ফরহাদ মজহার / যুগান্তর
‘যে কোনো সমাজেরই গভীরতর মূল্যবোধগুলো গুমের মতো অপরাধ লংঘন করে। যার মধ্যে রয়েছে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকার অঙ্গীকার, মানবাধিকার রক্ষা এবং মৌলিক স্বাধীনতা। যখন এ অপরাধ একটি নিয়মিত চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন তা হয়ে ওঠে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ (Declaration on Protection of all persons from enforced disappearance, preamble, UN).
প্রায় তিন দশক ধরে ল্যাটিন আমেরিকার গুম হয়ে যাওয়া নাগরিকদের পরিবারগুলো (Latin American Federation of Associations of Relatives of Disappeared-Detainees) একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আন্দোলনের ফলে মে মাসের শেষ সপ্তাহ আন্তর্জাতিকভাবে ‘গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য আন্তর্জাতিক সপ্তাহ’ হিসেবে পালিত হয়। কোনোদিন ভাবিনি যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া এ বাংলাদেশে আমাদেরও গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মরণে এবং তাদের পরিবারের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে মে মাসের শেষ সপ্তাহটি পালন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মানদণ্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দিক থেকে বিশ্বজুড়ে যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে তা তুলনাহীন বলা চলে। পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ ও ভারত বিশেষত কাশ্মীর- মানুষ গুম করে ফেলার মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আজ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত। তাই আজকের লেখাটি যে মানুষগুলো গুম হয়ে গিয়েছে তাদের জন্য এবং তাদের পরিবারের প্রতি সংহতি জানাবার জন্য লিখছি। আজ রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে নাগরিকদের রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার ও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের অনেকে লাশ হয়ে ফিরে আসে। নারায়ণগঞ্জে পেট ফুটা করে দড়িতে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া লাশ আবার ভেসে উঠেছিল। এতে বোঝা যায় কতটা যন্ত্রণা দিয়ে ও নিষ্ঠুরভাবে গুম হয়ে যাওয়া মানুষকে হত্যা করা হয়।
গুম করে ফেলা মানুষগুলো যে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও পরিণতির শিকার হয় সেটা নির্যাতনের একটা দিক মাত্র। লাশ হয়ে ফিরে আসা ও লাশ পাওয়া এক ধরনের ভাগ্য বলতে হবে; কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবারের দিক থেকে দেখলে নির্যাতনের আরেকটি ভয়ঙ্কর ছবি ভেসে ওঠে যা উপলব্ধি করা সহজে সম্ভব হয় না। সেটা হল গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবার ও যাদের কাছে প্রিয় মানুষ তাদের নিত্যদিনের অপরিসীম মানসিক যন্ত্রণা। ভেবে দেখুন আপনি যাকে ভালোবাসেন, আপনার স্বামী, সন্তান, ভাই, বন্ধু বা আত্মীয়- সে কোথায় আছে কীভাবে আছে, বেঁচে আছে কিনা তার কিছুই জানতে পারছেন না। লাশ ফিরে পেলে আপনি অন্তত কবর দিতে পারেন। ছেলেমেয়েরা জানে না তাদের বাবা বেঁচে আছে কিনা। যা থাকে তা এক নিদারুণ অপেক্ষা। এ অপেক্ষা ভয়ঙ্কর। এ বেদনার বোঝা, যারা ভুক্তভোগী নন বোঝা কঠিন।
তাছাড়া মৃত্যুর বৈধতা পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি জানেন না আপনি কী বিধবা নাকি আপনার গুম হয়ে যাওয়া স্বামী বেঁচে আছে। সম্পত্তির অধিকারের বিষয় আইনিভাবে ফয়সালা করা কঠিন। আপনি কি গুম হয়ে যাওয়া মানুষটিকে মৃত গণ্য করবেন, নাকি জীবিত? হয়তো মানসিক যন্ত্রণা মৃত্যুর বৈধতা প্রমাণের প্রসঙ্গের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া মানুষ যেমন নিত্য মনের দিক থেকে অত্যাচারিত, একইভাবে নানান সামাজিক এবং পারিবারিক জটিলতার মধ্যেও নিপতিত হন। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা খুবই কঠিন।
বাংলাদেশে মানুষ গুম করে ফেলার ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনীয়। জানা হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ৯৯১ শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ ডাক্তার, ৪২ আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশার আরও ১৬ জন মানুষ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এরা আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জহির রায়হানও গুম হয়ে গিয়েছেন, আর ফিরে আসেননি। আরও দুটি ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জ্বলজ্বল করে হাজির রয়েছে। সিরাজ শিকদার ১৯৭৫ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, তাকে পরে আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। কল্পনা চাকমা অপহৃত হন ১৯৯৬ সালে। তার হদিস আজও পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, গুম ও গুমহত্যা বিশেষভাবে বেড়েছে ২০০৯ সালের পর থেকে। এর আগে মানবাধিকার লংঘনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ‘ক্রসফায়ার’ বা আইনবহির্ভূত হত্যা। সেই হত্যা এখনও জারি রয়েছে- মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১৭০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ৬৩ জন ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। এদের মধ্যে রয়েছেন ২০১২ সালে গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ইলিয়াস আলী এবং ২০১৫ সালের গুম হয়ে যাওয়া আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ। সালাহ উদ্দিনের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি শুধু গুম হননি, তাকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এটা নতুন ফেনোমেনা।
আমাদের হাতের কাছে ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত একটি বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গুম হয়ে যাওয়া নাগরিকদের একটা বছরওয়ারি পরিসংখ্যান আছে (সূত্র : অধিকার)। গত পাঁচ বছরে যে ২৭৪ জনকে গুম করে ফেলা হয়েছে তাদের মধ্যে ৩৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তারা জীবিত নেই, এই তথ্যটুকু অন্তত জানা গেছে। ১৫৯ জনের মধ্যে অনেককে মুক্তি দেয়া হয়েছে অথবা কোনো না কোনো মামলায় আটক দেখানো হয়েছে; কিন্তু বাকি ৮০ জনের কোনো পাত্তাই নাই। দুই হাজার সতেরো সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ জন নাগরিককে গুম করে ফেলা হয়েছে।
এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের নির্বাচনী তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সালে যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছিল, তারা দ্বিতীয়বার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল কোনো নির্বাচন ছাড়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে কোনো নির্বাচন হয়নি। এর ফলে নির্বাচনের নৈতিক ও আইনি বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে প্রচণ্ড দমন-পীড়নের সময় গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। নির্বাচনের বছরে প্রচারণার ভয়ে গুম কিছুটা কমলেও এর পরের বছরগুলোতে গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। এ পরিসংখ্যানই গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে বাধ্য করে। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে, সেই তুলনায় গুম সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা কম। গুম বিশেষ মনোযোগের দাবিদার, কারণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের চরিত্রের দিক থেকে গুমসংক্রান্ত আলাদা আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। তার সুনির্দিষ্ট আইনি ব্যাখ্যাও আছে, গুম প্রতিরোধ করতে হলে যা জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। গুমের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা না গেলে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন-পীড়নের যে ধারাবাহিকতা ও মাত্রা আমরা দেখছি, তাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সাধারণ নাগরিকদের গুম করে ফেলার ঘটনা কমবে কিনা বলা দুঃসাধ্য হয়ে গিয়েছে। নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গুমের বিষয়টি রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সামনে নিয়ে আসা খুবই জরুরি।
দুই
বাংলাদেশে গুমের ঘটনা বৃদ্ধি আন্তর্জাতিকভাবে এতই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের বিবৃতি দিতে হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখতে হবে। ঘটনার শিকার যারা, সেসব নাগরিককে যথাযথ সহায়তা দিতে হবে বাংলাদেশের। সরকারের উচিত গুম ও অপহৃত ব্যক্তিদের সন্ধান করা এবং তাদের আত্মীয়দের তদন্তের অগ্রগতি জানানো।’
প্রতিবেদনে ছ’মাস আগে বিরোধী দলের তিন নেতার তিন সন্তানের অপহরণ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সে সময় জাতিসংঘের ‘গ্রুপ অব ইনভলান্টারি এনফোর্সড ডিসাপেয়ারেন্স’ বাংলাদেশ সরকারকে তাদের খুঁজে বের করার কথা বলে। হাম্মাম কাদের চৌধুরী ইতিমধ্যে মুক্তি পেলেও আরও দুজন মীর আহমেদ বিন কাশেম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ হিল আমান আল-আজমি এখনও রাষ্ট্রের কাছে বন্দি আছেন।
গুম ও হত্যা একটি নির্বাচিত সরকারের আমলে এত ভয়ঙ্করভাবে বাড়ল কেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়, আইনের শাসনের অভাব; কিন্তু সেটা খুব ভালো উত্তর নয়, কারণ এর পরের প্রশ্ন আইনের শাসনেরও বা অভাব কেন? তার উত্তর দিতে গেলে, বলা বাহুল্য, বিচার বিভাগকেই অনেকেই দোষারোপ করে থাকেন। অন্যদিকে খোদ প্রধান বিচারপতি দাবি করছেন, ‘প্রশাসন কোনোদিনই চায়নি বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে যারা আছে তাদের পরিচালনা করে কয়েকজন আমলা’ (দেখুন দৈনিক যুগান্তর ২৫ এপ্রিল ২০১৭)। বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রশাসনের এ দ্বন্দ্ব কতটুকু পেশাগত স্বার্থ আর কতটা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন বিচার প্রক্রিয়া গড়ে ওঠার সংকট সেই তর্কে আমরা যাব না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা এবং গ্রেফতার করার পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির করানোর ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের নির্দেশ অমান্য করার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ কোনো ভূমিকা পালন করতে অক্ষম, এটা মেনে নেয়া কঠিন।
দ্বিতীয়ত দাবি করা হয়, গুম নিয়ে আমাদের কোনো আইন নাই। অথচ এ দাবির কোনো ভিত্তি নাই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন, যা ‘রোম স্টেটিউড’ নামে পরিচিত (Rome Statute of the International Criminal Court), স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৭ জুলাই ১৯৯৮ সালে। একে র্যাটিফাই বা ‘অনুস্বাক্ষর’ করবার জন্য মানবাধিকার কর্মীরা তখন থেকেই কাজ করছেন। যার ফলে ২৩ মার্চ ২০১০ সালে বাংলাদেশ তা অনুস্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এ আন্তর্জাতিক আইনের আর বাইরে নয়। যারা গুমের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে সরকার তাদের অবশ্যই বিচার বিভাগের আওতায় আনতে পারেন, প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারেন। যারা গুম করছে তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটনার জন্য অপরাধী। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাদের বিচার হতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আদালত যদি বিচার করতে ব্যর্থ হয়, বিচার বিভাগকে আন্তর্জাতিক মহলে জবাবদিহি করতে হতে পারে।
কথা হচ্ছে রাষ্ট্রের দ্বারা নিজের নাগরিকদের গুম করা একটি অপরাধকে অন্যসব অপরাধ থেকে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করা হয়। যে কারণে আন্তর্জাতিক আইনে গুমের সংজ্ঞাকেও সুনির্দিষ্ট করতে হয়েছে :
Article 2 (International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance)
For the purposes of this Convention, 'enforced disappearance' is considered to be the arrest, detention, abduction or aû other form of deprivation of liberty by agents of the State or by persons or groups of persons acting with the authorization, support or acquiescence of the State, followed by a refusal to acknowledge the deprivation of liberty or by concealment of the fate or whereabouts of the disappeared person, which place such a person outside the protection of the law.
অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার, বন্দি করা, অপহরণ অথবা যে কোনোভাবে তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে এমন কাজ করা এবং সেই ব্যক্তি কোথায় আছে বা কেমন আছে এ তথ্য গোপন করার মাধ্যমে তাকে আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়া এনফোর্সড ডিসাপেয়ারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।
কেন সুনির্দিষ্ট করতে হল? যেখানে রাষ্ট্রকেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা করার কথা, রাষ্ট্র তা না করে পাল্টা নিজেই নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করছে এবং নিজেই নাগরিকদের আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেমালুম গায়েব করে দিচ্ছে। গুম করার একটি প্রধান উদ্দেশ্য নাগরিককে সব ধরনের আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা শুধু নয়, সে যেন কখনও জীবিত থেকে আইনি পরিমণ্ডলে প্রত্যাবর্তন করতে না পারে তার সম্ভাবনা নিশ্চিত করা। এর সোজা মানে হচ্ছে গুমের মতো অপরাধে জড়িয়ে রাষ্ট্র নিজের নৈতিক ও আইনি ভিত্তি নিজেই ধ্বংস করছে। এ দিকটি বোঝার মতো বিচক্ষণতা বিচার বিভাগের না থাকার কথা নয়। যে দেশে গুমের মতো ঘটনা ঘটে এবং বিচার বিভাগের কোনো সক্রিয় ভূমিকা থাকে না, সেই দেশের বিচার বিভাগও আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অপরাধী।
রাষ্ট্র কেন এ সন্ত্রাসী ভূমিকা নেয়? এর প্রধান কারণ নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক তৈরি করে গণতন্ত্র ও গণবিরোধী শাসন অব্যাহত রাখা। এর প্রতিরোধ করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন একটি কৌশলগত অবলম্বন হতে পারে। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটা আমরা এখনই বিচার করতে পারব না। তবে কেন গুম নিয়ে বিশেষ আন্তর্জাতিক আইন করতে হয়েছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কর্তব্যগুলো কী সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। যেমন, ১. নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার সুরক্ষা, ২. কোনো ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতন বা মানুষের জন্য অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি না পাওয়ার অধিকার, ৩. যদি রাষ্ট্র অভিযোগ আনে তাহলে কারাগারে মানবিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা, ৪. ব্যক্তি মাত্রই আইনের সুরক্ষার অধীন, অর্থাৎ আইন ও বিচারের পরিমণ্ডলের বাইরে নিক্ষিপ্ত না করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং ৫. সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতে সুবিচার পাওয়া, ইত্যাদি।
মানবতার বিরুদ্ধে এ ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই আবশ্যক হয়ে উঠেছে।
প্রায় তিন দশক ধরে ল্যাটিন আমেরিকার গুম হয়ে যাওয়া নাগরিকদের পরিবারগুলো (Latin American Federation of Associations of Relatives of Disappeared-Detainees) একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আন্দোলনের ফলে মে মাসের শেষ সপ্তাহ আন্তর্জাতিকভাবে ‘গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য আন্তর্জাতিক সপ্তাহ’ হিসেবে পালিত হয়। কোনোদিন ভাবিনি যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া এ বাংলাদেশে আমাদেরও গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মরণে এবং তাদের পরিবারের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে মে মাসের শেষ সপ্তাহটি পালন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মানদণ্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দিক থেকে বিশ্বজুড়ে যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে তা তুলনাহীন বলা চলে। পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ ও ভারত বিশেষত কাশ্মীর- মানুষ গুম করে ফেলার মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আজ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত। তাই আজকের লেখাটি যে মানুষগুলো গুম হয়ে গিয়েছে তাদের জন্য এবং তাদের পরিবারের প্রতি সংহতি জানাবার জন্য লিখছি। আজ রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে নাগরিকদের রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার ও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের অনেকে লাশ হয়ে ফিরে আসে। নারায়ণগঞ্জে পেট ফুটা করে দড়িতে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া লাশ আবার ভেসে উঠেছিল। এতে বোঝা যায় কতটা যন্ত্রণা দিয়ে ও নিষ্ঠুরভাবে গুম হয়ে যাওয়া মানুষকে হত্যা করা হয়।
গুম করে ফেলা মানুষগুলো যে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও পরিণতির শিকার হয় সেটা নির্যাতনের একটা দিক মাত্র। লাশ হয়ে ফিরে আসা ও লাশ পাওয়া এক ধরনের ভাগ্য বলতে হবে; কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবারের দিক থেকে দেখলে নির্যাতনের আরেকটি ভয়ঙ্কর ছবি ভেসে ওঠে যা উপলব্ধি করা সহজে সম্ভব হয় না। সেটা হল গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবার ও যাদের কাছে প্রিয় মানুষ তাদের নিত্যদিনের অপরিসীম মানসিক যন্ত্রণা। ভেবে দেখুন আপনি যাকে ভালোবাসেন, আপনার স্বামী, সন্তান, ভাই, বন্ধু বা আত্মীয়- সে কোথায় আছে কীভাবে আছে, বেঁচে আছে কিনা তার কিছুই জানতে পারছেন না। লাশ ফিরে পেলে আপনি অন্তত কবর দিতে পারেন। ছেলেমেয়েরা জানে না তাদের বাবা বেঁচে আছে কিনা। যা থাকে তা এক নিদারুণ অপেক্ষা। এ অপেক্ষা ভয়ঙ্কর। এ বেদনার বোঝা, যারা ভুক্তভোগী নন বোঝা কঠিন।
তাছাড়া মৃত্যুর বৈধতা পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি জানেন না আপনি কী বিধবা নাকি আপনার গুম হয়ে যাওয়া স্বামী বেঁচে আছে। সম্পত্তির অধিকারের বিষয় আইনিভাবে ফয়সালা করা কঠিন। আপনি কি গুম হয়ে যাওয়া মানুষটিকে মৃত গণ্য করবেন, নাকি জীবিত? হয়তো মানসিক যন্ত্রণা মৃত্যুর বৈধতা প্রমাণের প্রসঙ্গের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া মানুষ যেমন নিত্য মনের দিক থেকে অত্যাচারিত, একইভাবে নানান সামাজিক এবং পারিবারিক জটিলতার মধ্যেও নিপতিত হন। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা খুবই কঠিন।
বাংলাদেশে মানুষ গুম করে ফেলার ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনীয়। জানা হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ৯৯১ শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ ডাক্তার, ৪২ আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশার আরও ১৬ জন মানুষ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এরা আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জহির রায়হানও গুম হয়ে গিয়েছেন, আর ফিরে আসেননি। আরও দুটি ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জ্বলজ্বল করে হাজির রয়েছে। সিরাজ শিকদার ১৯৭৫ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, তাকে পরে আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। কল্পনা চাকমা অপহৃত হন ১৯৯৬ সালে। তার হদিস আজও পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, গুম ও গুমহত্যা বিশেষভাবে বেড়েছে ২০০৯ সালের পর থেকে। এর আগে মানবাধিকার লংঘনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ‘ক্রসফায়ার’ বা আইনবহির্ভূত হত্যা। সেই হত্যা এখনও জারি রয়েছে- মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১৭০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ৬৩ জন ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। এদের মধ্যে রয়েছেন ২০১২ সালে গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ইলিয়াস আলী এবং ২০১৫ সালের গুম হয়ে যাওয়া আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ। সালাহ উদ্দিনের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি শুধু গুম হননি, তাকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এটা নতুন ফেনোমেনা।
আমাদের হাতের কাছে ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত একটি বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গুম হয়ে যাওয়া নাগরিকদের একটা বছরওয়ারি পরিসংখ্যান আছে (সূত্র : অধিকার)। গত পাঁচ বছরে যে ২৭৪ জনকে গুম করে ফেলা হয়েছে তাদের মধ্যে ৩৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তারা জীবিত নেই, এই তথ্যটুকু অন্তত জানা গেছে। ১৫৯ জনের মধ্যে অনেককে মুক্তি দেয়া হয়েছে অথবা কোনো না কোনো মামলায় আটক দেখানো হয়েছে; কিন্তু বাকি ৮০ জনের কোনো পাত্তাই নাই। দুই হাজার সতেরো সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ জন নাগরিককে গুম করে ফেলা হয়েছে।
এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের নির্বাচনী তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সালে যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছিল, তারা দ্বিতীয়বার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল কোনো নির্বাচন ছাড়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে কোনো নির্বাচন হয়নি। এর ফলে নির্বাচনের নৈতিক ও আইনি বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে প্রচণ্ড দমন-পীড়নের সময় গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। নির্বাচনের বছরে প্রচারণার ভয়ে গুম কিছুটা কমলেও এর পরের বছরগুলোতে গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। এ পরিসংখ্যানই গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে বাধ্য করে। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে, সেই তুলনায় গুম সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা কম। গুম বিশেষ মনোযোগের দাবিদার, কারণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের চরিত্রের দিক থেকে গুমসংক্রান্ত আলাদা আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। তার সুনির্দিষ্ট আইনি ব্যাখ্যাও আছে, গুম প্রতিরোধ করতে হলে যা জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। গুমের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা না গেলে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন-পীড়নের যে ধারাবাহিকতা ও মাত্রা আমরা দেখছি, তাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সাধারণ নাগরিকদের গুম করে ফেলার ঘটনা কমবে কিনা বলা দুঃসাধ্য হয়ে গিয়েছে। নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গুমের বিষয়টি রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সামনে নিয়ে আসা খুবই জরুরি।
দুই
বাংলাদেশে গুমের ঘটনা বৃদ্ধি আন্তর্জাতিকভাবে এতই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের বিবৃতি দিতে হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখতে হবে। ঘটনার শিকার যারা, সেসব নাগরিককে যথাযথ সহায়তা দিতে হবে বাংলাদেশের। সরকারের উচিত গুম ও অপহৃত ব্যক্তিদের সন্ধান করা এবং তাদের আত্মীয়দের তদন্তের অগ্রগতি জানানো।’
প্রতিবেদনে ছ’মাস আগে বিরোধী দলের তিন নেতার তিন সন্তানের অপহরণ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সে সময় জাতিসংঘের ‘গ্রুপ অব ইনভলান্টারি এনফোর্সড ডিসাপেয়ারেন্স’ বাংলাদেশ সরকারকে তাদের খুঁজে বের করার কথা বলে। হাম্মাম কাদের চৌধুরী ইতিমধ্যে মুক্তি পেলেও আরও দুজন মীর আহমেদ বিন কাশেম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ হিল আমান আল-আজমি এখনও রাষ্ট্রের কাছে বন্দি আছেন।
গুম ও হত্যা একটি নির্বাচিত সরকারের আমলে এত ভয়ঙ্করভাবে বাড়ল কেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়, আইনের শাসনের অভাব; কিন্তু সেটা খুব ভালো উত্তর নয়, কারণ এর পরের প্রশ্ন আইনের শাসনেরও বা অভাব কেন? তার উত্তর দিতে গেলে, বলা বাহুল্য, বিচার বিভাগকেই অনেকেই দোষারোপ করে থাকেন। অন্যদিকে খোদ প্রধান বিচারপতি দাবি করছেন, ‘প্রশাসন কোনোদিনই চায়নি বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে যারা আছে তাদের পরিচালনা করে কয়েকজন আমলা’ (দেখুন দৈনিক যুগান্তর ২৫ এপ্রিল ২০১৭)। বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রশাসনের এ দ্বন্দ্ব কতটুকু পেশাগত স্বার্থ আর কতটা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন বিচার প্রক্রিয়া গড়ে ওঠার সংকট সেই তর্কে আমরা যাব না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা এবং গ্রেফতার করার পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির করানোর ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের নির্দেশ অমান্য করার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ কোনো ভূমিকা পালন করতে অক্ষম, এটা মেনে নেয়া কঠিন।
দ্বিতীয়ত দাবি করা হয়, গুম নিয়ে আমাদের কোনো আইন নাই। অথচ এ দাবির কোনো ভিত্তি নাই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন, যা ‘রোম স্টেটিউড’ নামে পরিচিত (Rome Statute of the International Criminal Court), স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৭ জুলাই ১৯৯৮ সালে। একে র্যাটিফাই বা ‘অনুস্বাক্ষর’ করবার জন্য মানবাধিকার কর্মীরা তখন থেকেই কাজ করছেন। যার ফলে ২৩ মার্চ ২০১০ সালে বাংলাদেশ তা অনুস্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এ আন্তর্জাতিক আইনের আর বাইরে নয়। যারা গুমের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে সরকার তাদের অবশ্যই বিচার বিভাগের আওতায় আনতে পারেন, প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারেন। যারা গুম করছে তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটনার জন্য অপরাধী। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাদের বিচার হতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আদালত যদি বিচার করতে ব্যর্থ হয়, বিচার বিভাগকে আন্তর্জাতিক মহলে জবাবদিহি করতে হতে পারে।
কথা হচ্ছে রাষ্ট্রের দ্বারা নিজের নাগরিকদের গুম করা একটি অপরাধকে অন্যসব অপরাধ থেকে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করা হয়। যে কারণে আন্তর্জাতিক আইনে গুমের সংজ্ঞাকেও সুনির্দিষ্ট করতে হয়েছে :
Article 2 (International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance)
For the purposes of this Convention, 'enforced disappearance' is considered to be the arrest, detention, abduction or aû other form of deprivation of liberty by agents of the State or by persons or groups of persons acting with the authorization, support or acquiescence of the State, followed by a refusal to acknowledge the deprivation of liberty or by concealment of the fate or whereabouts of the disappeared person, which place such a person outside the protection of the law.
অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার, বন্দি করা, অপহরণ অথবা যে কোনোভাবে তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে এমন কাজ করা এবং সেই ব্যক্তি কোথায় আছে বা কেমন আছে এ তথ্য গোপন করার মাধ্যমে তাকে আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়া এনফোর্সড ডিসাপেয়ারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।
কেন সুনির্দিষ্ট করতে হল? যেখানে রাষ্ট্রকেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা করার কথা, রাষ্ট্র তা না করে পাল্টা নিজেই নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করছে এবং নিজেই নাগরিকদের আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেমালুম গায়েব করে দিচ্ছে। গুম করার একটি প্রধান উদ্দেশ্য নাগরিককে সব ধরনের আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা শুধু নয়, সে যেন কখনও জীবিত থেকে আইনি পরিমণ্ডলে প্রত্যাবর্তন করতে না পারে তার সম্ভাবনা নিশ্চিত করা। এর সোজা মানে হচ্ছে গুমের মতো অপরাধে জড়িয়ে রাষ্ট্র নিজের নৈতিক ও আইনি ভিত্তি নিজেই ধ্বংস করছে। এ দিকটি বোঝার মতো বিচক্ষণতা বিচার বিভাগের না থাকার কথা নয়। যে দেশে গুমের মতো ঘটনা ঘটে এবং বিচার বিভাগের কোনো সক্রিয় ভূমিকা থাকে না, সেই দেশের বিচার বিভাগও আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অপরাধী।
রাষ্ট্র কেন এ সন্ত্রাসী ভূমিকা নেয়? এর প্রধান কারণ নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক তৈরি করে গণতন্ত্র ও গণবিরোধী শাসন অব্যাহত রাখা। এর প্রতিরোধ করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন একটি কৌশলগত অবলম্বন হতে পারে। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটা আমরা এখনই বিচার করতে পারব না। তবে কেন গুম নিয়ে বিশেষ আন্তর্জাতিক আইন করতে হয়েছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কর্তব্যগুলো কী সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। যেমন, ১. নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার সুরক্ষা, ২. কোনো ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতন বা মানুষের জন্য অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি না পাওয়ার অধিকার, ৩. যদি রাষ্ট্র অভিযোগ আনে তাহলে কারাগারে মানবিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা, ৪. ব্যক্তি মাত্রই আইনের সুরক্ষার অধীন, অর্থাৎ আইন ও বিচারের পরিমণ্ডলের বাইরে নিক্ষিপ্ত না করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং ৫. সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতে সুবিচার পাওয়া, ইত্যাদি।
মানবতার বিরুদ্ধে এ ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই আবশ্যক হয়ে উঠেছে।