অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
আরাফাত রহমান কোকো। পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন ১৯৬৯ সালে। বাবার কর্মস্থল কুমিল্লায়। জন্মের পরপরই আসে একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধে চলে যান বাবা। চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। তারপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। একটি স্বাধীন দেশ, একটি লাল-সবুজের পতাকা। যুদ্ধকালে মা ও বড়ভাই তারেক রহমানের সাথে পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা তার শৈশবের আখ্যান। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশার দিনগুলো তার জীবনের অন্যতম বড় ট্রাজেডি হলেও সেগুলো বিস্মৃতি হয়ে যায়। তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি বন্দিত্ব কিংবা মুক্তির আনন্দ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দেশ ও দেশের মানুষ তার একান্তই আপন। একটি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন আর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তাইতো নিভৃতচারী কোকো বেছে নিয়েছিলেন ক্রিড়া জগতকে। একজন রাজপুত্র, যিনি কিনা চাইলেই ক্ষমতার ভেতর থেকে আরাম-আয়েশে জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাষ্ট্র সংস্কারের পথ। দেশের ক্রিড়াঙ্গণকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন একজন সুদক্ষ ক্রীড়াশিল্পীর মতো।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর জীবনটা ছিলো বৈচিত্রময়। তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে যখন মুক্তি পান তখন তার বয়স মাত্র দুই বছর চার মাস চার দিন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের সময় তার বাবা জিয়াউর রহমান বন্দি হন এবং আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখনো তিনি মাত্র ছয় বছরের শিশু! এমনকী ১৯৮১ সালে বাবা জিয়াউর রহমান যখন শহীদ হন তখন আরাফাত রহমান কোকো মাত্র ১১ বছরের কিশোর! এই অল্প সময়ের মধ্যে কোকোর জীবনে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই বিয়োগান্তক। যার তার মনোজগতে বিরুপ প্রভাব ফেলে। যদিও তিনি এসবের কিছুই সেভাবে কখনোই প্রকাশ করেনি।
অবুঝ শৈশবেই ১৯৭১-এ পাক-হানাদার বন্দিশালায় আটক হওয়ার পর দ্বিতীয় বার ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্দি হন। ২০০৮ সালের ১৭ই জুলাই মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। ২০১৫ সালের ২৪শে জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই তার জীবনাবসান ঘটে।
আরাফাত রহমান কোকো ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাধারণ ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক অবদান রাখলেও তিনি ছিলেন সর্বদা প্রচার বিমুখ। কোকো ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে থাকাকালীন ক্রিকেট রাজনীতিমুক্তকরণ যেমন করেছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে কাজ করে স্থাপন করেন অনন্য নজির।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অধিকাংশই সরাসরি ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু কোকো ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে দ্বিতীয় বিভাগে খেলাটা পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মতো বিনয়! এ ধরনের বিনয় তার পুরো ক্রীড়া সংগঠক জীবনে লক্ষ্য করা যায়।
যেমন ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাকে ইচ্ছা তাকেই বোর্ড সভাপতি করতে পারতো। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত ব্যবহার করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন তিনি। কিন্তু কোকো তা না হয়ে বোর্ডের অধীনে ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমুলে বদলে ফেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে। তিনি কখনো তার অধিকারের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হাই পারফরমেন্স ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরির পাইপলাইনের সূচনা হয় তার হাত দিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল সাকিব, তামিম, মুশফিক, শুভ, এনামুল জুনিয়র প্রমুখ ক্রিকেটার হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। খেলোয়াড় তৈরির ধারাবাহিক পাইপ লাইন তৈরি হয়েছিল এই ডেভেলপমেন্ট কমিটির মাধ্যমে। যার মূল কারিগর ছিলেন কোকো।
আবহাওয়াজনিত কারনে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ক্রিকেট খেলা হতো না। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা এইসময় অলস বসে থাকতেন। এই সমস্যা দূর করতে ২০০৪ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ নেন কোকো। এটিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর করতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরির মাধ্যমে মিরপুর স্টেডিয়ামকে আধুনিকায়ন করেন কোকো। মিরপুর স্টেডিয়ামকে হোম অব ক্রিকেট দেখিয়েই ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বাগতিক দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ।
শুধু তাই নয়, দেশের ক্রিকেটকে বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখেন কোকো। তিনি ক্রিকেটকে মিরপুর ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত না করে সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এছাড়া ক্ষমতা থাকার পরও বগুড়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে না করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চান্দু নামে নামকরণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেন।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আনার ট্রেন্ড চালু করেন কোকো। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেত। ক্রিকেট বোর্ডকে করেছিলেন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকেরাই ছিলেন তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডে।
২০০৪ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোকোর ক্যারিশম্যাতেই। সে সময় তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ এত বড় আয়োজনের উৎসবে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য সারাদেশে হরতাল ডেকেছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও একদিনে পনেরটি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সফল এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কোকো। তিনি ছিলেন, নির্লোভ, নির্মোহ, অরাজনৈতিক ক্রীড়া সংগঠক।
এক এগারোর পরবর্তী সরকারের আমলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির রোষানলে পড়ে জিয়া পরিবার। তিনি ও তার ভাই তারেক রহমানের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে হয় তাকে। সেখানে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাগুলো মাথায় নিয়ে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবরে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৭ জানুয়ারি সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রায়-কারফিউ অবস্থার মধ্যে বায়তুল মোকাররমে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ি সেদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ, গোলাপ শাহ’র মাজার থেকে জিপিও মোড় পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় মানুষ। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেন। একজন প্রচার বিমুখ, সাদাসিধে কোকোর শেষ বিদায়ে লাখ লাখ মানুষ সেদিন ডুকরে কেঁদেছিলো। পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো কোকোর জানাজাও বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিলো বিস্ময়কর। একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সকল ভয় আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেদিন সাধারণ মানুষ চোখের জলে বিদায় জানায় এই অমর ক্রীড়াশিল্পীকে।
লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন, যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল আগের বছরের ২২ জানুয়ারি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেওয়ার দুদিন আগে আওয়ামী লীগ লগি-বইঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে। দেশের স্বার্থ বাদ দিয়ে দলীয় ক্ষমতার স্বার্থে এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই যে ‘চক্রান্ত’ তা কীভাবে স্পষ্ট হলো?
আওয়ামী লীগের তথাকথিত সেই ‘আন্দোলনের উসিলা’য় সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ‘জাতিসংঘের এক চিঠির’ কথা বলে নির্বাচন বাতিলের সুযোগ তৈরি করেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি। এই জরুরি আইনে সরকার সমাজে পরিচয় পায় ‘এক-এগারো’র সরকার নামে।
সেই কথিত ১/১১ সরকার তখন কী করেছে; কতটা দেশের কল্যাণে; আর নিজেদের প্রয়োজনে; এখনও জনগণের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আছে। এই ‘এক-এগারো’ সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সমঝোতা করেন। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করেন তিনি।
এরপর থেকে ২০২৪ সাল ৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম, নিপীড়ন, গণহত্যা, গুম, হামলা-মামলা, ফরমায়েশি রায়ে সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেন শেখ হাসিনা। আর মাঝে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ৪০ বছরের বাসভবন থেকে এক কাপড়ে জোরপূর্বক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বের করে আনা হয়। ব্যবহার করা হয় আদালতকে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে প্রায় কয়েক যুগের ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়া হলো; যার থেকে উত্তরণের জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন গণমানুষের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার।
আওয়ামী লীগের আমলনামা: গুম-খুন, ক্রসফায়ারের রাজত্ব
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় ফরমায়েশি রায়ে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। কোন কারাগার? পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের সেই পুরাতন, জংধরা, শ্যাওলাজমা বিচ্ছিন্ন এক পরিত্যক্ত কারাগার, যেখানে কয়েদি কেবল দেশনেত্রী একা। সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বেগম জিয়াকে জেলবন্দি করে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা মঞ্চায়ন করেন ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতারণাময় রাজনৈতিক চক্রান্ত।
এই প্রতারণায় উল্লেখযোগ্য ২০১৮ সালের ১ ও ৭ নভেম্বর গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের অনুষ্ঠিত সংলাপে সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা দেন শেখ হাসিনা। আর সংলাপের এক মাস না যেতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে (৩০ ডিসেম্বর) পুরো জাতি দেখলো রাতের অন্ধকারে কীভাবে মানুষের ভোটের অধিকার ডাকাতি করে নেওয়া হলো। শেখ হাসিনার এই চক্রান্তের রাজনীতি থেমে থাকলো না; পাশাপাশি চলছিল বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর অত্যাচারের নানামাত্রিক শোষণ।
রাজধানীসহ দেশের মানুষ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর সাক্ষী হয়ে গেলেন- কী নিখুঁত ও নির্মম পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে, মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে বিএনপির একটি জাতীয় মহাসমাবেশকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে বিনষ্ট করা হয়েছে। শত শত আহত, কয়েকজন শহীদ, রাতারাতি থানায়-থানায় মামলা। রাতের মধ্যে মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার। দুই দিনের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার।
ফ্যাসিজম নির্মাণের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা; ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ বানচাল করার পর টার্গেট করলেন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের; ২৪-এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে নিরঙ্কুশ করতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সকল শক্তিশালী বিএনপি নেতাকে জেলে পুরে দেওয়া হলো।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের অধিক সময়ে, ৫৮ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করে ১ লাখ ৫২ হাজার মামলা দেওয়া হয়। প্রায় ২ হাজার নেতাকর্মীকে ফরমায়েশি রায়ে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার এই হিসাব বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্য থেকে নেওয়া।
দেশের এমন কোনও জেলা নেই যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন সিরাজ শিকদার। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির ওই ঘটনার বর্ণনা তখনকার একজন পুলিশ সদস্য দিয়েছিলেন।
এরপর পরবর্তী সময়ে ‘একই গল্প’ বলে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০০৪ সালে দেশে ক্রসফায়ারের বিষয়টিকে অসৎ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে আলোচনায় আনে ‘একটি গোষ্ঠী’।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল আলোচিত অপরাধী বা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধ, প্রভাবশালীদের নির্দেশনা এবং প্রতিপক্ষকে দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
‘ক্রসফায়ারের’ মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার প্রবণতা শুরু হয় মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে। এসব ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলেও গণমাধ্যমে এসেছে।
যার একটা বড় নজির ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা। র্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদসহ ১১ জন র্যাব সদস্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেনের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে এসব খুনে জড়ান।
ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যমে পর্যালোচনা এসেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যারা ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন, তাদের ২৩ ধরনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত।
নিহতদের নামের পাশে পরিচয় হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নাম এসেছে। তবে বেশির ভাগ নামের পাশে রয়েছে ‘সন্ত্রাসী’, ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘বন্দুকধারী’ বা ‘অস্ত্রধারী’, ‘মাদক কারবারি’, ‘জলদস্যু’, ‘বনদস্যু’, ‘ডাকাত’, ‘ছিনতাইকারী’, ‘মামলার আসামি’, ‘চরমপন্থি’ ইত্যাদি। অনেক রাজনৈতিক কর্মীকেও এসব পরিচয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা হয় বলে অভিযোগ পারিবারিক ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে।
ক্রসফায়ারের একটি ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করেছিল ২০১৮ সালে। ওই বছরের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক। তিনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করা তালিকায় তার পরিচয় লেখা হয় ‘মাদক ব্যবসায়ী'।
হত্যা করতে নেওয়ার সময় একরাম তার মেয়েকে ফোন করেছিলেন। সেই কল কাটার আগেই একরামকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করা হয় পুরো সময়টায় ফোন কল চালু ছিল। পরে সেই কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে একরাম ও তার মেয়ের শেষ কথা, কান্না, গাড়ি থেকে নামানোর শব্দ, তারপর গুলির শব্দ মানুষকে নাড়া দিয়েছিল।
২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে যা আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিভাগে, এখানে নিহত হন ২৯১ জন।
খুলনা, সেখানে নিহত হয় ২৬০ জন। রাজশাহী বিভাগে ১১৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৮ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৭ জনকে বিচার ছাড়াই গুলি করে হত্যা করা হয়। এই সময়ে ৬৪ জেলার প্রতিটিতেই কোনও না কোনও সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ারের ঘটনা কক্সবাজারে।
রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা আলোচিত কাউকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার আগে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন নেওয়া হতো। নির্বাচনের আগে-পরে ক্রসফায়ার বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অতীতের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সর্বোচ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারের ২৪১টি ঘটনায় ৩০৭ জন নিহত হন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে ক্রসফায়ার বেড়ে যায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ১২৮ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়। যা আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু, এর আগে নবম জাতীয় নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হন ১২৫ জন। মাঝের বছরগুলোতে ২০১০ সালে ৯৩ জন, ২০১১ সালে ৬২ জন, ২০১২ সালে ৫৮ জন ও ২০১৩ সালে ৪২ জন নিহত হন।
ক্রসফায়ার ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিপক্ষকে দমন ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। এ জন্য নির্বাচনের আগে-পরে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্যে বলেছেন- ‘গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ারসহ নানা উপায়ে বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যা করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একদলীয় বাকশাল শাসন ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা।’
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দিলে ক্রসফায়ার বন্ধ হয়। যদিও ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল জার্মান রেডিও ডয়চেভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চার মাস পর ১৮ এপ্রিল কুমিল্লায় ক্রসফায়ারে নিহত হন রাজু নামে একজন, যিনি সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম হত্যার আসামি ছিলেন।
নিপীড়নেও অটুট অভীষ্ট লক্ষ্য
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট সরকারের ক্রমাগত নিপীড়নের মধ্যেও জীবন আর জীবিকার সংগ্রাম করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। কেবল শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পাড়ি দিয়েছে নদী, খাল; পুলিশের তাড়ায় কেউ হয়েছে হত। তবু লক্ষ্য ছিল অবিচল। কারাগার ও নিত্যনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে গণতন্ত্রের জন্য অটুট অবস্থানে দেখিয়েছেন মা, মাটি ও মানুষের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
আর তাই ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পলায়নপর পতনের মধ্য দিয়ে তৈরি হলো বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন আর সম্ভাবনা।
যে স্বপ্ন আর সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই আট হাজার মাইল দূর থেকে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একনিষ্ঠ লক্ষ্য স্থির রেখে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং দিয়েছেন। রাজপথে সরাসরি সক্রিয় থেকেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৮৪ মামলার আসামি হয়ে চারশ’ দিনের বেশি সময় কারাগার ভোগ করেন। ৮ বারের বেশি গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের এসব ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট আস্থার মধ্য দিয়েই ‘১-দফা’ যুগপৎ আন্দোলনে রূপলাভ করে। যা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।
এবার ‘৩১-দফা’ রাষ্ট্র সংস্কার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। নাগরিকরা বিশ্বাস করেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন।
লেখক: শায়রুল কবির খান
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সদস্য- বিএনপি মিডিয়া সেল ও বিএনপি চেয়ারপারসন প্রেস উইং
প্রায় দেড় যুগ আগের ১/১১-এর পটপরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন একটি ক্ষত, যে ক্ষত সময়ের প্রবহমানতায় জন্ম দিয়েছিল এক স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার।
বিশ্বের ইতিহাসে এমন দেশপ্রেমহীন স্বৈরাচারের নজির আর একটিও বোধ করি আর নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি এবং পরিতাপের বিষয় হলো— যারা ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই ওয়ান ইলেভেনের জন্ম দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে তারা সবচেয়ে ঘৃণিত। যাদের মধ্যে রিটায়ার্ড জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ও রিটায়ার্ড লে. জে. মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা প্রায়শই ভুলে যান, বৃটিশদের শত ষড়যন্ত্রের পরেও নবাব সিরাজ-উদ দৌল্লাকে এখনো জাতির কাছে বীরতুল্য আর অপরদিকে মীর জাফর একটি ঘৃণ্য নাম।
বিগত ১/১১-এর কুশীলব কে বা কারা, এদের সহযোগী মিডিয়া পার্টনার এবং প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নতুন করে তেমন কিছু বলবার নেই। কেননা সচেতনজন মাত্রই এই বিষয়ে কমবেশি ওয়াকিবহাল। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো— অনুমান করা যায় বিএনপি’র কিছু নেতৃত্বও জড়িত ছিলো যেটি প্রমাণিত হয় ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং শমসের মবিন চৌধুরীর মতন সুবিধাভোগীদের লজ্জাহীন কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে।
এছাড়া আরো অনেকেই এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন বলে সুস্পষ্ট অনুমান করা যায়।
মোটাদাগে বললে, ২০০১ পরবর্তী জোট সরকারের সময়ে দেশের দু’টি প্রধান পত্রিকা ও পত্রিকা দু’টির আলোচিত সম্পাদকেরা যোগসাজশে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় মূলত তারেক রহমান বিরোধী অপপ্রচার শুরু হতে থাকে।
এই অপপ্রচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়— আওয়ামী সফ্ট পাওয়ার এবং প্রতিবেশী দেশের হাইকমিশন।
বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিএনপি’র চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কখনোই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর খড়গহস্ত হননি। শুধু তাই নয় কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে যেসকল কার্টুনচিত্র আঁকতেন! সেগুলোকেও ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতেন। কেননা তারেক রহমান পূর্বেও মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন— সমালোচনা হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
অদ্ভুত বিষয় হলো— আওয়ামী সফ্ট পাওয়ারের অংশ কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য কিন্তু ২০০৮ পরবর্তী সময়ে আর কার্টুন বা ব্যাঙ্গচিত্র খুব একটা আঁকতে পারেননি; চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর তার সন্তান সন্ততি তো দূরের বিষয়।
২০০১ সালে বিএনপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে খুব একটা স্বস্তির ভেতর ছিলো না। দিল্লির ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয় এদেশের প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। এই অস্বস্তিকে বাড়িয়ে তোলে বিএনপি’র কোনো কোনো সিনিয়র নেতার তারেক রহমান বিরোধী অবস্থান। এই বিরোধিতাকে অধিকতর স্পর্শকাতর করে তোলে কল্পিত হাওয়া ভবন ন্যারেটিভ।
মিডিয়ার সহায়তায় অনেকেই এই হাওয়া ভবন ন্যারেটিভকে সত্যি বলে ভাবতে শুরু করে আর বিপত্তির শুরু হয় সেখানেই।
অথচ ওয়ান ইলেভেনের পর দেশনেত্রী বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি গ্রহণযোগ্য দুর্নীতির মামলা দিতে পারেনি ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী অনির্বাচিত সরকার। কিন্তু তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গোয়েবলসীয় বচন তারা জারি রেখেছে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে পতনের পূর্ব মুহুর্ত অব্দি।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু বাস্তবতা হলো বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নামে দেশের বাইরে নামে বেনামে কোনো সম্পত্তি নেই। এমনকি টাকা পাচার কিংবা ব্যাংক লুটের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতাও কেউ প্রমাণ তো দূরের কথা খুঁজে বের করতেও পারেননি।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য প্রমাণহীন বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত কথিত দুর্নীতি মামলার রায়ে সাজা না দেয়ায় বিচারক মোতাহার হোসেনকে হতে হয় দেশান্তরী।
প্রকৃত জাতীয়তাবাদীদের কাছে দেশ হলো মা ও মাটি। দেশ হলো জন্ম ও জন্মান্তরে তাদের শেষ গন্তব্য। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জন্য পূর্বোক্ত কথাটি এক অমোঘ সত্য বলে বিবেচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান টেমস নদীর তীরে নির্বাসনে থেকেও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ন্যায় বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তাঁর দেড় দশকের নিরলস সংগ্রাম গত ৫ আগস্টের সফল বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ইতোমধ্যেই আলোর মুখ দেখেছে।
শুধু তাই নয় তারেক রহমানের বক্তব্য দিকদর্শী এবং সুস্পস্ট বক্তব্য দিনকে দিন যে বিষয়টিকে আলোয় এনেছে। সেটি হলো— তাঁর বিরুদ্ধে যে প্রোপাগাণ্ডা ছিল, সেটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা এবং ওয়ান ইলেভেন ছিল— বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডার বাই প্রোডাক্টই শুধু নয় বরং ওয়ান ইলেভেন ছিলো দেশের স্বার্বভৌমত্ব হরণের সূচনা।
অতি সম্প্রতি তারেক রহমান ৩১ দফার ওপর যে আলোকপাত করেছেন, সেটি ইতোমধ্যেই সুধীজনের সুদৃষ্টি কেড়েছে।
যারা একসময় তাঁর বৈরী সমালোচনা করেছেন, তাদের অনেকেই আজ বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে শুভাকাঙ্ক্ষী সুলভ প্রশংসা করছেন।
এই বিষয়টি তারেক রহমান, বিএনপি ও বাংলাদেশ সকলের জন্যই ইতিবাচক ও ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগানিয়া বলেই বিবেচনা করি আমরা।
পরিশেষে বলা যায়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত দেড়যুগে বাংলাদেশের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক তারেক রহমানের মতো সৎ ও যোগ্য দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব।▫️
▪️ লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অবঃ); সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
১৯৭০ সাল সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন হবে কিন্তু হলো না। যা হয়েছিল তা কল্পনার অতীত ভোটের অধিকারকে দমন করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তার স্বাধীন দেশের পূর্ব পাকিস্তানে নাগরিকদের ওপর রাতের অন্ধকারে নির্মম গণহত্যা শুরু করে।
১৯৭১ সাল ২৫ মার্চ সেদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারে তারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।
ঢাকার ইপিআর সদরদপ্তর পিলখানায় থাকা ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার কয়েকটি স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা সদর দপ্তর। রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নীলক্ষেত ও দৈনিক ইত্তেফাকসহ প্রায় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আক্রমণ করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ট্যাংক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়।
সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময় যা পরিনত হয় গণহত্যায়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজির জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থে তার বিশদভাবে বিবরণ পাওয়া যায়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান।
মধ্য রাতে সেনা অভিযানের শুরুর আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান-এর বাসায় তখনকার গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ তাজউদ্দীন আহমদ ডক্টর কামাল হোসেনসহ কয়েকজন গিয়েছেন স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত কোনো লিখিত বক্তব্য কিংবা অডিও বক্তব্য তৈরি করে নিতে কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি তিনি তা দেননি।
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ মধ্য রাত পর্যন্ত সারাদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন চুড়ান্ত দিকে ধাবিত হতে থাকে। বিশেষ করে ১ মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রীকেট খেলা বন্ধ হয়ে যায়। শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
৩ মার্চ রঙিন “স্বাধীনতা পতাকা” উত্তলন করেন পল্টন ময়দান থেকে ছাত্র নেতা আ স ম রব। ৪ মার্চ স্বাধীনতা ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্র নেতা শাহজাহান সিরাজ।
৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে দেবেন।
চারদিকে প্রচার হতে থাকলো তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। লাখ জনতা তার ভাষণ শুনতে চুটে আসেন সমাবেশ স্থলে। জনতা নেতার ভাষণ থেকে ৪ টি শর্তের কথা স্পষ্ট ভাবে শুনেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পাননি উৎসুক জনতা। এমন কি ঐ ভাষণ পরদিন পাকিস্তান বেতারে সম্পূর্ণ প্রচার করা হয়।
১৪ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টাে ঢাকায় আসেন। ১৫ মার্চ পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের ইয়াহিয়া খান আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টােসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বৈঠক শুরু। ২৪ মার্চ পর্য়ন্ত ধারাবাহিক বৈঠক চলে।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই বৈঠকের আড়ালে তারা তাদের লক্ষ্য স্থির রেখে অপারেশন সার্চ লাইট চুড়ান্ত করে।
২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকবাহিনীর গণহত্যা। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সকল আওয়ামী লীগ নেতারা পলায়ন পর। সাধারণ মানুষ দিকবিদিকশুন্য দিশেহারা। শহরে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে।
এরকম পরিস্থিতিতে নিজ কর্তব্য বোধ থেকে শির উঁচু করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে জাতি আকাঙ্খা পূর্ণে জীবন ও পরিবারবে উৎস্বর্গ করে প্রথমে “উই রিভল্ট” এরপর চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান “স্বাধীনতা” ঘোষণা করেন। “আমি মেজর জিয়া বলছি বাংলাদেশ স্বাধীনতা” ঘোষণা করছি।
মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সামরিক কর্মকর্তা জানজুয়ারসহ তার নিয়ন্ত্রণে সকালকে গ্রেপ্তার করেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার “জেড ফোর্স” এবং ১ নম্বর ও ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।
রংপুর অঞ্চলে প্রথম ৫০০ বর্গ মাইল স্বাধীন ভূখন্ড ঘোষণা ও বেসরকারি প্রশাসনিক কাঠামো শুরু করেন করেন জিয়াউর রহমান।
দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
১৯৭১ সাল ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে বৃটেন ও ভারত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল।
১১ জানুয়ারি বাদ দিয়ে ১২ জানুয়ারি প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-কে বাদ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হোন।
এরপরে ইতিহাস অনেকই জানেন। দ্রুতই নাগরিকদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা ক্রমাগত দুঃস্বপ্নে পরিনত হতে থাকলো।
দূর্নীতি, লুটপাট, হত্যা হামলা মামলা গ্রেপ্তার, ভোট কারচুপি, চারদিকে সীমাহীন অরাজকতা চলতে।
১৯৭৪ দুর্ভিক্ষে ভয়াবহ অবস্থা। একদলীয় শাসন বাকশাল শুরু। মানুষ দিশেহারা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পটপরিবর্তন।
৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি পূর্বে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পটপরিবর্তন কিছুটা আলোকপাত দরকার। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থানে বিশাল পরিবর্তন আসে। বছরটি ছিল ১৯৭৫ সাল। এই বছরের আগস্টের ১৫ তারিখ এক সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
আগস্টের ১৫ তারিখে পটপরিবর্তনে বাংলাদেশের রেডিও থেকে মেজর ডালিম ঘোষণা করেছিলেন, খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন।
৭৫’-এর পটপরিবর্তনের ফলে দেশের রাজনীতির মোড় পরিবর্তন ঘটেছে।
এই উপ-ভারতবর্ষে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে বান ডাকে। যখন নদীর বান ডাকা স্তিমিত হয়ে আসে, তখন নদীর এক পাড় ভাঙে অন্য পাড়ে পলি জমা হয়ে নতুন ভূমি সৃষ্টি হয়।
এ কারণেই হয়তো ভাবুক কবি গান রচনা করেছিলেন, নদীর একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে/এই তো নদীর খেলা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের রাজনীতিও নদীর মতোই।
৭৫’-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পটপরিবর্তন ঘটে, তা কি নিছক নদী ভাঙনের সঙ্গে তুলনীয়? এ পরিবর্তনটি ঐতিহাসিক ভাবে উপমায় অনেকটাই ব্রহ্মপুত্র নদীর খাত পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনীয়।
১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে যমুনা নামে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ব্রহ্মপুত্র নদের পুরোনো খাতটি ময়মনসিংহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। ব্রহ্মপুত্রের খাত পরিবর্তনের ফলে ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের অংশটি মৃত্যুবরণ করে।
এতে পানির প্রবাহ শূন্যের কোঠায় চলে যায় এবং নদীটির নামকরণ করা হয় পুরোনো ব্রহ্মপুত্র। নিঃসন্দেহে ব্রহ্মপুত্র নদের খাত পরিবর্তন শক্তিশালী ভূমিকম্প না হলে হতো না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পের মতোই বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।
১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের ফলে ‘এক নেতা এক দেশ’ স্লোগানের মৃত্যু ঘটে।
প্রায় তিন মাসের মাথায় ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ সামরিক ক্যু’র ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুগতদের নিয়ে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটায়। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান-কে বন্দি করা হয়।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজে নিজেই মেজর জেনারেলে উন্নীত হন এবং সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এমজি তাওয়াব মেজর জেনারেলের র্যাংকব্যাজ পরিয়ে দেন।
প্রায় একই সময়ে বঙ্গভবনে বসে খালেদ মোশাররফ প্রয়াত সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খানের কাছ থেকে টেলিফোনে জানতে পারেন, তার মা ও ভাই আওয়ামী লীগের মিছিলে যোগ দিয়েছেন। এতে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বলতে থাকেন, আমার মা ও ভাই আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে। সেই সময় জনগণের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল দেশদ্রোহীর দল।
সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। তিনি দেশবাসীকে জানান, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এতেও খালেদ মোশাররফের শেষ রক্ষা হয়নি।
৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টে জওয়ানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা দলে দলে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে।
রাজপথে ট্যাংক ও কামানসজ্জিত হয়ে বিদ্রোহী সিপাহিরা বিপ্লবের স্লোগান দিতে থাকে।
তারা স্লোগান দিচ্ছিল, "সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ-জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ-বাংলাদেশ জিন্দাবাদ"। রাজপথে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে সিপাহি বিপ্লবের সমর্থনে সংহতি প্রকাশ করে। এ অভ্যুত্থানকে চিহ্নিত করা হলো! সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি" রূপে।
জিয়াউর রহমান-কে খালেদ মোশাররফ-এর বন্দিশালা থেকে সৈনিকরা মুক্ত করে আনল।
সূচিত হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়।
জিয়াউর রহমান বন্দি হয়েছেন জেনে সাধারণ মানুষ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।
অনেকে দারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। আসলে উৎকণ্ঠায় ভোগার ফলে সাধারণ মানুষ খাবার গিলতে পারছিল না। সর্বোপরি ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনো রকমের সরকার আছে কিনা, তা নিয়ে দারুণ উৎকণ্ঠায় পড়ে গেল সাধারণ মানুষ।
এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন। দেশকে তারা কত ভালোবাসেন।
সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে জাতির উদ্দেশে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। তিনি জনগণের প্রতি শান্ত থাকার আহবান জানালেন। সেনাবাহিনী আপনাদের পাশে আছে। আপনারা নিজ নিজ কাজে যোগদান করুন আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
জিয়াউর রহমান সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে সিপাহিদের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে নিরস্ত্র করতে সক্ষম হলেন। সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরে এলো। জিয়াউর রহমান যদি সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা উদ্ধারে সফল না হতেন, তাহলে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যেত।
৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। এই দিন বাংলাদেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র শপথ গ্রহণ করে। জিয়াউর রহমান-এর মতো একজন ব্যক্তির নেতৃত্বের ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
বিশ্ব দরবারে জাতি রাষ্ট্র হিসেবে "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়।
"১৯-দফা" কর্মসূচী'র মাধ্যমে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উৎপাদনের জোয়ার সৃষ্টি হয়।
জিয়াউর রহমান দেশের নারী-পুরুষ, কিশোর-যুবক, শিশু ও প্রৌঢ়সহ সব মানুষকে নিয়ে জাতি গঠনের মহান ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। তলাবিহীন ঝুড়ি রাষ্ট্রের বদনাম গুছিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক স্বনির্ভর বাংলাদেশ নির্মাণ করেন। তার নিখুঁত দেশপ্রেম ও জাতি গঠনে সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য জিয়াউর রহমান যুগ-যুগান্তরে মানুষের হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই নিয়ে আছেন ও থাকবেন।
জিয়াউর রহমান-এর দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রয়াস আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র গোষ্ঠী মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না, ফলে তাদের চক্রান্তের মধ্যে দিয়ে জিয়াউর রহমান ১৯৮১-এর ৩০ মে একদল বিপদগামী সামরিক অফিসারের হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তিনি শহীদ হোন।
থমকে দাঁড়ায় স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয়। এই গৌরবোজ্জ্বল বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক দল ও শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যার প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম।
তার রাজনৈতিক ও আর্দশিক উত্তরসূরী আমরা কোটি কোটি জনতা। রক্তের ও রাজনৈতিক এবং আর্দশিক উত্তরসূরী বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ২০২৪ আগস্ট পট-পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তার নেতৃত্বে "উন্নত ও কল্যাণ বাংলাদেশ" গড়ে উঠবে।
লেখক: শায়রুল কবির খান
সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, সদস্য বিএনপি চেয়ারপার্সন প্রেস উইং ও বিএনপি মিডিয়া।
দিনকাল/ ১৩ নভেম্বর ২০২৪