অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
একটি নতুন সময়, একটি নতুন দেশ, একটি নতুন প্রজন্মের সামনে বিএনপিকে নিয়ে যখন লিখছি তখন আমি নিজেও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের কথা ও কর্মের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। তেমনই আমিও ফিরে এসেছি আমার পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, নতুন করে। দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার এই আনন্দ সীমাহীন গৌরবের। যদিও আমার এই লড়াই-সংগ্রাম এদেশের কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘ দেড় দশকের নিপীড়ন-নিষ্পেষণের সামনে কোনোভাবেই উল্লেখযোগ্য নয়।
দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে যে নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গেছে তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। গণমানুষের কণ্ঠস্বর বিএনপি এদেশের সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়েছে। বছরের পর বছর অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা হাসিনা সরকার চেয়েছে এ দেশ থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু পারেনি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের সাধারণ কর্মী বুকের সবটুকু ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগের সর্বোচ্চ নজরানা দিয়ে আগলে রেখেছে প্রাণপ্রিয় দলকে। তাইতো দ্বিতীয় স্বাধীনতার এই সূচনা পর্বে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে নি:সন্দেহে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাদ ভিন্ন রকমের।
৭৫ সালের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক শুন্যতা পূরণে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সেনা ছাউনিতে সৃষ্টি হয়েছিলো আজকের বিএনপি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দলটি সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অথচ পৃথিবীর ইতিহাস বলে সেনা ছাউনি থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সময়ের শুন্যতা পূরণে সৃষ্টি হয় তেমনি শুন্যতা কেটে গেলে তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া গণমানুষের আস্থার ঠিকানা এই দলটি।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় গ্রন্থের ফ্ল্যাপের অংশেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তার মতে, ‘বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন সেনা নায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে । এ ধরণের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায়। বিএনপি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি শুধু টিকেই যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, বিএনপিতেও গনতন্ত্রের চর্চা হয় কিনা তা নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায়। কিন্তু দলটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই।’
১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে ১৯৫৩ সালে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তার ভূমিকা সব সময়ই ছিলো বীরোচিত। যা তাকে তার পেশাগত পরিমন্ডলে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় ভূষিত করে থাকে। সাহসী রণকৌশল ও অসীম বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ হিলাল-ই-জুরাত এবং তামঘা-ই-জুরাত পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকার বিষয়টি সর্বজন এবং আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ঘোষণা, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথ দেখানো এবং সশস্ত্র নেতৃত্বের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ খেতাব বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখে গেছেন।
১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ দিনের মাথায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, জনগণ, আইনের শাসন, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, ধর্মব্যবস্থা, মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি সকল কিছুর সমন্বয়ে একটা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নত মডেল তত্ত্ব।
১৯ দফা ছিলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেওয়া রাষ্ট্রের মুক্তির দিক-নির্দেশনাবলী। এক কথায় বলা যেতে পারে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ ফিরিয়ে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ১৯ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। তিনি ১৯ দফাতে যেমন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের ভালো যে দিক সমাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথাও বলেছেন। তিনি সমাজব্যবস্থার সকল উত্তম দিকের সমন্বয়ে একটা স্বাধীন, অখণ্ড ও স্বার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। এই ১৯ দফায় রাষ্ট্রকে তিনি যেমন সমসাময়িক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্রের পথ দেখিয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ওই তত্ত্বে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য নিরক্ষতা মুক্ত শিক্ষিত জাতির কথা বলেছেন। একটি দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ ছিলো তার সেই ১৯ দফায়।
বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজনে দলের হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলায় অনেকটা বেসামাল ছিল। তবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীন নেতৃত্ব ও সীমাহীন ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে দলটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রবাহমান নদীর মতো। সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘আপোসহীন নেত্রী’ হিসেবে।
এ বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় বইয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে বিএনপি তৈরি করলেও পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দল হিসাবে সেটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।"
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একদিকে বিএনপিকে নি:শেষ করার ষড়যন্ত্র অন্যদিকে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কূটকৌশল চলে। নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় আপোসহীন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আশ্রয়স্থল বেগম খালেদা জিয়াকে। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানকে করা হয় নির্বাসিত। সেই থেকে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ঢেউ এসে আঘাত হানে বিএনপিকে।
বিএনপিকে ধ্বংস ও নেতৃত্বহীন করতে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফরমায়েশি রায় দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তাঁকে অন্যায়ভাবে আটক রেখেছিল বহু বছর। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলায় ফাঁসানো হয়। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েন দলটির শীর্ষ নেতারাও। স্বৈরশাসক হাসিনা মনে করেছিলো এভাবে হামলা-মামলা আর গুম-খুনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটি হয়নি।
বরং দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আঘাতে আঘাতে হয়েছে আরো পরিণত, জনপ্রিয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সব ষড়যন্ত্র-কূটকৌশল মোকাবিলা করে বিএনপিকে রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। ঐ দু:সময়ে বহু দূর থেকে দলকে সংগঠিত করার কাজ করছেন অত্যন্ত মনোযোগ, ধীশক্তি ও দক্ষতা সহকারে। তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ে তরুণ সমাজকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে তারুণ্যের শক্তি যে অপরিহার্য- এই উপলব্ধিই তাকে চালিত করেছিল তরুণ সমাজকে সংগঠিত করতে। তৃণমূলে একটি রাজনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে সেই দলের জনপ্রিয়তা। তিনি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।
তারেক রহমান ৩১ দফার আদলে দলকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে। এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা আজ ডানা মেলেছে সেখানে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম, বিদেশী প্রভু শক্তির প্রতি যে উদ্ধত তর্জনী সে তো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরই ছড়িয়ে দেওয়া রাজনৈতিক দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাব।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গণমানুষের প্রিয় দল বিএনপির প্রতি অফুরন্ত শুভ কামনা।
লেখক: অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মহাসচিব ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) ও সদস্য মিডিয়া সেল, বিএনপি।
No comments:
Post a Comment