দেশের মানুষ। আপনি বারবার মুক্ত করেছেন এদেশের মানুষকে। এবারও আপনার হাত ধরেই আসবে গণমানুষের মুক্তি। আপনি তাদের একমাত্র আস্থা আর বিশ্বাসের ঠিকানা। সাধারণ মানুষই তাদের স্বার্থেই মুক্ত করে আনবে আপনাকে। তাদের হৃদয়ের সিংহাসনে আপনি রানীর আসনে অসীন থাকবেন চিরকাল।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০ 

‘উন্নত’ দেশ ও কম ভোটতত্ত্ব: কল্পনা না বাস্তবতা

গোলাম মোর্তোজা

বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এত ভালো, এত ভালো যে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। শুধু ভালো আর ভালোর মাঝেই হঠাৎ করেই পৃথিবীর সেরা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন, “দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।”

হঠাৎ করে কী এমন ঘটে গেল যে, এত ভালো থেকে “ভালো না” হয়ে গেল?

এক বছর আগে পর্যন্ত নির্বাচন ছিল এদেশের মানুষের কাছে উৎসব। উৎসবের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, মৃত ভোটারও ভোট দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বগুড়ার ভোটার দেশে না ফিরেও ভোট দিয়েছিলেন, পোস্টাল বা অনলাইন ভোটের ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও। শতভাগ ভোটের পাশাপাশি, তালিকার চেয়ে বেশি ভোটারের ভোট দেওয়ার ঘটনাও দৃশ্যমান হয়েছিল।
গোলাম মোর্তোজা

কিন্তু, পহেলা ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট উৎসব দৃশ্যমান হয়নি। অত্যন্ত কম সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে এসেছেন। ভোটার উপস্থিতি কম যে এবারই প্রথম দৃশ্যমান হয়েছে, তা নয়। উপনির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে যায়নি। তখন বলা হয়েছে, বিএনপি অংশ নেয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় মানুষ ভোট দিতে আসেনি। বিএনপি অংশ নেওয়ায় এবারের সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন যুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।

তবে যুক্তি দেওয়া বন্ধ হয়নি।

“সিটি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আসেনি তাদের একটি বড় অংশ খুব আরাম আয়েশে আছে। বাসায় খুব আরামে বসে পোলাও খাচ্ছে” নির্বাচনের দিন হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে একথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

নির্বাচন কমিশন সচিব কম ভোটার উপস্থিত বিষয়ে বলেছেন, তিনদিন ছুটি ছিল। ভোটাররা ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, এটাই ১০০ বছরের মধ্যে সেরা নির্বাচন।

ভোট কেন কম পড়ল, প্রথমাবস্থায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত। তারপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, উন্নত দেশে কত মানুষ ভোট দিতে আসেন? গণতন্ত্রের উদাহরণ আমেরিকা। সেখানে কত শতাংশ ভোট পড়ে? সেসব দেশের গণতন্ত্র কি ধ্বংস হয়ে গেছে?

ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগের বিজয়ী মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, “দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ যে উন্নতির দিকে যাচ্ছে তার প্রমাণ ভোটার উপস্থিতি কম।”

এমন কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক, বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন।

সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, উন্নত দেশের মানুষ ভোট দিতে যায় না। উন্নত দেশের নির্বাচনে খুব কম ভোট পড়ে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, উন্নত দেশের মানুষের কাজ ও জীবনযাপনের নিশ্চিত নিরাপত্তা থাকায় তারা নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেন না। কোন দল ক্ষমতায় এলো, কে এমপি বা মেয়র সেসব সংবাদ রাখেন না বা রাখার প্রয়োজন মনে করেন না।

কথাটা যে পুরোপুরি অসত্য তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলোর মেয়র নির্বাচনে ২০-২৫ শতাংশ ভোট পড়ার নজির রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কম ভোট পড়ার এমন নজির সর্বজনীন কি না? পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর ভোটের চিত্র কেমন?

এশিয়ার সবচেয়ে ও পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ জাপান। জাপানের রাজধানী টোকিওর ২০১৪ সালের মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এশিয়ার আরেক উন্নত দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ২০১৮ সালের মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

ইংল্যান্ডের ২০১৬ সালের সিটি নির্বাচনে চারটি শহরের চিত্র দেখে নেওয়া যাক। লন্ডনে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ব্রিস্টলে ২৪ শতাংশ, লিভারপুলে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ, ম্যানসফিল্ডে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ইউরোপের অন্যতম উন্নত দেশ জার্মানির ২০১৬ সালের বার্লিন ও মিউনিখের সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ৪৪ দশমিক ০১ শতাংশ। ২০১৬ সালের রোমের সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫০ দশমিক ০১ শতাংশ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লির বিধান সভা নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬২ দশমিক ০৫ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। উত্তর আমেরিকার আরেক উন্নত দেশ কানাডা। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে কানাডার ৬৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। জার্মানি ও ফ্রান্সের ২০১৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৭৬ দশমিক ০২ শতাংশ এবং ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নরওয়ের ২০১৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ৪৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল ২০১৯ সালের সুইজারল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে। ইংল্যান্ডের ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৬৭ দশমিক ৩০ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে জাপানের জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

সুতরাং বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে বা উন্নত হয়ে গেছে, এ কারণে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোট কম পড়েছে, কোনো বিবেচনায় কি এটা যুক্তি হতে পারে? যেসব উন্নত দেশের ভোটের চিত্র এখানে উল্লেখ করা হলো, সেসব দেশের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৪০-৫০ হাজার ডলার কম। মাথাপিছু ৫০ হাজার ডলার আয়ের মানুষ ভোট দিতে যায়, আর বাংলাদেশের ২০০০ ডলার আয়ের মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায় না!

ঢাকার মানুষ যে ভোট দিতে গেল না, তার প্রকৃত কারণ যে ‘উন্নত’ হয়ে যাওয়া নয়, যুক্তি দিয়ে তা না বোঝালেও চলে। তিনদিনের ছুটি, ফেসবুক বা পোলাও-কোরমা খাওয়াও যে কারণ নয়, যারা এসব কথা বলছেন তারাও তা জানেন। আসলে প্রকৃত কারণ আড়াল করতে চাইলে এমন অনেক কথা সম্ভবত বলতে হয়।

নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন গণপরিবহন বন্ধ করে দিল। মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলেরও অনুমোদন থাকল না। যিনি ভোটার হয়েছিলেন মোহাম্মদপুরে, বাসা বদল করে তিনি হয়ত চলে গেছেন উত্তরায়। তিনি উত্তরা থেকে মোহাম্মদপুরে কীভাবে আসবেন ভোট দিতে? বিষয়টি হয় নির্বাচন কমিশন বিবেচনায় নেয়নি, বা যাতে ভোট দিতে আসতে না পারেন তা বিবেচনায় নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোটারদের উৎসাহিত করার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই অভিযুক্ত ছিল।

ইভিএমে ভোট হলে রাতে ভোট বা কারচুপির সুযোগ থাকবে না, নির্বাচন কমিশনের এই যুক্তিতে মানুষের আস্থা ফিরে আসেনি। ইভিএমসহ সব যন্ত্রই মানুষ দ্বারা পরিচালিত। মানুষ যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত নয়। মানুষের সন্দেহ ইভিএমের প্রতি ছিল না। সন্দেহ এবং অনাস্থা ছিল নির্বাচন কমিশনারদের প্রতি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ইভিএমে ফলাফল পরিবর্তন বা জালিয়াতি করা যায় না। ইভিএমে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হবে মেশিন সেভাবে কাজ করবে। এবং যাদের নিয়ন্ত্রণে ইভিএম থাকবে, তারা প্রোগ্রাম পরিবর্তন করতে পারবেন। প্রযুক্তির এই যুগে এসব তথ্য কমবেশি সবাই জানেন।

অনাস্থা বা বিশ্বাসহীনতা নির্বাচন কমিশনের প্রতি হওয়ায়, ভোটের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়েছেন। ইভিএমে না হয়ে নির্বাচন ব্যালটে হলেই যে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরে আসতো, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। বাস্তবের ঘটনা আর নির্বাচন কমিশনের অবস্থান বা বক্তব্যে কোনো মিল খুঁজে পাননি ভোটাররা। এই বিশ্বাসে তারা পৌঁছে গেছেন যে, তাদের ভোটের কোনো গুরুত্ব নেই।

নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করতে শুরু করলেন যে, বিএনপি সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের ঢাকায় নিয়ে এসেছে। তারা ভোটকেন্দ্র দখল করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের অভিযোগের জবাবে বিএনপি নেতারা বললেন, আওয়ামী লীগ সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের ঢাকায় জড়ো করেছে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের সুযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলল, পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ বের হবেন না। বহিরাগতরা ঢাকা ছাড়ুন।

বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশের রাজধানী শহরে কেন ‘বহিরাগত’ হবেন? ‘পরিচয়পত্র’ সঙ্গে রাখার নির্দেশনা আসবে কেন? একটা আতঙ্ক ছড়ালো ভোটের আগের দিন। ভোটার কম উপস্থিতির এটাও একটি কারণ। নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব বক্তব্য বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে নীরবতা পালন করতে দেখা গেল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে এমন কথা বলানোর নির্দেশনা কী তাহলে নির্বাচন কমিশনই দিয়েছিল?

ভোটারদের আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, সরকারেরও। সেদিকে কারো নজর আছে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের অভিযোগ আনা হয় নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে। নাগরিক সমাজ তো ভোটারদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করেননি। বিএনপিকে অভিযুক্ত করা হয়, তাদের ডাকে মানুষ রাস্তায় নামে না। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সম্মিলিত ডাকেও মানুষ ভোটকেন্দ্রে এলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সত্যি-সত্যি জনগণ থেকে কতটা দূরে সরে গেছেন? রাজনীতিবিদদের আত্মোপলব্ধিতে কি আসছে বা আসবে বিষয়টি?

  • কার্টসি - ডেইলিস্টার / ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০

Sunday, February 9, 2020

কম ভোট পড়াই কি এখন নতুন ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হয়ে যাচ্ছে?

 ড. বদিউল আলম মজুমদার


গত কয়েকদিন যাবত আমি বার বার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি: কেমন হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটির নির্বাচন? এর উত্তর খুঁজতে নির্বাচনের পরে সুজন-এর ফেসবুক পেজে আমরা একটি অনলাইন ভোটের ব্যবস্থা করি। এতে চার হাজারেরও বেশি মানুষের সাড়া পড়েছে। যারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের প্রায় ৯৪ শতাংশই বলেছেন যে নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। যদিও অনলাইন ভোট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, এটি জনসাধারণের ধারণার অনেকটা ইঙ্গিত বহন করে।

এছাড়াও, সাম্প্রতিক নির্বাচন সম্পর্কে আমি প্রায় দুই ডজন সাংবাদিককে, যারা আমার প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করেছেন, তাদেরকে তাদের মতামত জিজ্ঞাসা করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে, তাদের কারোর কাছেই মনে হয়নি যে নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।

১ ফেব্রুয়ারির সিটি নির্বাচনে আমি নিজেও সাতটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে চারটি ঢাকা উত্তরের এবং বাকি তিনটি ঢাকা দক্ষিণের। এই কেন্দ্রগুলোতে আমি প্রিজাইডিং অফিসার এবং অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তখন অনেক ভোটারের সঙ্গেও কথা বলেছি। পরিদর্শনকালে আমি অনেককে দেখতে পেয়েছি ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাজ পরে কেন্দ্রের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান করছেন, যা ছিলো নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ এবং তারা একটি শোডাউনের অংশ হিসেবে সেখানে অবস্থান করছিলেন।

তবে আমি কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি পেয়েছি খুব নগণ্য এবং জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচনের প্রতি আগ্রহও দেখেছি অতি সামান্য। আমি যে কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছি সেখানে বিরোধীদলের মেয়র প্রার্থীদের কোনো এজেন্ট দেখতে পাইনি। কেন্দ্রগুলোতে আমি কোনো ধরনের সহিংসতাও দেখিনি, যা ছিলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কয়েকজন নির্বাচনী কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, গত জাতীয় নির্বাচনের মতো তারা চাপও অনুভব করেননি। সামগ্রিকভাবে, সেখানে আমি লক্ষ্য করেছি ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক অনীহা (cynicism) উদাসীনতা (resignation)।

ভোটারদের অনীহা ও উদাসীনতার কারণেই সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে, যেখানে আমি গিয়েছি, দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩৫৯ জনের মধ্যে ৩০ জন (বা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ) ভোট দিয়েছিলেন। সেগুনবাগিচা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৮ জনের মধ্যে ২৪৪ জন (বা ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ), বেগম রহিমা আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭৩ জনের মধ্যে ৩৯২ জন (১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ), মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের পুরুষ কেন্দ্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত ২ হাজার ২৩২ জনের মধ্যে ৪০০ জন (বা ১৭ দশমিক ৯২ শতাংশ) এবং ওখানকার নারী কেন্দ্রে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২ হাজার ৬৯৩ জনের মধ্যে ২৭০ জন (বা ১০ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ) ভোট দিয়েছিলেন। আমার নিজের দেখা এ নগণ্য ভোটের হারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ঢাকা উত্তরের ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণের ২৯ শতাংশের ফলাফল সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

নির্বাচন কমিশন গভীর রাত পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা করতে না পারার কারণেও ঘোষিত ফলাফল নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইভিএম থেকে তাত্ক্ষণিকভাবে ফলাফল পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু, কমিশন গভীর রাত পর্যন্ত সে ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী কমিশনের বিরুদ্ধে ফলাফল পাল্টানোর এবং ‘ডিজিটাল কারসাজি’র অভিযোগ তুলেছেন। দৈনিক মানবজমিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ আলমগীরের জালিয়াতির অভিযোগের কারণে ঢাকা দক্ষিণের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।

দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কম ভোট পড়ার জন্য মোটাদাগে চারটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত, ইভিএমের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ। নির্বাচনে ব্যবহৃত ইভিএমগুলোতে পেপার ট্রেইল (ভোটার ভেরিফিকেবল পেপার অডিট ট্রেইল- ভিভিপিএটি) নেই। উল্লেখ্য, অধিক নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিতের স্বার্থে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ২০১১ সালের এক আদেশের কারণে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তাদের ইভিএেম ভিভিপিএটি সংযুক্ত করেছে। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের গঠিত প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী পেপার ট্রেইল ছাড়া ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। নির্বাচন কমিশন তারপরও ভিভিপিএটি ছাড়াই ইভিএম ক্রয় করেছে। পেপার ট্রেইল থাকলে ভোটগুলো পুনরায় গণনা করা যেতে পারে, যার ফলে ফলাফল নিয়ে ওঠা অভিযোগের সহজেই সমাধান হতে পারে।

আমাদের ইভিএমের আরেকটি দুর্বলতা হলো: কিছু কিছু ভোটারের ক্ষেত্রে তাদের আঙ্গুলের ছাপ শনাক্ত করতে না পারা। যেমনটি হয়েছিলো ড. কামাল হোসেন, এমনকী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষেত্রেও। এই দুর্বলতার কারণে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ইভিএম ওভাররাইড এবং ভোটারদের পরিচয় আপলোড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো। গত জাতীয় নির্বাচনে ভোটার সংখ্যার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষেত্রে নির্বাচন কর্মকর্তাদের এই ক্ষমতা দেওয়া ছিলো। সাম্প্রতিক নির্বাচন দুটোতে এই ক্ষমতা দেওয়া ছিলো এক শতাংশ ভোটারের জন্য, যা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং নির্বাচন কমিশনের দেওয়া একটি বিশেষ কোড দিয়ে বাড়ানো যেতো।

নির্বাচন কর্মকর্তারা যদি তাদের আঙুলের ছাপ না নিয়েই ভোটারদের পরিচয় আপলোড করতে পারতেন, তাহলে তারা ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের অনুপস্থিতিতে ভোটও দিতে পারতেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ইতোমধ্যেই উঠেছে। উল্লেখ্য, ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা উত্তরের ৪৫টি কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ হলো ৭৮ দশমিক ২১ শতাংশ।  ঢাকা দক্ষিণের ৫০টি কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ হলো ৭৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। ভোট পড়ার এসব উচ্চ হার নিয়ে অনেকের মধ্যে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। প্রসঙ্গত নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধের শিরোনাম ছিলো- The only safe election is a low-tech election. (February 4, 2020)।

কম ভোট পড়ার দ্বিতীয় কারণ হলো: নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার অভাব। গত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকার কারণে অনেক নাগরিক এবারের ভোট বর্জন করেছেন। তাদের অনেকের মনে ধারণা হয়েছে যে, তাদের ভোটের কোনো প্রভাব নির্বাচনে পড়বে না। এছাড়াও, অনেকের মনে আশঙ্কা ছিলো যে ভোটকেন্দ্রে গেলেও তাদের ভোট দিতে দেওয়া হবে না।  তাদের প্রার্থীরা কোনো না কোনোভাবে বিজয়ী হবেনই, এই আত্মবিশ্বাসের কারণে এমনকী অনেক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরাও ভোট দিতে যাননি।

কম ভোট পড়ার তৃতীয় কারণ, ভোটকেন্দ্রগুলোর আশেপাশে শোডাউন করায় সৃষ্ট নিরাপত্তা-ঝুঁকি। এই নিরাপত্তা-ঝুঁকি অনেক ভোটারকে নিরুৎসাহিত করেছিলো ভোটকেন্দ্রে যেতে। তাদের ভয় ছিলো ভোটকেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা তাদের হয়রানি করতে পারে। এমনকী, ভোট দিতে বাধাও দিতে পারে। এই ধরনের ভয় বেশিরভাগ বিরোধীদলের প্রার্থীর সমর্থকদের নিরুৎসাহিত করেছিলো ভোটকেন্দ্রে যেতে।

ভোটের খরার চতুর্থ কারণ — ভোট প্রদানে বাধা। আমি অভিযোগ পেয়েছি, অনেক স্থানে ভোটকেন্দ্রের সামনে প্রকৃত ভোটারদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিলো। কোথাও কোথাও ভোট প্রদানে বাধা দিতে শোডাউনকারীরা কৃত্রিম লাইন তৈরি করেছিলো। কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থক হিসেবে পরিচিত ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এই ধরনের হয়রানির সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ভোটার তা দেখে ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুত্সাহিত হন।

আমি ভোটারদের কাছ থেকে আরও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। অনেকের মতে তারা নির্দ্বিধায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। ভোটকেন্দ্রে অবাঞ্ছিত ‘সহায়তাকারী’রা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করছিলো বা তারাই ভোটারদের পক্ষে ভোট দিয়ে দিচ্ছিলো। কিছু ভোটারকে বলা হয়েছিলো, ইভিএমে ভোট দিলে তারা কাকে ভোট দিচ্ছে তা গোপন থাকবে না। তাই তারা কাকে ভোট দিচ্ছে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বেশ কয়েকজন ভোটার অভিযোগ করেছিলেন, তাদের পরিচয় আপলোড করতে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পরই তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

সামগ্রিকভাবে, এটি স্পষ্ট যে সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ছিলো ‘নিয়ন্ত্রিত’, যদিও অতীতের তুলনায় নিয়ন্ত্রণের ধরন ছিলো ভিন্ন। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন এবং কম ভোট পড়া যেনো এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত, ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে যে উদ্বেগ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের মধ্যে যে আস্থাহীনতা ছিলো সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভবপর হয়নি, বরং সেগুলো আরও প্রকট হয়েছে।

এই উদ্বেগ ও আস্থাহীনতা আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে নির্বাচনই ক্ষমতা রদবদলের একমাত্র বৈধ এবং শান্তিপূর্ণ পথ। যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা এক অশুভ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারি, যার দায় নিতে ক্ষমতাসীনদেরকে এবং মাসুল গুনতে হবে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন - সুশাসনের জন্য নাগরিক
  • কার্টসি - ডেইলি স্টার/ ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০ 

বিদেশীরা নিয়ে যাচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা


বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীরা প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন? এ নিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। এ বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সমীক্ষা রয়েছে। ২০১৭ সালে করা সেই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, দেশে বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি বিদেশী নাগরিক কর্মরত রয়েছেন। প্রতি বছর এসব বিদেশী দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার (৫ বিলিয়ন ডলার)। বর্তমান ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হারে যার পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা।

তবে ২০১৮ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, আমাদের দেশে এখন বিপুলসংখ্যক বিদেশী কাজ করছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেশের কাজে লাগছে না। আমরা নিজেরাই দক্ষতা অর্জন করতে পারলে তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরো গতিশীল করবে।

তিনি আরো বলেছিলেন, দেশের বৃহৎ চারটি শিল্পখাতে মধ্যম এবং নির্বাহী পর্যায়ে দক্ষ জনবলের অভাবে বিদেশীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আর এ কারণে দেশ থেকে প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। মূল্যবান এ বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানোর পাশাপাশি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে দেশেই দক্ষ জনবল তৈরির কোনো বিকল্প নেই।

অন্য দিকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ২০১৩ সালের ২১ মে ‘ফিফটিন নেশসন সেন্ডিং হাইয়েস্ট রেমিট্যান্স টু ইন্ডিয়া’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অর্থাৎ ভারতের রেমিট্যান্স পাঠানোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে (২০১৩ সাল) বাংলাদেশে পাঁচ লাখ ভারতীয় বসবাস করছে। এসব ভারতীয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩৭১ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেশে প্রেরণ করছে। আগামী কয়েক বছর অর্থ প্রেরণের পরিমাণ আরো বাড়বে। এসব ভারতীয় অধিকাংশ তৈরী পোশাক খাত, এনজিও ও বস্ত্রখাতে কাজ করছে।

বিবিসির উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলা ট্রিবিউন ২০১৮ সালের ২০ মে এক তথ্যে জানায়, প্রতি বছর এ দেশ থেকে ভারতে ৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স হিসেবে চলে যাচ্ছে। মূলত ‘দক্ষ’ জনশক্তির অভাবে এ দেশে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় কাজ করছে। শুধু ভারতীয় নয়, এখানে শ্রীলঙ্কানও কাজ করছে। পাশাপাশি কিছু রয়েছে পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের অধিবাসী।

এ দিকে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীরা বছরে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করছে।

বেতন-ভাতার নামে এই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ‘বাংলাদেশে বিদেশীদের কর্মসংস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। গত বুধবার টিআইবির ধানমন্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি।

সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীর প্রাক্কলিত ন্যূনতম সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। ন্যূনতম এই সংখ্যার হিসাবে দেশ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায় এবং তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে ন্যূনতম প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়।

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এ দেশে বসবাসরত বিদেশীদের অধিকাংশই কাজ করছে তৈরী পোশাক খাতে। বাদবাকিরা চামড়া শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল ও বিদেশী কয়েকটি সংস্থায় কর্মরত। এসব বিদেশীর অধিকাংশ ট্রাভেল ভিসায় এখানে এসে অবৈধভাবে কাজ করছে। তবে সব বিদেশী এখানে কাজ করার প্রধান কারণ হচ্ছে- তারা যেসব কাজ করছে তা করার জন্য স্থানীয়ভাবে দক্ষ লোক পাওয়া যায় না।

ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই দেশের উদ্যোক্তরা বিদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট খাতে দক্ষ লোক এনে এখানে নিয়োগ দিচ্ছেন। আর এতে করে দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এখন এ প্রবণতা ঠেকানোর জন্য দেশে দক্ষ লোক তৈরি করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটির নামকরণ করা হয়েছে ‘স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি)।

প্রকল্পটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এডিএফ ঋণ, সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের (এসডিসি) অনুদান এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০২০ মেয়াদে দক্ষতা উন্নয়নে পাঁচ লাখ দুই হাজার লোককে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ছিল। যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থীকে সংশ্লিষ্ট শিল্প সংগঠনের আওতাভুক্ত শিল্প/প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করা হবে। তবে এই প্রকল্প থেকে এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক লোক প্রশিক্ষণ নিয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি।

  • কার্টসি- নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০