Search

Saturday, February 4, 2017

সুখী মানুষের খোঁজে...



জাকারিয়া চৌধুরী

 

নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের পরিবর্তে ‘রকিব উদ্দিন মার্কা নির্বাচন কমিশন’ হলে দেশ চরম অস্থিতিশীল হবে বলে মনে করছে বিএনপি। সেজন্য নতুন ইসি গঠনে নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যনমশ সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সব দল বা জোটের সাথে আলোচনা করে সকল দল বা জোটের মহাসচিব পর্যায়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ইসি গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন বেগম খালেদা জিয়া, গত ১৮ই নভেম্বর হোটেল ওয়েস্টিনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ২০-দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং আমন্ত্রিত দেশী-বিদেশী অতিথিরা। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনা শেষ হওয়ার এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যেই সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তা নাকচ করে গণমাধ্যমে কথা বলেন। এ নিয়ে নানা নাটকীয়তা, পক্ষে বিপক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতির পরে রাষ্ট্রপতি আলোচনার উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে বিএনপি, আওয়ামীলীগ সহ সর্বমোট ৩১টি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ম্যারাথন আলোচনা চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে প্রধান করে ছয় সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠনের ঘোষণা আসে বঙ্গভবন থেকে। কমিটিতে যাঁদের রাখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া বাকি পাঁচজনের নাম-ধাম, দলীয় পরিচয়, অভিজ্ঞতা এবং বলয়ের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৭শে জানুয়ারি দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন।

বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ঘোষিত সার্চ কমিটি কোনও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না।’ তিনি বলেন, এর আগে গত ১৮ই নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ ইসি গঠনে যে প্রস্তাব রেখেছিলেন, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সেটাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। দলীয় অনুগত লোকের সমন্বয়ে গঠিত সার্চ কমিটি একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে কিভাবে আমরা তা প্রত্যাশা করবো? সাধারণ জনগণই করে না। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের একজন মাননীয় বিচারপতিকে প্রধান করে ছয় সদস্যের যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে, আগেরবারের অনুসন্ধান কমিটিরও প্রধান ছিলেন ওই একই লোক। যাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই রকিব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে অযোগ্য, মেরুদ-হীন এবং বিতর্কিত কমিটি গঠিত হয়। একই ব্যক্তিকেই যখন দ্বিতীয়বারের মতো সার্চ কমিটির প্রধান করা হয় তখন আরেকটি রকিব উদ্দিন মার্কা ইসি গঠিত হবে বলেই ধারণা করা যায়।

অনুসন্ধান কমিটির আরেক সদস্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা ছিলেন, তাঁর ছোট ভাই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। অনুসন্ধান কমিটির আরেক সদস্য সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব ছিলেন। বিতর্কিত সেই নির্বাচনকে নিয়মসিদ্ধ করার পুরস্কার হিসেবে তিনি অবসরের পরেও পিএসসি’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি সরকারের ইচ্ছা পূরণে সচেষ্ট থাকবেন তা-ই স্বাভাবিক। কমিটির একমাত্র নারী সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরিন আখতার। মির্জা ফখরুল বলেন, শিরিন আখতার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী শিক্ষক হিসেবেই পরিচিত। তাঁর বাবা কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। শিরিন আখতার নিজে কক্সবাজার জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের নেত্রী ছিলেন। অনুসন্ধান কমিটির আরেক সদস্য মাসুদ আহমেদ একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি সরকারি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছয় সদস্যের মধ্যে পাঁচজনেরই নাম-ধাম, দলীয় পদ, পরিচয় তুলে ধরলেও সরকারি দল এসব অভিযোগকে আমলে না নিয়ে বরং উড়িয়ে দিয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশে অবস্থান করেন এবং সরকারে প্রভাব রাখেন এমন কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অতীতে সব সময়ই সরব ছিলেন। কিš ‘২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের পরে তাঁদের ভুমিকা অনেকটাই গৌণ হয়ে আসে সরকারের কঠোর ভারতঘেঁষা নীতি এবং ভারতীয় কূটনীতিতে বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে রাখার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে। কিন্তু তাঁরা আবার পর্দার সামনে এসেছেন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির সময় প্রার্থনা করে চিঠি দিয়ে। অবশ্য বঙ্গভবন এ বিষয়ে এখনও কিছু জানায় নি এবং তাঁদের যে এ বিষয়ে কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নেই সেই ইঙ্গিতই যেন পাওয়া গেল আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরের কথায়। কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সার্চ কমিটির বিষয়ে বিদেশীদের নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। বিএনপি’র কথায় প্রেসিডেন্টকে বিদেশীদের সঙ্গে বসতে হবে, কিন্তু আমরা কি মেরুদ-হীন জাতি? সেদিন চলে গেছে। আমাদের দেশের নীতি নির্ধারণ আমরাই করবো।

অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত সার্চ কমিটি। এ বৈঠকের পরেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ম্যারাথন আলোচনায় থাকা দলগুলোর কাছ থেকে পাঁচ সদস্যের নাম চাওয়া হয়েছে। আবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নাম প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শ নিতে সোমবার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে সার্চ কমিটি।

প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম প্রস্তাবের দায়িত্ব দেন। সার্চ কমিটির সুপারিশ থেকেই অনধিক পাঁচ সদস্যের নতুন ইসি নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট। রকিব উদ্দিন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারি, নির্বাচন কমিশনার এ কে এম শাহনেওয়াজের মেয়াদ আছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এখন সদ্যগঠিত সার্চ কমিটির ছয় জনের মধ্যে একজন বাদে বাকি পাঁচজনের দলীয় পরিচয় এবং বিএনপি’র আস্থাহীনতা, অন্যদিকে কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের অন্য এক আইনজীবী। শনিবার সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আবেদন জমা দেয়ার পর আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে একটি আইনের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন ও কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেই আইন প্রণয়ন করা হয় নি। একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংবিধানের বাইরে চলতে পারে না। আর আইনে সার্চ কমিটির কথা নেই। তাই সার্চ কমিটি গঠন করে যে গেজেট জারি করা হয়েছে তার বৈধতাই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে ওই আবেদনে।

এত আপত্তি, প্রশ্ন, কেন’র পরেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, সার্চ কমিটির কাছে বিএনপি তাদের প্রস্তাব পেশ করবে। সে অনুযায়ী বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভি এবং একই দিনে ক্ষমতাসীন দলের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ তাঁদের নিজ নিজ দলের পক্ষে পাঁচ জনের তালিকা নিয়ে যান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিতে। মঙ্গলবার বেলা ২টা পর্যন্ত ২৭টি রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবকৃত নাম জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বিধি) আব্দুল ওয়াদুদ।

আপাতত রাষ্ট্রপতি নির্দেশিত ১০ কার্যদিবস শেষ হওয়া তক অপেক্ষা করা ছাড়া রাজনৈতিক ভাবে কারও করণীয় কিছু আছে বলে মনে হয় না। আমাদেরকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আওয়ামীলীগ ও তাঁদের সরকার নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনা করতে নেমেছে নাকি জাতির ভাগ্যরেখাকে পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে তা বলে দিতে পারে একমাত্র ভবিষ্যৎ। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা জানি না বিচারপতি সাঈদের মতো আরেকজন সৎ এবং যোগ্য লোক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে আরেকবার পাবো কিনা!! আমার মনে আছে, সাঈদ সাহেব কতটা নিভৃতে মারা গেলেন !! পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর খবর ছাপার জায়গা হলো এক কলাম ইঞ্চি, মানে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবির সমান জায়গায়। তা-ও সেটা ছাপা হলো যে সব পৃষ্ঠায় হারবালের বিজ্ঞাপন ছাপা হয় সেখানে, একেবারে কোনার দিকে। রাষ্ট্র বলুন, বিএনপি কিংবা আওয়ামীলীগ যাদের কথা-ই বলুন না কেন, এই বীর পুরুষকে কেউ মনে রাখে নি। এখন তাকিয়ে আছি এমন আরেকজনের আশায় - যিনি দেশের হাল ধরবেন। দেশটাকে বাঁচিয়ে দেবেন। এমন একজন মানুষ যিনি অকপটে বলতে পারেন, ‘আমি সুখী কিনা জানি না কিন্তু আমার কোনও দুঃখ নেই। সারাদিন আমি নিজের কাজ সুষ্ঠুভাবে করি, রাতে ঘুমাই।’ বাস্তবতা হলো, এদেশে বীরের স্থান নেই। এখানে তাই বীরের জন্ম হয় না। আমাদেরকে শ’ শ’ বছর ধরে সয়ে যেতে হয় নন রেসিং স্টেট-এর খেতাব।

- লালপুর, নাটোর থেকে

No comments:

Post a Comment