Search

Monday, July 19, 2021

করোনা মোকাবিলায় নাগরিক ও রাষ্ট্রের দায়

--------------------------------

শায়রুল কবির খান

--------------------------------



করোনাভাইরাসের এক অদৃশ্য শক্তির মহাসংক্রমণে আজ বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকেই মহামারীর বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ-পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কত দিন এ অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে এমন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে সে বিষয়ে কোনোরকম স্পষ্ট ধারণা করতে পারছেন না কেউই। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট এই কভিড-১৯ মহামারী নিয়ে ইতিমধ্যে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নানারকম বিতর্ক শুরু হয়েছে। চলছে বাকযুদ্ধ। এর দায় কার? আর কীভাবে হবে এর সমাধান?

বাংলাদেশেও করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে। অবশ্য এর একটি যৌক্তিক কারণও আছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। যে রাষ্ট্রটি জিডিপির ৯.০৩ শতাংশ ব্যয় করে জনস্বাস্থ্য খাতে। ৫.৫৫ শতাংশ ব্যয় নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে নেপাল। ভারতের চেয়েও স্বাস্থ্য খাতে শ্রীলঙ্কার ব্যয় বেশি, জিডিপির ৩.৮১ শতাংশ। সেখানে ভারতের ব্যয় ৩.৫৩ শতাংশ। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা আমাদের বাংলাদেশের। জিডিপির ২.২৭ শতাংশ ব্যয় নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত চলছে। আর পাকিস্তানের ব্যয় এ খাতে জিডিপির ২.৯০ শতাংশ।

আমাদের সরকার বছর বছর লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে। মন্ত্রী-এমপিরা গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে বেড়ান গত বছর এত লাখ কোটি টাকার বাজেট ছিল। এ বছর আমরা এত লাখ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। এই হলো আমাদের উন্নয়ন। বিগত ১৩ বছরে উন্নয়নের আওয়াজ যত পাওয়া গেছে তার বিপরীতে গুণগত পরিবর্তন সামান্যই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বর্তমান মহামারীতে নাগরিকরা উপলব্ধি করেছেন। গেল বছর ডেঙ্গু মশার সংক্রমণে চিকিৎসাব্যবস্থার নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থাও দেখেছেন দেশবাসী।

নাগরিকদের যে কটি মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের রক্ষা করার দায়দায়িত্ব এর মধ্যে অন্যতম খাদ্য ও চিকিৎসা। খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় আর চিকিৎসাসেবার অভাবে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে মহামারী দেখা দেয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা নিয়ে নানাভাবে দোষ দেওয়া হচ্ছে ডাক্তারদের, নার্সদের। অথচ মূলত এ দায় রাষ্ট্রের অর্থাৎ সরকারের ব্যবস্থাপনার। ২৭ এপ্রিল বিবিসি বাংলার অনলাইন সংস্করণের প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশে এত বিভ্রান্তি কেন’। তারপরও এখনো সময় আছে, এই সংকট মোকাবিলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দমনপীড়ন বাদ দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার।

রাষ্ট্রের যে সংকটই আসুক না কেন, তা ঘনীভূত হওয়ার আগেই মোকাবিলা করতে সমাধানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিকল্প নেই। একটি সংকট জন্ম নেওয়ার পর থেকে সংকট ঘনীভূত হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব বেশিরভাগ সময়ই প্রধান দুই দলের মতাদর্শগত সংঘাতে যেন বিভক্ত হয়ে পড়ে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। যা এখন অতীব জরুরি। সরকার আর বিরোধী দলের মতাদর্শিক সংঘাতের মধ্যেও কিন্তু যৌক্তিক কথাটা তুলে ধরতে পারেন নাগরিক সমাজের নেতারা। সামগ্রিক সংকট মোকাবিলায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার কথা হলেও সেটা দেখা যাচ্ছে না। জনগণের ন্যায্য অধিকারের বিষয়গুলো প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে? ক্ষমতাসীন দল জাতীয় সংকটের মধ্যেও বিরোধী দলকে দমনপীড়ন ও দোষারোপের চক্রে রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশলে ব্যস্ত।




ফিরে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ছুটি-লকডাউন-কঠোর লকডাউন-শাটডাউন-কড়াকড়ি শাটডাউন এসবের মধ্যে দিয়েই দেশ অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু মহামারী মোকাবিলায় আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি। টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ নিয়েও দেখা গেছে নানা বিতর্ক। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি সাফল্যের বিপরীতের ব্যর্থতার অভিযোগও আছে। যেখানে টিকা সংগ্রহ করা দরকার ২৬ কোটি ডোজ সেখানে নিজস্ব ক্রয় ও অনুদান বাবদ প্রায় ২ কোটি ডোজও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

আর দফায় দফায় লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ চললেও সেটা যথাযথভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। লকডাউন হচ্ছে আবার লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে আসা-যাওয়ায় বাধ্য হচ্ছে। কে কোথায় কেমন করে যাবে, যাতায়াত ভাড়া কত পড়বে তার কোনোরকম ধারণা ছাড়াই সে পথে নামতে হচ্ছে মানুষকে। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা, হেঁটে, ট্রাকে গাদাগাদি করে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়েও মানুষকে গুনতে হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত-আটগুণ ভাড়া। এভাবে বারবার জীবিকার তাগিদে গার্মেন্টসকর্মীসহ অন্যান্য পেশার শ্রমজীবী আর নিম্ন আয়ের মানুষদের দফায় দফায় ছুটোছুটি করতে হচ্ছে রাজধানী আর বড় বড় শহর থেকে গ্রামে আর গ্রাম থেকে পুনরায় শহরে। এতে করোনার সংক্রমণও দফায় দফায় ছড়িয়ে পড়ছে।

সে ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির দায় আসলে কার? সাধারণ মানুষের নাকি সাধারণ নাগরিকদের ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ রাষ্ট্র পরিচালকদের?

আমাদের সমাজে যারা নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা হয় সরকারের অনুগত, তা না হলে রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত হয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম ব্যবসায়ী সমাজ। সাংবাদিক সমাজ। শিক্ষক সমাজ। চিকিৎসক সমাজ। আইনজীবীসহ প্রায় সব স্তরেই দেখা যাচ্ছে প্রায় একই পরিস্থিতি। নাগরিক সমাজের নেতারা রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসবেন না হয়তো, আসতেও চান না। তারা রাষ্ট্রের অসংলগ্নতাগুলোকে তুলে ধরবেন এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু জাতীয় সংকটের সময়েও তারা যথাযথভাবে ভূমিকা পালন না করায় সাধারণ জনগণ আজ অসহায়।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তবেই সাধারণ নাগরিকরা হয়তো আশার আলো দেখতে পাবেন। সময় খুব দ্রুততার সঙ্গে যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর কোনো বক্তব্য সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দৃশ্যমান নয়। আর সরকার নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে।

মহামারী মোকাবিলা আর লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকার যদি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটা জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করে সর্বসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করত তবে তা এই সংকটকালে জাতিকে অনেকটাই ভরসা দিতে পারত।

  • লেখক বিএনপি চেয়ারপার্সন এর মিডিয়া উইং এর সদস্য ও সাংস্কৃতিককর্মী 


No comments:

Post a Comment