সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে প্রশাসন কি ব্যর্থ? বিশেষজ্ঞদের কথায়, প্রশাসন শুধু ব্যর্থই নয়, এই ব্যর্থতার তালিকা লম্বাও হচ্ছে৷ এভাবে চলতে থাকলে বর্হিবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হবে৷ তাই এখনই সরকারি পদক্ষেপ দরকার৷
সমীর কুমার দে / ডয়চে ভেলে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় সরকারকে কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে৷ বিদেশে
আমাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে৷ পুলিশ পাহাড়ার মধ্যে কীভাবে আবার আগুন দেয়?
এটা হতে পারে না৷ ওখানে পুলিশের যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের এখনই প্রত্যাহার করতে হবে৷
দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ওখানে দায়িত্ব দিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে৷''
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে
মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া ও লুটপাটের পর মামলা হয়েছে৷ বেশ কিছু মানুষকে
পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে৷ পুরো এলাকার নিরাপত্তা মনিটরিং করছেন ঢাকার পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা৷
অথচ এর মধ্যেই আবার সেখানে একটি হিন্দু বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ রবিবার ভোরে
উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়ায় ছোট্ট দাসের বাড়িতে একটি জাল রাখার ঘরে আগুন দেওয়া হয়৷ এতে
ঐ ঘরে রাখা পাঁচটি জাল পুড়ে যায়৷ গত ৩০শে অক্টোবর হিন্দুদের ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িঘরে
হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে৷ সেই ঘটনার রেশ না কাটতেই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে
আবার অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটল৷
পুলিশি পাহাড়ার মধ্যেই
আবার হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়া হলো৷ তাহলে পুলিশ কি ব্যর্থ? এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যেখানে
আগুন দেয়া হয়েছে, সেখানেই পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন পাহাড়া দিচ্ছিল৷ রাত ৪টার দিকে পুলিশ
ঘুমাতে যায়৷ আর তখনই আগুন দেয়া হয়৷ আসলে এই ঘটনা নিয়ে খেলা হচ্ছে৷ শুধু পুলিশ দিয়ে
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না৷ সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে কোনো নিরাপত্তাই
কাজে আসবে না৷ আমরা সাধারণ মানুষকে সম্পৃত্ত করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছি৷''
অন্যদিকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ
উপজেলায় সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনায়ও প্রশাসন তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ উল্টে গুলিবিদ্ধ
সাঁওতালদের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ হাতকড়া লাগিয়ে চিকিৎসা দেয়ার বিষয়টি
সোমবার হাইকোর্টের নজরে আনেন ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া৷ গাইবান্ধায় চিকিৎসাধীন
অবস্থায় আটক থাকা তিন সাঁওতালের হাতকড়া খুলে দিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি)
কমিশনার, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি এবং গাইবান্ধার এসপিকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷ বিচারপতি
ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন৷ ১৬ই নভেম্বরের মধ্যে ব্যবস্থা
নিতে বলা হয়৷
ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময়
বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সেখানে প্রশাসন ফেল
করছে৷ এই ব্যর্থতার তালিকা লম্বা হচ্ছে৷ এখানে শুধু পুলিশ বা প্রশাসনকে অভিযোগ দিয়ে
কোনো লাভ নেই৷ সুশাসন ও সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার৷ এই সদিচ্ছা ছাড়া কোনোভাবেই
পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে বলে আমি মনে করি না৷''
অপরদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের
সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, রংপুর সুগার মিলের সাহেবগঞ্জ খামারের সরকারি
জমি অবৈধভাবে দখলে রাখতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সাঁওতালদের প্ররোচিত করছে৷ এছাড়া
সাঁওতালদের সামনে রেখে পেছনে ভাড়াটে লোকেরাই সেখানে অরাজকতা সৃষ্টি করে৷ তিনি বলেন,
‘‘রংপুর চিনিকলের জমি অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে৷ ঐ জমি
ও সম্পদ রার দায়িত্ব সরকারের৷''
তিনি আরও বলেন, ‘‘গত ৬ নভেম্বর স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের
নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য সুশৃঙ্খলভাবে অভিযান চালিয়ে সরকারি এই চিনিকলের
সম্পদ এবং জমি অবৈধ দখলমুক্ত করে৷
প্রশাসনের এই ধরনের বক্তব্য
ও কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালরা৷ এরই প্রেক্ষিতে সোমবার প্রশাসনের ত্রাণ
ফিরিয়ে দিয়েছে সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতাল সম্প্রদায়৷ সোমবার
সকালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল হান্নান সহিংস হামলার শিকার
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে যান৷ এ সময় ওই সম্প্রদায়ের কেউই তা গ্রহণ
করেননি৷ আবদুল হান্নান পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সকাল
সাড়ে নয়টা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মাঝে ত্রাণ দিতে মাদারপুর গির্জার
সামনে অপো করেছি৷ তাঁদের ঘরে ঘরে গিয়ে ত্রাণ নেওয়ার জন্য জানিয়েছি৷ কিন্তু তাঁরা কেউ
ত্রাণ নিতে রাজি হননি৷'' তিনি আরও বলেন, ‘‘আজ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ১৫০ পরিবারের প্রত্যেককে
২০ কেজি চাল, এক লিটার তেল, এক কেজি ডাল, এক কেজি আলু, এক কেজি লবণ ও দু'টি কম্বল বিতরণের
কথা ছিল৷''
ত্রাণ না নেওয়ার কারণ হিসেবে
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে
সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘প্রশাসন একমুখে দু'কথা বলছে৷ তারা একদিকে ত্রাণ দিতে
চাইছে, অন্যদিকে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আমাদের জমি নষ্ট করছে৷ তাই আমরা প্রশাসনের কোনো
ত্রাণ নেইনি৷''
সাঁওতালদের নামে দায়ের
করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘‘প্রশাসন নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে৷ কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ হচ্ছে না৷
তাছাড়া ঘটনার নয় দিনেও সাঁওতালদের ঘরে আগুন, বসতবাড়িতে লুটপাট ও সাঁওতাল হত্যার ঘটনায়
মামলা ও তদন্ত কমিটি হয়নি৷ আমরা এ সব ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই৷ আমাদের দাবি পূরণ
না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনের কোনো ত্রাণসহায়তা নেব না৷''