Search

Thursday, October 17, 2024

তারেক রহমানের রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা

 

গণবিপ্লবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিণত হয়েছেন দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দেশ এখন তাঁর দিকেই তাকিয়ে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি যে ক্ষমতায় আসবে, তা সবাই বুঝতে পারছে। তারেক রহমান হবেন রাষ্ট্র নায়ক। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিএনপি এখন রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ে রয়েছে। মানুষের মাথার উপর ছায়া হয়ে রয়েছে। আর এই ছায়ার উৎস হচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হতে পারে। তাঁর বক্তব্যগুলো নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে, কলাম লেখা হচ্ছে। মানুষ অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তাঁর প্রত্যেকটি কথায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির প্রচার স¤পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেছেন, তারেক রহমানের নির্দেশনায় ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ আমরা সবাই মানুষের পাশে থাকার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। এর মাধ্যমে বিএনপি রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তন এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে। তারেক রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বে, বিএনপি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গড়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিএনপির নেতাকর্মীরা মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, মানুষকে অভয় দিচ্ছেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে যাচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদের মনের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপরেখা মানুষের কাছে তুলে ধরছেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগাচ্ছেন। বিএনপির যেকোনো কর্মসূচি শেষে এখন রাস্তাঘাট, সমাবেশের স্থল পরিষ্কার করা হয়। এই পরিবর্তনের কারিগর তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, আমরা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। এখন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেনেন, বিএনপির প্রত্যাশা রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। তারেক রহমানের উক্তিটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি ¯পষ্ট সংকল্প ব্যক্ত করে, যেখানে তিনি জনগণের প্রত্যাশা ও ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বের মূল ভিত্তি হচ্ছে, একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। এ কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম চলমান, তা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রয়াস নয়, বরং একটি জাতীয় দায়িত্ব। এই দৃঢ় অবস্থান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণের জন্য তাঁর অঙ্গীকারকে প্রমাণ করে। তারেক রহমানের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, দলের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সততার জোরালো আহ্বান। তিনি ¯পষ্ট করেছেন, যদি কেউ বিএনপির নাম ভাঙিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়, তাহলে তার বিরুদ্ধ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থান দলের শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার প্রতীক। ইতিমধ্যেই বিএনপির উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতাকর্মী শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে, বিএনপি শুধু রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়, বরং জনগণের আশা ও আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে চায়। এই প্রক্রিয়ায়, তিনি একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং বৈষম্যহীন ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, যা আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও উদ্বেগজনক। কিন্তু তারেক রহমানের নির্দেশনা সমগ্র জাতির জন্য একটি শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে উঠেছে। তিনি সবসময় বিএনপির নেতাকর্মীদেরকে সাহস ও মানসিকতা বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন, যা সংগ্রামের এই সময়ে একান্ত প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর যে হামলা, মামলা এবং শারীরিক নির্যাতন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তারেক রহমানের সাহসিকতা নেতাকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছেন এবং তাঁর নেতৃত্বে দলটি কেবল রাজনৈতিক লড়াই নয়, বরং মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য একটি সংগ্রামী অবস্থান গ্রহণ করছে। সংকটময় সময়ে, তারেক রহমানের নেতৃত্ব জাতির জন্য আশার প্রদীপ হয়ে রয়েছে, যা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি বলেছেন, স্বৈরাচারের দোসররা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাঁর এই বক্তব্য বাস্তবসম্মত। কারণ, ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এ প্রেক্ষিতে, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি যে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে, তা সাধুবাদযোগ্য।

শুধু কথায় নয়, কাজেও তারেক রহমান প্রমাণ করেছেন, তিনি একজন প্রকৃত নেতা। তিনি যে পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরছেন, সেগুলো বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আবশ্যক। তার ফ্যামিলি কার্ডের ধারণা, রপ্তানিমুখী কৃষির উন্নয়ন এবং জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর। তারেক রহমান যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের বিরুদ্ধে করা কার্টুন শেয়ার করেন, তখন তিনি যে সমালোচনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন, তার নজির। একজন নেতা হিসাবে, তিনি নিজের প্রতি উঁচু মানসিকতা বজায় রাখছেন এবং সমালোচনাকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই সহিষ্ণু মনোভাব বাংলাদেশের জনগণ ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করছে। জনগণ যখন দেখে, তাদের নেতা সমালোচনা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ভয় পান না, তখন তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সংহতি সৃষ্টি হয়।

অনেকেই বলেন, একটি দেশ একবারই স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতা বেহাত হয়ে যাওয়ার পরে সেই স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য গণবিপ্লবের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা এসেছে, তা কি দ্বিতীয় স্বাধীনতা নয়? অবশ্যই দ্বিতীয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মানুষ এখন নতুন এক রাজনীতির স্বাদ পাচ্ছে। তারা ভোটাধিকার ফিরে পেতে চাচ্ছে। স্বৈরাচার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের একটিতেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়নি। মানুষ এখন ভোট দিতে চায়, সেই ভোটের মাধ্যমে মানুষ ক্ষমতায় আনবে তাদের সরকার, যারা দেশের মানুষের কথা বলবে। তাদের এই আশার প্রতীক তারেক রহমান। মানুষ যেমন আশা করে, সে হয়তো পুরোপুরি জানে না। কিন্তু মানুষ যা চায়, তা তারেক রহমান জানেন। তিনি কতদূর ভেবেছেন, তা হয়ত আমরা ভাবতে পারছি না। তিনি শুধু তাঁর দলের নেতাকর্মীকে বলেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন নতুন উদ্দীপনা। সারাদেশে নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়ে মানুষের আস্থা ধরে রেখেছেন। তিনি যে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলছেন, সেই এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরছেন।


আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সফল্য আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই সরকার ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হবে বাংলাদেশ, এটা অনুভব করেছেন তারেক রহমান। এই সরকার ব্যর্থ হলে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান ঘটবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরন্তর সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তারেক রহমান বলেছেন, ধর্ম যার যার নিরাপত্তা পাবার অধিকার সবার। স্বাধীন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর এই চিন্তা সার্বজনীন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকার মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা, গৃহ নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা কাজ করছেন। এমনভাবে তিনি কাজগুলো করেছেন, যা দলের অনেক নেতাকর্মীও জানে না।

তারেক রহমানের রাষ্ট্রচিন্তা অতুলনীয়। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, জাতীয় সরকার গঠন, এক ব্যক্তির দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া আমাদের দেশের জন্য নতুন ভাবনা। এই ভাবনা নিয়ে তিনি নিরন্তর কাজ করছেন। মানুষের কাছে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার চিন্তা তিনিই করছেন। তিনি একটি বিখ্যাত শ্লোগান দিয়েছিলেন, ‘টেইক ব্যাক বাংলাদেশ’, যা জনগণকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার কবল থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। ফলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠছেন তিনি, যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং সমৃদ্ধির পথ সুরক্ষিত থাকবে।


লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

বিএনপি কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা





১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান কর্তৃক জাতির সামনে উপস্থাপিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা —

১. জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন।

২. সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্রসত্ত্বা (Rainbow-Nation) ও 'জাতীয় সমন্বয় কমিশন ('National Reconciliation commission') গঠন।

৩. অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন।

8. আইনসভা, মন্ত্রীসভা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিচার বিভাগের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা।

৫.  প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা অনুর্ধ্ব পরপর দুই মেয়াদ নির্ধারন।

৬. বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইন সভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন।

৭. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন।

৮. নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধন।

৯. স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরনে সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করন।

১০. বর্তমান বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন ও সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন।

১১. গণমুখী ও জনকল্যাণমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন।

১২. মিডিয়া কমিশন গঠন করে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।

১৩. দূর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ।

১৪. সর্বস্তরে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা।

১৫. আত্মত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন।

১৬. ধর্মীয় স্বাধীনতার সর্বোচ্চ ও কার্যকর নিশ্চয়তা প্রদান।

১৭. মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির আলোকে শ্রমজীবি মানুষের ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত করা।

১৮. প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং নবায়নযোগ্য ও মিশ্র জ্বালানী ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ খাত আধুনিকায়ন।

১৯. জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন।

২০. প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধিকতর আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা।

২১. প্রশাসন ও সেবা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলি স্বশাসিত ও ক্ষমতাবান করা।

২২. শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান। 

২৩. কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বেকার ভাতা প্রবর্তন।

২৪. নারীর মর্যাদা সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ।

২৫. চাহিদা ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা।

২৬. "সবার জন্য স্বাস্থ্য" এবং "সার্বজনীন চিকিৎসা"ব্যবস্থা

কার্যকর করা। প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ পল্লী স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা করা এবং সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত করা।

২৭. কৃষকের উৎপাদন ও বিপণন সুরক্ষা দিয়ে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

২৮. সড়ক, রেল, নৌ পথের আধুনিকায়ন ও বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।

২৯. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ এবং নদী শাসন ও খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৩০. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং আণবিক শক্তির উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।

৩১. যুগোপযোগী, পরিকল্পিত, পরিবেশ বান্ধব আবাসন এবং নগরায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। 

বিচার বিভাগে দুর্নীতির দানব - পরিত্রাণের পথ শহীদ জিয়ার ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’

 


১৯৭৮ সালে অধ্যাদেশ বলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিচারপতি অপসারণে গঠন করেছিলেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’। দূরদর্শী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এ সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করতে সংবিধানের ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে কৌশলে অচল করে রাখে। দেড় দশকের মাফিয়াতন্ত্রে বিচার বিভাগকে পদানত রাখতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অচল করে রাখে এই কাউন্সিল। এ জন্য বন্দুকটিও রাখে আদালতের ঘাড়েই। হাসিনার দলীয় আনুগত্য স্বীকার করা বিচারাঙ্গনকে দুর্নীতির দানবে পরিণত হয়। সেই দানবকে বশে রাখার কোনো হাতিয়ারই অবশিষ্ট রাখা হয়নি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ বিচার বিভাগ সংস্কারের অনিবার্যতায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রণীত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’।


এ কাউন্সিল পুনঃজীবীতকরণের মধ্যেই বিশ্লেষকরা খুঁজছেন বিচার বিভাগকে দুর্নীতির রাহুমুক্তকরণের পথরেখা। জাতির এই সন্ধিক্ষণে তারা এখন বিচার বিভাগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানকে স্মরণ করছেন অকুণ্ঠভাবে। একইসঙ্গে ঘৃণাভরে স্মরণ করছে সদ্য উৎখাত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কথিত ‘বিচার-ব্যবস্থা’কে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে বাতিল করে দেয়া হয়। ২০১৭ সালে এ আদেশ দেন শেখ হাসিনার অনুগত তৎকালীন বিচারপতিগণ। এ রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্য আপিলও করেন শেখ হাসিনা। ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’ মঞ্চস্থ করার জন্য হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগে। এতে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ‘নন-ফাংশানাল’ হয়ে পড়ে। পরে ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করে সরকারপক্ষ। এতে গত ৭ বছর ধরে দেশে বিচারপতিদের অপসারণ করার মতো কোনো আইনি পদ্ধতিই বহাল নেই।


বিদ্যমান পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে গত ১৫ আগস্ট রিটকারী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আবেদন করেন। আদালতে তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে রয়েছে। এটির শুনানি হওয়া প্রয়োজন। পরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগীয় বেঞ্চ শুনানি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২০ অক্টোবর শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়।


এর আগে গতবছর ২৩ নভেম্বর বহুল আলোচিত বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ শুনানি ৬ জন বিচারপতি গ্রহণ করতে পারবেন সিদ্ধান্ত দেন তৎকালীন আপিল বিভাগ। তবে রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য একাধিকবার কার্যতালিকায় এলেও শুনানিতে আগ্রহ দেখায়নি শেখ হাসিনার সরকার।


২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়। সরকারপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চায়।


এর আগে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)র নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন। ওই বছর ৮ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়। এতে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন দশ সিনিয়র আইনজীবী। তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অন্যদের মধ্যে অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম. কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মতামত দেন।


এর আগে ২০১৬ সালের ৫মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংবিধানের ‘ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ’ বলে রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে এমপিগণ ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে এমপিদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে এমপিদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।


হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হয়। যা ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।

সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর ৫ নভেম্বর রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

১৯৭৫সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার। ১৯৭৮ সালে তিনি এক সামরিক ফরমানে গঠন করেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে এই ক্ষমতা দেন। তার সময়ই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে স্থান পায়।


সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারে বহাল থাকে। ওই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে। এতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা চলে যায় জাতীয় সংসদের হাতে। ওই বছর ৫ নভেম্বর ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ১০ আইনজীবীর পক্ষে রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।


যে প্রক্রিয়ায় বিচারপতি অপসারণ করে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ : কি প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারপতিকে অপসারণ করে-জানতে চাইলে রিটকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, কানো বিচারপতির অদক্ষতা, দুর্নীতি বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে প্রধান বিচারপতিকে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করতে বলবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিলে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিসহ মোট তিন সদস্যের কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলই অভিযোগের তদন্ত করবে। শুনানি নেবে। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে কমিশন। এরপর তারা সিদ্ধান্ত দেবেন যে, অভিযোগটি সঠিক কি না। পরে প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে ওই বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। সর্বশেষ ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার আমলে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে অভিশংসন করেছিলো। এসএম শাহিদুর রহমান সুপ্রিমকোর্ট বারের নেতৃত্বে ছিলেন। এ সময় তার বিরুদ্ধে বারের তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। তা সত্ত্বেও ২০০৩ সালের এপ্রিলে তাকে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। তার নিয়োগের বিরোধিতা করেন সুপ্রিমকোর্ট বারের আওয়ামীলীগপন্থি আইনজীবীরা। তার নিয়োগের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে আ’লীগ। বিচার বিভাগে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। এ সময় সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তিনি এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ তখন এসএম শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে জামিনের জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনেন। অভিযোগ তদন্তে গঠিত হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খন্দকার মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে কাউন্সিল অভিযোগ তদন্ত করে। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি কাউন্সিল প্রতিবেদন জমা দেয়। কাউন্সিলের সুপারিশ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সম্মতিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তিনি রিট করেন। হাইকোর্ট তার অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করেন। পরে সৈয়দ জে.আর. মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। পরবর্তীতে আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির প্যানেল ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি শাহিদুর রহমানের অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। এভাবেই ইতি ঘটে বিচারপতি এসএম শাহিদুর রহমানের ‘বিচারপতি’ পরিচয়।


স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতিসত্তা বিনির্মাণে শহীদ জিয়ার ঐতিহাসিক অবদান

প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান



শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রাম, গর্ব-অহঙ্কার আর স্বাধীকার আন্দোলনের মাস মার্চ। এই মাসেই সূচনা হয় আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের। যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের ৭ কোটি মানুষের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। পৃথিবীর বুকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি নতুন ভূখন্ড স্বীকৃতি পায় প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নামে।


স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানের বিষয়ে বিষদ আলোচনার আগে স্বল্প পরিসরে হলেও তার ব্যক্তিগত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়। ১৯৫২ সালে তিনি করাচি একাডেমি স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচিতে ডি. জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারী একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। করাচিতে দু’বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। একই বছর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন।


১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।


তিনি বলেন — This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, here by declared that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temporary Head of the Republic. I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours.


দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল সবুজের পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে দেশ যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিপতিত তখন জিয়াউর রহমান আবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন।


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির মধ্যদিয়ে তিনি গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের আশা আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাদপিঠে আসীন করে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন সরকার সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। বাকশাল প্রবর্তনে রুষ্ঠ সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে ব্যাকুল ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিয়াউর রহমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গণমাধ্যমের উপর থেকে সকল কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন।


একটি রাজনৈতিক সরকার যেখানে সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছিল তখন জাতির প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী থেকে আসা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিক স্বাধীনতার অন্যতম মূলস্তম্ভ বহুদলীয় গণতন্ত্র জাতিকে উপহার দিয়ে মুক্ত গনতান্ত্রিক চর্চার পথকে সুগম করেছিলেন। শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান এ কারণেই সবার থেকে আলাদা ছিলেন।


জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি তার যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, সততা ও ন্যায় পরায়ণতা দিয়ে সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় দেশের প্রায় প্রতিটি ক্রান্তিকালে অসামন্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে দেশ গঠনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃতজ্ঞজাতি আজও তার আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সততার মাপকাঠিতে তিনি আজও অনন্য ও অদ্বিতীয়। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েই দেশের চলমান অবনতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেন। শক্তহাতে চুরি, ডাকাতি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসে।


স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ—অফ—স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশারফ এর নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে । তারপর গোটা জাতি আবার আতংকিত হয়ে পড়ে তৎ পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান কে বন্দি করলে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেইনি এবং জনগণ আবারো দুঃশাসনের আশঙ্কা করেন তাই সিপাহী এবং জনতা মিলে বন্দীদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করে দেশের দায়িত্বভার তুলে দেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ—প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।


জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল অবস্থানের প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন “ I will make politics difficult for the politicians”.


১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ—সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।


লেখক:

প্রফেসর ড: মোর্শেদ হাসান খান

মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ইউট্যাব

দেশ-মাতৃকার কল্যাণে আজন্ম ছুটে চলা এক উত্তাল নদীর নাম বিএনপি

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান



একটি নতুন সময়, একটি নতুন দেশ, একটি নতুন প্রজন্মের সামনে বিএনপিকে নিয়ে যখন লিখছি তখন আমি নিজেও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের কথা ও কর্মের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। তেমনই আমিও ফিরে এসেছি আমার পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, নতুন করে। দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার এই আনন্দ সীমাহীন গৌরবের। যদিও আমার এই লড়াই-সংগ্রাম এদেশের কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘ দেড় দশকের নিপীড়ন-নিষ্পেষণের সামনে কোনোভাবেই উল্লেখযোগ্য নয়।


দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে যে নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গেছে তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। গণমানুষের কণ্ঠস্বর বিএনপি এদেশের সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়েছে। বছরের পর বছর অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা হাসিনা সরকার চেয়েছে এ দেশ থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু পারেনি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের সাধারণ কর্মী বুকের সবটুকু ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগের সর্বোচ্চ নজরানা দিয়ে আগলে রেখেছে প্রাণপ্রিয় দলকে। তাইতো দ্বিতীয় স্বাধীনতার এই সূচনা পর্বে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে নি:সন্দেহে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাদ ভিন্ন রকমের।


৭৫ সালের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক শুন্যতা পূরণে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সেনা ছাউনিতে সৃষ্টি হয়েছিলো আজকের বিএনপি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দলটি সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অথচ পৃথিবীর ইতিহাস বলে সেনা ছাউনি থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সময়ের শুন্যতা পূরণে সৃষ্টি হয় তেমনি শুন্যতা কেটে গেলে তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া গণমানুষের আস্থার ঠিকানা এই দলটি।


এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় গ্রন্থের ফ্ল্যাপের অংশেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তার মতে, ‘বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন সেনা নায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে । এ ধরণের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায়। বিএনপি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি শুধু টিকেই যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, বিএনপিতেও গনতন্ত্রের চর্চা হয় কিনা তা নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায়। কিন্তু দলটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই।’


১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে ১৯৫৩ সালে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তার ভূমিকা সব সময়ই ছিলো বীরোচিত। যা তাকে তার পেশাগত পরিমন্ডলে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় ভূষিত করে থাকে। সাহসী রণকৌশল ও অসীম বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ হিলাল-ই-জুরাত এবং তামঘা-ই-জুরাত পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব প্রদান করেন।


মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকার বিষয়টি সর্বজন এবং আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ঘোষণা, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথ দেখানো এবং সশস্ত্র নেতৃত্বের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ খেতাব বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখে গেছেন।


১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ দিনের মাথায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, জনগণ, আইনের শাসন, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, ধর্মব্যবস্থা, মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি সকল কিছুর সমন্বয়ে একটা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নত মডেল তত্ত্ব।


১৯ দফা ছিলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেওয়া রাষ্ট্রের মুক্তির দিক-নির্দেশনাবলী। এক কথায় বলা যেতে পারে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ ফিরিয়ে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ১৯ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। তিনি ১৯ দফাতে যেমন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের ভালো যে দিক সমাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথাও বলেছেন। তিনি সমাজব্যবস্থার সকল উত্তম দিকের সমন্বয়ে একটা স্বাধীন, অখণ্ড ও স্বার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। এই ১৯ দফায় রাষ্ট্রকে তিনি যেমন সমসাময়িক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্রের পথ দেখিয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ওই তত্ত্বে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য নিরক্ষতা মুক্ত শিক্ষিত জাতির কথা বলেছেন। একটি দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ ছিলো তার সেই ১৯ দফায়।


বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক।


শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজনে দলের হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলায় অনেকটা বেসামাল ছিল। তবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীন নেতৃত্ব ও সীমাহীন ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে দলটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রবাহমান নদীর মতো। সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘আপোসহীন নেত্রী’ হিসেবে।


এ বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় বইয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে বিএনপি তৈরি করলেও পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দল হিসাবে সেটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।"


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একদিকে বিএনপিকে নি:শেষ করার ষড়যন্ত্র অন্যদিকে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কূটকৌশল চলে। নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় আপোসহীন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আশ্রয়স্থল বেগম খালেদা জিয়াকে। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানকে করা হয় নির্বাসিত। সেই থেকে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ঢেউ এসে আঘাত হানে বিএনপিকে।


বিএনপিকে ধ্বংস ও নেতৃত্বহীন করতে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফরমায়েশি রায় দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তাঁকে অন্যায়ভাবে আটক রেখেছিল বহু বছর। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলায় ফাঁসানো হয়। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েন দলটির শীর্ষ নেতারাও। স্বৈরশাসক হাসিনা মনে করেছিলো এভাবে হামলা-মামলা আর গুম-খুনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটি হয়নি।

বরং দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আঘাতে আঘাতে হয়েছে আরো পরিণত, জনপ্রিয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সব ষড়যন্ত্র-কূটকৌশল মোকাবিলা করে বিএনপিকে রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।


তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। ঐ দু:সময়ে বহু দূর থেকে দলকে সংগঠিত করার কাজ করছেন অত্যন্ত মনোযোগ, ধীশক্তি ও দক্ষতা সহকারে। তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ে তরুণ সমাজকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে তারুণ্যের শক্তি যে অপরিহার্য- এই উপলব্ধিই তাকে চালিত করেছিল তরুণ সমাজকে সংগঠিত করতে। তৃণমূলে একটি রাজনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে সেই দলের জনপ্রিয়তা। তিনি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।


তারেক রহমান ৩১ দফার আদলে দলকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে। এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা আজ ডানা মেলেছে সেখানে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম, বিদেশী প্রভু শক্তির প্রতি যে উদ্ধত তর্জনী সে তো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরই ছড়িয়ে দেওয়া রাজনৈতিক দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাব।


প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গণমানুষের প্রিয় দল বিএনপির প্রতি অফুরন্ত শুভ কামনা।


লেখক: অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মহাসচিব ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) ও সদস্য মিডিয়া সেল, বিএনপি।