১৯৭৮ সালে অধ্যাদেশ বলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিচারপতি অপসারণে গঠন করেছিলেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’। দূরদর্শী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এ সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করতে সংবিধানের ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে কৌশলে অচল করে রাখে। দেড় দশকের মাফিয়াতন্ত্রে বিচার বিভাগকে পদানত রাখতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অচল করে রাখে এই কাউন্সিল। এ জন্য বন্দুকটিও রাখে আদালতের ঘাড়েই। হাসিনার দলীয় আনুগত্য স্বীকার করা বিচারাঙ্গনকে দুর্নীতির দানবে পরিণত হয়। সেই দানবকে বশে রাখার কোনো হাতিয়ারই অবশিষ্ট রাখা হয়নি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ বিচার বিভাগ সংস্কারের অনিবার্যতায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রণীত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’।
এ কাউন্সিল পুনঃজীবীতকরণের মধ্যেই বিশ্লেষকরা খুঁজছেন বিচার বিভাগকে দুর্নীতির রাহুমুক্তকরণের পথরেখা। জাতির এই সন্ধিক্ষণে তারা এখন বিচার বিভাগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানকে স্মরণ করছেন অকুণ্ঠভাবে। একইসঙ্গে ঘৃণাভরে স্মরণ করছে সদ্য উৎখাত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কথিত ‘বিচার-ব্যবস্থা’কে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে বাতিল করে দেয়া হয়। ২০১৭ সালে এ আদেশ দেন শেখ হাসিনার অনুগত তৎকালীন বিচারপতিগণ। এ রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্য আপিলও করেন শেখ হাসিনা। ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’ মঞ্চস্থ করার জন্য হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগে। এতে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ‘নন-ফাংশানাল’ হয়ে পড়ে। পরে ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করে সরকারপক্ষ। এতে গত ৭ বছর ধরে দেশে বিচারপতিদের অপসারণ করার মতো কোনো আইনি পদ্ধতিই বহাল নেই।
বিদ্যমান পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে গত ১৫ আগস্ট রিটকারী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আবেদন করেন। আদালতে তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে রয়েছে। এটির শুনানি হওয়া প্রয়োজন। পরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগীয় বেঞ্চ শুনানি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২০ অক্টোবর শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়।
এর আগে গতবছর ২৩ নভেম্বর বহুল আলোচিত বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ শুনানি ৬ জন বিচারপতি গ্রহণ করতে পারবেন সিদ্ধান্ত দেন তৎকালীন আপিল বিভাগ। তবে রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য একাধিকবার কার্যতালিকায় এলেও শুনানিতে আগ্রহ দেখায়নি শেখ হাসিনার সরকার।
২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়। সরকারপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চায়।
এর আগে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)র নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন। ওই বছর ৮ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়। এতে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন দশ সিনিয়র আইনজীবী। তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অন্যদের মধ্যে অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম. কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মতামত দেন।
এর আগে ২০১৬ সালের ৫মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংবিধানের ‘ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ’ বলে রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে এমপিগণ ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে এমপিদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে এমপিদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হয়। যা ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।
সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর ৫ নভেম্বর রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
১৯৭৫সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার। ১৯৭৮ সালে তিনি এক সামরিক ফরমানে গঠন করেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে এই ক্ষমতা দেন। তার সময়ই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে স্থান পায়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারে বহাল থাকে। ওই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে। এতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা চলে যায় জাতীয় সংসদের হাতে। ওই বছর ৫ নভেম্বর ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ১০ আইনজীবীর পক্ষে রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
যে প্রক্রিয়ায় বিচারপতি অপসারণ করে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ : কি প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারপতিকে অপসারণ করে-জানতে চাইলে রিটকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, কানো বিচারপতির অদক্ষতা, দুর্নীতি বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে প্রধান বিচারপতিকে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করতে বলবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিলে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিসহ মোট তিন সদস্যের কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলই অভিযোগের তদন্ত করবে। শুনানি নেবে। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে কমিশন। এরপর তারা সিদ্ধান্ত দেবেন যে, অভিযোগটি সঠিক কি না। পরে প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে ওই বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। সর্বশেষ ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার আমলে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে অভিশংসন করেছিলো। এসএম শাহিদুর রহমান সুপ্রিমকোর্ট বারের নেতৃত্বে ছিলেন। এ সময় তার বিরুদ্ধে বারের তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। তা সত্ত্বেও ২০০৩ সালের এপ্রিলে তাকে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। তার নিয়োগের বিরোধিতা করেন সুপ্রিমকোর্ট বারের আওয়ামীলীগপন্থি আইনজীবীরা। তার নিয়োগের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে আ’লীগ। বিচার বিভাগে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। এ সময় সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তিনি এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ তখন এসএম শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে জামিনের জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনেন। অভিযোগ তদন্তে গঠিত হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খন্দকার মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে কাউন্সিল অভিযোগ তদন্ত করে। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি কাউন্সিল প্রতিবেদন জমা দেয়। কাউন্সিলের সুপারিশ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সম্মতিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তিনি রিট করেন। হাইকোর্ট তার অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করেন। পরে সৈয়দ জে.আর. মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। পরবর্তীতে আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির প্যানেল ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি শাহিদুর রহমানের অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। এভাবেই ইতি ঘটে বিচারপতি এসএম শাহিদুর রহমানের ‘বিচারপতি’ পরিচয়।
No comments:
Post a Comment