Search

Sunday, November 27, 2016

নির্বাচন কমিশন এবং বিএনপির ভাবনা

By রুমীন ফারহানা

 
সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গত ১৮ নভেম্বর তিনি এ প্রস্তাব দিয়েছেন। তার পুরো বক্তব্যে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো- অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের একটি কমিশন কী করে, কাদের সমন্বয়ে গঠন করা যায়, যার প্রতি জন-আস্থা ফিরে আসবে, তা-ই ছিল মূলত এই প্রস্তাবের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

বর্তমানে বহুল বিতর্কিত যে নির্বাচন কমিশন আছে, তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মেয়াদ শেষে নতুন যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে তার অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০১৪ সালে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক এক নির্বাচনের পর ২০১৮-এর শেষে বা ২০১৯-এর শুরুতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা দিক দিয়ে তা গুরুত্ব বহন করে। এ কারণেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ ও নির্বাচনের সময় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিশ্চত করা সরকারের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বাহন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধানে পরিষ্কার বলা আছে- ‘দেশের সকল ক্ষমতার উৎস এর জনগণ’। জনগণ এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন, তাই তাদের জবাবদিহিতা থাকে জনগণের প্রতি। কোনো সরকার যদি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত না হয়, তাহলে জবাবদিহিতার প্রশ্ন হুমকির মুখে পড়ে এবং গণতন্ত্রের অন্যান্য যে বাহন বা নিয়ামক যেমন- আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, সুশাসন, মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা এ সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারকে তখন তার ন্যায্যতা কায়েম করতে ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’, ‘বেশি উন্নয়ন কম গণতন্ত্র’, ‘সীমিত গণতন্ত্র’ ইত্যাদি নানা অগণতান্ত্রিক ফর্মুলার আশ্রয় নিতে হয়, যার কোনোটিই রাষ্ট্র, সরকার বা জনগণের জন্য শুভ পরিণতি বয়ে আনে না। আর গণতন্ত্রের প্রধান বাহন যে নির্বাচন- তা যদি একটি দক্ষ, যোগ্য, সৎ, নিরপেক্ষ, সাহসী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশনের অধীনে না হয়- তাহলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এ কারণেই একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রথম ও প্রধান শর্ত। নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে আমাদের সংবিধানের ১১৮ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে- ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলিসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দান করবেন।’ দুঃখজনক হলেও সত্য, এ আইন বা বিধানাবলি আজো প্রণীত হয়নি। ঠিক সে কারণেই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্কের ধারাও অব্যাহত আছে। আর তাই নির্বাচন কমিশন গঠন ও তা শক্তিশালীকরণ সংক্রান্ত বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রণয়ন বাঞ্ছনীয়। তবে যত দিন পর্যন্ত না আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত স্থায়ী ব্যবস্থা প্রণীত হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে কী করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন ও তা শক্তিশালী করা যায়, সেটিই ছিল বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য।

বিএনপি চেয়ারপারসনের এ বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটি চর্বিত চর্বণ, অন্তঃসারশূন্য, হাস্যকর, জাতির সাথে তামাশা ও নির্লজ্জ মিথ্যাচার। আমাদের এই স্বাধীন দেশে অন্তত ক্ষমতায় যারা আছে, তাদের যথেচ্ছ মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদের তার ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করতেই পারেন। তবে এটি যদি তাদের দলীয় বক্তব্য বা স্ট্যান্ড হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোন প্রক্রিয়ায় ১৩ দফার এই প্রস্তাবটি আওয়ামী লীগ ১৩ সেকেন্ডের কম সময়ে কোনোরকম বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই নাকচ করে দিলো? অথচ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের কোথাও এটি স্পষ্ট হলো না যে, তিনি বা তারা এর কোন কোন অংশের সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন, কেন করছেন, এর বিকল্প প্রস্তাব কী হতে পারে, একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনে আওয়ামী লীগের ভাবনাই বা কী? ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বারবারই বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। এটি আংশিক সত্য। কিন্তু যে অংশটি তারা বাদ দিয়ে যাচ্ছেন তা হলোÑ সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগ দেবেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে। এখানেই যত বিপত্তি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নাম যদি সব রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবে অভিন্ন না হয়, তখনই বিতর্কিত দলীয় নিয়োগের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন কোনো অবাস্তব প্রস্তাব নয়। ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ বহু দেশে সরকার ও বিরোধী দল যৌথভাবেই নির্বাচন কমিশন গঠন করে থাকে। তবে আশার কথা হলো, আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে প্রস্তাবটি নাকচ করলেও দেশের সুধীসমাজ ও বেশ কয়েকজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং স্বীকার করেছেন যে, প্রস্তাবটি আলোচনার দাবি রাখে। এখানেই এ প্রস্তাবের স্বার্থকতা।

বেগম খালেদা জিয়ার এ প্রস্তাবকে বিতর্কিত করার প্রথম চেষ্টা হিসেবে বলা হয়েছে- বিএনপির এ প্রস্তাব কৌশলে জামায়াতকে সাথে রেখেই নির্বাচনের একটি কৌশল। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রস্তাবনায় সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী নেই। কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। তবে দ্বিতীয় বিকল্প অর্থাৎ কী ধরনের রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা হতে পারে, সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ‘স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সব রাজনৈতিক দল’। উল্লেখ্য, প্রস্তাবের প্রথম ও দ্বিতীয় বিকল্পের মাঝে ‘এবং’ ‘অথবা’ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যদি দ্বিতীয় বিকল্পের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির আপত্তি থাকে, তাহলে তাকে প্রথম বিকল্প অর্থাৎ কেবল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেই আলোচনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সুতরাং সুকৌশলে নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দল জামায়াতকে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করেননি বেগম খালেদা জিয়া। বরং অযাচিতভাবে জামায়াতকে সামনে এনে অযথা বিতর্কের চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হয়।

কোনো কোনো মহল আবার নির্বাচনের সময় বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাবে গোস্বা হয়ে এমনও প্রশ্ন তুলেছেন যে, এ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিএনপি দেশে একটি সামরিক আইন জারি করতে চায়। এ প্রসঙ্গে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, জাতীয় প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিয়োজিত করার সুযোগ আছে। সিআরপিসিতে যার অনেক নজিরও আছে। এ ধরনের মোতায়েনকে সামরিক আইন বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রিরিয়াল ক্ষমতা প্রদান বিচারকাজ পরিচালনার ক্ষমতা বুঝায় না। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রতিরক্ষা বাহিনী আইনানুগভাবে তথা সীমা লঙ্ঘন না করে, অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করে দায়িত্ব পালন করবে। বর্তমানে মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্টের অধীন পুলিশ কমিশনার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে কেবল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োগ করলে কার্যকর ও সন্তোষজনক ফল পাওয়া সম্ভব হয় না বিধায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনে ম্যাজিস্ট্রিয়াল ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৯ সালে আরপিও সংশোধনের আগ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এর মধ্যে দু’টি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও দু’টিতে বিএনপি জয়লাভ করে। ২০০৯ সালের পর থেকে নির্বাচনের কাজে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বাদ দেয়ার পর যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়, তাতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির ভূমিকা সমালোচিত হয়েছিল এবং বিভিন্ন সময় এসব বাহিনীপ্রধানদের রাজনৈতিক বক্তব্যও দিতে দেখা গেছে। তাই জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো বিকল্প নেই।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, তিনি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আসলে কেউই চায় না। কিন্তু নির্বাচন যাতে আর প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকেই। প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের প্রাথমিক শর্তই হলো একটি প্রশ্নমুক্ত ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন। তাই সরকারের এ বিষয়ে সদিচ্ছা কতটুকু বা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সরকার আসলে কেমন দেখতে চায়, সেটা পরিষ্কার হবে ২০১৭ সালের নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়েই।                 

-       লেখক : আইনজীবী ও রাজনীতিক 

No comments:

Post a Comment