সাখাওয়াত সায়ন্ত
ঢাকার দুই সিটিতে ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ভোটকেন্দ্রিক উৎসব ও উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছে উৎসবটা বেশ জমে উঠেছে। এত পোস্টার, এত মাইকিং, ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এত নির্বাচনী গান-প্যারোডি আগের কোনো নির্বাচনে হয়েছে বলে মনে হয় না। শহরের প্রতিটা অলিগলি-পাড়া-মহল্লা ছেয়ে গেছে পোস্টারে। যদিও এই পোস্টার প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে সরকারি দলের প্রার্থীরা। এই অতিপ্রচার নিয়ে বিশেষ করে শব্দদূষণ নিয়ে অনেকে বিরক্ত।
নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থী ও তাদের দলীয় সমর্থকদের উৎসব দেখা গেলেও এই উৎসব ভোটারদের উৎকণ্ঠা কাটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ভোট কেমন হবে এই প্রশ্নটি যেকোনো সাধারণ ভোটারকে জিজ্ঞেস করলেই তারা কেমন যেন এক রহস্যময় হাসি দিয়ে এর উত্তর এড়িয়ে যান।
পোস্টার, মাইকিং, গানবাজনা, ঢোলবাদ্যের আড়ালে ঢাকা পড়া এই যে ভোটারের উৎকণ্ঠা তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে কমই। নিজেরা বেশি প্রচার চালিয়ে, বিরোধী দলকেও কিছুটা সুযোগ দিয়ে নির্বাচনকে উৎসবমুখর বানানোটাও আওয়ামী লীগের কোনো বিশেষ কৌশল কি না সেটা জানা যাবে আর দুদিন পরই। প্রচারের ডামাডোলের আড়ালে তাদের কী কৌশল লুকিয়ে আছে, সেই উৎকণ্ঠা থেকেও মুক্ত নয় শহরবাসী।
সাধারণ ভোটারের পাশাপাশি এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুই প্রধান দলের উৎকণ্ঠাও কম নয়। সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই শিবিরের উৎকণ্ঠা দুই ধরনের। আওয়ামী লীগের উৎকণ্ঠা কী নিয়ে তা বুঝতে হলে এই সংবাদ শিরোনামগুলো মনে রাখাই যথেষ্টÑ ‘মেয়র জেতাতে মরিয়া আওয়ামী লীগ’ (দেশ রূপান্তর), ‘আ.লীগের ভাবনায় শুধুই জয়’ (প্রথম আলো)। এই প্রতিবেদনই বলে দেয় আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই হারতে চায় না এই নির্বাচনে। যেকোনোভাবে জিততে মরিয়া দলটি। তারা মনে করছে, ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার এই নির্বাচনে তারা হারলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার গল্পের বেলুন ফুটো হয়ে যাবে। এতে করে মনোবল ভেঙে যাবে তাদের নেতাকর্মীদের। আর মাত্র এক বছর আগে নগণ্যসংখ্যক ভোট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করা বিএনপি এখন জিতে গেলে আগের নির্বাচনগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের আর বলার কিছু থাকে না। এই নির্বাচনে বিজয়ী হলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হতে পারে। তারা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নিতে পারে। সামনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তারা রুখে দাঁড়াতে পারে। আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। এইসব উৎকণ্ঠা আছে আওয়ামী লীগের।
কিঞ্চিৎ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আওয়ামী লীগ অবশ্য মনে করে, ঢাকা সিটি নির্বাচনে হেরে গেলেই সরকারের পতন হবে, এমন তো নয়। তাই নির্বাচন ব্যবস্থা যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং তার পুরোটা দায় আওয়ামী লীগের কাঁধে তা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে এই নির্বাচনটি সুষ্ঠু সুন্দর গ্রহণযোগ্য করা উচিত। একাদশ জাতীয় নির্বাচন তাদেরকে যে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে তার বিপরীতে তারা এই নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলতে পারবে যে এই সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। এই ফর্মুলা প্রয়োগ করেই হয়তো অনেকে বলছেন, ঢাকা দক্ষিণে যেকোনোভাবে জয় কেড়ে নেবে আওয়ামী লীগ। আর কিছুটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে উত্তরে হারার ঝুঁকি নিতেও পারে আওয়ামী লীগ। কারণ হিসেবে এই গ্রুপটা মনে করছে, শেখ পরিবারের ছেলে তরুণ নেতা তাপসকে এমপি থেকে পদত্যাগ করিয়ে সিটি নির্বাচনে নামানো হয়েছে, পরাজয় মেনে নেওয়ার জন্য নয়। ব্যারিস্টার তাপস নিজেও বলেছেন, হারার জন্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে আসিনি। কিন্তু পুরান ঢাকার সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনকে হারিয়ে অভিজাত ধানম-ি থেকে আসা তাপসকে জেতাতে যে বেগ পেতে হতে পারে, তা ঢাকতে উত্তর সিটিতে পরাজয়ের ঝুঁকি নেবে কি তারা? আ.লীগ তখন বলতে পারে, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে উত্তরে বিএনপি জিতল কীভাবে?
কিন্তু এই দুই গ্রুপের বাইরেও আরেক গ্রুপ আছে যারা কোনো যুক্তিতেই আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে নারাজ। তারা মনে করে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনকেন্দ্রিক লজ্জাশরম ভেঙে গেছে অনেক আগেই। আর মাত্র দুদিন পরেই জানা যাবে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কোন গ্রুপের ধারণা সঠিক হয়।
আসলে ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ আছে উভয় সংকটে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে হারলেও বিপদ। কারচুপি করে জিতলেও বিপদ। কেউ মনে করতে পারেন, কত নির্বাচনে কত রকম জালিয়াতিই তো করা হলো। তাতে কী এমন বিপদটা হয়েছে? বিএনপি তো কিছুই করতে পারল না! তারা হয়তো ভাবে না, জাতির সামনে ভোট ডাকাতি প্রমাণিত হলে সেটাও কম ক্ষতি নয় দলটির জন্য। তাই ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের উৎকণ্ঠা উভয়মুখী ও ব্যাপক।
অন্যদিকে এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উৎকণ্ঠা আওয়ামী লীগের মতো নয়। বিএনপির উৎকণ্ঠার জায়গাটা যে কী তাও বোঝা যায় দেশ রূপান্তরের শিরোনাম থেকেইÑ ‘পুলিশের জেনে ফেলার ভয় : গোপনে এজেন্ট তালিকা করছে বিএনপি’। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি জানে, এই নির্বাচনে তাদের যতটুকু প্রচারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটা লোক-দেখানো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আগের নির্বাচনগুলোতে বিএনপিদলীয় পোলিং এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে, গ্রেপ্তার করে কীভাবে কেন্দ্রগুলো ধানের শীষের এজেন্টশূন্য করা হয়েছিল তা জানে বিএনপি। তাই দলটির সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠাটি পোলিং এজেন্ট নিয়ে। একটা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা কতটা ভেঙে পড়লে, একটা সরকার বিরোধী দলের প্রতি কতটা নিপীড়নমূলক হলে বিএনপির মতো একটি বড় দলের পোলিং এজেন্টের তালিকা করতে হয় গোপনে! কেন্দ্রে শক্তভাবে দলীয় এজেন্ট না থাকলে যে ভোটাররা ভোট দিতে অস্বস্তি বোধ করেন তা তো সবারই জানা। অভিযোগ আছে, সরকারদলীয় এজেন্ট ও প্রশাসনের লোকজন ভোটারদের বাধ্য করেন তাদের সামনে ভোট দিতে। আবার কোথাও আরও এক ডিগ্রি এগিয়ে ভোটারকে কষ্ট না দিতে তার ভোটটি তারাই দিয়ে দেন বলেও জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগী। তাই বিএনপির প্রথম ও প্রধান উৎকণ্ঠা, এত ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দলীয় এজেন্টরা কেন্দ্রে থাকবেন কি না সেটা নিশ্চিত করা।
বিএনপির দ্বিতীয় উৎকণ্ঠা ইভিএম নিয়ে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে, বিরোধী দলকেও কিছুটা প্রচারের সুযোগ দিয়ে, আপাতদৃষ্টিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেখিয়ে ইভিএম কারসাজি করে ফলাফল পাল্টে নৌকাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে কি না সে উৎকণ্ঠাও আছে বিএনপির। ঢাকা সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে ইভিএমের বিরোধিতা করে দলটি একাধিক আলোচনা অনুষ্ঠানের মূলে আছে ইভিএম জালিয়াতি নিয়ে উৎকণ্ঠা।
বিএনপি মনে করে, সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের যেভাবে অপমান-অপদস্ত করেছে তার জবাব তারা সুযোগ পেলে ভোটের মাধ্যমে দেবে। কেননা গুম, খুন, মানবাধিকার হরণ, গণতন্ত্র ধ্বংস, শেয়ারবাজার লুট, ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার, অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্যসহ এত কিছু নিয়ে জনগণের ক্ষোভ আছে যে, তার জবাব সাধারণ ভোটাররা নিশ্চয়ই ভোটের মাধ্যমে দেবে। তাছাড়া এই শহরটাকে বসবাস উপযোগী রাখতে না পারা, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, জলাবদ্ধতাসহ অনেক বিষয়েও ঢাকার মানুষ মহাবিরক্ত এই সরকার ও তাদের মেয়রদের ওপর। এই শহরটি যানজটে পৃথিবীর নিকৃষ্ট, বসবাসের উপযোগিতার বিচারেও নিকৃষ্ট। বায়ুদূষণে পৃথিবীর সেরা। নারীর জন্য অনিরাপদ নগরীর তালিকায়ও চতুর্থ। আরও কত সব কলঙ্কতিলক এই শহরের কপালে জুটেছে। দক্ষিণের নৌকার প্রার্থী তাপসও বলেছেন, অচল ঢাকাকে তিনি সচল ঢাকা বানাবেন।
টানা এগারো বছর দেশের ক্ষমতায় ও প্রায় অর্ধযুগ সরকারদলীয় মেয়র থাকার পরও ঢাকা অচল নগর হয়ে থাকা, ঢাকার কপালে এত কলঙ্ক লেপন করা, ঢাকাকে মানুষের জন্য অনিরাপদ নগরী বানিয়ে রাখার কথা মানুষ ভুলবে না। অন্যদিকে জনগণের করের টাকা শহরবাসীর সেবায় ব্যবহার না করে লোপাট করাও মানুষ ভুলবে না। তাদের যে মানুষ ভোট দেবে না, এটা শুধু বিএনপি কেন অনেকেরই ধারণা। তাই ভোটপ্রাপ্তি নিয়ে বিএনপির উৎকণ্ঠা কম। শুধু ভোটারদের কেন্দ্র পর্যন্ত নিতে পারলেই হলো। বিএনপির উৎকণ্ঠা সরকার ও তাদের অনুগত নির্বাচন কমিশনের জালিয়াতির আশঙ্কা নিয়ে।
এই উৎকণ্ঠা নির্বাচনের ফলাফল না আসা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, নাকি ভোট চলা অবস্থায়ই পরিষ্কার হয়ে যাবে সেটা আসলে কার ওপর নির্ভর করে? এ প্রসঙ্গে সিটি নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেছেন ‘এজেন্টদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। যাদের পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে তাদের ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে। বাকিটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। প্রধানমন্ত্রী কেমন নির্বাচন চান তা ভোটের দিন স্পষ্ট হবে।’
মানুষ হয়তো সব সময় জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে পারে না। কিন্তু জালিয়াতদের ঘৃণা করতে পারে অনায়াসে। সেই ঘৃণাও এক সময় জালিয়াতদের কঠিন পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- লেখক-চিকিৎসক ও কলামনিস্ট/
- কার্টসি - দেশ রূপান্তর / জানুয়ারি ৩১, ২০২০