Search

Sunday, May 28, 2017

গুম: গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই আবশ্যক

ফরহাদ মজহার / যুগান্তর


 
‘যে কোনো সমাজেরই গভীরতর মূল্যবোধগুলো গুমের মতো অপরাধ লংঘন করে। যার মধ্যে রয়েছে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকার অঙ্গীকার, মানবাধিকার রক্ষা এবং মৌলিক স্বাধীনতা। যখন এ অপরাধ একটি নিয়মিত চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন তা হয়ে ওঠে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ (Declaration on Protection of all persons from enforced disappearance, preamble, UN).

প্রায় তিন দশক ধরে ল্যাটিন আমেরিকার গুম হয়ে যাওয়া নাগরিকদের পরিবারগুলো (Latin American Federation of Associations of Relatives of Disappeared-Detainees) একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আন্দোলনের ফলে মে মাসের শেষ সপ্তাহ আন্তর্জাতিকভাবে ‘গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য আন্তর্জাতিক সপ্তাহ’ হিসেবে পালিত হয়। কোনোদিন ভাবিনি যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া এ বাংলাদেশে আমাদেরও গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মরণে এবং তাদের পরিবারের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে মে মাসের শেষ সপ্তাহটি পালন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মানদণ্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দিক থেকে বিশ্বজুড়ে যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে তা তুলনাহীন বলা চলে। পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ ও ভারত বিশেষত কাশ্মীর- মানুষ গুম করে ফেলার মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আজ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত। তাই আজকের লেখাটি যে মানুষগুলো গুম হয়ে গিয়েছে তাদের জন্য এবং তাদের পরিবারের প্রতি সংহতি জানাবার জন্য লিখছি। আজ রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে নাগরিকদের রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার ও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে উঠেছে।

গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের অনেকে লাশ হয়ে ফিরে আসে। নারায়ণগঞ্জে পেট ফুটা করে দড়িতে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া লাশ আবার ভেসে উঠেছিল। এতে বোঝা যায় কতটা যন্ত্রণা দিয়ে ও নিষ্ঠুরভাবে গুম হয়ে যাওয়া মানুষকে হত্যা করা হয়।

গুম করে ফেলা মানুষগুলো যে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও পরিণতির শিকার হয় সেটা নির্যাতনের একটা দিক মাত্র। লাশ হয়ে ফিরে আসা ও লাশ পাওয়া এক ধরনের ভাগ্য বলতে হবে; কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবারের দিক থেকে দেখলে নির্যাতনের আরেকটি ভয়ঙ্কর ছবি ভেসে ওঠে যা উপলব্ধি করা সহজে সম্ভব হয় না। সেটা হল গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবার ও যাদের কাছে প্রিয় মানুষ তাদের নিত্যদিনের অপরিসীম মানসিক যন্ত্রণা। ভেবে দেখুন আপনি যাকে ভালোবাসেন, আপনার স্বামী, সন্তান, ভাই, বন্ধু বা আত্মীয়- সে কোথায় আছে কীভাবে আছে, বেঁচে আছে কিনা তার কিছুই জানতে পারছেন না। লাশ ফিরে পেলে আপনি অন্তত কবর দিতে পারেন। ছেলেমেয়েরা জানে না তাদের বাবা বেঁচে আছে কিনা। যা থাকে তা এক নিদারুণ অপেক্ষা। এ অপেক্ষা ভয়ঙ্কর। এ বেদনার বোঝা, যারা ভুক্তভোগী নন বোঝা কঠিন।

তাছাড়া মৃত্যুর বৈধতা পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি জানেন না আপনি কী বিধবা নাকি আপনার গুম হয়ে যাওয়া স্বামী বেঁচে আছে। সম্পত্তির অধিকারের বিষয় আইনিভাবে ফয়সালা করা কঠিন। আপনি কি গুম হয়ে যাওয়া মানুষটিকে মৃত গণ্য করবেন, নাকি জীবিত? হয়তো মানসিক যন্ত্রণা মৃত্যুর বৈধতা প্রমাণের প্রসঙ্গের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া মানুষ যেমন নিত্য মনের দিক থেকে অত্যাচারিত, একইভাবে নানান সামাজিক এবং পারিবারিক জটিলতার মধ্যেও নিপতিত হন। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা খুবই কঠিন।

বাংলাদেশে মানুষ গুম করে ফেলার ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনীয়। জানা হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ৯৯১ শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ ডাক্তার, ৪২ আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশার আরও ১৬ জন মানুষ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এরা আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জহির রায়হানও গুম হয়ে গিয়েছেন, আর ফিরে আসেননি। আরও দুটি ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জ্বলজ্বল করে হাজির রয়েছে। সিরাজ শিকদার ১৯৭৫ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, তাকে পরে আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। কল্পনা চাকমা অপহৃত হন ১৯৯৬ সালে। তার হদিস আজও পাওয়া যায়নি।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, গুম ও গুমহত্যা বিশেষভাবে বেড়েছে ২০০৯ সালের পর থেকে। এর আগে মানবাধিকার লংঘনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ‘ক্রসফায়ার’ বা আইনবহির্ভূত হত্যা। সেই হত্যা এখনও জারি রয়েছে- মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১৭০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ৬৩ জন ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। এদের মধ্যে রয়েছেন ২০১২ সালে গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ইলিয়াস আলী এবং ২০১৫ সালের গুম হয়ে যাওয়া আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ। সালাহ উদ্দিনের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি শুধু গুম হননি, তাকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এটা নতুন ফেনোমেনা।


আমাদের হাতের কাছে ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত একটি বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গুম হয়ে যাওয়া নাগরিকদের একটা বছরওয়ারি পরিসংখ্যান আছে (সূত্র : অধিকার)। গত পাঁচ বছরে যে ২৭৪ জনকে গুম করে ফেলা হয়েছে তাদের মধ্যে ৩৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তারা জীবিত নেই, এই তথ্যটুকু অন্তত জানা গেছে। ১৫৯ জনের মধ্যে অনেককে মুক্তি দেয়া হয়েছে অথবা কোনো না কোনো মামলায় আটক দেখানো হয়েছে; কিন্তু বাকি ৮০ জনের কোনো পাত্তাই নাই। দুই হাজার সতেরো সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ জন নাগরিককে গুম করে ফেলা হয়েছে।

এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের নির্বাচনী তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সালে যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছিল, তারা দ্বিতীয়বার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল কোনো নির্বাচন ছাড়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে কোনো নির্বাচন হয়নি। এর ফলে নির্বাচনের নৈতিক ও আইনি বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে প্রচণ্ড দমন-পীড়নের সময় গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। নির্বাচনের বছরে প্রচারণার ভয়ে গুম কিছুটা কমলেও এর পরের বছরগুলোতে গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। এ পরিসংখ্যানই গুম ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে বাধ্য করে। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে, সেই তুলনায় গুম সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা কম। গুম বিশেষ মনোযোগের দাবিদার, কারণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের চরিত্রের দিক থেকে গুমসংক্রান্ত আলাদা আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। তার সুনির্দিষ্ট আইনি ব্যাখ্যাও আছে, গুম প্রতিরোধ করতে হলে যা জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। গুমের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা না গেলে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন-পীড়নের যে ধারাবাহিকতা ও মাত্রা আমরা দেখছি, তাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সাধারণ নাগরিকদের গুম করে ফেলার ঘটনা কমবে কিনা বলা দুঃসাধ্য হয়ে গিয়েছে। নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গুমের বিষয়টি রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সামনে নিয়ে আসা খুবই জরুরি।

দুই

বাংলাদেশে গুমের ঘটনা বৃদ্ধি আন্তর্জাতিকভাবে এতই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের বিবৃতি দিতে হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখতে হবে। ঘটনার শিকার যারা, সেসব নাগরিককে যথাযথ সহায়তা দিতে হবে বাংলাদেশের। সরকারের উচিত গুম ও অপহৃত ব্যক্তিদের সন্ধান করা এবং তাদের আত্মীয়দের তদন্তের অগ্রগতি জানানো।’

প্রতিবেদনে ছ’মাস আগে বিরোধী দলের তিন নেতার তিন সন্তানের অপহরণ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সে সময় জাতিসংঘের ‘গ্রুপ অব ইনভলান্টারি এনফোর্সড ডিসাপেয়ারেন্স’ বাংলাদেশ সরকারকে তাদের খুঁজে বের করার কথা বলে। হাম্মাম কাদের চৌধুরী ইতিমধ্যে মুক্তি পেলেও আরও দুজন মীর আহমেদ বিন কাশেম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ হিল আমান আল-আজমি এখনও রাষ্ট্রের কাছে বন্দি আছেন।

গুম ও হত্যা একটি নির্বাচিত সরকারের আমলে এত ভয়ঙ্করভাবে বাড়ল কেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়, আইনের শাসনের অভাব; কিন্তু সেটা খুব ভালো উত্তর নয়, কারণ এর পরের প্রশ্ন আইনের শাসনেরও বা অভাব কেন? তার উত্তর দিতে গেলে, বলা বাহুল্য, বিচার বিভাগকেই অনেকেই দোষারোপ করে থাকেন। অন্যদিকে খোদ প্রধান বিচারপতি দাবি করছেন, ‘প্রশাসন কোনোদিনই চায়নি বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে যারা আছে তাদের পরিচালনা করে কয়েকজন আমলা’ (দেখুন দৈনিক যুগান্তর ২৫ এপ্রিল ২০১৭)। বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রশাসনের এ দ্বন্দ্ব কতটুকু পেশাগত স্বার্থ আর কতটা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন বিচার প্রক্রিয়া গড়ে ওঠার সংকট সেই তর্কে আমরা যাব না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা এবং গ্রেফতার করার পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির করানোর ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের নির্দেশ অমান্য করার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ কোনো ভূমিকা পালন করতে অক্ষম, এটা মেনে নেয়া কঠিন।

দ্বিতীয়ত দাবি করা হয়, গুম নিয়ে আমাদের কোনো আইন নাই। অথচ এ দাবির কোনো ভিত্তি নাই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন, যা ‘রোম স্টেটিউড’ নামে পরিচিত (Rome Statute of the International Criminal Court), স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৭ জুলাই ১৯৯৮ সালে। একে র‌্যাটিফাই বা ‘অনুস্বাক্ষর’ করবার জন্য মানবাধিকার কর্মীরা তখন থেকেই কাজ করছেন। যার ফলে ২৩ মার্চ ২০১০ সালে বাংলাদেশ তা অনুস্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এ আন্তর্জাতিক আইনের আর বাইরে নয়। যারা গুমের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে সরকার তাদের অবশ্যই বিচার বিভাগের আওতায় আনতে পারেন, প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারেন। যারা গুম করছে তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটনার জন্য অপরাধী। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাদের বিচার হতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আদালত যদি বিচার করতে ব্যর্থ হয়, বিচার বিভাগকে আন্তর্জাতিক মহলে জবাবদিহি করতে হতে পারে।

কথা হচ্ছে রাষ্ট্রের দ্বারা নিজের নাগরিকদের গুম করা একটি অপরাধকে অন্যসব অপরাধ থেকে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করা হয়। যে কারণে আন্তর্জাতিক আইনে গুমের সংজ্ঞাকেও সুনির্দিষ্ট করতে হয়েছে :

Article 2 (International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance)

For the purposes of this Convention, 'enforced disappearance' is considered to be the arrest, detention, abduction or aû other form of deprivation of liberty by agents of the State or by persons or groups of persons acting with the authorization, support or acquiescence of the State, followed by a refusal to acknowledge the deprivation of liberty or by concealment of the fate or whereabouts of the disappeared person, which place such a person outside the protection of the law.

অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার, বন্দি করা, অপহরণ অথবা যে কোনোভাবে তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে এমন কাজ করা এবং সেই ব্যক্তি কোথায় আছে বা কেমন আছে এ তথ্য গোপন করার মাধ্যমে তাকে আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়া এনফোর্সড ডিসাপেয়ারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।

কেন সুনির্দিষ্ট করতে হল? যেখানে রাষ্ট্রকেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা করার কথা, রাষ্ট্র তা না করে পাল্টা নিজেই নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করছে এবং নিজেই নাগরিকদের আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেমালুম গায়েব করে দিচ্ছে। গুম করার একটি প্রধান উদ্দেশ্য নাগরিককে সব ধরনের আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা শুধু নয়, সে যেন কখনও জীবিত থেকে আইনি পরিমণ্ডলে প্রত্যাবর্তন করতে না পারে তার সম্ভাবনা নিশ্চিত করা। এর সোজা মানে হচ্ছে গুমের মতো অপরাধে জড়িয়ে রাষ্ট্র নিজের নৈতিক ও আইনি ভিত্তি নিজেই ধ্বংস করছে। এ দিকটি বোঝার মতো বিচক্ষণতা বিচার বিভাগের না থাকার কথা নয়। যে দেশে গুমের মতো ঘটনা ঘটে এবং বিচার বিভাগের কোনো সক্রিয় ভূমিকা থাকে না, সেই দেশের বিচার বিভাগও আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অপরাধী।

রাষ্ট্র কেন এ সন্ত্রাসী ভূমিকা নেয়? এর প্রধান কারণ নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক তৈরি করে গণতন্ত্র ও গণবিরোধী শাসন অব্যাহত রাখা। এর প্রতিরোধ করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন একটি কৌশলগত অবলম্বন হতে পারে। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটা আমরা এখনই বিচার করতে পারব না। তবে কেন গুম নিয়ে বিশেষ আন্তর্জাতিক আইন করতে হয়েছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কর্তব্যগুলো কী সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। যেমন, ১. নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার সুরক্ষা, ২. কোনো ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতন বা মানুষের জন্য অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি না পাওয়ার অধিকার, ৩. যদি রাষ্ট্র অভিযোগ আনে তাহলে কারাগারে মানবিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা, ৪. ব্যক্তি মাত্রই আইনের সুরক্ষার অধীন, অর্থাৎ আইন ও বিচারের পরিমণ্ডলের বাইরে নিক্ষিপ্ত না করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং ৫. সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতে সুবিচার পাওয়া, ইত্যাদি।

মানবতার বিরুদ্ধে এ ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই আবশ্যক হয়ে উঠেছে।

Thursday, May 25, 2017

এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়


 
আশরাফুল ইসলাম /  নয়া দিগন্ত 

(Bangladeshi Voices Blog) — একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকা থেকে গাজীপুরে গিয়েছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শাখায় ৪ ঘণ্টা অবস্থান করেন তারা। এর মধ্যে ৪০ মিনিট বিদ্যুৎ ছিল। বাকি ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট কাটাতে হয় বিদ্যুৎবিহীন। তেলচালিত জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের জোগান দেয়া হচ্ছিল। এক সময় জেনারেটরও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে টিকতে না পেরে নতুন এ শাখা থেকে দ্রুত বের হয়ে রাস্তায় পার্কিংয়ে থাকা এসি চালিত গাড়িতে অবস্থান নিতে হয় তাদের। 


এ ঘটনা গত মঙ্গলবারের। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিদ্যুতের এ দুর্বিষহ অবস্থা বলতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, টেলিভিশনের পর্দায় বিদ্যুতে সয়লাব হয়ে গেছে দেশ এমন দাবির কথা শোনা যায় ক্ষমতাসীনদের মুখে। কিন্তু বাস্তবে চিত্র উল্টো। তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়ার কথা বলে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে দফায় দফায়। অথচ এর সুফল পাচ্ছে না জনগণ। ওই কর্মকর্তার প্রশ্ন, তাহলে সরকারের দাবি অনুযায়ী এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়?

রাজধানীর অভিজাত এলাকা খ্যাত উত্তরার এক বাসিন্দা গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে জানান, রাত ১২টা থেকে সকাল পর্যন্ত তিন দফা লোডশেডিং হয়েছে। একে তো ভ্যাপসা গরম তার ওপর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে রাতে ঘুম হয়নি। বনশ্রীর এক বাসিন্দাও বিদ্যুতের একই চিত্র তুলে ধরে জানান, বাসায় জেনারেটর নেই। আইপিএস আছে। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে গভীর রাতে আইপিএসেও চার্জ না থাকায় বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রচণ্ড গরমে কোমলমতি শিশুরা ঘুমাতে পারেনি। রাত জেগে হাতপাখা দিয়ে তিনি সন্তানদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

গত কয়েক দিন দেশে চলছে তীব্র তাপদাহ। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। রাজধানীর পাশাপাশি সারা দেশই ভুগছে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায়। ঢাকার বাইরে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মঈন উদ্দিন খান। বাবা মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে তিনি পিরোজপুর গিয়েছিলেন কয়েক দিন আগে। ঢাকায় ফিরে তিনি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সরকার বিদ্যুৎ দেয়ার নামে গ্রামের মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। গ্রামের পর গ্রাম বিদ্যুতের খাম্বা গেড়ে বিদ্যুতের লাইন দেয়া হয়েছে। কিন্তু দিনে রাতে এখন বড় জোর দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকছে না। জেনারেটর, আইপিএস বা বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এক ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যে বাস করছে গ্রামের মানুষ।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ২২ মে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন চার দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ইতোমধ্যে সময়সীমার দুই দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু লোডশেডিং পরিস্থিতি গতকালও অপরিবর্তিত ছিল। ভয়াবহ লোডশেডিং খোদ রাজধানীতেই।

পিডিবির ওয়েবসাইটে গতকাল দেখানো হয়েছে, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৫৭৮ মেগাওয়াট। কিন্তু গতকাল অফপিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে আট হাজার ৩৮৮ মেগাওয়াট। আর পিক আওয়ারে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত উৎপাদন দেখানো হয়েছে আট হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। চাহিদা দেখানো হয়েছে, ৯ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ গতকাল চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের ঘাটতি এক হাজার ৫২ মেগাওয়াট। 

চাহিদার চেয়ে উৎপাদনের এ ঘাটতি দেখানোর বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল হাসান নয়া দিগন্তকে জানান, আসন্ন রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১০টি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্কারের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। ইতোমধ্যে কিছু উৎপাদনে এসেছে। আগামী ২৬ মে আরো দু’টি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। সবমিলে রমজানের আগেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে তিনি আশা করেন।

কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। কারণ সরকার গড়ে আট হাজার থেকে সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। কিন্তু যে ভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে তাতে প্রকৃত চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। সে হিসাবে ঘাটতি সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। সুতরাং বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি কতটুকু যৌক্তিক তা বাস্তবেই প্রমাণ হচ্ছে।


Sunday, May 21, 2017

লুটপাটের রাজত্ব

ড. আবদুল লতিফ মাসুম / নয়া দিগন্ত


 
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দৃশ্যমান হবে, দেশটি লুটপাটের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছে। অর্থনীতির যেসব খাত রয়েছে, যেমন - উন্নয়ন, ব্যাংক, শিল্প ব্যবস্থাপনা, আমদানি ও রফতানি ইত্যাদি খাতগুলোয় শাসক দলের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অনাচার একধরনের ধস নামিয়েছে। ক্ষমতাসীন লোকেরা অনৈতিক ও বেআইনিভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে একেক জন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণী। রাজনীতিতে ইতোমধ্যে ব্যবসায়িক প্রাধান্য এতটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, লোকজন পার্লামেন্টকে ‘কোটিপতিদের ক্লাব’ বলে সমালোচনা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ব্যাংক আইনের সংশোধনী প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘অর্থশক্তির ক্ষমতা যে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শক্তিকে অতিক্রম করে গেছে, এই সংশোধনীর মাধ্যমে তা প্রমাণিত হলো’। মূলত সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। আপাতত ব্যাংক লুটপাটের কাহিনীই পত্রস্থ হলো। 

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক


সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শোচনীয় অবস্থা ফুটে উঠেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে রাষ্ট্রীয় পাঁচটি শীর্ষ ব্যাংকের মূলধন উধাও হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো লাভ তো দূরের কথা সরকারের ব্যাংক খাতের লোকসান গুনতে গুনতে এখন মূলধনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো নিজের মূলধন তো হারিয়েছেই, উপরন্তু সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যবসায়ের পরিবর্তে এসব ব্যাংক এখন মূলধন জোগান দিতেই চিন্তিত। ইতোমধ্যে মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। ঘাটটিতে থাকায় এসব ব্যাংক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসায় পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়েছে। ব্যাংক পাঁচটি হচ্ছে -  সোনালী, রূপালী, বেসিক, কৃষি এবং রাশজাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক ঋণের মান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিধিব্যবস্থা বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ও দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন পূরণের প্রসঙ্গে জানা যায়, ক্ষমতাসীনদের বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণ আদায় না করতে পারায়ই ব্যাংকগুলোর মূলধনের ঘাটতি বেড়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১১-২০১৩ সালের মধ্যে সোনালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা বেহাত হয়েছে। এর বাইরে রূপালী, অগ্রণী ব্যাংকসহ বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর দুর্নীতির তথ্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে উঠে আসে। 

ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র 


অতি সম্প্রতি, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯২ সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রচলিত নিয়ম-রীতি, আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে এ সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হতে যাচ্ছে। নতুন নিয়মে একই পরিবারের চারজন ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন। পরিচালকেরা ব্যাংকে থাকতে পারবেন টানা ৯ বছর। মূলত প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সুযোগ দিতেই এভাবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হলো। বর্তমান আইনে অনেকেরই পরিচালক থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করল সরকার। ব্যাংক অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকে অবাধ লুটপাটের দরজা খুলে দেয়া হলো। এই সিদ্ধান্ত এটাই প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে লুটপাটের রাজত্ব কায়েমের জন্যই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বাধা-বন্ধনহীন ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে অনেক। বিশৃঙ্খল হবে পুরো ব্যাংক খাত। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবশ্যই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উল্লেখ্য, সরকারি দলের লোকজন সব ব্যাংক দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে দেশে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৪০টি। এসব ব্যাংকের উদ্যোক্তারা মূলধনের জোগান দিয়েছেন ১৬ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে এখন আমানতের পরিমাণ ছয় লাখ কোটি টাকা। আমানতের তুলনায় উদ্যোক্তা পরিচালকদের মূলধন মাত্র আড়াই শতাংশের চেয়ে কিছু বেশি, অথচ তারাই এখন ব্যাংকের মালিক-মোখতার সেজে বসেছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সালে প্রণীত হয়। এটি সংশোধিত হয় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। ওই আইন অনুযায়ী চলতি বছরেই বেশির ভাগ পরিচালকের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এ কারণে ২০১৬ সালের মধ্যভাগ থেকে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক-বিএবি, সংশ্লিষ্ট আইনের বেশ কিছু ধারা পরিবর্তনের দাবি করে আসছিল। এখন তাদের দাবিদাওয়া অনুযায়ী ব্যাংক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। 

লাগামহীন খেলাপি ঋণ


ব্যাংক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের লুটপাটের রাজত্বের আরেকটি বড় প্রমাণ ঋণ নিতে নিতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে ফেলা। এ বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এক বছরেই ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের লাগাম কোনোভাবেই টানতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ সুবিধা দিয়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ দীর্ঘ মেয়াদে পুনর্গঠন করা হয়েছে। একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পর্যাপ্ত অর্থ জমা ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরেও গত মার্চ ২০১৭ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। ব্যাংকের মোট ঋণের এটি ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। এ বছরেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এ হিসাবের বাইরে আরো ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এই অবলোপনের তথ্য যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ পরিসংখ্যানটি যেকোনো মানুষকে বিচলিত করবে। ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ নেয়া হচ্ছে। অপর দিকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা নিজেদের মধ্যে ঋণ দেয়া-নেয়া করছেন। যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। জনপ্রিয় একটি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ব্যবসায়ীরা ঠিক করছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে কারা আসবেন। প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয় যে, এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে ক্রমেই খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা বেরিয়ে আসছে। সাধারণ মানুষ দেখতে পাচ্ছে, অর্থঋণ ও দেউলিয়া আদালতের মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের কোনো বিচার হচ্ছে না। 

লুটপাটের রাজত্ব


উপরিউল্লিখিত প্রতিবেদনগুলোর আলোকে বলা যায়, দেশের বেশির ভাগ অর্থনৈতিক খাত লুটপাটের অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এর ফলে দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ধ্বংসের পথে। এর আগে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা নামের দুটো বিশেষায়িত ব্যাংক ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংস করা হয়েছে সবচেয়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বেসিক ব্যাংককে। অর্থনীতিবিদ শওকত হোসেন মাসুম এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন, একের পর এক সরকারি ব্যাংক ধ্বংসের জন্য সরকার নিজেই দায়ী। সরকার এসব ব্যাংককে জনগণের সেবা দেয়ার জন্য নয় বরং, সমর্থক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ধনী ও নব্য ধনীদের সুবিধা দেয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে রেখেছে। এ কাজে যারা সহায়তা দিতে পারবেন তাদেরই উচ্চপদে বসানো হয়েছে। এ কারণেই এসব ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানো হয়। কেউ কেউ ছয় বছরের বেশি সময় ধরে এমডি থেকে যান। সরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালনা বোর্ড নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রেও কাজ করে রাজনৈতিক বিবেচনা। বোর্ডে স্থান পান দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ব্যাংকের এসব বোর্ড চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরাও অনিয়মের সহায়তাকারী ও দর্শক। প্রতিবেদক উদাহরণ দিয়ে বলেন, সরকারি মালিকানায় থেকেও একসময় বেসিক ব্যাংক শিল্প সচিবের নেতৃত্বে একটি ভিন্ন ব্যবস্থায় চলত। ২০০৯ সালে সেখানেও চেয়ারম্যান করা হয় জাতীয় পার্টির একজন মধ্যম সারির নেতাকে। তার নেতৃত্বে ব্যাপক লুটপাটের কারণে বেসিক ব্যাংক এখন মৃত প্রায়। উল্লেখ্য, সব ব্যাংকের পরিচালনা পদে আওয়ামী লীগের নেতা, পাতি নেতাদের বসিয়ে দেয়া হয়। জনাব শওকত তার প্রতিবেদনে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের এমডি হিসেবে একনাগাড়ে ছয় বছর থাকার উদাহরণ উল্লেখ করেন। ওই কর্তাব্যক্তির অন্যায়-অনিয়মের অনেক প্রতিবেদন জাতীয় দৈনিকগুলোতে ছাপা হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হাস্যকর হলেও সত্য, মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র এক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক লোক দেখানো পদক্ষেপ হিসেবে ওই ব্যক্তিকে অপসারণ করে। পরে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পলাতক থাকেন। তিনি এতই ক্ষমতাসীন যে, জামিন নিয়ে তিনি বিদেশে চলে গেছেন বলে খবর রয়েছে। প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাবেক এমডিও দেশ ছেড়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। উল্লেখ্য, বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডিও পলাতক এবং দেশ ছাড়া হয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বেশ কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১৫ হাজার কোটি টাকার অর্থ সরকারি ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। এ পর্যন্ত এ দুষ্কর্মের জন্য কেউ শাস্তি পায়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ওই সময় হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিষয়ে হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনাকে অর্থমন্ত্রী ‘সামান্য কয়েকটি টাকা’ ধরনের মন্তব্য করে লোকজনকে বিস্মিত করেছিলেন। প্রতিবেদক শওকত হোসেন আরো তথ্য দেন যে, দুদকের মামলায় বেসিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ব্যক্তির নামই নেই। এসব ঘটনায় কি প্রমাণ হয়, বিচার বা দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে সরকারের আগ্রহ কম। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আত্মসাৎ করা পুরো অর্থই ব্যাংক থেকে তুলে নিতে দেয়া হয়। প্রতিবেদক যথার্থভাবেই উল্লেখ করেন, সব ব্যাংকই এখন তথ্যপ্রযুক্তির দিক দিয়ে উন্নত। সুতরাং কোন ব্যাংক হিসাব থেকে কী পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, অর্থ কোথায় কোথায় গেছে, কার হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে তা চাইলেই বের করা সম্ভব, কিন্তু এ কাজটি করা হয় না। এ কথা সহজেই বলা যায়, এসব লুটপাটের সাথে কারা জড়িত এবং পেছনে সহায়তাকারী কারা, তা খুঁজে বের করতে সরকারের কোনো সদিচ্ছা নেই। ঘটনাদৃষ্টে বলা যায়, দুদক ‘হুমকিসর্বস্ব’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিভিন্নভাবে গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি এসব লুটপাটের বিরুদ্ধে বাদ-প্রতিবাদ করলেও দুদকের তেমন সাড়া দৃশ্যমান হয়নি। 

এটি গোটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক, এভাবে বেপরোয়াভাবে দেশের সম্পদ, জনগণের অর্থ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক দিনগুলোতেও একই দৃশ্য একই লুটপাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার দিনে এটি প্রবাদ বাক্যের মতো ছিল যে, ‘ওলটপালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই’। সময় বদলেছে। লুটপাটের সীমা-পরিসীমা বিস্তৃত হয়েছে অনেক। এখন উন্নয়ন থেকে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি সব জায়গাতেই বিনিয়োগ এবং লুটপাট। কথায় বলে, History repeats itself, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সময় বদলায় মানুষ বদলায় না। ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’!

লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com

Saturday, May 13, 2017

বিএনপির নেতাকর্মীরা আরও চাঙ্গা


হাবিবুর রহমান খান ও নজরুল ইসলাম/ যুগান্তর


বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ ঘোষণার পর দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা আরও চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেছে। এজন্য দলের চেয়ারপারসনের ঘোষিত ভিশনকে সামনে রেখে তারা আগেভাগেই ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত দু’দিনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অসংখ্য নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এমন প্রতিক্রিয়া ও তথ্য জানা গেছে।

তারা বলছেন, চেয়ারপারসনের ভিশন ঘোষণা তাদের নতুন করে উজ্জীবিত করেছে। একই সঙ্গে তারা এটাও বিশ্বাস করেন, অতীতে রাষ্ট্রপরিচালনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারলে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক নতুন ধারা সৃষ্টি হবে।

এদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা শুক্রবার যুগান্তরকে জানান, এই ভিশনের আলোকেই তৈরি হবে আগামী নির্বাচনী ইশতেহার। সেখানে অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ চমক থাকবে। কম সময়ের মধ্যে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর বিশেষ কর্মপরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে, যা এই মুহূর্তে প্রকাশ করা হবে না। রাজনীতিতেও ইতিবাচক আমূল পরিবর্তন আসবে।

তিনি বলেন, ওই ফর্মুলা দেয়ার পর শুধু দলের নেতাকর্মী নন দেশের প্রতিটি মানুষ নতুন এক প্রত্যাশায় উজ্জীবিত হবে। তারা যৌক্তিকভাবে স্বপ্ন দেখতে পারবে- সেদিন আর বেশি দূরে নয়, বাংলাদেশ খুব কম সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে পরিণত হবে।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘোষিত ভিশন-২০৩০ দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। দল নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে। ইতিমধ্যে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন ধারার রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে স্বপ্ন ভিশনে দেখানো হয়েছে তা এখন জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে চলছে জোর প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে ৩৭ ইস্যুতে ২৫৬ দফার এ ভিশনটি বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আজ শনিবার থেকে প্রতিটি জেলা সদরে পাঠানো হচ্ছে।

দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার মতে, বিএনপির প্রতি জনআস্থা ও বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় করতে এ ভিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই বিষয়টিকে কিভাবে সব শ্রেণীপেশার মানুষের আলোচনার অন্যতম উপাদান করা যায় সেই কৌশল নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পুরো ভিশনকে নির্বাচনের আগে ও পরে দুই ভাগে ভাগ করে তৈরি করা হচ্ছে কর্মপরিকল্পনা। ভিশনে প্রতিটি ইস্যুর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকবে নির্বাচনী ইশতেহারে। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে ইশতেহার ঘোষিত হবে তা হবে জনসমর্থন অর্জনে আরও সক্ষম ও সমৃদ্ধ।

এদিকে ভিশন-২০৩০ বই আকারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক, সুশীলসমাজের প্রতিনিধিসহ নানা পেশার মানুষের কাছে দ্রুত পাঠানো হবে। সঙ্গে একটি চিঠিও দেয়া হবে। এ প্রক্রিয়ায় কারও কোনো যুক্তিসঙ্গত মতামত থাকলে তা সংগ্রহ করা হবে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা শিগগির কাজ শুরু করবেন। প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, ভিশন-২০৩০ নিয়ে রমজানের মধ্যে অথবা পরে ঢাকায় একটি বড় আকারের সুধীসমাবেশের আয়োজন করা হবে। এ ছাড়া সামনের দিনগুলোতে দলটির প্রতিটি অনুষ্ঠানে নেতাদের বক্তব্যের মূল ফোকাস থাকবে বিএনপির ভিশন-২০৩০।

তারা মনে করেন, সময় পাল্টাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম ভোটার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। এ অবস্থায় তাদের চিন্তার সঙ্গে মিল রেখে বিএনপি ভিশন ঘোষণা করেছে। এখানে সব মানুষের প্রত্যাশার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এই ভিশন-২০৩০ ঘোষণায় দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু দেশেই নয়, বিদেশী কূটনীতিকদের মধ্যেও বিএনপির ভিশন-২০৩০ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি বরাবরই ভিশনারি রাজনৈতিক দল। ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালেও আমরা ভিশন তুলে ধরেছি। বর্তমান বাস্তবতা ও বিশ্বায়নের কথা চিন্তা করেই আমাদের নেত্রী ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছেন। ইতিমধ্যে তা নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। নতুন ধারার রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের এ বার্তা দেশের প্রতিটি জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। সে লক্ষ্যে আমরা নানা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছি। এরফলে বিএনপির প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আরও বাড়বে বলেই মনে করেন তিনি।

ফখরুল ইসলাম বলেন, এ ভিশনে যেসব বিষয় রয়েছে তা বাস্তবায়ন কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তিনি জানান, এ ভিশনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে তা সুনির্দিষ্ট করা হবে।

সূত্র জানায়, ভিশন-২০৩০ সবার কাছে পৌঁছে দিতে ইতিমধ্যে নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কর্মিসভা, সেমিনার, সুধী সমাবেশসহ ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিএনপি। বিষয়টিকে প্রচারের শীর্ষে রাখতে দলটির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে। প্রাথমিকভাবে আজ থেকে বই আকারে জেলা পর্যায়ে পাঠানো হচ্ছে। এরপর বড় পরিসরে উপজেলাগুলোতে পাঠানো হবে। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর ব্যানারেও এ নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আজ রাজধানীর লেডিস ক্লাবে হবে একটি শিক্ষাবিষয়ক সেমিনার। সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ সেমিনারে অংশ নেয়া  প্রায় ৩০০ শিক্ষকের হাতেও ভিশনটি তুলে দেয়া হবে। এ সেমিনারের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আগামীকাল রোববার বিএনপি সমর্থিত একটি সংগঠনের উদ্যোগে রাজধানীতে আরও একটি সেমিনার হবে। সেখানেও আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে বিএনপির ভিশন-২০৩০।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, আমাদের চেয়ারপারসন ঘোষিত ভিশন দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশের মানুষও ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের যে সমর্থন রয়েছে তা ভিশন ঘোষণার পর আরও বাড়ছে। তবে এ ভিশন বাস্তবায়ন করতে গেলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া প্রয়োজন। সেজন্য সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হতে হবে। আশা করি, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারও প্রতিষ্ঠা হবে।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স যুগান্তরকে বলেন, ভিশন ২০৩০’র ইতিবাচক দিকগুলো দেশের তৃণমূলের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে দলের চেয়ারপারসন আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ ঘোষণার পর যুব সমাজের নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। এ ভিশন আগামী আন্দোলন ও নির্বাচনে যুব সমাজসহ নতুন প্রজন্মের কাছে বিএনপির জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আমরাও যুবদলের চলমান সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি এ ভিশন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে নানা কর্মসূচি নিচ্ছি।

রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন যুগান্তরকে বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি। এ দল ও দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে তরুণ প্রজন্মসহ মানুষের চাহিদাও অনেক বেশি। এমন প্রেক্ষাপটে ভিশন-২০৩০ এ দেশের মানুষের মনের কথা রয়েছে। ফলে এটা সাধারণ মানুষসহ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলছে, যা সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।

Thursday, May 4, 2017

Battering the innards of a nation

By Fazal M. Kamal

At a recent event the Prime Minister told members of the Rapid Action Battalion, “You all must give attention to the fact that common people don't suffer in any way... they must not face any unnecessary torture and oppression.” She added, “Remember, we're public servants as our wages and allowances come from people's pockets.”

Rarely have administration leaders made such honest, forthright and frank observations anywhere in the world (naturally keeping the incumbent US president away from these computations for the sake of fairness while avoiding the possibility of rational evaluation getting all tangled up).

But the Prime Minister’s very mild and awfully civil exhortation, it has to be admitted, sadly, for the sake of candor, has come a tad too late for hundreds of people because either they have already gone missing or their lifeless bodies have been discovered or at the very least they have already paid their wages for attracting the attention of members of law enforcement entities all across this land over the last one decade at the minimum.

Additionally, it maybe recalled, these statements of the PM come in the wake of entreaties made not too long back by law enforcement officials who had bleated with the Prime Minister to relieve them of the legal burden of barring them from tormenting persons arrested by them and in their custody.

Clearly, these were not the words they were eager to hear even if they emerged from the highest level of the state.

Moreover, this is also bound to cause a whole lot of head scratching and a great deal of confusion among the law enforcement personnel. They might well wonder, if over all these years they had carte blanch for whatever and whichever way they preferred to proceed, why suddenly are they being reminded of issues they had, for all and every practical purposes, given a pass with the utmost nonchalance.

Be that as it may. The situation had devolved over the years to such a degree that persistent and universal urgent admonitory statements from human rights organizations located in many different parts of the world were treated with unreserved disdain while the tears and fervent appeals of people and victims within the country were viewed as troublesome and annoying garbage.

In the meantime there were reports galore in the media and rampant among the populace of hapless citizens being intimidated with the greatest malice and often subjected to physical abuse reminiscent of the worst colonial behavior inflicted on a subjugated nation. In fact, almost out of the pages of Ripley’s Believe it or Not came stories from wives of law enforcement personnel of abuse, threats and worse inflicted on them by their hubbies. And if these weren’t astonishing enough, there were inconceivable tales of handcuffed persons being physically battered.

The answer to any question relating to the whys of these episodes is: there are more than sufficient incentives to encourage uniformed personnel licensed by the state to resort to atrocious stuff. The evidence seen so far, incidentally, suggests that they haven’t been merely given a 007 license; they actually appear to possess 0014 authorizations and, more importantly, there ain’t no M to report to. Which pretty much provides them—i.e. those who wish to metamorphose into rogue elements—with the liberty to easily outdo any incarnation of Bond, James Bond. Or perhaps even Goldfinger.

To illustrate the existing circumstances we can select any instance at random. For example here are some allegations made a few days back by a woman named Jibon Ara in Cox’s Bazar. She said, “As I refused to give bribe to the sub-inspector [Manosh], he became angry and then he gave me electric shocks. I passed out at the time.” As per reports, Jibon Ara added that the Cox's Bazar District and Sessions Judge's Court granted her bail on March 23 following submission of a report by Judicial Magistrate Tamanna on the torture by SI Manosh.

Per news reports, she was shifted to Chittagong Medical College Hospital's One-Stop Crisis Center where she was found to have injuries on her chest and genital area due to electric shocks.

Subsequently, Jibon Ara filed two cases with the Cox's Bazar District and Sessions Judge's Court -- one of torture and seeking bribe and another under the Women and Children’s Repression Prevention Act. In spite of her nerve to openly accuse a police officer, as is often the case, nothing much happens after the “inquiry”.

So why do they continue to get rotten? It’s of course assumed, for obvious reasons, that a majority of them don’t take that path. But those who can’t curb their avaricious enthusiasm are certainly more prone to take the low road. The causes for an increasing number of them transforming themselves into the latter form are a combination of factors--aside from the lust factor--which also include their commanding officials spewing the most bizarre political and pseudo-political statements. And then there’s the persistent, albeit incongruous, hogging of media attention.

In this context a very recent event may also explain the strange shenanigans going on. At a meeting of captains of industries and businesses with a Cabinet member and assorted officials the pronouncements of a servant of the republic in charge of revenue accumulation reprimanding, nay threatening, some business people were tantamount to the contemptible verging on the ludicrous. The entirety of the fault isn’t his alone: he was being provided with the opportunity to pontificate at confabulations almost everyday and thus elevated to the level of pontifex maximus.

In point of fact one of the primary reasons for this type of creepy behavior relates to what the Prime Minister herself had to remind the law enforcement people; i.e. “Remember, we're public servants as our wages and allowances come from people's pockets.” Rather most of them come to believe they are masters of the people, not their servants. And yet more significantly they begin to believe they’ll remain in office forever and a day.

All the above observations are recorded much more from a sense of sadness that a hopeful nation’s vitals are being eroded from the inside, mainly, due the myopic and tunnel vision of those who have their hands on the levers of power, and are willing to cave in to the cravings of the crass to perpetuate themselves in power. This in turn is offering rogue elements the opportunities to rush after their thirst for material benefits at any cost not only to others but to themselves too even if they refuse to realize the latter fact now.

Tuesday, May 2, 2017

AI: Dissenting voices trapped between fear and repression

The following is an Amnesty International news release:

The Bangladeshi government has not only failed to protect dissenting voices or hold accountable the armed groups that threaten them, it has also stifled freedom of expression through a slew of repressive tactics and new laws, according to a new Amnesty International report published today [May2].

The report, Caught between fear and repression: Attacks on freedom of expression in Bangladesh, documents how armed groups have thrived in a climate of impunity, carrying out a high-profile spate of killings of secular bloggers with few consequences. In four years, only a single case has resulted in convictions.

Activists also regularly receive death threats, forcing some of them to leave the country for their own safety, while the authorities have refused to offer them protection.

Over the last year, the Bangladeshi government has also intensified its crackdown on public debate and criticism, harassing media workers, interfering with their work, and bringing criminal charges against them under draconian laws.

“Between the violence of armed groups and state repression of the state, secular voices in Bangladesh are being consistently silenced. Not only is the government failing to protect people’s freedom of expression, it has been blaming them for the threats they face and criminalizing the work of bloggers and journalists through a slew of repressive laws,” said Olof Blomqvist, Amnesty International’s Bangladesh researcher.

After the online activist Nazimuddin Samad was hacked to death near his university campus in Dhaka in April 2016, the government sought to blame the tragedy on him. The Home Minister Asaduzzaman Khan Kamal said the police would scrutinize his writings for “objectionable” content. Meanwhile, Prime Minister Sheikh Hasina denounced the work of secular writers as “filthy words”.

In several other cases, activists told Amnesty International the police refused to register their complaints about threats they received. In other instances, the police suggested the victims should leave the country, or even began harassing them for writing on “secular topics”.

One secular blogger, who received more than a dozen death threats by phone and on social media, told Amnesty International: “I made several attempts to get some help, but [to] my face they refused to help me.”

Meanwhile their attackers have been able to enjoy almost complete impunity. Since the Awami League government was re-elected in 2014, only one case resulted in convictions - eight alleged members of Ansar al-Islam were found guilty in December 2015 for their role in an attack. 

This has brought a climate of fear in Bangladesh’s once-vibrant civil society, who now resort to self-censorship.

Speaking to Amnesty International, journalists described the repression as the worst they’ve endured since Bangladesh returned to civilian rule in 1991. There are now “red lines” that journalists are careful not to cross. Few dare publish reports that may be deemed critical of Prime Minister Sheikh Hasina or her family, knowing that they could be shut down without explanation or have pressure brought to bear on their advertisers.

“The Bangladeshi government treats journalism as if it were a crime. Through imprisonment, threats, intimidation, and constant interference in their work, Bangladesh’s government has done all it can to silence critical voices in the media,” said Olof Blomqvist.

The 2006 Information and Communications Technology (ICT) Act, which carries a minimum sentence of seven years, is seen as the principal instrument to muzzle critical voices in the country. Its vaguely worded clauses empower the authorities to prosecute people “in the interest of sovereignty, integrity or security of Bangladesh” or if they are deemed to “prejudice the image of the State” or “hurt religious belief”.

The government has used the draconian law to silence criticism in the media by bringing criminal charges against journalists for simply doing their work. In December 2016, Nazmul Huda, a print and television journalist, was arrested, viciously beaten in custody and then charged under the ICT Act for covering protests by garment workers outside Dhaka.

In 2013, the government also used the ICT to bring criminal charges against four secular bloggers for allegedly “hurting religious sentiments”.

Since 2013, several high-profile journalists and editors have been subjected to politically-motivated criminal charges. Most of them have been associated with media outlets that are critical of the government or supportive of the political opposition.

One journalist told Amnesty International: “The government has picked a few individuals to make examples out of. This has been to instill fear in other media, to show what happens when you cross the line.”

In one instance, Awami League supporters filed a flurry of 83 politically motivated cases against Mahfuz Anam, editor of Bangladesh’s The Daily Star newspaper.

Shafik Rahman, an elderly opposition supporter and the editor of the weekly Mouchake Dil magazine, was held in solitary confinement for over three weeks on a trumped-up charge of “conspiring to abduct and assassinate” ruling party politician Sajib Wazed Joy.

Bangladesh’s authorities have frequently invoked archaic, colonial-era criminal defamation and sedition laws against critical journalists.

The authorities are also now proposing new laws, such as a Digital Security Act and Liberation War Denial Crimes Act. If enacted, these laws would impose further restrictions on freedom of expression by creating new criminal offences, sometimes using national security as a cover.

“The crackdown on dissent and secular thought in Bangladesh must end. The very first steps must include providing protection to those who are threatened for raising their voices, and to repeal or reform the draconian laws that are used to punish anyone voicing inconvenient opinions,” said Olof Blomqvist.

Tuesday, April 25, 2017

বহুমাত্রিক সমস্যার কবলে হাওর জনপদ


জি মুনীর / নয়াদিগন্ত 

 


সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওর অঞ্চল একসময় সুপরিচিত ছিল দেশের অন্যতম শস্যভাণ্ডার ও একই সাথে মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে। একসময়ের যে বাংলার পরিচিত ছিল ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ’ অভিধায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল এই হাওরাঞ্চল। অবশ্য এই প্রবাদটির যে সংস্করণটি হাওর এলাকায় পরিচিত ছিল তা ছিল এমন : ‘গোলা ভরা ধান আর বিল ভরা মাছ’। কারণ, হাওর এলাকায় পুকুরের চেয়ে বিলের ছড়াছড়িই বেশি। এসব বিলে ছিল মিঠাপানির প্রচুর দেশী মাছ, যা সারা দেশের মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ করে আসছিল ব্যাপকভাবে। আর এসব বিলের চার পাশ ঘুরে রয়েছে বিস্তীর্ণ বোরো ধানের ক্ষেত। এসব ফসলের ক্ষেত বর্ষায় ডুবে থাকে কয়েক হাত পানির নিচে। আর গ্রামগুলো পানিতে ভাসে ভেলার মতো। শুধু হেমন্তে এসব ক্ষেত থাকে একটি ফসল ফলানোর উপযোগী, যা বোরো ফসল নামে সুপরিচিত। এই এক ফসলের ওপর নির্ভর করে এতদিন হাওরের কৃষকেরা সচ্ছল জীবনযাপন করে আসছিল। কারণ, এ অঞ্চলে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল বেশি, আর আজকের দিনের মতো আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এত ঘনঘন ফসলহানি ঘটত না। তখন হাওরের মানুষ মূলত কৃষি অর্থনীতির ওপরই নির্ভর ছিল। সরকারের কাছেও এরা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করত না। সরকারের কাছে ছিল না তাদের কোনো দাবি-দাওয়া। আর সরকারের বিরুদ্ধেও ছিল না তাদের কোনো অভিযোগ-অনুযোগ। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মাথাপিছু জমির পরিমাণ এক দিকে কমে গেছে, অপর দিকে বছর বছর অকাল বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে বোরো ধানের ক্ষেত। হাওরেও আগের মতো মাছ নেই। ফলে আজ হাওরাঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি বলতে গেলে ভেঙে পড়েছে। তাই আজকের দিনে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে হাওরের কৃষক পরিবারগুলো।

এবার বৈশাখ আসার আগেই চৈত্রের শেষ দিকেই প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল, ভারত থেকে আসা উজানের পানি এসে হাওরাঞ্চলে যে অকালবন্যা হয়েছে, তাতে তলিয়ে গেছে উল্লিখিত সাত জেলার হাওর এলাকার ৯০ শতাংশ বোরো ধানের ক্ষেত। এর ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে এক ধরনের হাহাকার। তা ছাড়া ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় ধানগাছ পচে হাওর এলাকার পানি এরই মধ্যে বিষাক্ত হয়ে গেছে। এর ফলে হাওরের ও নদীর মাছ মরে ভেসে উঠছে। তা ছাড়া এই বিষাক্ত মাছ খেয়ে কিংবা বিষাক্ত পানির বিরূপ প্রভাবে মরে যাচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার হাঁস। এর ফলে কৃষক ও খামারিরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। এর আগেও অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলে ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে এভাবে মাছের মড়ক ও ঝাঁকে ঝাঁকে হাস মরে যেতে দেখা যায়নি। এই মাছের মড়ক ঠেকানো না গেলে হাওর এলাকার জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবেন। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন : ঘরে নেই খানি, ঘরের চালে নেই ছানি, বিষাক্ত মাছ ধরা ও খাওয়ায় এসেছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, নেই কেনো কর্মসংস্থানের সুযোগ, জেলে-চাষি চোখে দেখছেন অন্ধকার। হাওর পারের মানুষের দীর্ঘশ্বাস হাওরাঞ্চলের বাতাস ভারী করে তুলেছে।

অকালে ফসল তলিয়ে গেছে সময়মতো হাওর রক্ষা বাঁধগুলো নির্মাণে সরকারের চরম ব্যর্থতা ও হাওর রক্ষা বাঁধের টাকা লুটপাটের কারণে। আর এখন মাছ ও হাঁসের মড়ক ঠেকানোয় সরকারের কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। শুধু বিচ্ছিন্নভাবে হাওরের পানিতে চুন ছিটিয়ে মাছের মড়ক ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য উপহাসমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। যখন এবারের অভাবনীয় মাত্রার অকাল বন্যার বাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখে চার দিক থেকে দাবি উঠেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকাকে ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করে বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতি জরুরিভাবে মোকাবেলার, তখন সরকারি কর্মকর্তারা এই দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিদারদের মূর্খ বলে প্রতিপন্ন করার প্রয়াসে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। তাদের এই বক্তব্য ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষকদের কাটা ঘায়ে নুন ছিটানোরই শামিল। সব কিছু হারিয়ে হাওর এলাকার মানুষ যখন বাঁচার লড়াইয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে শুরু করেছে, তখন সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের বক্তব্য ঔদ্ধত্যের চরম বহিঃপ্রকাশ।

গত বুধবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেছেন, ‘এই বন্যায় কোথাও একটি ছাগলও মরেনি।’ তিনি এ ধরনের মন্তব্য করে কৃষকদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন। শুধু এ কথা বলেই তিনি থামেননি, বরং তিনি বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাতেও প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটি আইন আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকার অর্ধেকেরও বেশি লোক মারা যাওয়ার পর এই এলাকাকে দুর্গত ঘোষণা করতে হয়। না জেনে যারা এমন সস্তা দাবি জানায়, তাদের জ্ঞানই নেই।’ তিনি ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে আরো বলেছেন, ‘কিসের দুর্গত এলাকা? একটি ছাগলও তো মারা যায়নি।’ 

উল্লেখ্য, ফসলডুবির ঘটনায় হাওরাঞ্চলের সর্বত্র জনপ্রতিনিধিরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কৃষক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমের লেখালেখির মাধ্যমে বিভিন্ন মহল ফসল ডুবে যাওয়া হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে প্রতিবাদী মানুষের সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’। পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা সচিব শাহ কামালের এই অযাচিত বক্তব্যের যথার্থ জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘সচিব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের ২২ নম্বর ধারার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ধারায় রাষ্ট্রপতির ওপর দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, ‘দেশের কোনো অঞ্চলে দুর্যোগের কোনো ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় রোধে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করা জরুরি ও আবশ্যক, তাহা হইলে সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করিতে পারিবেন।’ হাওর আন্দোলনের এই নেতা আরো বলেন, ‘সচিবের এই বক্তব্য অবিবেচনাপ্রসূত, হাওর এলকার মানুষ ও প্রাণীকুলের প্রতি চরম অন্যায়। এখন মাছের মড়ক লেগেছে। হাঁস ও পাখি মরছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ছাগলও মরবে। কঠিন হবে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা।’

আসলে এবারের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সচিব কামাল ছোট করে দেখাতেই এ ধরনের মন্তব্য করেছেন বলে মনে হয়। নইলে তিনি এই দুর্যোগ-দুঃসময়ে এ ধরনের বক্তব্য রাখতেন না। প্রশ্ন জাগে, হাওর এলাকায় এখন কী ঘটছে, কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা কি তিনি দেখছেন না? এরই মধ্যে হাওর এলাকার সার্বিক পরিস্থিতির খবর সরকারি মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছার কথা, কারণ তিনি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। তা ছাড়া অন্তত গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশিত খবরগুলো তো তার না জানার কথা নয়। দেশবাসী তো এরই মধ্যে গণমাধ্যম সূত্রেই জেনে গেছে- কয়েক দিনে সুনামগঞ্জের শুধু ধর্মপাশা উপজেলায়ই খামারিসহ গৃহস্থদের পাঁচ শতাধিক হাঁস মারা গেছে। ধর্মপাশার রবিউর রহমানের খামারে দেড় হাজারের মতো হাঁস ছিল। দু’দিনে হাওরের বিষাক্ত পানিতে মরে যাওয়া পচা মাছ খেয়ে মারা গেছে তার ১২০টি হাঁস। ফলে বেঁচে থাকা অন্য হাঁসগুলো তিনি এখন আর হাওরের পানিতে ছাড়ছেন না। বাড়িতে রেখেই এগুলোর যত্ন নিচ্ছেন। জানা গেছে, এই বিষাক্রান্ত হাঁস এক দিনেই মারা যায়। রবিউর রহমানের বাড়ি ধর্মপাশা উপজেলার বাদেহরিপুর গ্রামে। রবিউর রহমানের মতো একই অবস্থা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের সরিষাকান্দা ইসলামপুর গ্রামের খামারি আল আমিনেরও। আল আমিনের ৭০০ হাঁসের মধ্যে দু’দিনে মারা গেছে ৭০টি। জানা যায়, ধর্মপাশা উপজেলায় ২৬০ জন খামারি ও ছোটখাটো গৃহস্থের সাত লাখ ১৫ হাজার ৩১০টি হাঁস রয়েছে। এগুলো নিয়ে খামারিরা এখন বিপদে। একইভাবে মোহনগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হাঁস মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওরে মারা গেছে অনেক হাঁস। হাঁস ও পাখি মারা গেছে হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজারের বড়লেখা অংশে। সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে ভেসে উঠেছে অনেক মরা মাছ। হাকালুকি হাওরেও মাছ মরছে। আরো বহু জায়গায় মাছ ও হাঁস মরার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে একাধিক জাতীয় দৈনিকে। একইভাবে মাছের মড়ক ঠেকানোর জন্য চুনের পানি ছিটাতে দেখা গেছে অনেক হাওরে। এমনি পরিস্থিতিতে ‘একটি ছাগলও এখনো মরেনি’ ধরনের বক্তব্য একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে কাম্য নয়। হাওর জনপদের দিশেহারা মানুষের পক্ষ থেকে যখন হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি উঠেছে, তখন তাদের জ্ঞানই নেই বলে কটাক্ষ করাও অপ্রতাশিত।

এরই মধ্যে ধর্মপাশা ও মোহনগঞ্জের কয়েকটি হাওরের পানির উপাদান ও গুণাগুণ পরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি গবেষকদল গত বুধবার সকালে ধর্মপাশার কাইঞ্জা ও ধরাম হাওরের এবং বৃহস্পতিবার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে পানি পরীক্ষা করে। গবেষণায় দেখা যায়, হাওরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে পাঁচ মিলিগ্রামের নিচে নেমে গেছে এবং প্রতি লিটারে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়েছে আধা থেকে ১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ৬ মিলিগ্রামের বেশি এবং অ্যামোনিয়ামের পরিমাণ প্রতি লিটারে শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য দুই (০.০০২) মিলিগ্রামের চেয়ে কম থাকার কথা। তবে গত বুধবার ধর্মপাশার হাওরে একটানা বৃষ্টিপাতের ফলে হাওরের পানির অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে বলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাদে মতে, হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কমে যাওয়া এবং অ্যামোনিয়ামের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় মাছ ও হাঁস মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে কখনোই এবারের মতো বন্যার পানিতে মাছ, হাঁস ও পাখি মরতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইউরেনিয়াম খনি থেকে বিষাক্ত উপাদান হয়তো এবারের বন্যার পানিতে মিশে বাংলাদেশের হাওরে ছড়িয়ে পড়েছে। এই পানি একসময় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ওপেন পিট ইউরেনিয়াম খনি। এ খবর দিয়েছে, ইরানের গণমাধ্যম পার্সটুডে। 

রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তিকেন্দ্রের রসায়ন বিভাগের প্রধান ড. বিলকিস আরা বেগম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভারত থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি বাংলাদেশের হাওর এলাকাগুলোতে আসার সম্ভাবনা প্রচুর। আর যদি তা-ই ঘটে, তা হবে আমাদের জন্য পিজ্জনক। তবে এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না চালিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু ভারত থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, গত ডিসেম্বরে মেঘালয়ের স্থানীয় খাসিয়া জনগোষ্ঠী সে এলাকার রানিকর নদীর পানি নীল থেকে বদলে সবুজ হয়ে যেতে দেখে। এ প্রেক্ষাপটে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাসিয়া স্টুডেন্ট ইউনিয়ন এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। সংগঠনটি তখন এই নদীর মাছ মরে যাওয়ার বিষয়টিও অবহিত করে। এমনকি জলজ প্রাণীবিহীন এই নদীটি এখন মৃতপ্রায় বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। খাসিয়া সম্প্রদায়ের নেতা মারকনি থঙনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সন্দেহ ইউরেনিয়াম খনি খননের ফলে এ থেকে নিঃসৃত ইউরেনিয়াম পানিতে মিশে নদীর পানির রঙ বদলে দিয়েছে এবং এর প্রভাবে এর মাছও মরে গেছে। ভারতের যে নদীতে ইউরেনিয়াম মিশে যাওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার জাদুকাটা নদী থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে বলে পার্সটুডের খবরে বলা হয়েছে।

এমনিতেই হাওর এলাকার সমস্যার অন্ত নেই। এর মধ্যে এবার হাওরের পানিতে প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া ও অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং ভারতের ইউরেনিয়াম খনি থেকে ইউরেনিয়ামের উপাদানের পানিতে এসে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা ইতাদি পরিবেশিক সমস্যা এখন দেখা দিয়েছে হাওরাঞ্চলের সমস্যার এক নতুন উপসর্গ হিসেবে। হাওরে এই সময়ে মাছ মরে যাওয়ার ঘটনা আমাদের সামনে নিয়ে এলো নতুন তাগিদ। হাওরের মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ সম্পদকে বাঁচাতে হলে হাওরের পানির ওপর নিয়মিত নজর রাখতে হবে। হাওরের পানি যেন সব সময় মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার উপযোগী থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সবার আগে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের বিষয়টি সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্বটি পালন করতে হবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদেরই। ভুললে চলবে না, হাওর এলাকার মাছ যেমন মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উৎস, তেমনি হাওরের মাছ সম্পদ থেকে সরকার প্রতি বছর পেয়ে থাকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। পাশাপাশি হাওর এলাকার জেলেদের জীবন-জীবিকা মূলত নির্ভরশীল মাছ সম্পদের ওপর। কিন্তু সময়ের সাথে হাওরের মাছ সম্পদ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এর সাথে সম্প্রতি হাওরের পানিতে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এতদিন হাওর এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি অবহেলিত হয়ে আসছে। এখন তা বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে এসে ঠেকেছে। এখন এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলার অবকাশ নেই।

হাওর এলাকার জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি এখন পুরাপুরি ভঙ্গুর পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এই এলাকার মানুষ সার্বিক দৃষ্টিতে লেখাপড়ায় পিছিয়ে। ফলে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে রুটিরুজি করাও তাদের জন্য কষ্টকর। এর পরও এবারের ফসলহানি তাদের বাধ্য করছে গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে শহরমুখী হতে। অনেকেই হালের গরু অর্ধেক দামে বিক্রি করে ঋণের দায় মিটিয়ে গ্রাম ছাড়ছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে, মহাজনদের হাত থেকে বাঁচতে হাওরের অনেক কৃষক গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। এ অবস্থায় অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দেয়ার স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছেন। কারণ বছরের পর বছর ঋণের টাকায় ফসল ফলাবে, আর সেই ফসল প্রতি বছর পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে- এভাবে তো চলতে পারে না। এর ফলে হাওরের মানুষ ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সার্বিকভাবে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে জাতীয় কৃষির ওপর। আর হাওরে মাছ না থাকলে জেলেরা বাধ্য হবে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হতে। 
  • লেখকঃ কলামিস্ট

Sunday, April 23, 2017

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক

এম. সিরাজুল ইসলাম / বণিক বার্তা


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ভারত সফর করেছেন। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দারুণ আতিথেয়তা দেখিয়েছেন। মোদি সরকার এ সফরের মর্যাদাকে একটি সরকারি সফর থেকে একটি রাষ্ট্রীয় সফরে উন্নীত করেছিল, যা ছিল পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রটোকলের ব্যতিক্রম, কেননা রাষ্ট্রীয় সফরে যান রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান নন।


২০১০ সালেও কিন্তু একই ধরনের প্রতিষ্ঠিত প্রটোকলের ব্যতিক্রম ঘটানো হয়েছিল। ওই সফরকেও একটি রাষ্ট্রীয় সফর হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। এবার নয়াদিল্লি প্রতিষ্ঠিত প্রটোকলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজেই অভ্যর্থনা জানান। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন না।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ দুই সফরের মধ্যে আরেকটি পার্থক্য রয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে ভারত সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার ক্ষমতায় আসার তিন বছরের বেশি সময় পর দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফরের আমন্ত্রণ পান। প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ মেয়াদে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে উভয় পক্ষের আন্তরিকতার প্রতিফলন হিসেবে প্রায়ই দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার— যার সঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসার মিল রয়েছে— পর থেকে ওই ধরনের ঘন ঘন উচ্চপর্যায়ের সফর অনেকটাই কমে যায়। প্রকৃতপক্ষে নয়াদিল্লির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল গত বছরের ডিসেম্বরে, যখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর প্রতিরক্ষাসেবার তিনজন উপদেষ্টাসহ ঢাকা সফরে আসেন। ওই সফর ফাঁস করে দেয় যে, হঠাত্ করেই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করতে চাইছে।

প্রতিরক্ষা বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ভালো নয়, যদিও খুনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে চূড়ান্ত ধাক্কা দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। চূড়ান্ত ধাক্কায়— তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১— ভারত কয়েক হাজার সৈন্য হারিয়েছিল। তথাপি যখন ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখনো ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুই দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নিতে বলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ওই কথোপকথন ও ভালোবাসার সোনার বাংলাকে পূর্বের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দ্ব্যর্থহীনভাবে গুরুত্বারোপ করছে যে, ভারতসহ যেকোনো দেশের সঙ্গে সামরিক জোট তৈরি করার কোনো সুযোগ বাংলাদেশের নেই। অধিকন্তু হয়তো উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের সামনে বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশ কখনো কোনো বহিরাগত আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়নি।

এজন্য এটা স্বাভাবিক ছিল যে, যখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিসেম্বরের সফরে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রস্তাব দেন, তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে উত্সাহী ছিলেন না। গুজব ও অনানুষ্ঠানিক তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর, যারা প্রস্তাবিত চুক্তির বিষয়ে মতামত জানাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের উদ্ধত মনোভাব নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যকে আরো জটিল করে তুলেছিল।

এটা স্বাভাবিক যে, ল্যান্ড ট্রানজিট বাংলাদেশ মেনে নেয়ার পর ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চাইবে। কৌশলগত বিষয় নিয়ে যারই সাধারণ জ্ঞান রয়েছে, তারাই বুঝতে পারবেন, বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো তৈরির জন্য ভারত ‘সফট লোন’ হিসেবে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিতে চেয়েছিল, তা আদতে ছিল ওইসব সড়ক ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য ব্যবহারযোগ্য করে গড়ে তোলা, যাতে এ সড়ক ব্যবহার করে কৌশলগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সেভেন সিস্টার্সে তারা যেতে পারে এবং একসময় ঠিকই ভারত ল্যান্ড ট্রানজিটকে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য এ ধরনের চুক্তি করতে চাপ দেবে।

বাংলাদেশ নিজে ভারতের জন্য কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি নয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে যে ধরনের নিরাপত্তা সমস্যা ছিল, তা ভারতীয় ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যৌথভাবে সামলে নিয়েছে। এটা ঠিক যে, ভারতীয় কৌশলগত বিবেচনায় চীনের কারণে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সবসময় ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুপার পাওয়ার হওয়ার দৌড়ে শক্তিশালীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। হয়তো শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে এক নম্বর আসন দখল করবে দেশটি।

এবং চীনের সঙ্গে ভারতের বড় ধরনের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা রয়েছে। চীন ভারতীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশ দাবি করে এবং এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে ১৯৫২ সালে দেশটির যুদ্ধও হয়েছে। সেভেন সিস্টার্সের একটি রাজ্য অরুণাচল। চীনের আঞ্চলিক দাবির একটি বড় অংশ রয়েছে এ রাজ্যে। ওই অংশে অভিযোগ রয়েছে, চীন সেভেন সিস্টার্সে বিছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উত্সাহিত করছে এবং ভারত ভয় পাচ্ছে যে, এ ধরনের সম্পৃক্ততা বন্ধ হয়নি। এজন্য বাংলাদেশ ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নয়াদিল্লি তত দিন পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না, যত দিন না তারা নিশ্চিত হবে যে, প্রয়োজনের সময় চীনের হুমকি মোকাবেলায় মূল ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তাদের সেনাবাহিনী চলাচল করতে পারবে।

প্রতিরক্ষা চুক্তি ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তারা যত দ্রুত পারে বাংলাদেশের সঙ্গে এটি করতে চাইছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ইচ্ছা, যে কারণে তিনি ভারতকে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছেন, এটিকে ভারত তার দুর্বলতা ভেবে ভুল করেছে এবং মনে করেছে, তারা এ চুক্তি করার জন্য তাকে রাজি করাতে পারবে। তিনি সেটা করেননি এবং কয়েকবার ওই সফর বিলম্ব করেন, যাতে ওই চুক্তির বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী আরো সচেতন ছিলেন যে, সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এ চুক্তির বিরোধিতা করবে।

এজন্য যখন নয়াদিল্লি বুঝতে পারল যে, প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে পারছে না, তখন তারা আর তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো প্রচেষ্টা করেনি। প্রকৃতপক্ষে এ চুক্তির জন্য নয়াদিল্লির সবচেয়ে ভালো চেষ্টা ছিল নয়াদিল্লি সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও মমতা ব্যানার্জির মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি চেয়ে চেয়ে দেখলেন, মমতা ব্যানার্জি তিস্তা চুক্তি হওয়ার পথে নতুন সমস্যা দাঁড় করিয়ে দিলেন। তিনি তিস্তার ওপর নতুন গবেষণার দাবি জানিয়েছেন। তিনি জানান, তিস্তা তার জনগণের হূদয়স্বরূপ এবং তিনি এটিকে ছিন্নভিন্ন হতে দেবেন না। এর চেয়ে বরং তিনি অন্য চারটি নদ-নদীর পানি দিতে চেয়েছেন, যেগুলোর কোনোটাই দুই দেশের মধ্যকার আলোচনায় কখনই আসেনি।

একটি দরিদ্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং ভারত একটি ‘আপাতদৃষ্টিতে ফেডারেশন’, যেখানে কেন্দ্র ‘ইউনিটারি স্টেটের’ মতো প্রায় একই রকম শক্তিশালী। নয়াদিল্লির কোষাগারের ক্ষমতা রয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যেখানে রাজ্য কোনো ধরনের বাধা তৈরি করতে পারে না, যদি না কেন্দ্র চায়। বাংলাদেশের দাবি প্রত্যাখ্যানের যুক্তি হিসেবে নয়াদিল্লি বলছে, নদীর পানি ভাগ রাজ্যের বিষয়। কিন্তু অবশ্যই রাজ্যের ক্ষমতা আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে খাটে না বা খাটতে পারে না।

যদি নয়াদিল্লি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ইচ্ছার বিন্দুমাত্র প্রদর্শন করত, তবে তিস্তা চুক্তি অনেক আগেই হয়ে যেত। কংগ্রেসের শাসনামলে স্থানীয় রাজনীতির কারণে সংবিধানের খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তিস্তা চুক্তি আটকে রেখেছিল নয়াদিল্লি। এ সময় প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই না করায় বাংলাদেশের ওপর নাখোশ ছিল নয়াদিল্লি। এজন্য তারা মমতা ব্যানার্জির অদ্ভুত দাবিতে সায় দিয়েছিল। নয়াদিল্লির এমন মনোভাব ছিল দুর্ভাগ্যজনক এবং যদি তারা মনে করে, ছোট প্রতিবেশীর সঙ্গে তারা যা খুশি তা-ই করতে পারবে, তবে তা সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে না।

আন্তর্জাতিক আইন ও অন্যান্য কনভেনশনে নিম্ন উপকূলবর্তী বা অববাহিকার দেশের জন্য অনুমোদন রয়েছে, সেই মোতাবেক বাংলাদেশ তিস্তা ও অন্যান্য ‘কমন’ নদ-নদীর ন্যায্য ভাগ দাবি করেছে। যদি জাতি হিসেবে মৃত্যু ঘটাতে চায়, তবেই বাংলাদেশ নিজ অধিকার থেকে সরে আসতে পারে। সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রয়োজন, দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতিতে যার অবদান অপরিহার্য। এজন্য বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি যদি ভারত বিন্দুমাত্র আমলে নেয়, তাতে দেশটির উচিত হবে না চুক্তির জন্য চাপ প্রয়োগ করা। এ চুক্তি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ও দেশপ্রেমিক প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে রাজি না হলে ভারতও তিস্তা চুক্তি আরেকবার এড়িয়ে যাবে, এমনটা যে হবে, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে যাওয়ার আগেই বোঝা গিয়েছিল। এটি এ সফরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সুযোগ কমিয়ে  দেয়। এজন্যই প্রটোকলের প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছে ভারতীয়রা। তারা দেখাতে চেয়েছে যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঠিকঠাক রয়েছে।

কিন্তু শেখ হাসিনা এটা অনুমোদন করেননি। প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লির কাছে পরিষ্কার করেছেন যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক টেকসই করার জন্য পানি প্রধান চাবিকাঠি এবং ঢাকায় প্রস্তাবিত উদযাপন বাতিল ছিল এ বার্তাকে ভারতের কাছে আরো পরিষ্কার ও জোরালোভাবে পাঠানো। এর সঙ্গে আরো একটি বার্তা দেয়া হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ইচ্ছার সমকক্ষতা অর্জন করা, যা ভারতের ধারাবাহিক দুই প্রধানমন্ত্রী দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশ বড় ধরনের ছাড় দেয়ার পরও ভারতের উচিত ছিল বাংলাদেশের জরুরি চাহিদা, বিশেষ করে পানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার, ভারত তা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

শেখ হাসিনা এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বলটি ভারতের কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, রাজনৈতিক ঝুঁকি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ইচ্ছার মতো ভারত একই ধরনের রাজনৈতিক ইচ্ছা দেখায় কিনা এবং বাংলাদেশকে তার পানির অধিকার দেয় কিনা। ভারতের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তি উঠিয়ে নিতে হবে, কারণ এ সফর জানাচ্ছে যে, এটি একটি ‘জিরো সাম’ প্রস্তাব, যেটা ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থের ক্ষতি করে সই করতে হবে।

যদি এর পর ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তির জন্য চাপ প্রয়োগ করে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে, তবে এটা বলা অনুচিত হবে না যে, এটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বড় ধরনের আঘাত দেবে। এ সফর আরো বলছে, ভারতের শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছারই অনুপস্থিতি নেই, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবেও দেশটির দূরদৃষ্টি ও মানসের অভাব রয়েছে। দেশটি এও দেখতে ব্যর্থ হয়েছে যে, বিশ্বাসের দিক থেকে বাংলাদেশে ভারতের গ্রহণযোগ্যতায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।

ভারতের এটা বোঝা উচিত যে, কয়েক বিলিয়ন ডলারের ‘সফট লোন’ দেশটির কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ চায় না বা তাদের প্রয়োজন নেই। একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে তারা যথাযোগ্য সম্মান চায়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে সামনে এগোতে হলে ভারতকে এটি এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তিস্তা নিয়ে মমতা ব্যানার্জিকে অদ্ভুত প্রস্তাব দিতে অনুমোদন দেয়া এবং প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রস্তাব দিয়ে ভারত দেখিয়ে দিয়েছে যে, যত দিন পর্যন্ত তাদের স্বার্থ পূরণ হচ্ছে, তত দিন তারা বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করে না।
  • লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

Monday, April 17, 2017

কবে ফিরবেন ইলিয়াস আলী? রাষ্ট্রের কি কোন দায় নেই?

  কাদের গনি চৌধুরী

 

এম ইলিয়াস আলী। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা। স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় অসীম সাহসী এ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জাগিয়ে রাখতো মিছিল, স্লোগান আর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তাঁর গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রাজধানীর রাজপথ। স্বৈরশাসকের রক্ত চক্ষু মেধাবী এ ছাত্রনেতাকে টলাতে পারেনি কখনো। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তিনি। কি অসীম সাহস, কি নিখাদ দেশপ্রেম! অনেকে মজা করে বলতো আপনার কাছ থেকে কিছু সাহস আমাদের ধার দেন না ইলিয়াস ভাই। তিনি জবাবে বলতেন দেশকে ভালবাস, সাহস ধার নেয়া লাগবেনা। সাহস ধার দিতে পারবে। 

স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী অগ্নিঝড়া আন্দোলনের রাজপথের লড়াকু এ যোদ্ধাকে কেউ উপাধি দিলেন রাজপথপুত্র, কেউ বলতেন রাজপথের দাবানল, কেউ বলতেন রাজপথের অগ্নিমশাল। আরো কত কি। 

দেশে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ের এ বীর 'ছাত্রনেতা' থেকে অল্প সময়ে হয়ে উঠেন ' জননেতা'। জনপ্রিয় জননেতা থেকে জননন্দিত জননেতা। আবার জননেতা থেকে পার্লামেন্ট মেম্বার - জাতীয় নেতা। বাংলাদেশের সর্ববৃহত রাজনৈতিক দল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। জাতীয়তাবাদের পতাকা উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুর্বার গতিতে। যে ইলিয়াস আলী জনতার,তাঁকে রুধিবে সাধ্য কার?

না, জননন্দিত এ নেতাকে আর এগুতে দিলো না, থামিয়ে দিল ফ্যাসিবাদী সরকার। এতবড় একজন জাতীয় নেতাকে গুম করার পর কি কোন সরকারের সাফল্য থাকতে পারে? সাধারণ মানুষ কি নিরাপদবোধ করতে পারেন? মানুষের যদি নিরাপত্তাই দিতে না পারে কিসের জন্য এ সরকার? কার জন্য এ সরকার?

কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি এম. ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ঢাকার বনানী থেকে ব্যক্তিগত গাড়ীচালক আনসার আলীসহ রহস্যজনকভাবে গুম হন তিনি। সে থেকে এখনো তাঁর পরিবার খুঁজে বেড়াচ্ছে ইলিয়াস আলী। তাদের কান্নার যেন আর শেষ নেই। তাদের অপেক্ষার যেন সমাপ্তি নেই। ইলিয়াস আলীর বৃদ্ধা মা সন্তানের পথ পানে চেয়ে থাকেন, এবুঝি আসছে 'বাছাধন'। প্রিয় সন্তানের চিন্তায় মা মৃত্যুপথ যাত্রী। ঈদ, আর নববর্ষে বাংলার মানুষ যখন উৎসবে মেতে উঠে, তখন ইলিয়াস আলীর পরিবারে দেখা দেয় কান্নার রোল। বাবাকে ছাড়া ইলিয়াসের সন্তানরা কিভাবে আনন্দ করবে?

ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর দেশব্যাপী গড়ে উঠে কঠোর আন্দোলন। ওই আন্দোলনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নির্বিচারে গুলি চালালে ইলিয়াসের ভালবাসায় প্রাণ দেন বিশ্বনাথের তিন বিএনপি কর্মী। ফিরে পাওয়ার আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা-মামলা শিকার হন হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। মামলায় কারাবরণ করেন অনেকে। তবুও আন্দোলন থেকে পিছু হঠেনি ইলিয়াস প্রেমিরা।

কিন্তু একে একে পাঁচ বছর পূর্ণ হলেও আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান দিতে পারেনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাবেক এ সংসদ সদস্যকে উদ্ধারে সরকারের কোন তৎপরতাও চোখে পড়েনি। এপরও নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস’র জন্য অন্তহীন অপেক্ষা চলছে তার পরিবার, বিশ্বনাথের আপামর জনতা ও দেশবাসীর।

সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান মারা যাওয়ার পর এম ইলিয়াস আলী হয়ে উঠেন সিলেট বিএনপির একমাত্র কান্ডারী। শুধু সিলেট নয়, গোটা বিভাগের একজন অভিভাবক হিসেবে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।

তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার মিনতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছরেও সন্ধান মিললোনা তাঁর। এরপরও তাঁর নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন ইলিয়াস আলী জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় আবার তাদের কাছে ফিরে আসবেন।

গত বছর এক সাক্ষাৎকারে গুম হওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন ও পশ্চিমবঙ্গের কোনো একটি কারাগারে বন্দি আছেন এমন দাবি করেছেন তার আপন ছোট ভাই আসকির আলী। চ্যানেল আই-লন্ডনের স্ট্রেইট ডায়ালগ অনুষ্ঠানের লাইভ প্রোগ্রামে তিনি এ দাবি করেন।

তবে ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদি লুনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। খবর বিভিন্ন ওয়েবসাইটের। আসকির আলী আরও বলেন, আমাদের কাছে বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য রয়েছে তাতে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, ইলিয়াস আলী এখনও জীবিত আছেন। তাকে ভারতের দমদমের কাছাকাছি কোনো এক কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। যেমন করে কলকাতায় সুখরঞ্জন বালি আছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। তারপর থেকে তাকে বহনকারী গাড়ির চালককেও পাওয়া যায়নি। তবে দুটি মোবাইল ফোনসহ গাড়িটি রাস্তায় পড়েছিল। নিখোঁজ হওয়ার পর ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোন থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে কল করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার পর তার মোবাইল থেকে বারবার বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে ফোন আসাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। 

Monday, April 10, 2017

Recording Lifts Lid on Extra-Judicial Killings and Disappearances


BY DAVID BERGMAN

Dhaka: A secret recording of a senior officer employed by Bangladesh’s paramilitary organisation, Rapid Action Battalion (RAB), has added pressure on the government to come clean on its use of enforced disappearances, torture and extra-judicial killings.

In the recording, obtained and authenticated by Swedish National Radio, which broadcast the story on Monday (April 3), the RAB officer talks about how the organisation routinely picks people up, kills them and disposes off their bodies.

Swedish foreign minister Margot Wallström condemned the practices. “There is only one thing to say about this: that it’s horrific and that it must stop and that Bangladesh must take responsibility for this.”

“We will act, in particular via the EU, but also through our bilateral contacts, to make it completely clear that this is not acceptable, and must stop immediately,” she said.

The report comes a week after the UN Human Rights Committee published a report criticising the Bangladesh government for its “reported high rate of extra-judicial killings by police officers, soldiers and Rapid Action Battalion (RAB) force members and the reported enforced disappearances, as well as the excessive use of force by State actors.”

The UN committee went onto say that, it “is further concerned by the lack of investigations and accountability of perpetrators, leaving families of victims without information and redress.”

Since the Awami League came to power in 2009, human rights organisation Odhikar has identified over 325 people who were picked up and secretly detained for various degrees of time, allegedly by one of the country’s law enforcement bodies, including the RAB. After weeks or months in unlawful detention, the men are then either ‘shown arrested’ or killed. Out of the more than 90 people secretly detained in 2016, 22 dead bodies have been found.
In relation to extra-judicial killings – which happened in even greater numbers under previous governments – since 2009, Odhikar reports nearly 1,300 deaths.
[...]
In the Swedish Radio recording, the unnamed senior RAB officer, who was unaware that his conversation was being taped, said that there were three aspects to an enforced disappearance: the capture, the killing and the disposal.

“Everyone is not an expert on forced disappearances,” the officer is reported by Swedish radio to have said. “We have to make sure no clue is left behind. No ID cards that slip-off. We have to wear gloves; we can’t leave footprints behind and have to wear covers on our shoes to prevent that. We can’t smoke during these operations.”

The officer talks about how some of the picked up men are tortured. According to Swedish Radio, the officer “describes a dark room with a lamp in the middle where an arrested man was stripped naked. They hung him in handcuffs, and tied bricks to his testicles. His testicles were almost ripped off by the weight, the officer says. The tortured man fell unconscious and the RAB officer says he did not know if the man was dead or alive.”

In the recordings obtained by the radio station, the RAB officer is said to have claimed that dead bodies of the men who are killed are disposed of by throwing them into a river with blocks of concrete attached to their bodies. He says the fate of the men is decided by “high ups”.

This description of the disposal matches what happened to seven men who were picked up and killed by the RAB in April 2014, in a dispute between local leaders of the governing Awami League belonging to the district of Naranganj, close to the country’s capital city of Dhaka. A few days later their bloated bodies floated to the surface of the Shitalakkya river where they had been dumped. In January this year, a court convicted 35 people of involvement in the murders, sentencing 26 of them, including three former RAB officers, to death.

No other recent disappearances – including those of 19 opposition activists picked up in the capital city of Dhaka over a two week period four months earlier – has resulted in similar investigation or prosecution.

The Swedish Radio recording of the RAB officer is the first time that a media organisation has managed to record a conversation in which a Bangladeshi law enforcement officer has admitted to their involvement in disappearances and extra-judicial killings.

RAB’s legal and media wing director, Commander Mufti Mahmud Khan, denied the allegations contained in the secret recording. He told Bangladesh’s national newspaper Prothom Alo  that “RAB do nothing going against legal provision. …Those who have been killed in RAB’s crossfire so far are armed notorious terrorists, robbers and militants. When drives are conducted to arrest them, they open fire on RAB. And RAB also open fires in self-defence,” he added. ‘Things are not as though only terrorists were killed in the RAB shooting; RAB officers and members were also killed and maimed.”

The Swedish public broadcaster is unwilling to provide any information on how it managed to undertake or obtain the recording of the conversation due to the ‘sensitivity’ of the matter and the need to protect their sources. In addition, at present, it is not willing to provide a transcript or copy of the recording.
[Excerpted]