জি মুনীর / নয়াদিগন্ত
সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওর অঞ্চল একসময় সুপরিচিত ছিল দেশের অন্যতম শস্যভাণ্ডার ও একই সাথে মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে। একসময়ের যে বাংলার পরিচিত ছিল ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ’ অভিধায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল এই হাওরাঞ্চল। অবশ্য এই প্রবাদটির যে সংস্করণটি হাওর এলাকায় পরিচিত ছিল তা ছিল এমন : ‘গোলা ভরা ধান আর বিল ভরা মাছ’। কারণ, হাওর এলাকায় পুকুরের চেয়ে বিলের ছড়াছড়িই বেশি। এসব বিলে ছিল মিঠাপানির প্রচুর দেশী মাছ, যা সারা দেশের মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ করে আসছিল ব্যাপকভাবে। আর এসব বিলের চার পাশ ঘুরে রয়েছে বিস্তীর্ণ বোরো ধানের ক্ষেত। এসব ফসলের ক্ষেত বর্ষায় ডুবে থাকে কয়েক হাত পানির নিচে। আর গ্রামগুলো পানিতে ভাসে ভেলার মতো। শুধু হেমন্তে এসব ক্ষেত থাকে একটি ফসল ফলানোর উপযোগী, যা বোরো ফসল নামে সুপরিচিত। এই এক ফসলের ওপর নির্ভর করে এতদিন হাওরের কৃষকেরা সচ্ছল জীবনযাপন করে আসছিল। কারণ, এ অঞ্চলে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল বেশি, আর আজকের দিনের মতো আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এত ঘনঘন ফসলহানি ঘটত না। তখন হাওরের মানুষ মূলত কৃষি অর্থনীতির ওপরই নির্ভর ছিল। সরকারের কাছেও এরা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করত না। সরকারের কাছে ছিল না তাদের কোনো দাবি-দাওয়া। আর সরকারের বিরুদ্ধেও ছিল না তাদের কোনো অভিযোগ-অনুযোগ। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মাথাপিছু জমির পরিমাণ এক দিকে কমে গেছে, অপর দিকে বছর বছর অকাল বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে বোরো ধানের ক্ষেত। হাওরেও আগের মতো মাছ নেই। ফলে আজ হাওরাঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি বলতে গেলে ভেঙে পড়েছে। তাই আজকের দিনে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে হাওরের কৃষক পরিবারগুলো।
এবার বৈশাখ আসার আগেই চৈত্রের শেষ দিকেই প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল, ভারত থেকে আসা উজানের পানি এসে হাওরাঞ্চলে যে অকালবন্যা হয়েছে, তাতে তলিয়ে গেছে উল্লিখিত সাত জেলার হাওর এলাকার ৯০ শতাংশ বোরো ধানের ক্ষেত। এর ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে এক ধরনের হাহাকার। তা ছাড়া ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় ধানগাছ পচে হাওর এলাকার পানি এরই মধ্যে বিষাক্ত হয়ে গেছে। এর ফলে হাওরের ও নদীর মাছ মরে ভেসে উঠছে। তা ছাড়া এই বিষাক্ত মাছ খেয়ে কিংবা বিষাক্ত পানির বিরূপ প্রভাবে মরে যাচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার হাঁস। এর ফলে কৃষক ও খামারিরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। এর আগেও অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলে ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে এভাবে মাছের মড়ক ও ঝাঁকে ঝাঁকে হাস মরে যেতে দেখা যায়নি। এই মাছের মড়ক ঠেকানো না গেলে হাওর এলাকার জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবেন। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন : ঘরে নেই খানি, ঘরের চালে নেই ছানি, বিষাক্ত মাছ ধরা ও খাওয়ায় এসেছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, নেই কেনো কর্মসংস্থানের সুযোগ, জেলে-চাষি চোখে দেখছেন অন্ধকার। হাওর পারের মানুষের দীর্ঘশ্বাস হাওরাঞ্চলের বাতাস ভারী করে তুলেছে।
অকালে ফসল তলিয়ে গেছে সময়মতো হাওর রক্ষা বাঁধগুলো নির্মাণে সরকারের চরম ব্যর্থতা ও হাওর রক্ষা বাঁধের টাকা লুটপাটের কারণে। আর এখন মাছ ও হাঁসের মড়ক ঠেকানোয় সরকারের কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। শুধু বিচ্ছিন্নভাবে হাওরের পানিতে চুন ছিটিয়ে মাছের মড়ক ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য উপহাসমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। যখন এবারের অভাবনীয় মাত্রার অকাল বন্যার বাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখে চার দিক থেকে দাবি উঠেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকাকে ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করে বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতি জরুরিভাবে মোকাবেলার, তখন সরকারি কর্মকর্তারা এই দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিদারদের মূর্খ বলে প্রতিপন্ন করার প্রয়াসে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। তাদের এই বক্তব্য ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষকদের কাটা ঘায়ে নুন ছিটানোরই শামিল। সব কিছু হারিয়ে হাওর এলাকার মানুষ যখন বাঁচার লড়াইয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে শুরু করেছে, তখন সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের বক্তব্য ঔদ্ধত্যের চরম বহিঃপ্রকাশ।
গত বুধবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেছেন, ‘এই বন্যায় কোথাও একটি ছাগলও মরেনি।’ তিনি এ ধরনের মন্তব্য করে কৃষকদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন। শুধু এ কথা বলেই তিনি থামেননি, বরং তিনি বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাতেও প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটি আইন আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকার অর্ধেকেরও বেশি লোক মারা যাওয়ার পর এই এলাকাকে দুর্গত ঘোষণা করতে হয়। না জেনে যারা এমন সস্তা দাবি জানায়, তাদের জ্ঞানই নেই।’ তিনি ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে আরো বলেছেন, ‘কিসের দুর্গত এলাকা? একটি ছাগলও তো মারা যায়নি।’
এবার বৈশাখ আসার আগেই চৈত্রের শেষ দিকেই প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল, ভারত থেকে আসা উজানের পানি এসে হাওরাঞ্চলে যে অকালবন্যা হয়েছে, তাতে তলিয়ে গেছে উল্লিখিত সাত জেলার হাওর এলাকার ৯০ শতাংশ বোরো ধানের ক্ষেত। এর ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে এক ধরনের হাহাকার। তা ছাড়া ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় ধানগাছ পচে হাওর এলাকার পানি এরই মধ্যে বিষাক্ত হয়ে গেছে। এর ফলে হাওরের ও নদীর মাছ মরে ভেসে উঠছে। তা ছাড়া এই বিষাক্ত মাছ খেয়ে কিংবা বিষাক্ত পানির বিরূপ প্রভাবে মরে যাচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার হাঁস। এর ফলে কৃষক ও খামারিরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। এর আগেও অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলে ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে এভাবে মাছের মড়ক ও ঝাঁকে ঝাঁকে হাস মরে যেতে দেখা যায়নি। এই মাছের মড়ক ঠেকানো না গেলে হাওর এলাকার জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবেন। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন : ঘরে নেই খানি, ঘরের চালে নেই ছানি, বিষাক্ত মাছ ধরা ও খাওয়ায় এসেছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, নেই কেনো কর্মসংস্থানের সুযোগ, জেলে-চাষি চোখে দেখছেন অন্ধকার। হাওর পারের মানুষের দীর্ঘশ্বাস হাওরাঞ্চলের বাতাস ভারী করে তুলেছে।
অকালে ফসল তলিয়ে গেছে সময়মতো হাওর রক্ষা বাঁধগুলো নির্মাণে সরকারের চরম ব্যর্থতা ও হাওর রক্ষা বাঁধের টাকা লুটপাটের কারণে। আর এখন মাছ ও হাঁসের মড়ক ঠেকানোয় সরকারের কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। শুধু বিচ্ছিন্নভাবে হাওরের পানিতে চুন ছিটিয়ে মাছের মড়ক ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য উপহাসমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। যখন এবারের অভাবনীয় মাত্রার অকাল বন্যার বাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখে চার দিক থেকে দাবি উঠেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকাকে ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করে বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতি জরুরিভাবে মোকাবেলার, তখন সরকারি কর্মকর্তারা এই দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিদারদের মূর্খ বলে প্রতিপন্ন করার প্রয়াসে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। তাদের এই বক্তব্য ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষকদের কাটা ঘায়ে নুন ছিটানোরই শামিল। সব কিছু হারিয়ে হাওর এলাকার মানুষ যখন বাঁচার লড়াইয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে শুরু করেছে, তখন সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের বক্তব্য ঔদ্ধত্যের চরম বহিঃপ্রকাশ।
গত বুধবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেছেন, ‘এই বন্যায় কোথাও একটি ছাগলও মরেনি।’ তিনি এ ধরনের মন্তব্য করে কৃষকদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন। শুধু এ কথা বলেই তিনি থামেননি, বরং তিনি বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাতেও প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটি আইন আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকার অর্ধেকেরও বেশি লোক মারা যাওয়ার পর এই এলাকাকে দুর্গত ঘোষণা করতে হয়। না জেনে যারা এমন সস্তা দাবি জানায়, তাদের জ্ঞানই নেই।’ তিনি ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে আরো বলেছেন, ‘কিসের দুর্গত এলাকা? একটি ছাগলও তো মারা যায়নি।’
উল্লেখ্য, ফসলডুবির ঘটনায় হাওরাঞ্চলের সর্বত্র জনপ্রতিনিধিরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কৃষক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমের লেখালেখির মাধ্যমে বিভিন্ন মহল ফসল ডুবে যাওয়া হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে প্রতিবাদী মানুষের সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’। পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা সচিব শাহ কামালের এই অযাচিত বক্তব্যের যথার্থ জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘সচিব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের ২২ নম্বর ধারার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ধারায় রাষ্ট্রপতির ওপর দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, ‘দেশের কোনো অঞ্চলে দুর্যোগের কোনো ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় রোধে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করা জরুরি ও আবশ্যক, তাহা হইলে সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করিতে পারিবেন।’ হাওর আন্দোলনের এই নেতা আরো বলেন, ‘সচিবের এই বক্তব্য অবিবেচনাপ্রসূত, হাওর এলকার মানুষ ও প্রাণীকুলের প্রতি চরম অন্যায়। এখন মাছের মড়ক লেগেছে। হাঁস ও পাখি মরছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ছাগলও মরবে। কঠিন হবে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা।’
আসলে এবারের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সচিব কামাল ছোট করে দেখাতেই এ ধরনের মন্তব্য করেছেন বলে মনে হয়। নইলে তিনি এই দুর্যোগ-দুঃসময়ে এ ধরনের বক্তব্য রাখতেন না। প্রশ্ন জাগে, হাওর এলাকায় এখন কী ঘটছে, কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা কি তিনি দেখছেন না? এরই মধ্যে হাওর এলাকার সার্বিক পরিস্থিতির খবর সরকারি মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছার কথা, কারণ তিনি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। তা ছাড়া অন্তত গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশিত খবরগুলো তো তার না জানার কথা নয়। দেশবাসী তো এরই মধ্যে গণমাধ্যম সূত্রেই জেনে গেছে- কয়েক দিনে সুনামগঞ্জের শুধু ধর্মপাশা উপজেলায়ই খামারিসহ গৃহস্থদের পাঁচ শতাধিক হাঁস মারা গেছে। ধর্মপাশার রবিউর রহমানের খামারে দেড় হাজারের মতো হাঁস ছিল। দু’দিনে হাওরের বিষাক্ত পানিতে মরে যাওয়া পচা মাছ খেয়ে মারা গেছে তার ১২০টি হাঁস। ফলে বেঁচে থাকা অন্য হাঁসগুলো তিনি এখন আর হাওরের পানিতে ছাড়ছেন না। বাড়িতে রেখেই এগুলোর যত্ন নিচ্ছেন। জানা গেছে, এই বিষাক্রান্ত হাঁস এক দিনেই মারা যায়। রবিউর রহমানের বাড়ি ধর্মপাশা উপজেলার বাদেহরিপুর গ্রামে। রবিউর রহমানের মতো একই অবস্থা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের সরিষাকান্দা ইসলামপুর গ্রামের খামারি আল আমিনেরও। আল আমিনের ৭০০ হাঁসের মধ্যে দু’দিনে মারা গেছে ৭০টি। জানা যায়, ধর্মপাশা উপজেলায় ২৬০ জন খামারি ও ছোটখাটো গৃহস্থের সাত লাখ ১৫ হাজার ৩১০টি হাঁস রয়েছে। এগুলো নিয়ে খামারিরা এখন বিপদে। একইভাবে মোহনগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হাঁস মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওরে মারা গেছে অনেক হাঁস। হাঁস ও পাখি মারা গেছে হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজারের বড়লেখা অংশে। সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে ভেসে উঠেছে অনেক মরা মাছ। হাকালুকি হাওরেও মাছ মরছে। আরো বহু জায়গায় মাছ ও হাঁস মরার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে একাধিক জাতীয় দৈনিকে। একইভাবে মাছের মড়ক ঠেকানোর জন্য চুনের পানি ছিটাতে দেখা গেছে অনেক হাওরে। এমনি পরিস্থিতিতে ‘একটি ছাগলও এখনো মরেনি’ ধরনের বক্তব্য একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে কাম্য নয়। হাওর জনপদের দিশেহারা মানুষের পক্ষ থেকে যখন হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি উঠেছে, তখন তাদের জ্ঞানই নেই বলে কটাক্ষ করাও অপ্রতাশিত।
আসলে এবারের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সচিব কামাল ছোট করে দেখাতেই এ ধরনের মন্তব্য করেছেন বলে মনে হয়। নইলে তিনি এই দুর্যোগ-দুঃসময়ে এ ধরনের বক্তব্য রাখতেন না। প্রশ্ন জাগে, হাওর এলাকায় এখন কী ঘটছে, কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা কি তিনি দেখছেন না? এরই মধ্যে হাওর এলাকার সার্বিক পরিস্থিতির খবর সরকারি মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছার কথা, কারণ তিনি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। তা ছাড়া অন্তত গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশিত খবরগুলো তো তার না জানার কথা নয়। দেশবাসী তো এরই মধ্যে গণমাধ্যম সূত্রেই জেনে গেছে- কয়েক দিনে সুনামগঞ্জের শুধু ধর্মপাশা উপজেলায়ই খামারিসহ গৃহস্থদের পাঁচ শতাধিক হাঁস মারা গেছে। ধর্মপাশার রবিউর রহমানের খামারে দেড় হাজারের মতো হাঁস ছিল। দু’দিনে হাওরের বিষাক্ত পানিতে মরে যাওয়া পচা মাছ খেয়ে মারা গেছে তার ১২০টি হাঁস। ফলে বেঁচে থাকা অন্য হাঁসগুলো তিনি এখন আর হাওরের পানিতে ছাড়ছেন না। বাড়িতে রেখেই এগুলোর যত্ন নিচ্ছেন। জানা গেছে, এই বিষাক্রান্ত হাঁস এক দিনেই মারা যায়। রবিউর রহমানের বাড়ি ধর্মপাশা উপজেলার বাদেহরিপুর গ্রামে। রবিউর রহমানের মতো একই অবস্থা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের সরিষাকান্দা ইসলামপুর গ্রামের খামারি আল আমিনেরও। আল আমিনের ৭০০ হাঁসের মধ্যে দু’দিনে মারা গেছে ৭০টি। জানা যায়, ধর্মপাশা উপজেলায় ২৬০ জন খামারি ও ছোটখাটো গৃহস্থের সাত লাখ ১৫ হাজার ৩১০টি হাঁস রয়েছে। এগুলো নিয়ে খামারিরা এখন বিপদে। একইভাবে মোহনগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হাঁস মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওরে মারা গেছে অনেক হাঁস। হাঁস ও পাখি মারা গেছে হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজারের বড়লেখা অংশে। সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে ভেসে উঠেছে অনেক মরা মাছ। হাকালুকি হাওরেও মাছ মরছে। আরো বহু জায়গায় মাছ ও হাঁস মরার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে একাধিক জাতীয় দৈনিকে। একইভাবে মাছের মড়ক ঠেকানোর জন্য চুনের পানি ছিটাতে দেখা গেছে অনেক হাওরে। এমনি পরিস্থিতিতে ‘একটি ছাগলও এখনো মরেনি’ ধরনের বক্তব্য একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে কাম্য নয়। হাওর জনপদের দিশেহারা মানুষের পক্ষ থেকে যখন হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি উঠেছে, তখন তাদের জ্ঞানই নেই বলে কটাক্ষ করাও অপ্রতাশিত।
এরই মধ্যে ধর্মপাশা ও মোহনগঞ্জের কয়েকটি হাওরের পানির উপাদান ও গুণাগুণ পরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি গবেষকদল গত বুধবার সকালে ধর্মপাশার কাইঞ্জা ও ধরাম হাওরের এবং বৃহস্পতিবার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে পানি পরীক্ষা করে। গবেষণায় দেখা যায়, হাওরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে পাঁচ মিলিগ্রামের নিচে নেমে গেছে এবং প্রতি লিটারে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়েছে আধা থেকে ১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ৬ মিলিগ্রামের বেশি এবং অ্যামোনিয়ামের পরিমাণ প্রতি লিটারে শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য দুই (০.০০২) মিলিগ্রামের চেয়ে কম থাকার কথা। তবে গত বুধবার ধর্মপাশার হাওরে একটানা বৃষ্টিপাতের ফলে হাওরের পানির অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে বলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাদে মতে, হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কমে যাওয়া এবং অ্যামোনিয়ামের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় মাছ ও হাঁস মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে কখনোই এবারের মতো বন্যার পানিতে মাছ, হাঁস ও পাখি মরতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইউরেনিয়াম খনি থেকে বিষাক্ত উপাদান হয়তো এবারের বন্যার পানিতে মিশে বাংলাদেশের হাওরে ছড়িয়ে পড়েছে। এই পানি একসময় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ওপেন পিট ইউরেনিয়াম খনি। এ খবর দিয়েছে, ইরানের গণমাধ্যম পার্সটুডে।
রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তিকেন্দ্রের রসায়ন বিভাগের প্রধান ড. বিলকিস আরা বেগম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভারত থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি বাংলাদেশের হাওর এলাকাগুলোতে আসার সম্ভাবনা প্রচুর। আর যদি তা-ই ঘটে, তা হবে আমাদের জন্য পিজ্জনক। তবে এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না চালিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু ভারত থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, গত ডিসেম্বরে মেঘালয়ের স্থানীয় খাসিয়া জনগোষ্ঠী সে এলাকার রানিকর নদীর পানি নীল থেকে বদলে সবুজ হয়ে যেতে দেখে। এ প্রেক্ষাপটে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাসিয়া স্টুডেন্ট ইউনিয়ন এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। সংগঠনটি তখন এই নদীর মাছ মরে যাওয়ার বিষয়টিও অবহিত করে। এমনকি জলজ প্রাণীবিহীন এই নদীটি এখন মৃতপ্রায় বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। খাসিয়া সম্প্রদায়ের নেতা মারকনি থঙনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সন্দেহ ইউরেনিয়াম খনি খননের ফলে এ থেকে নিঃসৃত ইউরেনিয়াম পানিতে মিশে নদীর পানির রঙ বদলে দিয়েছে এবং এর প্রভাবে এর মাছও মরে গেছে। ভারতের যে নদীতে ইউরেনিয়াম মিশে যাওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার জাদুকাটা নদী থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে বলে পার্সটুডের খবরে বলা হয়েছে।
এমনিতেই হাওর এলাকার সমস্যার অন্ত নেই। এর মধ্যে এবার হাওরের পানিতে প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া ও অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং ভারতের ইউরেনিয়াম খনি থেকে ইউরেনিয়ামের উপাদানের পানিতে এসে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা ইতাদি পরিবেশিক সমস্যা এখন দেখা দিয়েছে হাওরাঞ্চলের সমস্যার এক নতুন উপসর্গ হিসেবে। হাওরে এই সময়ে মাছ মরে যাওয়ার ঘটনা আমাদের সামনে নিয়ে এলো নতুন তাগিদ। হাওরের মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ সম্পদকে বাঁচাতে হলে হাওরের পানির ওপর নিয়মিত নজর রাখতে হবে। হাওরের পানি যেন সব সময় মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার উপযোগী থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সবার আগে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের বিষয়টি সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্বটি পালন করতে হবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদেরই। ভুললে চলবে না, হাওর এলাকার মাছ যেমন মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উৎস, তেমনি হাওরের মাছ সম্পদ থেকে সরকার প্রতি বছর পেয়ে থাকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। পাশাপাশি হাওর এলাকার জেলেদের জীবন-জীবিকা মূলত নির্ভরশীল মাছ সম্পদের ওপর। কিন্তু সময়ের সাথে হাওরের মাছ সম্পদ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এর সাথে সম্প্রতি হাওরের পানিতে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এতদিন হাওর এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি অবহেলিত হয়ে আসছে। এখন তা বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে এসে ঠেকেছে। এখন এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলার অবকাশ নেই।
হাওর এলাকার জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি এখন পুরাপুরি ভঙ্গুর পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এই এলাকার মানুষ সার্বিক দৃষ্টিতে লেখাপড়ায় পিছিয়ে। ফলে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে রুটিরুজি করাও তাদের জন্য কষ্টকর। এর পরও এবারের ফসলহানি তাদের বাধ্য করছে গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে শহরমুখী হতে। অনেকেই হালের গরু অর্ধেক দামে বিক্রি করে ঋণের দায় মিটিয়ে গ্রাম ছাড়ছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে, মহাজনদের হাত থেকে বাঁচতে হাওরের অনেক কৃষক গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। এ অবস্থায় অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দেয়ার স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছেন। কারণ বছরের পর বছর ঋণের টাকায় ফসল ফলাবে, আর সেই ফসল প্রতি বছর পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে- এভাবে তো চলতে পারে না। এর ফলে হাওরের মানুষ ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সার্বিকভাবে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে জাতীয় কৃষির ওপর। আর হাওরে মাছ না থাকলে জেলেরা বাধ্য হবে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হতে।
- লেখকঃ কলামিস্ট