শেখ আবু তালেব, শীর্ষ নিউজ,
ঢাকা: জঙ্গি হামলার পর থেকে দীর্ঘ এক মাস পেরিয়ে গেলেও নিরাপত্তা শঙ্কায় ক্রেতার অভাবে
ভেঙ্গে পড়েছে গুলশান এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন আগের চেয়ে প্রায়
৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বিক্রি কমে গিয়েছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পণ্যর দাম কমানোর
পাশাপাশি কৌশলী ভূমিকা নিচ্ছেন অনেকেই।
পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন
পর্যন্ত দুপুরের ও রাতের বুফে খাবারের সঙ্গে গেট-ওয়ান, ফ্রি-ওয়ান নামে বিশেষ অফার শুরু
করে দিয়েছে। তারপরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
গত ১ জুলাই গুলশানের অভিজাত
রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২জন। এরমধ্যে
বিদেশি নাগরিক হলেন ২০ জন। উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও এক বাবুর্চি নিহত হন। এ হামলার
পর থেকেই ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে।
বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানের
পণ্যের পসরা বসে গুলশান এলাকায়। সবচেয়ে দামি ও বিলাসবহুল পণ্যের জন্য এ এলাকার বিপণি
বিতানগুলোতে যেতে হয় ক্রেতাদের। খাবারের মসলা থেকে শুরু করে নামি ব্রান্ডের পোশাক পেতে
এখানকার শপিং সেন্টারগুলোর উপরই ভরসা করতে হয় ক্রেতাদের। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লেনদেনকারী
ব্যবসায়ীরা এখন অলস সময় পার করছেন। একজন গ্রাহকের অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো চেয়ে
থাকছেন তারা। খাবারের দোকানগুলো গ্রাহক টানতে একটির সঙ্গে আরেকটি ফ্রি দিচ্ছে। গুলশান-১
ও ২ এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
গুলশান, বারিধারা ও বনানী
এলাকায় বিদেশি নাগরিকদের আবাস ও চলাফেরা। এ হামলার পর থেকে বিদেশি নাগরিকরা চলাচল একেবারেই
কমিয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তার নামে গুলশান-১ পর্যন্ত বাস চলাচল করেছে প্রশাসন। গুলশান-২
এ সকল প্রকার বাস ও গণপরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রিক্সা চলাচল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা
হয়ছে। চলাচলে বিশেষ রিক্সা এখনো নামানো হয়নি। গুলশান এলাকায় ঢুকতে চলছে নিরাপত্তা চেক।
অনেক সময় হয়রানির শিকার হচ্ছেন পথচারিরা। অহেতুক হয়রানি এড়াতে গুলশান এলাকায় যাতায়াত
কমিয়েছেন সবাই। গাড়িওয়ালারাও না পারলে এড়িয়ে চলছেন গুলশান। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
কমে গিয়েছে এ এলাকার ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অভিজাত
শ্রেণীর রেস্টুরেন্টগুলো খাবার ও আবাসিক হোটেলগুলো তাদের রুম ভাড়ার ওপর দিচ্ছে বিশেষ
ছাড়। ক্রেতার অভাবে খাদ্য তৈরি কমিয়ে দিয়েছে ফাস্টফুড, চাইনিজ, থাই, ইন্ডিয়ান খাবারনির্ভর
বিভিন্ন অভিজাত রেস্টুরেন্ট। অনেকেই এমাসের প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচতো দুরের কথা ভাড়া
পর্যন্ত উঠাতে পারেনি। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলোর
আয় কমে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভেঙ্গে পড়েছে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। বিক্রি না থাকায় তারা
মূলধন ভেঙ্গে সংসার চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
ক্ষতির তালিকায় প্রথম সাড়েতে
রয়েছে বিদেশি নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো। সূত্র জানিয়েছে, পাঁচতারকা হোটেল ওয়েস্টিন ভুগছে
গ্রাহক সংকটে। আপদকালীন সময়ে কোনমতে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহক শুন্যতায় ভুগছে হোটেলটির
ক্যাফে। অতিথি আকর্ষণে দুপুর ও রাতের বেলায় বুফে খাবারের সঙ্গে একটি নিলে একটি ফ্রি
দিতে গেট-ওয়ান, ফ্রি-ওয়ান বিশেষ অফার দিচ্ছ। আবাসিক রুমের ভাড়ার ওপর দিচ্ছে বিশেষ ছাড়।
প্রচারণা চালাচ্ছে কৌশলী ভূমিকায়। নিয়মিত গ্রাহকদের জন্য দিচ্ছে বিশেষ ছাড়। এছাড়ও গ্রাহক
টানতে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতেও সকল সেবার উপর বিশেষ ছাড় দিচ্ছে হোটেলটি।
গুলশান কেন্দ্রীয় জামে
মসজিদের বিপরীতে ইন্ডিয়ান খাবারের জন্য বিখ্যাত একটি রেস্টুরেন্ট। জানা গেছে, সারাদিন
অলস সময় পার করতে হয়। সন্ধ্যার দিকে একটু কাস্টমার হয়। তা ঘণ্টা খানেকের জন্য। আগে
গুলশান জমত রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। রাত যত গভির হতো কাস্টমারও তত বেশি হতো। রাত ১২টা
পর্যন্ত আমার রেস্টুরেন্ট খোলা রাখতাম। এখন রাত নয়টার মধ্যেই বন্ধ করতে হয়।
সকাল আট টা থেকে রাত তিনটা
পর্যন্ত প্রায় ১৮ ঘণ্টা ওষুধের দোকান খোলা রাখেন গুলশান-২ গোলচত্বর এলাকার এক ব্যবসায়ী।
দোকানটির মালিক জানান, তার কাছে দেশি-বিদেশি প্রায় সকল ওষুধই পাওয়া যায়। গ্রাহকদের
জন্য সকাল ৮টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখা হয়। গ্রাহক সামাল দিতে রয়েছে ১২
জন কর্মচারি। গুলশান হামলার পরে দোকানে বিক্রি কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশের মতো। বিদেশিরা
আসছেন না একেবারেই।
তিনি জানান, গুলশান চলেই
মূলত আশপাশের লোকজন দিয়ে। বনানী এলাকার লোকজনও গুলশান থেকেই কেনাকাটা করেন। তারা আসতে
পারছেন না, আবার নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক আছে। তাই কাস্টমাররা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন।
এ অবস্থা চলতে থাকলে দোকানের কর্মচারি কমাতে হবে।
সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রিত
গুলশান মার্কেটেও নেই ক্রেতা সামাগম। পার্কিং এলাকায় আগে যেখানে গাড়ি দাঁড় করানো মুশকিল
হতো। এখন সেখানে ফাঁকা জায়গা পড়ে রয়েছে।
এই মার্কেটেই এন্টিক (দুর্লভ)
জিনিসের বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী জানান, রাজা-বাদশাহদের আমলে ব্যবহৃত ও হারিয়ে
যাওয়া দুর্লভ বস্তুই আমরা বিক্রি করি। এর মধ্যে পিতলের জিনিসপত্রই বেশি। সৌখিন এসব
জিনিসপত্রের ক্রেতা মূলত বিদেশি ও ধনী শ্রেণির লোকজন। জঙ্গি হামলার পর থেকে বিদেশিরা
আসছেন না। দেশিয়রা আসছেন, দেখছেন চলে যাচ্ছেন। বিক্রিতে ধ্বস নেমেছে।
গুলশান মার্কেটের কাপড়ের
দোকান সৌখিন বস্ত্রালয়ের কর্মচারি জানান, ছোট্ট এই দোকনটিতে মেয়েদের থ্রী-পিছ, তোয়ালে,
গামছা, মোজাসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পাওয়া যায়। আগে দৈনিক পনেরো থেকে বিশ হাজার টাকার
বিক্রি হতো। এখন দুই হাজার টাকাও হয় না। গুলশান হামলার পর থেকে এবারের ঈদেও বিক্রি
কম হয়েছে। এমাসে দোকান ভাড়া ষোল হাজার টাকাও উঠানো যাবে না। একই অবস্থার কথা জানিয়েছেন
পাশের দোকানদারও।
এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি
সংকটে পড়েছে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘ দশ বছর ধরে এ এলাকায় ব্যবসা করছেন কামাল। বিভিন্ন
দরের বড় সাইজের তোয়ালে বিক্রি করেন তিনি। কামাল জানালেন, এখন চালান ভেঙ্গে সংসার চালাতে
হচ্ছে। আর কয়েকদিন এভাবে চললে গুলশান এলাকা ছাড়তে হবে। অন্য ব্যবসায় নামতে হবে।
আতঙ্কের কারণে গুলশান এলাকায়
চলাফেরা করছেন না সাধারণ মানুষ ও বিদেশি নাগরিকরা। এর প্রভাব পড়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে গুলশান এলাকায় কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অফিস থাকবে না।
অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুলশান ছাড়তে বলা হয়েছে। ফলে নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ীদের
মধ্যে। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়া এসব প্রতিষ্ঠান কোথায় নিয়ে যাবেন, সে চিন্তা দানা
বেঁধেছে তাদের মনে।
গুলশানবাসী ও ব্যবসায়ীরা
বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সড়ালেই যে সমস্যা সমাধান হবে তা নয়। আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক
করতে হবে। আতঙ্কিত মানুষদের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সকল উদ্যোগে স্বচ্ছতা দেখাতে হবে প্রশাসনকে।
পরিস্থিতি উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজকে ভূমিকা রাখতে হবে। নইলে দেশের মধ্যে
ও বিদেশে বাংলাদেশের মর্যাদা আরও ক্ষুন্ন হবে।
No comments:
Post a Comment