এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় এক এগারোর ভুক্তভোগী সামকগ্রিকভাবে বাংলাদেশ। ৯০ দশকের পুরোটা জুড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জীবন দানের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে জনকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা ২০০৭-এর এক এগারোর সময় মুখ থুবড়ে পড়ে। এই পথপরিক্রমায় ২০১৪ ও ২০১৮-এর ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও ভোটচুরির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত মৃত্যু ঘটানো হয় । তাই বলা যায় আজকের গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশের দুঃখজনক পরিণতির সদর দরজা হচ্ছে এক এগারো। আর এই পরিণতিতে উপনীত হতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভ্যানগার্ড বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও এর নেতৃত্বের উপর শুরুতেই আনা হয় চরম আঘাত। বিএনপির ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কাণ্ডারি তারেক রহমানকে করা হয় চূড়ান্ত নিশানা । মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগ এনে তাঁকে সেপ্টেম্বর ৩, ২০০৭, কারাবন্দি করা হয়। এরপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁকে শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। কারাগারের নির্মম সেই অত্যাচারের ঘটনার সামান্যই আমরা জানি। ক্ষমতার অংশীজন না হয়েও কেবল মাত্র শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র হওয়া এবং বিএনপির আগামী দিনের অনিবার্য প্রধান নেতা হওয়ার কারণেই, তাঁর উপর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ নিষ্ঠুর নির্যাতন নেমে আসে।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ ভোর রাতে সে সময়কার অবৈধ সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী যৌথবাহিনী দেশের কোথাও কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও বাসা থেকে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। দিনের পর দিন রিমান্ডে নির্যাতন ও টানা ৫৫৪ দিন কারাবাসের পর সরকারের সাজানো সবকটি মামলায় আদালত থেকে জামিন পেয়ে ২০০৮ সালের এইদিনে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি পান আগামীর স্বপ্নদ্রষ্টা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারীদের হিংসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিষ্ঠুর নির্যাতনে জননেতা তারেক রহমান মুক্তির পরও হাসপাতালের বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। এই অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় এ তরুণ নেতার জীবন এখনও যন্ত্রণাকাতর। এখনও বিদেশে সেই নির্মম নির্যাতনের ক্ষত সারাতে চিকিৎসা নিতে হয় তাঁকে। গ্রেফতারের ১৬ বছর পর সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী আদালত এক রায় দিয়েছে। সেই রায় এবং বিচার প্রক্রিয়া যে সম্পূর্ণ সাজানো ও প্রহসনের সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
কথিত ১/১১’র মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ ভোর রাতে কোনো ওয়ারেন্ট, মামলা, জিডি এমনকি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই বিতর্কিত সরকারের নির্দেশে জরুরি বিধিমালায় গ্রেফতার করা হয় সমকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক তারেক রহমানকে। গ্রেফতারের পরদিন কাফরুল থানায় পুলিশ একটি জিডি ও গুলশান থানায় করা হয় চাঁদা দাবির মামলা। সেই সরকার ও পরবর্তীতে বর্তমান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করে শতাধিক সৃজনকৃত মামলা। গ্রেফতারেরর আগে, পরে ও এখনো গোয়েবলসীয় কায়দায় তাঁর বিরুদ্ধে চলছে মিথ্যাচার।
মুদ্রা পাচারের মিথ্যা অভিযোগে দুদকে দায়ের করা একটি মামলায় নিম্ন আদালত থেকে খালাস পেলেও হাইকোর্ট তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। নিম্ন আদালতের যে বিচারক তারেক রহমানকে খালাস দিয়েছিলেন সরকারের রোষানলে পড়ে তিনিও আজ নির্বাসিত। মূলত নিম্ন আদালত থেকে তারেক রহমান খালাস পেলেও সরকারের ইচ্ছায় তাঁকে রাজনীতি থেকে সরাতে এই সাজা দেয়া হয়।
এক এগারোর সরকারের দুই বছরসহ বর্তমান সরকারের আমলেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সর্বশক্তি দিয়ে টাস্কফোর্স, দুদকসহ সকল সংস্থাই দেশে-বিদেশে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেও তাঁর বিরুদ্ধে অভযোগ দায়ের করার মতো কোনো অপরাধের প্রমাণ পায়নি। সে সময় পুলিশ রিমান্ডে নির্যাতন ও তাঁকে চাপে রাখতে গ্রেফতার করা হয় তাঁর মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও একমাত্র ছোট ভাই আরাফাত রহমানকে। তাঁকে দেশ ছাড়তে প্রচণ্ড চাপ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি মায়ের মতোই রাজি হননি দেশ ছাড়তে। ফলে বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা তারেক রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করে। তার শরীর অসংখ্য জখমে ভরে দেয়া হয় রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে। তাঁকে অনেক উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়। মেরুদণ্ডে আঘাত করে মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে দিনের পর দিন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে। কিন্তু দেশবাসীর দোয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। রিমান্ডে সীমাহীন বর্বরোচিত নির্যাতন, হাসপাতালে ভর্তি, প্রিয় নানীকে হারানো, মা ও একমাত্র ভাইয়ের কারাবরণ ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে কারাগার ও হাসপাতালের প্রিজন সেলে এক বছর ৫ মাস ২৯ দিন কাটান তিনি।
গ্রেফতারের পর থেকে তারেক রহমানের প্রতি সরকারের আচরণ ও মামলাগুলো পর্যালোচনা করলেই দেখা যায়, কত নিষ্ঠুরভাবেই বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একজন নেতাকে মিথ্যা কালিমা লেপন করে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে চেয়েছিল। গ্রেফতারের পরদিন ৮ মার্চ কাফরুল থানার ওসি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এক জিডিতে উল্লেখ করেন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নিজে ও দলীয় নেতাকর্মী, বন্ধুবান্ধব ব্যবসায়িক পার্টনারদের দিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিদেশি টেন্ডার ক্রয়, বিমান মন্ত্রণালয়ের কমিশন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যে বিপুল অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। তাঁর নিজ ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমার প্রাথমিক প্রমাণাদি আছে। জরুরি অবস্থাকালীন সরকারের সকল সংস্থার সহায়তায় তদন্ত শেষে দুদক ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন দেয়। এতে ব্যাংক স্থিতি হিসেবে ঢাকা ব্যাংকের একাউন্টে ২৮ হাজার ১৬২ টাকা ও এবি ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৬ হাজার ২৯০ টাকার সন্ধান পায়। স্থাবর সম্পত্তি হিসাবে ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকার থেকে পাওয়া ঢাকা ও বগুড়ায় কিছু জমি পায়। এর বাইরে আজ পর্যন্ত কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। অবশ্য ২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল কাফরুল থানায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা জিডির বিষয়ে ওসির ক্ষমা প্রার্থনা ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদনের প্রেক্ষিতে তারেক রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে জিডিটি নথিভুক্ত করা হয়। অব্যাহতি দেয়া হয় দৈনিক দিনকাল সংক্রান্ত মামলা থেকেও। গ্রেফতারের ১৬ ঘণ্টা পর গুলশান থানায় এক কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে ব্যবসায়ী আমিন উদ্দিন চৌধুরী মামলা দায়ের করে। এই মামলায় ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পর তারেক রহমানকে পুলিশের হেফাজতে না দিয়ে অজ্ঞাত স্থানে অজ্ঞাত লোকদের হেফাজতে নিয়ে চোখ বেঁধে বর্বরোচিত কায়দায় শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় বলে পরে তিনি আদালতকে অবহিত করেন। জরুরি অবস্থাকালীনই মামলার বাদী আমিন উদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে এবং স্ট্যাম্পে হলফনামায় দাবি করেন এক বিভীষিকাময় মুহূর্তে যৌথবাহিনী তাকে আটকিয়ে রেখে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়। তারেক রহমান তার নিকট কোনো সময়ে চাঁদা দাবি করেননি বা তিনি কোথাও এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ করেননি। ষড়যন্ত্রকারীদের হিংসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে তারেক রহমানের ওপর যে ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়েছিল তা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বিরল। তারেক রহমানের উপর এক লে: কর্নেল নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল বলে অবশেষে স্বীকার করেছে ষড়যন্ত্রকারীদের মূলকুশীলব জেনারেল মঈন। গ্রেফতারের পর পুলিশ রিমান্ড ও কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্মম নির্যাতনের মধ্যে একটানা ৫৫৪ দিন বা ১৮ মাস কারাবাসের পর ১২টি মামলায় জামিন পেয়ে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি পিজি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি পান। মুক্তির পরও হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। আদালতের নির্দেশে সেখান থেকেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি যান লন্ডনে। তিনি এখনো সেই লন্ডনেই রয়েছেন।
তারেক রহমানকে বলা হয় ক্যারিশমেটি লিডার। তিনি শত জুলুম-নির্যাতনের পরও হাল ছাড়েননি। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের নেপথ্য রূপকার তারেক রহমান দেশের প্রতিটি গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বীজ বুনে দিয়েছিলেন তা আজকে মহীরূহ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারেক রহমানের একটি ডাকে এখন মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র সবখানেই আজ বিএনপি নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি। সভা-সমাবেশ মুক্তিকামী জনতার ঢেউ।
তাইতো অতীতের মতো আজও ভোট ডাকাত, ব্যাংক লুটেরাদের আতঙ্কের নাম দেশনায়ক তারেক রহমান। যার হাতে আগামী সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ, যারা কাঁধে দেশের ১৮ কোটি মানুষের সুষম উন্নয়ন, আর্থিক নিরাপত্তা ও সুখ-সমৃদ্ধির ভার। দেশের মানুষ আজ তার ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়। দেশের মানুষ আরেকটা বিপ্লবের অপেক্ষায়। আরেক মুক্তির অপেক্ষায়। আরেক নেতার আবির্ভাবের প্রতীক্ষায়। সেই নেতাটি আর কেউ নন, তিনিই জিয়া দৌহিত্র তারুণ্যের প্রতীক তারেক রহমান। যার হাতে নিরাপদ থাকবে দেশ, মাটি ও মানুষ।
লেখক — সহপ্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল এবং মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাব।