By জাকারিয়া চৌধুরী
সকল রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে
আজ পর্যন্ত যে সকল দল বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে কোন না কোন সময়ে প্রতিনিধিত্ব করেছে
তাঁদের অথবা সেসব দলের প্রতিনিধিদের সমন্বিত জোটের ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থায়ী নির্বাচন
কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা
জিয়া। গেল ১৮ নভেম্বর হোটেল ওয়েস্টিনে দেশ বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিএনপি সহ বিশ
দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, দেশি বিদেশী অতিথি সহ সমাজের নানান শ্রেণী পেশার
গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে তিনি তাঁর প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। যার মাধ্যমে তিনি
রাষ্ট্রপতির প্রতি জোটের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরেন।
তাঁর পুরো বক্তব্যে যে সকল বিষয় স্পষ্ট হয়ে
সামনে এসেছে তা হচ্ছে - অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের
জন্য নিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষ ও সাহসী নির্বাচন কমিশন গঠনের কোন বিকল্প নেই। এ ধরনের একটি
কমিশন গঠনের মৌলিক প্রক্রিয়া, যোগ্য লোক বাছাইয়ের মাধ্যমে সমন্বিত করণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়
জনমনের ভীতি দূরীকরণ ও জন আস্থা ফিরিয়ে এনে
একে আনন্দমুখর করে তোলা। প্রজাতন্ত্রের বিতর্কিত ও প্রকাশ্য আনুগত্য পোষণকারী কর্মচারীদের
চিহ্নিত করণ এবং তাদেরকে যে কোন নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট
সকলের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা-ই ছিল এই প্রস্তাবের মূল বিষয়।
বর্তমানে যে আজব দুর্গন্ধময় এবং সঙ'য়ে পরিপূর্ণ,
প্রকাশ্যে আনুগত্যকারী ভাসমান, পদলেহনকারী নির্বাচন কমিশন রয়েছে তাঁর মেয়াদ স্বাভাবিক
নিয়মে শেষ হবে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এবং এ কমিশনের পরে নতুন যে কমিশন গঠিত হবে,
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে সেটার অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
২০১৪ সালে বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক, চাতুর্যপূর্ণ, প্রহসনে ভরা, কুকুর
বেষ্টিত যে নির্বাচন ( যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পেছনে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক
বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন , দ্রুত সময়ের মধ্যেই সকলের সাথে আলাপ
আলোচনার মাধ্যমে তিনি আরেকটি নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন।
এ জাতি শেখ হাসিনাকে যেমন জানেন, নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা তেমন ব্যবহার করেছেন। বেমালুম
ভুলে গেছেন পুরো বিষয়টা ) হয়েছিল। এরপর যে
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা দিক দিয়ে গুরুত্ব বহন
করে। আর এ কারনেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচনী কাঠামোকে যুগোপযোগী করা তথা নির্বাচন
কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও শক্তিশালী করণ এবং নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন
সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বিশেষ
চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় - একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করণ
এবং নির্বাচনোত্তর শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমে।
গণতন্ত্র একদিনের কোনও পায়ে হাঁটা সহজ পথ
নয়। আজকের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রই হয়ত একশ বছর পার করে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের রূপ পায়।
আর এ কাঠামোর মাধ্যমেই জনমতের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে।
বাংলাদেশের সংবিধানে পরিস্কার বলা আছে, ‘দেশের সকল ক্ষমতার উৎস এর জনগণ’। সেই জনগণ তাঁদের স্বীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রতি
পাঁচ বছর পর ভোটের মাধ্যমে তাঁদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেন। আর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত
এই জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে তাঁদের জবাবদিহিতা দিতে বাধ্য। আবার যেসকল সরকার জনগণের
প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নন, তাঁদের জবাবদিহিতার প্রশ্ন হুমকির মুখে পড়ে। ফলে গণতন্ত্রের
অন্যান্য বাহন বা নিয়ামক যেমন - আইনের শাসন,
ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, সুশাসন, মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার, বিচার বিভাগের
স্বাধীনতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গুলোর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা সবই সেই
অনির্বাচিত সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সরকারকে তখন তার ন্যায্যতা, যোগ্যতা, দক্ষতা,
ক্ষমতা প্রমাণ করতে গিয়ে নানান ফন্দিফিকির আর ছলাকলার আশ্রয় নিতে হয়। নতুন নতুন ফর্মুলার
মুলা ঝুলিয়ে জনগণকে চমক দেখিয়ে ব্যস্ত রাখতে হয়। গত ক’বছরে আমরা এমন সব আজব কর্মকাণ্ড
দেখেছি। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’, ‘বেশি উন্নয়ন কম গণতন্ত্র’, ‘সীমিত গণতন্ত্র’ ইত্যাদি
নানা অগণতান্ত্রিক ফন্দি, যার কোনোটিই সাংবিধানিক পথ নয় এবং এসব কলা রাষ্ট্র, সরকার
বা জনগণের জন্য শুভ পরিণতি বয়ে আনে না। আবার গণতন্ত্রের প্রধান বাহন যে নির্বাচন -
তা যদি একটি দক্ষ, যোগ্য, সৎ, নিরপেক্ষ, সাহসী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশনের অধীনে না
হয় - তাহলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করাও
অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এ কারণেই একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রথম ও প্রধান শর্ত। নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে আমাদের সংবিধানের
১১৮ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে - ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে
নিয়ে বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি
সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ
দান করবেন।’
দুঃখজনক হলেও সত্য, এ আইন বা বিধানাবলি আজো
প্রণীত হয়নি। ঠিক সে কারণেই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্কের ধারাও অব্যাহত আছে। আর
তাই নির্বাচন কমিশন গঠন ও তা শক্তিশালীকরণ সংক্রান্ত বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম
খালেদা জিয়া বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের
অধীনে, একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন
অনুষ্ঠানের জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রণয়ন বাঞ্ছনীয়। তবে যত দিন পর্যন্ত না আইন
করে নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত স্থায়ী ব্যবস্থা প্রণীত হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত সবার
ঐক্যমতের ভিত্তিতে কী করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন ও তা শক্তিশালী করা যায়,
সেটিই ছিল বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপরিউক্ত সুপারিশমালা
প্রদানের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সদ্য সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল
কাদের বলেন, বিএনপি নেত্রীর নির্বাচন কমিশন নিয়ে পুনর্গঠন প্রস্তাবনা চর্বিতচর্বণ ও
অন্তঃসার শুন্য। তাঁর এ প্রস্তাবনা প্রমান করেছে যে, তিনি জনগণের উপর আস্থাশীল নন।
তিনি এমন কিছু প্রসঙ্গ এনেছেন যা ইতোমধ্যেই আমাদের সংবিধান বা নির্বাচনী আইনে অন্তর্ভুক্ত
আছে। তিনি আওয়ামী লীগের পুরানো অভ্যাসমত কথায় কথায় অতীত টেনে এনে বলেন, বেগম খালেদা
জিয়া রাষ্ট্রপতিকে যে সংলাপ অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন, তা খুবই হাস্যকর। কারন তিনি প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার সংলাপ আহবানকে অসম্মান দেখিয়েছেন। তাঁর পুত্র বিয়োগের পর প্রধানমন্ত্রী
তাকে সমবেদনা জানাতে গুলশান কার্যালয়ে গেলে তিনি কার্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে
সংলাপের সম্ভাবনাকে চিরদিনের জন্যে রুদ্ধ করে দিয়েছেন। ( পাঠক, খেয়াল করুন নির্বাচনের
আগে হাসিনার উসিলা ছিল সংবিধান সুরক্ষা এবং আজকে ওবায়দুল কাদেরের উসিলা হচ্ছে বেগম
খালেদা জিয়া কেন দুয়ার বন্ধ রাখলেন সেজন্য আলোচনা হবে না। অথচ, কিছুদিন আগ পর্যন্ত
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা মুখে ফেনা তুলে ফেলছিলেন এই বলে যে, বেগম খালেদা জিয়া কেন
একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পেশ করছেন না। এটি যেন মেষ শাবক আর সিংহের একই ঘাঁটে পানি
খাওয়ার গল্পকে মনে করিয়ে দেয়। ) তিনি তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, ‘কোনও প্রেসক্রিপশন দেওয়ার
আগে খালেদাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার
চেষ্টা, মানি লন্ডারিং ......ইত্যাদি ইত্যাদি’র জন্যে। এখানে পাঠকদের আরেকটা বিষয় মনে
করিয়ে দিতে চাই। যারা শেখ হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলন প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই
খেয়াল করেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা যখন হাসিনার মতামত
জানতে চাইলেন তখনও তিনি ওবায়দুল কাদেরের কথা গুলোই যেন প্রতিধ্বনিত করলেন। একটা শব্দ
কিংবা একটা বর্ণ পর্যন্ত এদিক সেদিক হয়নি। এর মানে দাঁড়ায়, বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনা
শুরুর আগেই তাঁদের প্রতিক্রিয়া প্রস্তুত ছিল। তাঁদের দুজনের কেউই এ বিষয়টি নিশ্চিত
করতে এগিয়ে এলো না, বেগম খালেদা জিয়া তাঁর প্রস্তাবনায় কি কি ভুল করেছেন, কোথায় কোথায়
তাঁরা দ্বিমত করছেন কিংবা কোথায় কোন সমস্যা আছে যার কারনে একে গ্রহন করা যাচ্ছে না?
তাঁদের আচরন রয়ে গেল ৬০ এর দশকের আওয়ামী লীগের মতই যা তাঁদের মত নয় তা অবশ্যই শত্রুদের
মত। সুতরাং, ভিন্ন মত দেখলেই চালাও তলোয়ার। তবে হ্যাঁ, একটা বিষয় জনমানসের মনে আশা
যুগিয়েছে। যে প্রস্তাবনা আওয়ামী লীগ ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে
সে প্রস্তাবনই গ্রহন করেছে এদেশের সাধারন মানুষ, কিছু কূটনীতিক এবং সাবেক দুইএকজন নির্বাচন
কমিশনার। তাঁরা বলেছেন এটি ভাল প্রস্তাব এবং নিঃসন্দেহে এটি আলোচনার দাবি রাখে। মাঝখানে
জামাতকে টেনে এরা আবারো আগের মতই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছিল যা হালে পানি
পায়নি।
এই বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী
কমিটির সদস্য জনাব আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী অন্য এক আলোচনা সভায় বলেন, ’বাংলাদেশের
সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনের প্রধান নিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু এ নিয়োগ
কোন পদ্ধতির মাধ্যমে হবে সেটা সংবিধানে উল্লেখ নেই। এ সমস্যাটির সমাধান রয়েছে বেগম
খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনায়।’ জনাব খসরু সাহেব বিষয়টিকে পরিস্কার করে দেবার পরেও এরা
আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ
হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, তিনি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন
আসলে কেউই চায় না। কিন্তু নির্বাচন যাতে আর প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে
সরকারকেই। প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের প্রাথমিক শর্তই হলো একটি প্রশ্নমুক্ত ও সবার কাছে
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন। তাই সরকারের এ বিষয়ে সদিচ্ছা কতটুকু বা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন
সরকার আসলে কেমন দেখতে চায়, সেটা পরিষ্কার হবে ২০১৭ সালের নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য
দিয়েই।
• বিভিন্ন সূত্রের
সহায়তা নেয়া হয়েছে।