Search

Friday, December 17, 2021

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উল্টো রথে বাংলাদেশ

— অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান ও ফারহান আরিফ

 

১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রচিত ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির শেষাংশ এমন, ‘সময় ছিল অতি মূল্যবান। আমি ব্যাটালিয়নের অফিসার, জেসিও আর জওয়ানদের ডাকলাম। তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলাম… তাদের নির্দেশ দিলাম সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। …তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সাল। রক্তের আঁখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণ রাখবে, ভালোবাসায়। এই দিনটিকে তারা কোনদিন ভুলবে না। কোনো-দি-ন-না।’ ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আজ আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের আলো-বাতাস উপভোগ করছি তার শুরুটা ছিল এমন।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাক হানাদার বাহিনীর আত্নসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে সগৌরবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে নতুন পরিচয় পেয়েছে এ জাতি তার মূল চেতনা ছিল, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যয়বিচার।’ একটি বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই বাঙালীর সেই আত্মত্যাগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু শেখ মুজিবুরের শাসনকালে তাতে মরিচা পড়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মধ্য দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা ফিকে হতে শুরু করলো। এ নির্বাচনে জনগণের ভোট ছিনতাই করা হল, যা ছিল এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এক অকল্পনীয় ঘটনা। নির্বাচনে জয়লাভ করল একজন, আর ঘোষণা করে দেয়া হল একজন আওয়ামী লীগারের নাম। এ ধরণের নির্বাচনের সাথে মানুষ পরিচিত ছিল না। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও এরূপ ঘটেনি। ১৯৭৩ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের টুঁটি চেপে ধরার জন্য একের পর এক কালাকানুন জারি করতে লাগলো। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন, নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ আইন, সরকারি কর্মচারীদের লেখালেখিতে নিষেধাজ্ঞা আইন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হল। বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্ক্ষাসমূহকে হত্যা করে দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হল। রক্ষিবাহিনীর হত্যা, খুন ও অত্যাচারে মানুষের জীবন ছিল জেরবার। আওয়ামী লীগের অপশাসন, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে দেশ নিপতিত হল ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে। এমন পটভূমিতে সংঘটিত হয় ১৫ই আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৫ সালের এই তারিখে শেখ মুজিব নিজ দলের লোকজনেরই যোগসাজশে সপরিবারে প্রাণ হারান। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির এক অংক থেকে আরেক অংকে পদার্পণ করে বাংলাদেশ।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঘোর সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের পঙ্কিল কর্দমে নিপতিত হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে। এমন ক্রান্তিকালে ১৯৭১ এর মত আরো একবার ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও এর প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগ কর্তৃক পদদলিত মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে পুনরুদ্ধার করেন। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, স্বনির্ভর অর্থনীতি, উৎপাদনের রাজনীতি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানুষের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, সে বাংলাদেশকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থান করে দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষের বাংলাদেশে কৃষি বিপ্লব ও খালকাটা কর্মসূচীর মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এ অগ্রযাত্রা চক্রান্তকারীদের সহ্য হয় নি। তাইতো তারা আধুনিক ও স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জিয়াউর রহমানকে থামিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়। সাহসী দেশপ্রেমিক জিয়া ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজশে সেনাবাহিনীর কতিপয় বেপথু সৈনিকের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।

সেই থেকে বাংলাদেশ আরেকবার পথ হারালো। নতুন করে স্বৈরশাসকের করতলগত হল বাংলাদেশ। স্বৈরাচার এরশাদের বন্দুক, কামানের নিয়ন্ত্রণ থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সমগ্র বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেন বেগম খালেদা জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য তথা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের গুরুদায়িত্ব বহন করে এক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেন তিনি। একজন গৃহবধু থেকে ক্রমশ তিনি এদেশের মানুষের কাছে নন্দিত হন আপসহীন নেত্রী, দেশনেত্রী থেকে দেশমাতা রূপে। মুক্তিযুদ্ধের হৃত চেতনা তথা ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যয়বিচার’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল। হোঁচট খাওয়া গণতন্ত্র ফিরে এলো আবার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে।

কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডাধারী গণতন্ত্রকামী বেগম খালেদা জিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত থেমে থাকেনি। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হয়ে গেলেও এই আধিপত্যবাদি শক্তির তাঁবেদার, দূর্নীতিবাজ গোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে বাংলাদেশ পূর্ণরূপে মুক্তি পায় নি। কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে; ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা রাখা হয়েছে। বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করা মাত্রই গুম, খুনের শিকার হতে হচ্ছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার মত রাজনৈতিক অধিকারের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেতনা নিয়ে স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশ এখনো গণতন্ত্র সূচকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ হিসেবে অবস্থান করছে। দ্য ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পরিচালিত এ বছরের বৈশ্বিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫টি দেশের মধ্যে ৭৬তম। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইব্রিড রেজিমে অবস্থিত দেশসমূহে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এছাড়া আইনের শাসন, সুশীল সমাজ, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির দুর্বলতা এসব দেশসমূহে প্রকট। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা উপেক্ষিত; সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয় মদদে দমন করা হচ্ছে। এ বছরের ১৪ অক্টোবর নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট কর্তৃক পরিচালিত এক প্রতিবেদনে আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪তম। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ভোটাধিকার ইত্যাদির এমন দুরাবস্থার ফলেই সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। এটি মূলতঃ আমাদের গণতন্ত্রের দূরাবস্থার বিষয়টিকেই চিত্রায়িত করে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের এমন অপমানজনক অবস্থান যেন সেই শেখ মুজিবের বাকশাল আমলের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কেবল গণতন্ত্রের বিপন্ন অবস্থাই নয়; বরং গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে পুরো রাষ্ট্রের কঙ্কালসার অবস্থা বেরিয়ে আসছে। একদলীয় নব্য বাকশাল ব্যবস্থার অধীনে দূর্নীতির এক স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার লুটসহ নানা আর্থিক কেলেঙ্কারি, মেগা প্রজেক্টের নামে দেশের জনগণের ভ্যাট, ট্যাক্সের টাকা হাতিয়ে নেয়ার এক মহোচ্ছব চলছে দেশ জুড়ে।  স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে যে সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রায়নের পথে এগুচ্ছিলো, সে পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় ২০১২ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত তিনটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ গণতন্ত্রায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের পরিচালক প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্তিশালী অবস্থানে আসার আগেই এ পথকে রুদ্ধ করে দেয়া হল। মূলতঃ এর মাধ্যমে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দূরভিসন্ধিকে আনুষ্ঠানিকতা দেয়া হয়। শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে উঠার পূর্বেই এমন একটি হঠকারিতামূলক সিদ্ধান্তের ফলে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগের লাইসেন্স প্রতিষ্ঠা করে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যকার বিরাট পার্থক্যের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তাদের ভোগবিলাসের নিয়ামকে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। এ যেন পঁচাত্তর-উত্তর বাংলাদেশেরই পুনরাবৃত্তি।

ইতোমধ্যে দেশব্যপী এক মাৎস্যন্যয় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হচ্ছে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এই লুটপাটের সাক্ষ্য বহন করে বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থা ও শেয়ারবাজার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ডিএসই-এর সূচকে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। শেয়ারবাজারের সেই অস্থিরতার ডামাডোলে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীরা বিরাট অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সে ঘটনার উপর দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। সেই প্রতিবেদনে সরকারদলীয় এমপি সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, বেক্সিমকো গ্রুপ ২০০৯ সালে শেয়ার মার্কেট থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়। কেবল তাই নয়; ১৯৯৬ সালেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় সালমান এফ রহমানের নামে দু’টি মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু উচ্চ আদালত মামলাগুলোকে কোয়াসমেন্ট দিয়ে দেয়। এভাবে বিএসইসির উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক চাপের মুখে বেক্সিমকো, শাইনপুকুর সিরামিকসসহ ক্ষমতার বলয়ে থাকা ব্যক্তিদের কোম্পানিসমূহ পার পেয়ে যায়।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলের আর্থিক কেলেঙ্কারি কেবল এখানেই থেমে থাকে নি। এ সরকারের গত এক যুগেরও বেশি সময়কার শাসনামল জুড়েই আলোচিত রয়েছে ব্যাংকখাতের নানা অনিয়ম। গত এক যুগকে ব্যংক লুটপাটের যুগ বললে সেটা অত্যুক্তি হবে না। ঋণের নামে ব্যাংকে রাখা জনগণের আমানতের টাকার যথেচ্ছ লুটপাট করা হয়েছে। খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশর ব্যংকগুলো এক ভয়াবহ নজির স্থাপন করেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১লা মে ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭,৭৮০ কোটি টাকা। টানা সাত বছর দায়িত্ব পালন শেষে তিনি যখন পদত্যাগ করেন তখন অবলোপনসহ ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রেখে যান (দৈনিক বণিক বার্তাঃ ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)। ২০১৮ সালের ৪ জুন দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার সুষ্ঠু প্রয়োগ উপেক্ষিত থাকার ফলে ব্যাংকিং খাতে এমন ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। কোন আবেদন-জামানত ছাড়াই অসাধু ব্যক্তিবর্গকে এসব ঋণ দেয়া হয়, যা পরবর্তিতে উঠিয়ে আনা সম্ভব হয় নি। এক্ষেত্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সন্তুষ্টি ও সমৃদ্ধি সাধনেই সরকারের খেয়াল গোচরীভূত হয়। দৈনিক কালের কণ্ঠে ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অন্ততঃ ৬০০ বড় বড় ঋণখেলাপিকে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ঋণখেলাপিদের তালিকা বহির্ভূত রাখা হয়েছে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপঃ জনতা ব্যাংকের মূলধন ৪ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। ব্যাংক নীতিমালা অনুযায়ী মূলধনের ২৫ শতাংশ ঋণ প্রদানের নিয়ম থাকলেও জনতা ব্যাংক কেবল এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট লেদার নামক দুইটি কোম্পানিকেই যথাক্রমে ৫ হাজার ও ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে! এই ঋণ ব্যাংকটির একক ঋণসীমার চার গুণ অতিক্রম করেছে (দৈনিক যুগান্তরঃ ১০ এপ্রিল, ২০১৮)। ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মোট প্রদেয় ঋণের ২৫ শতাংশই রয়েছে চার শিল্প প্রতিষ্ঠান তথা বেক্সিমকো, এননটেক্স, এস আলম এবং ক্রিসেন্ট লেদারের কাছে। এসব ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণ সংক্রান্ত কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয় নি। অপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালি ব্যাংকও ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে দেশজুড়ে আলোচিত ছিল। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালি ব্যাংকের প্রভাবশালী কর্তাদের যোগসাজশে হলমার্ক গ্রুপকে অন্ততঃ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেয়া হয়। নীতিবিরুদ্ধ এই ঋণ পাইয়ে দেয়ার কুশীলবদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রয়োগে সরকারকে আন্তরিক মনে হয় নি। জন অসন্তোষের মুখে হলমার্কের তানভির ও জেসমিন দম্পত্তিকে গ্রেফতার করা হলেও তাদেরকে যারা সহযোগীতা করেছিল তাদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় নি। সোনালি ব্যাংকের তৎকালীন এমডি হুমায়ুন কবিরের ব্যাংকিং পেশায় কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় তাকে এ পদে আসীন করা হয়। দায়িত্ব নিয়েই তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে কমিশনের বিনিময়ে অনৈতিক ঋণ পাইয়ে দিতে বিভিন্ন অসাধু ব্যক্তিবর্গকে সহযোগিতা করেন। সোনালি ব্যাংকের সাবেক এ কর্মকর্তা এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। সরকারের উদাসীনতায় তাকে এখন পর্যন্ত বিচারের মুখোমুখি হতে হয় নি। তাছাড়া ঋণের নামে লোপাট হয়ে যাওয়া অর্থও হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।

সোনালি, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকের মত সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকও আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাংক লুটপাটের আরেকটি দৃষ্টান্ত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুট হয় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এ সময়কালে এ ব্যাংকটির এমডি ছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির চিত্র সামনে এলে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও টাকা লুটপাট থামানো যায় নি। ৪ আগস্ট, ২০১৮ দৈনিক দিনকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাচ্চুর অব্যহতির পরও ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক থেকে আরো চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। দৈনিক প্রথম আলোতে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে আবদুল হাই বাচ্চু এমডি থাকাকালীন সময়ে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার শতকরা ৫ ভাগ থেকে শতকরা ৬৮ ভাগে বৃদ্ধি পায়। কেবল তাই নয়, ব্যাংকটির মোট ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টি শাখাই লোকসান গুনছে। অন্যদিকে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নয়টি ব্যাংককে অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের কেলেঙ্কারি আর সবকিছুকে হার মানিয়েছে। ব্যাংকটির পরিচালক হিসেবে সরকারের মন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর দায়িত্ব নিয়েই এটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেন। আইসিবি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক থেকে শেয়ার মূলধন দিয়েও ব্যাংকটিকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। দৈনিক যুগান্তরের ৩০শে এপ্রিলের এক প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া ৯টি ব্যাংকের একটি দ্য ফারমার্স ব্যাংক। ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয় ব্যাংকটির। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭২৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ ছিল ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকার বেশি। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫৫২ কোটি টাকা বা ৩২২ শতাংশ।’ ফারমার্স ব্যাংকের লুটপাটের ভয়াবহতা এতটাই ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে, ব্যাংকটিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের রাখা জলবায়ু তহবিলের ৫০৯ কোটি টাকা আটকে যায়। জনগণের এ টাকা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। সরকারের মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর এবং ব্যাংকটির এমডি মাহবুবুল হক চিশতির যোগসাজশে ঋণ জালিয়াতি, ঋণ প্রদানে কমিশন গ্রহণ, গ্রাহকের হিসাব থেকে নিজের হিসাবে অর্থ স্থানান্তরসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। তবে সরকারি দলের সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে এসব বিষয়ে কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।  এছাড়াও ইসলামি ব্যাংকে আওয়ামী লীগ সরকারের অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসার পর থেকেই ব্যাংকটিতে ধ্বস নামতে শুরু করে। নতুন বোর্ড আসার পর থেকেই ইসলামি ব্যাংকে নানা রকমের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার শুরু হয়। ব্যাংকিং খাতের এই দুর্নীতি কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহেই প্রভাব ফেলেনি, বরং সরকারি-বেসরকারি সব ধরণের ব্যাংক খাত এক ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। আবেদন-জামানতবিহীন এসব ঋণসুবিধা গ্রহণ করে প্রভাবশালীরা বিদেশে অর্থ পাচারের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে। পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি, প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে পড়ে সরকারি মদদপুষ্ট প্রভাবশালীদের নাম। বেনামি কোম্পানিতে অর্থ লগ্নির নামে দেশ থেকে হাতিয়ে নেয়া জনগণের টাকায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ে তোলে এসব দুর্বৃত্তরা।

ব্যাংকিং খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায়। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ চুরির এ ঘটনা ঘটে। বিবিসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঐ বছরের ৪ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিউ ইয়র্কস্থ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট থেকে এক বিলিয়ন ইউএস ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। চুরিকৃত অর্থের মধ্যে শ্রীলংকায় ২০ মিলিয়ন এবং ফিলিপাইনে ৮১ মিলিয়ন ইউএস ডলার পাচার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অদক্ষতার ফলে এ অর্থ পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় নি। এখন পর্যন্ত কেবল ফিলিপাইনে পাচার হয়ে যাওয়া ৮১ মিলিয়নের মধ্যে মাত্র ১৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার উদ্ধারে সমর্থ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ কেলেঙ্কারির মতই বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকবার সমালোচনার মুখে পড়ে ভল্টের স্বর্ণের শংকর ধাতুতে পরিণত হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে থাকা ৩০০ কেজি ওজনের সোনার চাকতি শংকর ধাতুতে পরিণত হবার ঘটনা প্রকাশ পায়। এছাড়াও সোনার গুণগত মানে পরিবর্তনের কথা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভল্টে গচ্ছিত ২২ ক্যারেট মানের সোনা কোন এক দৈব গুণে ১৮ ক্যারেটে পরিণত হয়ে যায়। রিজার্ভ চুরির ঘটনার মতই এ কেলেঙ্কারিরও কোন কুলকিনারা হয় নি। এসব অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ পর্দার আড়ালেই রয়ে যায়। এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনগণের টাকা লুটপাটের নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ডেসটিনি, ইউনিপে টুসহ কয়েকটি এমএলএম কোম্পানি। সম্প্রতি ইভ্যালি, ধামাকার মত অনলাইন ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর আর্থিক অব্যবস্থাপনার কবলে পড়ে কষ্টার্জিত অর্থ খুইয়েছেন ভোক্তা সাধারণ। কিন্তু এসবের বিপরীতে সরকার কার্যকর কোন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা দেখিয়েছে।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুটের মত আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি এ সরকারের হরিলুটের আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে মেগাপ্রজেক্ট। চটকদার মেগাপ্রজেক্টের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়েছে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। টেকসই উন্নয়নকে উপেক্ষা করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের আড়ালে জনগণের ট্যাক্সের টাকা লুট করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে প্রভাবশালীরা। ন্যয়সঙ্গত খরচ না করে, অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে কিংবা কাজের মেয়াদ প্রলম্বিত করে দফায় দফায় বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে মহাসমারোহে চলছে লুটের উৎসব। এ সরকারের বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহৃত পদ্মা সেতু প্রকল্পে চলছে দূর্নীতির মহোৎসব। ২০০৭ সালে এ সেতু নির্মাণ বাবদ ১০,১৬১ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়। ২০১৮ সালের ২৫শে নভেম্বর সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এসেও তা শেষ হয় নি। উপরন্তু বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে বর্তমানে এর বাজেট ৩০,১৯৩ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যয়কে এর সাথে যুক্ত করলে মোট প্রাক্কলিত বাজেট দাঁড়ায় ৬৯,৪৪৫ কোটি টাকা। কাজ সম্পাদনে দীর্ঘসূত্রিতার ফলেই ব্যয়ের পরিমাণ এতোটা বেড়েছে বলে মনে করা হয়। উল্লেখ্য যে, এ সেতু নির্মাণ সংক্রান্ত দরপত্র নিরূপণের দায়িত্ব প্রদানে সুস্পষ্ট দূর্নীতির অভিযোগ থাকায় বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটিতে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়।

অন্যান্য মেগাপ্রকল্পগুলোতেও একই রকম লুটপাটের উৎসব চলছে। মেট্টোরেল প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় ২১,৯৮৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ১৩,০০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা বাড়িয়ে ১৮,০৩৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আবার ২০১০-১৩ মেয়াদে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও পরবর্তিতে তা ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কর্ণফুলি টানেল নির্মাণ প্রকল্পেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। ৮৪৪৬ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে গৃহীত প্রকল্পটির কাজ ২০২০ সালে শেষ হবার কথা থাকলেও এখনো এর কাজ শেষ হয় নি। বরং ১০,৩৯১ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন মেয়াদ ধার্য করা হয়েছে। এ সরকারের মেগাপ্রকল্প নির্মাণে অদূরদর্শিতার এক বিরাট দৃষ্টান্ত পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প। ২০১৩ সালে উদ্বোধন হওয়া এ প্রকল্পটির কাজ শেষ হবার কথা ছিল ২০১৮ সালের জুনে। অথচ ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এসে অলাভজনক আখ্যা দিয়ে প্রকল্পটির কাজ বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের কয়েক হাজার কোটি টাকা নষ্ট হল, সে লোকসান কে পুষিয়ে দিবে তার কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। আওয়ামী সরকারের দূর্নীতির আরেক মহাক্ষেত্র হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৩,০৯৬ কোটি টাকা, যার সুদ দিতে হবে ৬৯,০০০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মধ্যে এর প্রথম ইউনিটটির কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও কাজের কোন অগ্রগতি নেই। এখন তারিখ পিছিয়ে ২০২৪ সাল নির্ধারণ করা হয়েছে। রূপপুর প্রকল্পে দূর্নীতির যে মহাসমারোহ, তা দেখা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকাগুলোতে। প্রকল্পের প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫৯৫৭ টাকা। আবার সেগুলোকে আবাসিক ভবনের খাটে উঠানোর মজুরি দেখানো হয়েছে বালিশ প্রতি ৭৬০ টাকা। প্রতিটি লেপ বা কম্বলের মূল্য দেখানো হয়েছে ১৬,৮০০ টাকা। অথচ এর বাজারমূল্য হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকা মাত্র। একটি বিছানা চাদরের দাম দেখানো হয়েছে ৫,৯৩৬ টাকা। ১৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পে ২০ তলা ও ১৬ তলা দু’টি ভবন নির্মাণের বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটায় এ দূর্নীতির চিত্র পাওয়া যায়। আবার এই প্রকল্পের জনবল প্রশিক্ষণ, চুল্লি নির্মাণ, রড সরবরাহ ইত্যাদি কাজে ২০১৭ সালে ভারতকে যুক্ত করা হয়; অথচ ভারতের নিজেদের পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত। এ সরকারের আরেকটি মেগাপ্রকল্প রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে সুন্দরবন ধ্বংসের পাশাপাশি প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের ক্ষতিগ্রস্থ হবার কথা বলেছে ইউনেস্কো সহ অন্যান্য সংস্থার বিশেষজ্ঞগণ। তাছাড়া শেখ হাসিনা এ প্রকল্পে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বললেও ভারতের এনপিটিসির সাথে কৃত চুক্তিতে দেখা যায়, এখানে সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রকল্পটির কাজ ২০১৯ সালে শেষ হবার কথা থাকলেও দুই বছর পেছানো হয়েছে। সাথে সাথে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে আরো এক হাজার কোটি টাকা।

বর্তমান সরকারের দূর্নীতির আরেক দৃষ্টান্ত হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহের অন্যতম সুলভ স্বাস্থ্যসেবা পাবার অধিকার থেকে দেশবাসি যে কেবল বঞ্চিতই হচ্ছে তা নয়; বরং এ খাতে সরকারের ছত্রছায়ায় চলছে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য। সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবার নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের কাছে। তারা সংবেদনশীল এ বিষয়টিকে নিজেদের লুটপাটের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত এক রিপোর্টে টিআইবি’র বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে কমিশন ভিত্তিক বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। যেখানে চিকিৎসা ব্যয়ের ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক, সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মী, রিসিপশনিস্ট ও দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে। রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাক্তার ও দালালদের ১৫ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন চুক্তি রয়েছে।’ কেবল তাই নয়, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি ক্রয়ে এক অভূতপূর্ব দুর্নীতির নজির স্থাপিত হয়েছে। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার একটি বই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ক্রয় করেছে ৮৫,৫০০ টাকায় (বাংলা ট্রিবিউনঃ ৩০ আগস্ট, ২০১৯)। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নাস্তার খরচে যে দুর্নীতির চিত্র দেখা গিয়েছে, তাতে সচেতন নাগরিক সমাজের চক্ষু চড়কগাছে উঠেছে। এসব দূর্নীতির মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা বিভিন্ন সিন্ডিকেট। নকল ওষুধ সরবরাহ, হাসপাতালের বেড বাণিজ্য, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয় বাণিজ্য ইত্যাদি নানা রকমের দুর্নীতিতে জেরবার স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুর দশা ভেসে উঠে সাম্প্রতিক করোনা মহামারিকালে। আইসিইউ না পেয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডারের অপ্রতুলতা, এম্বুলেন্সের অভাব ইত্যাদি কারণে এক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতেও রাজনৈতিক বিবেচনাকে গুরুত্ব দেয়ার ফলে বাংলাদেশ সংকটে পড়েছে।

সরকারের অব্যবস্থাপনা শিক্ষাখাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১৩ বছরে একাধিকবার শিক্ষাকাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমে স্থির মনযোগ দিতে পারে নি। পাসের হারে ঊর্ধগতি দেখালেও সেটা যে নামমাত্র ছিল, তা প্রমাণিত হয় শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরীক্ষায় ব্যাপক ভরাডুবি দেখে। অন্যদিকে প্রশ্ন ফাঁস, অবাধ নকলের উৎসবের ফলে কার্যকর শিক্ষা নিরুৎসাহিত হয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহে দলীয়করণের মতই পাঠ্যপুস্তকেও দলীয়করণের চূড়ান্ত করা হয়েছে। পাঠক্রম থেকে সঠিক ইতিহাস বাদ দিয়ে কেবল এক ব্যক্তির বন্দনা ও দলীয় স্বার্থানুকূল ইতিহাসকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড এর ২১ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, Global Talent Competitiveness Index (GTCL) পরিচালিত ২০২১ সালের মেধা সূচকে বাংলাদেশ ১৩৪ টি দেশের মধ্যে ১২৩তম অবস্থানে রয়েছে। উক্ত মেধা সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সর্বশেষ এক যুগের শাসনামলে ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিরোধী মত দলনের ঘটনা ঘটেছে। অসহনশীল সরকার সামান্যতম বিরোধিতা করলেও সেটাকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে সচেষ্ট রয়েছে। সরকারের এই রোষাণল থেকে কেবল বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই নয়; সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী, পেশার মানুষ- কেউই নিস্তার পায় নি। বিরোধী মত দলনে বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড যেন শেখ মুজিবের শাসনামলকে পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দেয়; এমনকি এক্ষেত্রে বর্তমান আওয়ামী সরকারের ভূমিকা মুজিব শাসনামলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে মিছিল, র‍্যালি, এমনকি সাধারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহের উপরেও সরকারের দমননীতি আরোপিত আছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মুক্ত রাজনৈতিক চর্চার আকাঙ্ক্ষাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকার বিরোধী রাজনীতির অনুসারী হবার কারণে সারাদেশে প্রায় প্রতিটি কর্মীর মাথার উপর ঝুলছে মামলার খড়গ। ২০১৮ সালে দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি’র প্রকাশিত এক প্রামাণ্য প্রতিবেদনে দাবী করা হয়, দলটির অনুসারী ৪৫ লক্ষ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অন্ততঃ ৯৫ হাজার গায়েবি মামলা রয়েছে। কেবল মামলাই নয়; বরং রাষ্ট্রীয় মদদে প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরকে গুম, জেলখানায় নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। বিএনপি’র সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী, চৌধুরি আলমসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গত ১৩ বছরে গুম করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেব অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোন না কোনভাবে ফিরে এসেছেন। অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন পরিবারের কাছে তার কোন তথ্য নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোন তথ্য দিতে পারে নি। এদের পরিবার-পরিজন এখনো নিজেদের সন্তান, স্বামী কিংবা ভাইয়ের ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। সরকারি বাহিনী কর্তৃক গুম হওয়া এ তালিকায় কেবল বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীই নন; অনেক মানবাধিকার কর্মী, সংবাদকর্মীরও নাম রয়েছে। সাদা পোশাকধারী পুলিশ কর্তৃক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যপী নিখোঁজ থাকার পর অনেককে সীমান্তের ওপাড়ে পুশ করে দেয়া কিংবা গ্রেপ্তার দেখানোর মত ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের মত আরো অনেকেই আছেন এ তালিকায়। অনেককে মুক্তি দিলেও ভয়ভীতি দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ধর্মীয় বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার, পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা’র পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামীর মত আরো অনেকে আছেন এ তালিকায়।

ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যার এক ভয়ঙ্কর ত্রাস চালু করেছে বর্তমান সরকার। রাষ্ট্রীয় বাহিনী র‍্যাবকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। কক্সবাজারের একরামুল হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার, ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনি ও নুরুল ইসলামের মত এমন ভাগ্যাহতের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়া অসংখ্য ক্রসফায়ারের ঘটনা সামনে আসে। এ ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ওসি প্রদীপ সাহার বিরুদ্ধে অসংখ্য ক্রসফায়ার ঘটানোর অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই যে কাউকে ধরে এনে মাদক উদ্ধার অভিযানের নামে ক্রসফায়ারে দেয়ার ঘটনাগুলো জাতিকে বিমূঢ় করে দেয়। কেবল তাই নয়, কথা মত না চলার অভিযোগে অনেক তরুনীকে বাড়ি থেকে তুলে এনে ধর্ষণ করার অভিযোগও রয়েছে ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। ওসি প্রদীপের এসব কাণ্ডকীর্তি রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় থাকা এমন অসংখ্য পুলিশ-র‍্যাব কর্মকর্তাদের একটি চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে। এছাড়াও রিমান্ড ও জেলহাজতে নির্যাতনের মুখে মৃত্যুর অভিযোগও রয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। লেখক মুশতাক আহমেদকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন আহমদ পিন্টুকে জেলহাজতে নির্যাতন ও যথাযথ চিকিৎসা প্রদান না করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে বলে বিএনপি’র পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে। সর্বোপরি আওয়ামী সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী মত দলন, জুলুম, নির্যাতনের এই ধারা জাতীয় পর্যায় ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গোচরীভূত হয়েছে। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম, খুন ও মানবাধিকার হরণের এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘কমিটি এগেইনস্ট টর্চার’-এর সভায় বাংলাদেশে সংঘটিত এসব ঘটনা প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশ বিগত ২৩ বছরে এই কমিটিতে নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করে নি। এছাড়াও এ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ও এর পর আরো একাধিকবার ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবারই তা উপেক্ষা করে গিয়েছে। বর্তমান সরকারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগকে এমন উপেক্ষা করার ফলাফল আমরা পেলাম স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে এসে। গত ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার হরণ, গুম, বিচার বহির্ভুত হত্যা ইত্যাদি অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ও ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের অবরোধ নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজিপি, র‍্যাবের ডিজিসহ সাত জন। প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‍্যাবও এই অবরোধের আওতায় পড়েছে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরাপর মিত্র রাষ্ট্রসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও অনুরূপ অবরোধের সম্ভাবনা থেকে যায়। কেবল তাই নয়, সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কর্তৃক আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায় নি। নির্বাচনি ব্যবস্থা বিনষ্টিকরণ, কর্তৃত্ববাদী শাসনতন্ত্র, দূর্নীতি-দুঃশাসন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশকে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয় নি বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিশীল রাষ্ট্রসমূহের এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত দেশসমূহের তালিকায় বাংলাদেশের না থাকা এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপর আরোপিত অবরোধ বিশ্বব্যপী বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সংকটে নিপতিত করবে বলেই প্রতীয়মান হয়।

বস্তুতঃ বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া মোটামুটি অনুমিতই ছিল। কারণ মানবাধিকার হরণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসনকে উপেক্ষার যে সংস্কৃতি এই সরকারের আমলে বিদ্যমান রয়েছে, তাতে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন সুযোগ ছিল না। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে চূড়ান্তভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের উপর বর্তমান সরকারের কঠোর সেন্সরশীপের কথা প্রায়ই আলোচনায় আসে। ‘গুড নিউজ’ সেকশন নামক অলিখিত একটা প্রকাশনা নীতি চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সরকারেরকৃত দূর্নীতি ও অপকর্মসমূহকে জনগণ থেকে আড়াল করে রাখা হয়। তথাপিও কোন সাংবাদিক বা সংবাদ মাধ্যম সাহস নিয়ে এগিয়ে এলেই তাকে ও তদীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। বর্তমান সরকারের আমলে সরকারের অপরাধচিত্র তুলে ধরার দায়ে একাধিক গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভিসহ দৈনিক আমার দেশের মত জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অসংখ্য সাংবাদিক, সম্পাদককে জেল-জুলুম ভোগ করতে হয়েছে; দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। প্রথিতযশা সাংবাদিক শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, আবুল আসাদকে কারাবরণ করতে হয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের নয় বছর কেটে গেলেও এর কোন সুরাহা হয় নি। বরং অন্ততঃ বারবার চার্জশীট দাখিলের তারিখ পেছানো হয়েছে।

গণমাধ্যমের উপর কঠোর নজরদারির মতই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও পদপিষ্ট করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহের উপর রয়েছে কঠোর নজরদারি। সরকারের বিরুদ্ধে কোন লেখালেখি করলেই তার উপর নেমে আসছে নির্যাতনের খড়গ। সরকারের এরূপ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নামক এক নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে জনগণের জান ও জবানকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম, অভিনেত্রী নওশাবা, লেখক মুশতাক, কার্টুনিস্ট কিশোরসহ বহুসংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ধর্মবেত্তা, শিক্ষক, ছাত্র এমনকি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও এই নিবর্তনমূলক আইনি নির্যাতন থেকে রেহাই পায় নি। স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে মসজিদসহ বিভিন্ন উপাসনালয়েও নজরদারি করা হয়েছে। মসজিদে জুমার নামাজের খুতবা প্রদানে সরকারি নীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

অবশ্য কেবল রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেই যে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মত দলন করেছে তা নয়। বরং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের রয়েছে দানবীয় ভূমিকা। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নোমানি হত্যার মাধ্যমে ছাত্রলীগ তাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এরপর গত ১৩ বছরে ছাত্রলীগের হাতে অপরাপর ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী, সাধারণ ছাত্র, এমনকি নিজ দলীয় কর্মীরাও রেহাই পায় নি। পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ সংগঠনের নেতা জুবায়ের হত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র আবু বকর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগেরই সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরি ও প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজীবসহ আরো অনেকের রক্তে রঞ্জিত হয় ছাত্রলীগের হাত। এছাড়া ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় বারো বছরের শিশু রাব্বি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন হাফিজুর মোল্লা; চোখ হারান এহসান রফিক। সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয় খাদিজাকে। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসেন খাদিজা। এমসি কলেজে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন এক নববধূ। আধিপত্যবাদ বিরোধী লেখালেখির অভিযোগে বুয়েটের ছাত্রাবাসে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে। আওয়ামী লীগ সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হওয়া ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, হত্যা, রাহাজানি যেন মুজিব শাসনামলের রক্ষী বাহিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মত জনস্বার্থমূলক যৌক্তিক আন্দোলনে ছাত্রলীগ তাদের সর্বস্ব দিয়ে সন্ত্রাসি হামলা চালিয়েছে। এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদেরকে জেলে পুরা হয়েছে; শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। কেবল ছাত্রলীগই নয়; বরং যুবলীগ, শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীদেরও এসব অন্যায়, অপকর্মে লিপ্ত হতে দেখা যায়। ২০১৮ সালের তথাকথিত জাতীয় নির্বাচনে কেবলমাত্র ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেয়ার অপরাধে নোয়াখালির সূবর্ণচরে স্বামীকে বেঁধে গৃহবধূকে ধর্ষণ করে ঐ এলাকার আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন। বগুড়ায় মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করে মা ও মেয়ে উভয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয় শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার। এসব ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। বিশ্বজিৎকে হত্যাকারিদের নিম্ন আদালত থেকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হলেও পরবর্তীতে তারা উচ্চ আদালত থেকে খালাস পেয়ে এখন আরাম আয়েশে জীবনযাপন করছে। তাই সদ্য ঘোষিত আবরার হত্যাকারীদের ফাঁসির আদেশ আসলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় যে এই রায় বদলে যাবে না, এ বিষয়ে সচেতন সমাজ নিশ্চিত হতে পারছে না। নারী নিপীড়ন এবং ধর্ষকামীতার এসব উদাহরণ যে কেবল এদের মাঝেই সীমিত তা নয়। বরং আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী এমপিদের মধ্যেও এসবের উদাহরণ মেলে। সম্প্রতি পদ হারানো আওয়ামী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসানের চিত্রনায়িকাকে ধর্ষণের হুমকি এবং সম্ভ্রান্ত নারীদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য জনগণের কাছে ধিকৃত হয়েছে। উক্ত মন্ত্রীর ফাঁস হওয়া কথোপকথন থেকে প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে চিত্রনায়িকাকে হুমকি দেয়ার কথা শুনা যায়। এসব কাণ্ড যেন আমাদেরকে পুনর্বার মুজিবের বাকশাল আমলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। টঙ্গীর মোজাম্মেলের ধর্ষণের এক ঘটনা ঐ সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এভাবে প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করে এবং প্রশাসনকে নানাভাবে বাধ্য করে সরকারদলীয় এমপি, মন্ত্রী ও অন্যান্য নেতাকর্মীরা অপরাধবৃত্তি করে বেড়াচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের অনৈতিকতার আরেকটি বিরাট দৃষ্টান্ত হচ্ছে ক্যাসিনো কাণ্ড। ২০১৯ সালে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতৃবৃন্দের নাম। যুবলীগ নেতা সম্রাটসহ অনেক এমপি, মন্ত্রী এবং আওয়ামী প্রভাব বলয়ে থাকা ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নামে চাঞ্চল্যকর ঘটনাসমূহ প্রকাশ পেতে শুরু করে। একইভাবে মাদক ও নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে অনেক সাংসদ ও আওয়ামী নেতাদের নাম। কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির বিশাল ইয়াবা সাম্রাজ্য আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। এছাড়াও পাপিয়া নামক এক নারী সরবরাহকারীর খদ্দের তালিকায় উঠে আসে অনেক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও আমলা, ব্যবসায়ীদের নাম। এভাবেই এসব সমাজবিরোধী কীর্তিকলাপের মাধ্যমে বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করেছে বর্তমান সরকার; সুস্থ ধারার রাজনীতির বিকাশের পথকে রুদ্ধ করা হয়েছে। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রামাণ্য তথ্যচিত্রে শেখ হাসিনার শাসনামলে তার ছত্রছায়ায় প্রশাসন, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে কিভাবে একটি জনগণের রাষ্ট্র মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

অনৈতিকতা, লুটপাট, হত্যা, রাহাজানি ছাড়াও বর্তমান সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ালেও রাজনৈতিক কার্ড হিসেবে সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে সুফল ভোগ করছে তারা। আওয়ামী লীগ শাসনামলের সর্বশেষ ১৩ বছরে যশোরের অভয়নগর, কক্সবাজারের রামু, সুনামগঞ্জের শাল্লা, ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং সর্বশেষ কুমিল্লায় মন্দিরে কুরআনের অবমাননাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালি, ফেনী, রংপুরসহ দেশের একাদিক স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় প্রশাসনের তাৎক্ষণিক তৎপরতার পরিবর্তে নির্লিপ্ত থাকার কারণে জনমনে এর পেছনে সুবিধাভোগী কুশীলবের ধারণা শক্ত হয়। এমনকি এসব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। তথাপিও এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। উপরন্তু এদের অনেককে দলীয়ভাবে পুরষ্কৃতও করা হয়। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের উপর হামলায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা তিনজনকে সম্প্রতি ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। সম্প্রতি কুমিল্লায় কুরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরে মন্দিরে হামলায় স্থানীয় হাজীগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের হৃদয় নামক একজনকে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু পল্লীতে হামলায় কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈকত মণ্ডলের প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। হিন্দু মহাজোটের সভাপতি গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের এক বক্তব্যে কুমিল্লার ঘটনার সাথে স্থানীয় সাংসদ আকম বাহারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সরকারি মদদে দলীয় লোকদের দ্বারা কিংবা প্রশাসনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার ইস্যু তৈরি করে সহিংসতার সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে। শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশে নিছক রাজনৈতিক ফায়দা উদ্ধারের বশে এভাবে সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা সাম্য প্রতিষ্ঠার আকঙ্ক্ষাকে কলুষিত করা হয়েছে।

আওয়ামী রাজনীতির আরেকটি কার্ড হচ্ছে ‘জঙ্গীবাদ’। প্রতিবারই নির্বাচন এলে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জিগির তুলে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ও তার জোট বিগত তেরো বছরে জঙ্গীবাদ মোকাবিলায় ব্যর্থতার নজির স্থাপন করেছে। এ সরকারের আমলেই ২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গী হামলায় ১৭ জন বিদেশি নাগরিক সহ মোট ২৯ জন নিহত হয়। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানেও জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়াও ২০১৫ সালে দেশব্যপী সিরিজ ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটে। কিন্তু সরকার এসব হামলা নিরোধে পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থতা দেখিয়েছে। উপরন্তু ক্রসফায়ারের নামে একাধিক অভিযানে সন্দেহভাজন জঙ্গীদের হত্যার মাধ্যমে হামলার ব্লু প্রিন্ট নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। অন্যদিকে প্রকৃত কুশীলবদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এর শিক্ষক, ছাত্রদের উপর দোষ চাপানো হয়। এর মাধ্যমে এক ধরণের সামাজিক বিদ্বেষ ও সন্দেহপ্রবণতার সৃষ্টি হয়, যার ফলে সমাজে মানবিক মর্যাদা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলেও দেশে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। যশোরে উদিচীর অনুষ্ঠানে হামলা, সিপিবি’র সমাবেশে হামলা এবং রমনার বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তৎকালীন সরকার এসব ঘটনার কোন সুষ্ঠু সুরাহা করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী ধারাক্রমে চারদলীয় জোট সরকার আমলেও ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা, ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু তৎকালীন সরকার এসব হামলার মোটিভ উদ্ধারে কৃতকার্যতা প্রমাণ করে। দুর্ধর্ষ জঙ্গী শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ অন্যান্যদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করে। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত মুফতি হান্নানকেও তৎকালীন সরকার গ্রেফতার করে। কিন্তু বর্তমান সরকার মুফতি হান্নানকে অন্য মামলায় তরিঘড়ি ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করে ২১শে আগস্ট হামলা মামলার প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে সচেষ্ট হয়। অতঃপর এ মামলাকে একটি রাজনৈতিক কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপি’র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ  মামলায় অভিযুক্ত করে। এভাবেই আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তিসমূহ সংবেদনশীল ইস্যুসমূহ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদের মত ইস্যুসমূহের রাজনীতিকরণের মাধ্যমে দেশে ‘রুল এন্ড ডিভাইড’ পলিসি প্রতিষ্ঠা করে এর রাজনৈতিক সুফল ভোগ করে চলছে। অথচ প্রয়োজন ছিল এসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করার।

আওয়ামী লীগ সরকার যে কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুসমূহেই নিজেদের ব্যর্থতা ও দুর্বৃত্তপনার স্বাক্ষর রেখেছে তা নয়; বরং আমরা দেখি, কূটনৈতিক অঙ্গনেও সে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। সীমান্ত হত্যা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রকাশিত ‘Human Rights Violation by Indian Border Security Force (BSF) against Bangladeshi citizens’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান শাসনামলে ২০০৯-২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অন্ততঃ ৫০৬ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত হত্যার এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানির লাশ। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তের কাঁটাতারের সাথে ১৫ বছর বয়সী ফেলানির লাশ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু বর্তমান সরকার ফেলানি সহ এসব সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফোরামে ন্যুনতম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নি। ক্ষমতা প্রলম্বিত করার মানসে বর্তমান সরকারের এই কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌম মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। নয় মাসব্যপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যে প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, বর্তমান সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আমাদের সে প্রত্যাশাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে।

বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতিগত দুর্বলতার আরেকটি উদাহরণ রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে ব্যর্থতা। ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট তারিখে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ঢল নামে। রাখাইন প্রদেশের এসব মুসলিম অধিবাসীরা মায়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক ভূমি থেকে উচ্ছেদ, চলাফেরার স্বাধীনতা হরণসহ খুন, ধর্ষণের মতো চরম সহিংসতার হয়। ফলে দুই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাৎক্ষণিক আশ্রয় প্রদানে সরকার গড়িমসি দেখালেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যহত চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সঠিক কূটনীতির অভাবে বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত এসব রোহিঙ্গাদেরকে তাদের স্বভূমে প্রত্যাবাসিত করার সাফল্য দেখাতে পারে নি বর্তমান সরকার। বরং নিজেদের বহিরাগত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মিত্রদের কাছে কোণঠাসা সরকার এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে সাহস পর্যন্ত দেখাচ্ছে না। অথচ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ অভিমুখে শরণার্থী হবার এ ঘটনা এটিই প্রথম নয়। বরং এর আগেও ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকারের সাহসী ও স্বাধীন কূটনৈতিক ভূমিকার মাধ্যমে সে সময় রোহিঙ্গাদের সফল প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সফলতা দেখিয়েছিল। খালেদা জিয়া সরকারের সময়েও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তৎকালীন সরকারের শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে এ বিষয়ে আশাতীত সাফল্য এসেছে। অথচ বর্তমান সরকারের সামনে এসব সফল কূটনৈতিক দৃষ্টান্ত থাকা সাপেক্ষেও তারা কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারছে না।

আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জোরপূর্বক চিরদিন ক্ষমতায় থাকা এবং একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদগ্র ও গণবিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্ত ও স্বৈরশাসনের কারণে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ভূলুণ্ঠিত। যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এদেশের মানুষ দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন এক দলীয় শাসনের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত। যে মহান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন তিনি আজ কারারুদ্ধ। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তিতে যখন প্রত্যাশা ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি ও ঐক্যবদ্ধ উদযাপন, সেখানে চরম হতাশা নিয়ে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে একটি বিভক্ত সমাজ নিয়ে। কেবল ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জীঘাংসামূলক বাসনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যয়বিচারের অঙ্গীকারকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাণিজ্যিকিকরণের মাধ্যমে মানুষের মনন থেকে প্রকৃত দেশপ্রেমের চেতনাকে ফিকে করে দেয়ার অপচেষ্টা বর্তমান রয়েছে। মানুষে মানুষে বিভেদ, লুণ্ঠনের রাজনীতি, সেবাখাতসমূহে দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এসবই যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। মানবাধিকার হরণ, নির্বাচনি ব্যবস্থার অবলুপ্তি, গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ হয়ে পড়ছে বন্ধুহীন। যদিও ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী- আমলাদের মুখে উন্নয়নের প্রগলভতা শুনা যায়, কিন্তু বাস্তব অবস্থা তার বিপরীত। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারি মানুষের সংখ্যা দুই কোটি চল্লিশ লাখ। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ১১৭ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮ তম। অতএব মুখে যে উন্নয়নের মহাসড়কে চলার কথা বলা হয়, তা কেবলই ফাঁপা বুলি। বাস্তবে বাংলাদেশ চলছে উল্টো রথে। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে এসে যখন ন্যয়ভিত্তিক সমাজ, টেকসই উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি; সেখানে বাংলাদেশ যেন ক্রমেই ফিরে যাচ্ছে পঁচাত্তর পূর্ববর্তি সেই দিনগুলোতে। তবুও বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আদর্শে উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ এখনো প্রত্যাশা করে, এদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির হাত ধরেই বাংলাদেশ পুনর্বার ফিরবে তার প্রকৃত লক্ষ্যের পথ্র। আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির আগামীদিনের ভরসাস্থল জনাব তারেক রহমানের হাত ধরেই এদেশে আবার এগিয়ে যাবে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরে।   

— 

ড. মোর্শেদ হাসান খান, অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহসম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি

ফারহান আরিফ সাবেক শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, আহবায়ক কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল


No comments:

Post a Comment