Search

Saturday, December 10, 2016

কামালপুরের যুদ্ধ এবং এক দুঃসাহসী মেজরের গল্প

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে মেজর জিয়া



By জাকারিয়া

জুলাই, ৩য় সপ্তাহ, ১৯৭১


ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার মইনুল হোসেনের প্রতি জিয়ার হুকুম এলো কামালপুর বিওপিতে হিট করতে হবে। কামালপুরের মত এত শক্তিশালী পাকিস্তানী ঘাঁটিতে আক্রমনে মইনের হাঁতে না আছে রসদ, না আছে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত সৈন্য, না পর্যাপ্ত গোলাবারুদ। মইন যখন হিট এন্ড রান কৌশল নিয়ে ভাবছিলেন তখন জিয়ার এই নির্দেশ তাঁর মাথায় বজ্রাঘাতের মতই মনে হল। অথচ  জিয়া তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং ঢাকা প্রবেশের সংযোগ মুখেই ছিল কামালপুর বিওপির অবস্থান। জিও স্ট্র্যাটেজিক্যালি এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটি অক্ষত থাকা মানেই মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকায় প্রবেশের স্বপ্ন চিরতরে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু জিয়া নামের স্বল্প পরিচিত এক মেজরের স্বপ্ন তিনি ঢাকায় প্রবেশ করবেন এবং তা করবেন এই ঘাঁটিটিকে গুড়িয়ে দিয়েই।


কামালপুর ঘাঁটিটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এতোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে যে, এখানে মোট চারবার নিয়মিত বাহিনী পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধ হয়েছে। ( ৩১ জুলাই, ২২ অক্টোবর, ১৪ নভেম্বর, ২৪-৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ )। হিট এন্ড রান হয়েছে মোট ২০ বার।

কামালপুর যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১৯৭ জন, আহত অসংখ্য, পাকিস্তানের মেজর আইয়ুব সহ মোট নিহত ২২০ জন। শুধুমাত্র এই এক যুদ্ধেই বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক মিলিয়ে ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসিকতায় পুরস্কার পেয়েছেন। পুরো মুক্তিযুদ্ধে এমন ইতিহাস দ্বিতীয়টি আর নেই।

যুদ্ধ

রাত ৩:০০ টা। জিয়া নিজে অবস্থান নিয়েছেন টিলার উপরে। আর সে অবস্থান থেকে কামানের গোলা বর্ষণের মাধ্যমেই যুদ্ধের সুচনা হয়। রাত সাড়ে তিনটায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ তাঁর দুই প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শত্রু ঘাঁটিতে ঢুকে পড়েন। সেখানে তিনি বিওপির একদম কাছে গিয়ে মেগাফোনে পাকিস্তানিদের উদ্দ্যেশ্যে বলতে থাকেন,


‘আভি তক ওয়াক্ত হ্যাঁয়। শালালোগ সারেন্ডার করো, ন্যাহি তো জিন্দা নেহি ছোড়েংগা’।

সালাউদ্দিন মমতাজের অসীম সাহসে আর তাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমনে পাকিস্তানিদের প্রথম ডিফেন্স কর্ডন শেলপ্রুফ বাঙ্কারে ঢুকে পরে। এ সময় সালাউদ্দিন মমতাজ আরও সাহসী হয়ে উঠেন এবং ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে বিওপির কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়েন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তিনি কমান্ড করছিলেন। তাঁর সহযোদ্ধারা তাকে নিরাপদ পজিশন নিতে বললেও লাভ হয়নি। হঠাৎ ই মেশিনগানের গুলি এসে ঢুকে তাঁর মাথায়, পাশে বিস্ফোরিত হয় মর্টারের শেল। লুটিয়ে পড়েন এই বীরযোদ্ধা...

স্বাধীনতার সোনালী রোদের স্পর্শ তাঁর আর পাওয়া হল না।

এক পর্যায়ে সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রের পরিবর্তে হাতাহাতি আর বেয়নেট দিয়ে যুদ্ধ হয় বাংকারের ভেতরে বাইরে।

সালাউদ্দিন মমতাজের নিহত হবার খবর জানতে পেরে মেজর মইন ওয়ারল্যাসে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে কমান্ড করেন পেছন থেকে আক্রমনের জন্য। কিন্তু ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাড়া না পেয়ে তিনি ঝোপঝাড় আর গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে  খোলা জায়গায় চলে আসেন যেন ওয়ারল্যাস ভালোভাবে কাজ করতে পারে। দুর্ভাগ্য এবারেও পিছু ছাড়েনি তাঁদের।এক ঝাঁক মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান ওয়ারল্যাস অপারেটর। এ সময় তাঁর ওয়ারল্যাস সেটটিও অকেজো হয়ে যায়।  মেজর মইন হতভম্ব হয়ে এ সময় চিৎকার করে অনেকটা নিষ্ফল নির্দেশ দিয়ে যেতে  থাকেন। খুব দ্রুত ভোরের আলো ফুটে উঠে। তাঁরা দেখতে পান চারিদিকে হতাহতের ছড়াছড়ি। ক্যাপ্টেন হাফিজ আহত হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। লেঃ মান্নানও আহত হয়েছেন। জিয়া উদ্ধারকাজে যোগ দেন। গোলাগুলি চলা অবস্থাতেই জিয়া, মইন, লিয়াকতরা মিলে হাফিজ, মান্নান সহ অন্য আহত যোদ্ধাদের উদ্ধার করে পিছু হটেন।

অন্যদিকে দুইটি ১২০ মি মি মর্টার আর বেশ কিছু সেনা সহ বকশিগঞ্জ থেকে কামালপুরের দিকে আসতে থাকা তিনটি লড়ি উড়ে যায় কাট অফ পার্টির পুতে রাখা মাইনে। তাঁদের এ্যামবুশে দশ জন পাক সেনা নিহত এবং ১০-১১ জন আহত হয়। এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, ২/৩ জন আহত হন। এ যুদ্ধে মোট ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন আর আহত হন সাতান্ন জন যা মোটামুটি প্রথম বেঙ্গলের এক দশমাংশ। কামালপুরের এই যুদ্ধ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের জন্য ছিল এক দুঃসহ  নাইটমেয়ার। তাঁরা ধারণাই করতে পারেনি যে, নাতিদীর্ঘ প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদেরকে নিয়ে জেড ফোর্স এত শক্ত কামড় দিতে পারে।


ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতার দলিল পত্রের ১০ম খন্ডে জানিয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়েছিল সে যুদ্ধে।


শাফায়াত এবং মইন দুজনেই বলেছেন, টানা তিনদিন পাকিস্তানী আর্মির হেলিকপ্টার ঢাকা থেকে কামালপুর আসা যাওয়া করেছে কেবল পাকিস্তানী আর্মিদের লাশ আর আহতদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য।

যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ হেলিকপ্টারে করে জেড ফোর্স হেড কোয়ার্টারে আসেন আর উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘জেড ফোর্স শুড আপ রিয়াল টাইগার ক্যারেকটার।’ এমনকি এটাও বলেন, তাঁর ধারণাতেও ছিল না যে, জেড ফোর্স এমন অপারেশনের সাহস রাখে। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী জেড ফোর্স কে যেসব ওয়ারল্যাস দিয়েছিলেন সেগুলো নিম্ন মানের এবং ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে মেজর মইন জেনারেল মানেকশ কে অভিযোগ করেছিলেন। মেজর মইনের মতে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সময়মত ওয়ারল্যাসে কমান্ড করতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হত এবং শত্রুপক্ষের ক্যাজুয়ালটি আরও বেশি হত। অতি দরকারের সময় ওয়ারলেসের কাজ না করা ছিল মড়ার উপর খাড়ার ঘা। যুদ্ধের সেই সময়টাতে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং আগের কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় পাট ক্ষেতে এক ফুট পানি জমে গিয়েছিল। এ ধরনের যুদ্ধে ক্রলিং এবং কুইক মুভের যে প্রয়োজন হয় তাঁর বিপরীতে এই ব্যাপারটাকে ‘ক্রুশিয়াল লুজিং ফ্যাক্টর’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন মেজর মইন।

কামালপুর যুদ্ধে ঘোর অন্ধকার আর মুষলধারে বৃষ্টির কারনে যুদ্ধ প্রায় ৩০ মিনিট দেরিতে শুরু হয়। কিন্তু এদিকে জেড ফোর্সের প্রি এইচ আওয়ার বোমা গুলোও বিস্ফোরিত হতে থাকে। ফলে নিজেদের বোমাতেও ১ম বেঙ্গল ধরাশায়ী হয়েছিল সে রাতে।
কামালপুর যুদ্ধের আহত-শ্রান্ত যোদ্ধাদের নিয়ে ফিরে আসলেন জিয়া এবং মইন। সেদিন ৩১শে জুলাইতেই জিয়া মেজর শাফায়াত জামিলকে ৩য় বেঙ্গল সহ পাঠান জেড ফোরসের ২য় অপারেশনে।

২য় অপারেশনের এই যুদ্ধটিকেই পরবর্তীতে বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাটের যুদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়।


৩১শে জুলাই, ১৯৭১


দুপুরবেলায় যাত্রা শুরু করেন ৩য় বেঙ্গলের সৈন্যরা। পরপর তিনটি ছোট বড় নদী আর কাঁদা পানিতে হেঁটে প্রায় পচিশ মাইল পেরিয়ে সবুজপুর পৌঁছান। সেখান থেকে ১২ টি নৌকায় অপারেশন জোনে পৌঁছান। ব্রক্ষ্মপুত্র আর যমুনার সাথে তিস্তা যেখানে এসে মিশেছে সেখান থেকে চিলমারি বন্দর, কুড়িগ্রাম, উত্তরবঙ্গ আর বক্ষ্মপুত্রের দুই পাড়ে মুক্তিযোদ্ধা ঘাটিগুলোকে নিয়ন্ত্রন করা যায়।

১লা আগস্ট ভোর রাত ৫ টায় লেঃ নুরুন্নবির ডেল্টা কোম্পানি প্রথম হিট করে। ডেল্টা কোম্পানিকে ব্যাকআপ দেয় লেঃ আনোয়ারের আলফা কোম্পানি। ৩০ মিনিটের সেই যুদ্ধে ৩ টি বার্জ, ২ টি শান্টিং ইঞ্জিন ধ্বংস করা হল আর দুইটি বগিতে হেভি মেশিনগানের ব্রাশফায়ার করে বেশ কিছু পাক সেনা আহত কিংবা নিহত করা হল। এর ফলে বাহাদুরাবাদ ঘাট ব্যাপক ভাবে ধ্বংস হয় আর উত্তরবঙ্গের সাথে বাহাদুরাবাদ রেল রুট ক্লোজ হয়ে যায়।

এরই মাঝে জেড ফোর্স’র ৩য় অপারেশনে জিয়া আবার নিজে সম্মুখ সমরে হাজির হন ৩রা আগস্ট ভোর তিনটা ৪৫ এ। অপারেশনটির দায়িত্ব ছিল অষ্টম বেঙ্গলের উপর। শেরপুরের ঝিনাইগতি থানার এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রান এন্ড ক্রল করে বিওপির ৫০ গজের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতায় সেনারা বিওপি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী ক্ষেতে পালিয়ে গিয়েছিল। আক্রমনে ছিল ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদের ব্র্যাভো কোম্পানি আর লেঃ মোদাসসের’র ডেল্টা কোম্পানি। আর বিওপির পাশে শালবনে ফরোয়ার্ড এরিয়া এসেম্বলি থেকে জিয়া ওয়ারল্যাস  যোগাযোগের মাধ্যমে যুদ্ধ কো-অরডিনেট করছিলেন। মোট ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা সে যুদ্ধে শহীদ হন।

বাহাদুরাবাদ ঘাট আর দেওয়ানগঞ্জে যুদ্ধবিজয়ী ৩য় বেঙ্গল'র যোদ্ধারা তেলঢালায় ফেরার পথে শাহ কামালের মাজারের পাশে একটি জিপ গাড়ির পাশে মেজর জিয়াকে দুঃশ্চিন্তিত অবস্থায় দেখতে পান। ফিরতে দেরি দেখে মেজর জিয়া ধারণা করেন ৩য় বেঙ্গল বাহাদুরাবাদ অপারেশনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। কিন্তু যখন দেওয়ানগঞ্জ অপারেশনের কথা জিয়াকে জানিয়ে বলা হল - এখন থেকে দেশের ভেতরেই যুদ্ধ চালানো অসম্ভব কিছু না তখন জিয়া স্মিত হেসে বললেন,


‘তাহলে তো একবার সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই হয়’। 


- মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে আহরিত তথ্য এই লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে।  

No comments:

Post a Comment