Search

Wednesday, November 9, 2016

৭ নভেম্বর: জাতি গঠনের মহান স্মারক


ড. মাহবুব উল্লাহ 


১৯৭৫র ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য দিন। এই দিনে সিপাহী জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে ঘিরে আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়। এই দিবসটি এদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতি বছর এই দিবসটি আমাদের নতুন করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করে। দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতার ফলে কখনো কখনো এই দিবসটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদালাভে ব্যর্থ হয়। আবার কখনো কখনো যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে।

জাতি গঠনের পথ আকাবাঁকা রেখার মতো এগিয়ে চলে। কোন জাতির ইতিহাসই সরল রেখার মতো একমুখী হয় না। জাতি গঠনের পরম লক্ষ্য হল সমগ্র জাতিসত্তার ঐক্য ও সংহতি অর্জন। এই ঐক্য ও সংহতি অর্জনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে অনেক চড়াই-উৎরাই। পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা অতিক্রম করেই একটি জাতি গ্রানাইট পাথরের মতো মজবুত দৃঢ়তা অর্জন করে। মাঝখানের চড়াই-উৎরাইগুলো অনেক অশ্রু এবং রক্ত ঝরানো হলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে অধিষ্ঠানের শিখরে প্রস্থাপিত করে। সমকালীন বিশ্বে মার্কিন জাতির জাতি হিসেবে গড়ে ওঠা এক চমকপ্রদ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা বর্ণের নানা দেশের অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। ধর্মীয় বৈচিত্র্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণাঢ্যরূপে বিরাজমান। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে  বর্ণবৈষম্য জাতিসত্তাকে খন্ডিত করে রেখেছিল। মার্কিন জাতির এই খন্ড বিখন্ড অবস্থা আজ আর  নেই বললেই চলে। এ কারণেই বলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হল melting pot of history। কিছু কিছু ক্ষুদ্র বিচ্যুতিকে পেছনে ফেলে রেখে মার্কিনীরা গর্ব করে বলে গ্রেট আমেরিকান নেশন। এরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ইতিহাসের এই মহান অর্জনের পথ দুর্ভাগ্যক্রমে পিচ্ছিল হয়েছিল গৃহযুদ্ধের রক্তপাতে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য মিছিলে, সমাবেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখর হয়েছিল গত শতাব্দীর ৬০র দশকে। মহান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র  I have a dream বলে সাদা ও কালো মানুষের বিভেদ দূর করতে শেষ পর্যন্ত আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। মার্কিন জাতি গঠনে এগুলো ছিল বেদনাদায়ক অধ্যায়। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি, সমরশক্তি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পৃথিবীর সেরা দেশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ অনেক সময় অগ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজ দেশে মার্কিনীরা টেকসই প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়ে এবং সেগুলোকে কার্যকর করে দেশের ভেতরে এক সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণই আমাদের বলে দেয় ভাষা, বর্ণ, ধর্ম এবং জাতিসত্তার উত্তরাধিকারকে অতিক্রম করে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীও শেষ পর্যন্ত জাতিতে পরিণত হতে পারে, যদি তারা সম্মিলিতভাবে অনুভব করে তাদের সত্তা এক ও অভিন্ন রূপ পেয়েছে।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বীরের রক্তের স্রোত এবং মায়ের অশ্রুধারার মধ্য দিয়ে যে জাতি এবং যে রাষ্ট্রের উত্থান, তার ফলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম আমাদের জাতি গঠনের কাজটি সমাপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে উদ্ভবের পর আমরা দেখেছি আমাদের বিপদের বন্ধু হিসেবে যারা হাত বাড়িয়েছিল তারা সে কাজটি নিছক পরার্থপরতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে করেনি। সম্ভবত এই অভিজ্ঞতা পৃথিবীর অনেক জাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গণতন্ত্র ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মহাসড়কে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র স্বাধীনতার ৩ বছরের মাথায় মুখ থুবড়ে পড়লো। জাতির ওপর চেপে বসলো একদলীয় শাসনের জগদ্দল পাথর। সুবিচার ও ন্যায়পরায়নতার আদর্শও জলাঞ্জলি দেয়া হল। পাঠক যদি একটু কষ্ট স্বীকার করে সাংবাদিক মাসুদল হকের গবেষণা সমৃদ্ধ গ্রন্থ মুক্তি যুদ্ধে র ও সিআইএ পাঠ করেন এবং এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে যুক্ত করা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটিও পাঠ করেন তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে কীভাবে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এসব দৃষ্টান্ত নেতিবাচক হলেও এর ইতিবাচক দিকটি হল স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্বেষায় উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। জাতি হিসেবে এদেশের ৯৯% মানুষ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির নির্ঝরণীতে প্রতিদিন অবগাহন করলেও জাতিসত্তার দিক থেকে একাত্মতা অর্জন করতে তাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে অমসৃণ ও পদতল বিদীর্ণকারী পথ। এমন পথ চলা হয়তো আরও অনেক বছর চলবে। এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জাতি গঠন প্রক্রিয়া একটি পরিণত রূপ লাভ করবে।

১৯৭৫র ৩ নভেম্বর তৎকালীন সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। খালেদ মোশাররফ যে অজুহাতে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন তা ছিল সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এধরনের প্রয়াসের সঙ্গে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের কোন সম্পর্ক ছিল না অথচ তাকে সঙ্গে না পেলে চেইন অব কমান্ডের অজুহাতটি চুপসে যায়, তাই তাকে বন্দি করে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে খালেদ মোশাররফ ক্যু করে বসেন। সেদিন যেসব সেনা কর্মকর্তা তার সঙ্গে ছিলেন এবং তার মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে জানা যায় সেনাবাহিনীতে জিয়া ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার এই জনপ্রিয়তার কারণ ১৯৭১র মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা এবং সততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন। জিয়াকে বন্দি করার ফলে সৈনিকরা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তখন জাসদ সহ কিছু বাম রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশে জড়িত ছিল। এদের মধ্যে জাসদপন্থীরা আলোচ্য পরিস্থিতিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটানোর পর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন থেকে কোনরূপ রাষ্ট্রীয় ঘোষণা ও বক্তব্য প্রচারিত না হওয়ায় জনগণ চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। বস্তুত ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্য রাত পর্যন্ত জনগণের বুঝে উঠতে পারা সম্ভব হয়নি আসলে রাষ্ট্র ক্ষমতা কার হাতে। জনগণের মধ্যে চরম শংকার সূত্রপাত হয়। তারা শংকিত বোধ করে, বুঝি আবার বাকশাল ফিরে আসছে, আবারও হয়তো দুর্ভিক্ষের দুর্দিন ফিরে আসছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সৈনিকরা সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে রাজপথে নেমে আসে। জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। জনগণ হাজারে হাজারে ঢাকার রাজপথে নেমে বিপ্লবী সৈনিকদের অভিনন্দিত করে এবং তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শ্লোগান তোলে সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ।

জনগণ আবারো রেডিও টেলিভিশনে জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে আশ্বস্ত হয়। দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাদপ্রদীপের নিচে এসে দাঁড়ান জিয়া। তিনি এই দায়িত্বভার সৈনিক ও জনগণের ব্যক্ত ইচ্ছার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ক্ষমতার জবরদখলকারী ছিলেন না। রাষ্ট্রের এক ঐতিহাসিক সংকট মুহূর্তে দ্বিতীয়বারের মত তিনি জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। ৭ নভেম্বর ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় জীবনে এক অমোচনীয় পথচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭ নভেম্বর দেশপ্রেমিক সৈনিক এবং জনগণের ঐক্যের স্মারক।

No comments:

Post a Comment