Search

Sunday, August 14, 2022

জনগণকে হাত-পা বেঁধে যেন মাঝনদীতে ফেলে দেওয়া হলো

— শাহানা হুদা রঞ্জনা



বড় ধরনের একটা ঝড় আসবে আসবে বলে আশংকা করছিলাম। ঝড়টা এসেই গেল মনে হচ্ছে। এই ঝড় প্রতিহত করার ক্ষমতা আমাদের নেই সত্যি। কিন্তু ঝড়ের প্রভাব থেকে আমরা কিভাবে বাঁচবো এরও কোন নির্দেশনা নেই, নেই অগ্রিম সতর্কবার্তা ও আপদকালীন পরামর্শ। ফলত যা হওয়ার তাই হবে। অর্থনীতির এই ঝড়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়বে সাধারণ মানুষ। বিপর্যস্ত হবে তাদের জীবনব্যবস্থা।

প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, যারা শক্তিশালী তারা টিকে থাকবে। কিন্তু আর্থিকভাবে এই শক্তিশালী মানুষ আসলে কতজন। একটি দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে টেনেটুনে হয়তোবা শতকরা ১০ জন। বাকি ৯০ শতাংশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই অর্থনৈতিক ঝড়টা শুরু হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর, যেদিন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন হলো, ঠিক সেদিনই জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলে বসলেন, "আামি প্রাইস বাড়াচ্ছি কারণ আমার দেউলিয়াত্ব থেকে আমি বাঁচতে চাই।"

দাম বাড়িয়ে উনি না হয় বাঁচলেন কিন্তু জনগণের কি হবে? সবার মনে এখন একই প্রশ্ন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমতির দিকে, তখন বাংলাদেশে দাম এতটা বৃদ্ধি করা হলো কেন? জনগণ কি পারবে এই ভার বহন করতে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, "মানুষের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানো হলো। মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকলে জ্বালানি তেলের মূল্য এতটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না।"

তিনি আরো বলেছেন, "বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। আর এই যে সমন্বয়ের কথা ওনারা বারবার বলেন, কিন্তু তেলের দাম যখন দীর্ঘদিন ধরে অনেক কম ছিল আমরা তো কম দামে তেল কিনিনি। ওই টাকা যদি হিসাব করা হয়, তাহলে লাভের কত টাকা জমা আছে বিপিসির কাছে। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সেই টাকাটা কি সমন্বয় করা যায় না?"

গত ২৭ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, "অকটেন এবং পেট্রল কিন্তু আমাদের কিনতে হয় না। এটা আমরা যে গ্যাস উত্তোলন করি, সেখান থেকে বাই প্রডাক্ট হিসেবে পেট্রল ও অকটেন পাই। বরং আমাদের যতটুকু চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি পেট্রল ও অকটেন আমাদের আছে। আমরা অনেক সময় বাইরে বিক্রিও করি", তখন দারুণ একটা স্বস্তিবোধ করেছিলাম। তাহলে গোলটা বাঁধলো কোথায়? সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা জানতে চাইছি এই কয়দিনে কী এমন ঘটলো যে প্রধানমন্ত্রীর কথাও রাখা গেল না?

সাধারণ মানুষ এত হিসাব-নিকাশ বুঝে না। শুধু দু'বেলা ডাল ভাত খেয়ে, পরিবার নিয়ে নিরাপত্তার মধ্যে বাঁচতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে যখন অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো হলো তেলের দাম, তখন মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোনো প্রস্তুতি নেই, নেই কোন আলোচনা বা আগাম সতর্কতা।

সরকার কি জানেনা নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা আর্থিকভাবে কতটা সংকটপূর্ণ, সেটা তো সরকারের বিবেচনায় থাকা দরকার ছিল। কিন্তু, তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তাতে মনে হয় না যে তাদের এই বিবেচনাটা খুব একটা আছে। বলা যায়, জনগণকে হাত-পা বেঁধে মাঝ নদীতে ফেলে দেয়ার মতো অবস্থা হলো। এটা কোনো বিবেচনাতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং হঠকারি সিদ্ধান্ত বলা যায়।

এই আপদকালীন সময়ে সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বললেন, "আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার বিষ গিললো।" কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো বুঝতে হবে এই বিষ দেশের জনগণ গিললো। আইএমএফ এর লোন কেন দরকার, কোথায় খরচ হবে, কিভাবে খরচ করবে, সুদ কত, সরকার কিভাবে-কতদিনে সুদ মেটাবে, জনগণকে কতটা বহন করতে হবে--- এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করা দরকার সরকারকেই, কারণ তা না হলে মেনন সাহেবের বিষ গেলার কথাটাই সত্য বলে ধরে নিতে পারে বিপদগ্রস্ত জনগণ।

এমনিতেই বাংলাদেশ কি শ্রীলংকা হবে, নাকি ইউক্রেন হবে এসব চিন্তাভাবনা, হাস্যরস, আশংকা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিলই। সরকার নানাভাবে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। কখনো কখনো প্রকৃত পরিস্থিতি গোপন করে হলেও তারা ভেবেছে জনগণকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যখন বলে বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা এবং দ্রুত খালি হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ শ্রীলংকাকে দ্রুত অস্থির করে তুলছে, তখন তো আইএমএফ লোন নিয়ে সাধারণ মানুষ ভয় পাবেই।

মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, শিশুখাদ্যের অস্বাভাবিক দাম সবকিছুকে এড়ানো সম্ভব হলেও ডলারের অনিয়ন্ত্রিত বাজার, গ্যাস সংকট, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং সর্বশেষ জ্বালানির প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে একেবারে পেরেশান করে তুলেছে। এরমধ্যে সরকারের মন্ত্রী, এমপি মহোদয়রা এতটাই অপ্রাসঙ্গিক বাণী দিয়ে চলেছেন, যা মানুষকে বিরক্ত করছে বহুগুণ।

আমি নিশ্চিত যে শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ শোনার পর অনেক মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে কাটাতে বাধ্য হবেন। যাদের উপর পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব, তারা রাত জেগে খামোখাই আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে গেছেন, যে হিসাব আসলে আর মিলবে না।

তারা জানেন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তেল, নুন, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে বাস-রিকশা, বাড়িভাড়া সব বেড়ে যাবে। বেড়েছে এবং আরো বাড়বে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের বিল। শিক্ষা ব্যয় বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। আমাদের মতো নির্ধারিত আয়ের মানুষের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো বাজারে সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়বে, আমার আয় বাড়বে না কিন্তু আমাকে খরচ কমাতে হবে।

আমরা অনেকেই ১৯৭৪ সালের পর অর্থনীতির এত বিপর্যয় দেখিনি। এবার যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এরকম বড় আরো একটি ধাক্কা দেশের অর্থনীতিকে একেবারে পঙ্গু করে দিতে পারে বলে অনেকেই আশংকা করছেন।

মানুষের চোখের সামনে শ্রীলংকা ও পাকিস্তান মন্দ অর্থনীতির উদাহরণ হিসেবে খাড়া হয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছে। এতবড় একটা ঋণের বোঝা কিভাবে বাংলাদেশ শোধ করবে, সেটা নিয়েও মানুষ চিন্তিত।

একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সংকোচন ও মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে সরকারের অপরিমিত ব্যয়, দুর্বল ব্যাংকিং নীতি, অর্থনীতিবিদদের কথা অবজ্ঞা করা, কালো টাকা হালালীকরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বিলাসব্যসন, ভর্তুকি ব্যবস্থা, বিদেশ ভ্রমণ, অ-দরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীন আমদানি নীতি, করোনাকালীন ক্ষয়ক্ষতি এবং জনগণের আয়-ব্যয় এর কথা না ভাবা সব বিরূপ প্রভাব ফেলেছে অর্থনীতির উপর।

করোনার পর অর্থনীতিতে এত বড় ঝড় দেখে সবারই একটা আশংকা তৈরি হয়েছে যে আবার কি আমাদের কাজের জায়গা ছেড়ে, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে, শহরের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে হবে আশ্রয়ের জন্য? সংসার খরচ, সন্তানের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, বিল, গাড়িভাড়া, ওষুধ, বাবা-মায়ের খরচ সব নির্ভর করে চাকরির বেতনের উপর বা নির্ধারিত আয়ের উপর। আয়ের পথ রুদ্ধ হলে, স্থানীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হলে, কীভাবে চলবে সংসার?

সাম্প্রতিক গণশুমারি অনুযায়ী ঢাকাতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সাড়ে চার কোটি। অনেকের ধারণা তা পাঁচ কোটি হবে। সে যাই হোক, এই মানুষগুলোর অর্ধেকও যদি বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে না পেরে আবার গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, তখন বিপর্যয়টা কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে, তা সহজেই অনুমেয়।

আবার যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হচ্ছে, এর মধ্যে সাধারণ মানুষ বাঁচবে কেমন করে? শুধু যে দরিদ্র মানুষের গায়ে এই মন্দার তাপ লাগবে, তা নয়। তাপ লাগবে মধ্যবিত্তর জীবনে। শুধু আর্থিক বিপর্যয় নয়, মানসিক বিপর্যয়ও সমাজ ও দেশকে অস্থির করে তুলবে।

কৃষকরা প্রথম ধাক্কা খেয়েছেন সেচের জন্য বিদ্যুৎ না পেয়ে, অনাবৃষ্টিতে ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। কিছুদিন আগে কয়েকটি জেলায় হয়ে গেল বন্যা, বেড়েছে সারের দাম। এখন আরো বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। ডিজেলের দামের সাথে অনেককিছুর মূল্যবৃদ্ধি জড়িত। এই মূল্যবৃদ্ধি গ্রাম ও শহরের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছিল সেই করোনাকাল থেকেই, এবার মনে হয় সত্যি গিলে ফেলবে।

আমরা শুধু অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে ভাবছি কিন্তু সমাজের উপর এর প্রভাব হবে আরো অনেক ভয়াবহ। অর্থকষ্ট, শিক্ষার সুযোগ কমে যাওয়া, জীবন চালাতে না পারা, চাকরি হারানো, উপার্জনের সুযোগ না থাকার মতো বিষয়গুলো সমাজে বাড়াবে খুন, জখম, আত্মহত্যা, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, হতাশা, মাদক গ্রহণ এবং শারীরিক অসুস্থতা।

সামাজিক অস্থিরতা ও মানবিক হতাশা এমন বিষয় যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফিরে এলেও শান্তি ফিরিয়ে আনাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সময়ে যে লাগামটা আমাদের টেনে ধরার দরকার ছিল, তা আমরা টেনে ধরতে পারিনি। তাই আন্তর্জাতিক অচলাবস্থা আমাদের যতোটা না ঘায়েল করবে, এর চেয়েও আমরা নিজেদের বেশি ক্ষতি করবো হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে।

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

No comments:

Post a Comment