কাদের গনি চৌধুরী
এম ইলিয়াস আলী। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা। স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় অসীম সাহসী এ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জাগিয়ে রাখতো মিছিল, স্লোগান আর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তাঁর গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রাজধানীর রাজপথ। স্বৈরশাসকের রক্ত চক্ষু মেধাবী এ ছাত্রনেতাকে টলাতে পারেনি কখনো। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তিনি। কি অসীম সাহস, কি নিখাদ দেশপ্রেম! অনেকে মজা করে বলতো আপনার কাছ থেকে কিছু সাহস আমাদের ধার দেন না ইলিয়াস ভাই। তিনি জবাবে বলতেন দেশকে ভালবাস, সাহস ধার নেয়া লাগবেনা। সাহস ধার দিতে পারবে।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী অগ্নিঝড়া আন্দোলনের রাজপথের লড়াকু এ যোদ্ধাকে কেউ উপাধি দিলেন রাজপথপুত্র, কেউ বলতেন রাজপথের দাবানল, কেউ বলতেন রাজপথের অগ্নিমশাল। আরো কত কি।
দেশে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ের এ বীর 'ছাত্রনেতা' থেকে অল্প সময়ে হয়ে উঠেন ' জননেতা'। জনপ্রিয় জননেতা থেকে জননন্দিত জননেতা। আবার জননেতা থেকে পার্লামেন্ট মেম্বার - জাতীয় নেতা। বাংলাদেশের সর্ববৃহত রাজনৈতিক দল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। জাতীয়তাবাদের পতাকা উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুর্বার গতিতে। যে ইলিয়াস আলী জনতার,তাঁকে রুধিবে সাধ্য কার?
না, জননন্দিত এ নেতাকে আর এগুতে দিলো না, থামিয়ে দিল ফ্যাসিবাদী সরকার। এতবড় একজন জাতীয় নেতাকে গুম করার পর কি কোন সরকারের সাফল্য থাকতে পারে? সাধারণ মানুষ কি নিরাপদবোধ করতে পারেন? মানুষের যদি নিরাপত্তাই দিতে না পারে কিসের জন্য এ সরকার? কার জন্য এ সরকার?
কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি এম. ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ঢাকার বনানী থেকে ব্যক্তিগত গাড়ীচালক আনসার আলীসহ রহস্যজনকভাবে গুম হন তিনি। সে থেকে এখনো তাঁর পরিবার খুঁজে বেড়াচ্ছে ইলিয়াস আলী। তাদের কান্নার যেন আর শেষ নেই। তাদের অপেক্ষার যেন সমাপ্তি নেই। ইলিয়াস আলীর বৃদ্ধা মা সন্তানের পথ পানে চেয়ে থাকেন, এবুঝি আসছে 'বাছাধন'। প্রিয় সন্তানের চিন্তায় মা মৃত্যুপথ যাত্রী। ঈদ, আর নববর্ষে বাংলার মানুষ যখন উৎসবে মেতে উঠে, তখন ইলিয়াস আলীর পরিবারে দেখা দেয় কান্নার রোল। বাবাকে ছাড়া ইলিয়াসের সন্তানরা কিভাবে আনন্দ করবে?
ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর দেশব্যাপী গড়ে উঠে কঠোর আন্দোলন। ওই আন্দোলনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নির্বিচারে গুলি চালালে ইলিয়াসের ভালবাসায় প্রাণ দেন বিশ্বনাথের তিন বিএনপি কর্মী। ফিরে পাওয়ার আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা-মামলা শিকার হন হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। মামলায় কারাবরণ করেন অনেকে। তবুও আন্দোলন থেকে পিছু হঠেনি ইলিয়াস প্রেমিরা।
কিন্তু একে একে পাঁচ বছর পূর্ণ হলেও আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান দিতে পারেনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাবেক এ সংসদ সদস্যকে উদ্ধারে সরকারের কোন তৎপরতাও চোখে পড়েনি। এপরও নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস’র জন্য অন্তহীন অপেক্ষা চলছে তার পরিবার, বিশ্বনাথের আপামর জনতা ও দেশবাসীর।
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান মারা যাওয়ার পর এম ইলিয়াস আলী হয়ে উঠেন সিলেট বিএনপির একমাত্র কান্ডারী। শুধু সিলেট নয়, গোটা বিভাগের একজন অভিভাবক হিসেবে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।
তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার মিনতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছরেও সন্ধান মিললোনা তাঁর। এরপরও তাঁর নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন ইলিয়াস আলী জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় আবার তাদের কাছে ফিরে আসবেন।
গত বছর এক সাক্ষাৎকারে গুম হওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন ও পশ্চিমবঙ্গের কোনো একটি কারাগারে বন্দি আছেন এমন দাবি করেছেন তার আপন ছোট ভাই আসকির আলী। চ্যানেল আই-লন্ডনের স্ট্রেইট ডায়ালগ অনুষ্ঠানের লাইভ প্রোগ্রামে তিনি এ দাবি করেন।
তবে ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদি লুনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। খবর বিভিন্ন ওয়েবসাইটের। আসকির আলী আরও বলেন, আমাদের কাছে বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য রয়েছে তাতে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, ইলিয়াস আলী এখনও জীবিত আছেন। তাকে ভারতের দমদমের কাছাকাছি কোনো এক কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। যেমন করে কলকাতায় সুখরঞ্জন বালি আছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।
এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। তারপর থেকে তাকে বহনকারী গাড়ির চালককেও পাওয়া যায়নি। তবে দুটি মোবাইল ফোনসহ গাড়িটি রাস্তায় পড়েছিল। নিখোঁজ হওয়ার পর ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোন থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে কল করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার পর তার মোবাইল থেকে বারবার বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে ফোন আসাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।