Search

Sunday, August 27, 2017

এই কি সেই মাণিক রতন!

By হিরন্ময় শ্যেণ 

মণীষী বাক্যে আছে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো মাণিক রতন! খুঁজিতে হয় নাই। উনি আগেই আবিস্কৃত হইয়া‌ছেন। তিনি তখন নিজেই রায় লিখিতেছিলেন। অকাশের ঠিকানা অবলম্বনে। আর যাহা হউক প্রতিভাকে তো আর চেপে রাখা যায় না। মানিক যতো কদাকার থলিতেই থাকুক না কেন উহার প্রভা ছড়াইবেই। কারও না কারও চোখ পড়িবেই। আর  দুষ্ট লোকের তো কথাই নাই।
 
খতরনাক সাংবাদিকের চোখেও প্রতিভা ধরা পড়িয়া গেলো। তি‌নি এ বিষয়ে মন্ত্রিসভার অন্যতম সিনিয়র সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েলের ‌মনোযোগ টানিতেই ‌তিনি বলি‌লেন, ইহা আর নতুন কি! উনি তো আদা‌লতেই সংসদকে লইয়া অনেক কথাই বলিয়াছেন। সংসদকে প্রশ্নবিদ্ধ করিয়াছেন। স্পিকারের জ্ঞান লইয়াও কথা তুলিয়াছিলেন। সংসদ সদস্যরা তাঁর এসব বক্তব্যের জন্য নিন্দু‌কের মতো খাঁটি সমঝদার না হইয়া পারেন নাই।

এর আগে গতকাল শনিবার, আগস্ট ২৬, এক আলোচনা সভায় সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সরাসরি রায় দিয়া মোক্ষম  মধ্যম পুরুষ ব্যবহার করিয়া কহিলেন , 'সবচেয়ে বড় কথা, তুমি শুধু প্রধান বিচারপতির পদ ছাড়বা না, এই দেশ ছাড়তে হবে। এ দেশে থাকার কোনো অধিকার তোমার নাই।

এ বিষয়টি উল্লেখ করে আজ একজন সাংবাদিক বাণিজ্যমন্ত্রীর মন্তব্য জানতে চান। জবাবে এসব কথা বলেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিচারপতি মানিকের এই কথার বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তিনি নিজেও সংসদকে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন।

২০১২ সালের ২৯ মে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে স্পিকার ও একজন সংসদ সদস্য বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্য নিয়ে ওই বছর ৫ জুন হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সড়ক ভবন-সংক্রান্ত এক মামলার শুনানিতে সংসদে দেওয়া স্পিকারের ওই বক্তব্যের বিষয়ে আদালতে মন্তব্য করেন। ওই দিনই সংসদের অধিবেশনে বিচারপতির ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি মানিকের অপসারণ দাবি করেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৮ জুন স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদে রুলিং দেন। সেখানে এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

Saturday, August 26, 2017

A blazing rush to the bottom

By Fazal M. Kamal
 


All too evidently the government is suffering from a daymare (you heard that right; it’s a legit word) since the Supreme Court issued its judgment on the Sixteenth Amendment to the Constitution. To saner people the ruling party motormouths’ incessant pronouncements are likely to sound strange, implausible and perplexing especially because it would strike sensible people as a judicial decision made in the larger interest of the nation and for the greatest good.

In point of fact some of the declarations made by persons purported to be members of the Cabinet and party leaders supposed to hold “high-level” positions are so ludicrous, when not contemptuous and utterly crude, that they are bound to boggle the mind, i.e. if it still can preserve a modicum of sanity. In an evident rush to the bottom, often their assertions have been comprehensively and outright contemptible.

Obviously these aural assaults on the highest judiciary---leaving aside the threats to the Chief Justice---cannot point toward even the least tolerant of administrative edifices. On the other hand, the government’s stance coupled with its verbal war can only generate further anxieties among an already worried people as they hear the intensifying venom of the words with profound and increasing alarm.

Still more worrisome is the history of the Awami League which is loaded with acts, activities, decisions and of course words that indicate in brazen terms the lack of tolerance over the many decades the party has been in existence. It simply cannot handle criticism or opposition to its desires, which with disturbing regularity have displayed a phenomenal weakness for total control and exclusionary political dispensations.

If we add to this the irrepressible ambitions and avarice of its members and hangers-on it can easily lead to horrendous consequences for the nation as, unfortunately, has occurred numerous times during the times the party had its tentacles on the levers of state power. It just finds such temptations as compelling as moths find a flame.

Certainly these outrageous acts of hostility against the apex judiciary cannot auger well for Bangladesh---and indeed it hasn’t in the past either when the Awami League had launched attacks on the courts. Now merely because the Supreme Court has attempted to correct some misrepresentations, misperceptions and misinformation ruling party honchos and administration officials---astoundingly one particular employee of the state too---have gone berserk.

To recover sanity in statecraft government leaders must come to terms with realities and not persist with myths, personal desires and personality cults (almost a la President Trump!). After all, even Mr. Trump has realized that tweets and Trumps cannot supersede everything else all the time. If there’s to be any semblance of democracy in a country, it can faithfully function and help the people only if it’s inclusive.

While this ugly onslaught has been progressing unabashedly there has been---of course---no let up in malfeasance and malevolence of any kind. Many of those who display any gumption to oppose and/or criticize the administration continue to disappear (a game from which law enforcement tools seemingly compress a huge amount of entertainment) and sometimes they reappear and sometimes they don’t, and oftentimes they reappear as corpses.

Be that as it may. In their endeavor to oppose the Supreme Court’s judgment and simultaneously drag the Chief Justice down not only have they slithered to an accustomed nadir but their attitude, approach and audio cacophony have exhibited to the entire world--both to its bemusement and horror—that the ability to be loathsome is not strained, in which state they can also easily continue to be incogitant.

Contemptible verbal diarrhea from persons apparently with little affinity either with democratic norms or passable education or acceptable social conduct lead to gratuitous exhibition of their disgraceful predilections while indispensable institutions of the state are battered consistently so that they cower to the will of the rulers. That of course is in truth tyranny of the few many of whom would have no accoutrement without political patronage.

That, sadly for the nation, is indeed a shameful state of affairs.

ENDS

Monday, August 21, 2017

সুন্দরবন রক্ষায় বার্লিনে ঐক্যমত্য

By আরাফাতুল ইসলাম, বার্লিন থেকে [ডয়চে ভেলে]


 
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ১৯ ও ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত রামপাল বিষয়ক সম্মেলন থেকে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ অনতিবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে৷ সম্মেলনে শেষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘রামপালে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের পাশাপাশি মানুষের জীবন ও জীবিকা সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে৷''

তাই বার্লিন সম্মেলনে অংশ নেয়া পেশাজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, পরিবেশবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এবং রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র না করার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে নানাভাবে উদ্যোগ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন৷ পাশাপাশি বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি গুরুত্ব দিতে সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে৷ দু'দিনব্যাপী সম্মেলনের আয়োজন করে তেল-গ্যাস- খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ইউরোপীয় নেটওয়ার্ক৷

এই সম্মেলনে অংশ নেয়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবনের কোল ঘেষে হচ্ছে, আমরা দেখতে পেলাম এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ, অন্য যেকোন জায়গায় বাংলাদেশের যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হচ্ছে, এমনকি কয়লাভিত্তিকও – তার থেকে প্রায় তিনগুণ৷ সুতরাং বাংলাদেশে এত দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রয়োজন নেই৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সারা বাংলাদেশের রক্ষাবর্ম, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম এবং বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন একেবারে ধ্বংসের কিনারায় চলে যাবে৷''

বার্লিন সম্মেলনে বক্তারা রামপালের সমালোচনার পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা, বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির বহুল প্রসার ইত্যাদি সম্পর্কেও মতামত জানান৷ তারা মনে করেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে, যেদিকে সরকারের আরো মনোনিবেশ করা উচিত৷ বর্তমানে বার্লিন সফররত গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিও সম্মেলনে অংশে নেন৷

তিনি বলেন, ‘‘আমরা সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য, উপাত্ত, যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছি যে এই রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করবে৷ সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং এটা কেবল বাংলাদেশ, ভারতেরই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই একটা বড় ঐতিহ্য৷'' তিনি বলেন, ‘‘সুন্দরবন ঐ অঞ্চলের জন্য একটা প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, বাংলাদেশের জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন৷ সুন্দরবন হচ্ছে বাংলাদেশের ফুসফুস৷ সুন্দরবন যদি ধ্বংস হয়ে যায়, বাংলাদেশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷''

উল্লেখ্য, সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে ভারতের সহায়তায় ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ বর্তমানে অব্যাহত রয়েছে৷ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপক সমালোচনা হলেও সরকার মনে করছে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এই কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে৷

একটি রায় ও কিছু কথা

রুমীন ফারহানা

পহেলা আগস্ট ঘোষিত হলো আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির সর্বসম্মত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়। এই রায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সাথে সাথে বিচারকদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধিও প্রণয়ন করেছে। রায় ঘোষণার পর থেকেই এটি নিয়ে নানা মহলের তর্কবিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা, বিশ্লেষণ, পক্ষ-বিপক্ষে লেখা চলছে। এটি যে আরও কিছুদিন আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। রায়টি বাংলাদেশের সংবিধান, বিচার বিভাগ বা আইনসভার জন্যই কেবল গুরুত্ব বহন করে না বরং তা বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিরও একটি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। এই রায়ের শুরুতেই এটি স্পষ্ট করা হয়েছে যে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক কিনা এর উত্তরে যুক্ত আছে আমাদের সাত যুগ ( ১৯৪৭ - ২০১৬) এবং বিশেষভাবে গত সাড়ে চার যুগের (১৯৭১-২০১৬) রাজনৈতিক ইতিহাসের কতগুলো গভীর ও জটিল ইস্যু এবং ঘটনাবলী।

এই গভীর ও জটিল ইস্যু এবং ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এখানে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি রাষ্ট্র পরিচালনায় ঘটে যাওয়া নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি, অদূরদর্শিতা যেমন ক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনীতি, রাজনীতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রীকতা বা আমিত্বের ব্যাপক প্রসার যার অনিবার্য পরিণতিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে ক্ষমতাধর ‘দৈত্য’ তৈরি, নিরপেক্ষ ও হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচনের অভাবে অবিকশিত গণতন্ত্র, ঝুঁকিপূর্ণ মানবাধিকার, অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি, অকার্যকর সংসদ, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাহী বিভাগের অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া আচরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সহ নানা বিষয় ওঠে এসেছে। এতে সংসদ এবং সাংসদদের মোটামুটি অযোগ্য হিসাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকার পরিচালনার ধরন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

রায়ে মূলত যে বিষয়গুলো ওঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘অদূরদর্শী রাজনীতিকরণ’ যাকে একটি সংক্রামক রোগ হিসাবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে এর ফলে মানুষ এমন ভবিষ্যত চিন্তা করতে পারছে না যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরো জাতি, কোনও একজন ব্যক্তি নন। যে গণতন্ত্রের কথা বর্তমানে বাংলাদেশে বলা হয় তার ব্যাপারে রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও মেকী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এটি করা হয়েছে লজ্জাজনক ভাবে সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ রায়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দল, ব্যক্তিসহ গোটা দেশ ও জাতির ইতিহাস বিশ্লেষণের এক পর্যায় বলা হয়েছে এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা আছি যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না কিন্তু খারাপ লোকেরা আরও লুটপাটের জন্য বেপরোয়া। ক্ষমতার দাম্ভিকতা এবং অপব্যবহার দেখানোর ক্ষেত্রে বাঁধা দেওয়ার মতো কোনও নজরদারি বা তদারককারী প্রতিষ্ঠান নেই। এমন কী কোনও একটি জনপ্রতিষ্ঠানকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়নি। এ রায়ে বারবার এসেছে I'ness বা আমিত্ব ও ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার কথা। ‘আমাদের লোক’ কিংবা ‘আমি একাই সব’ এই আত্মঘাতী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হয় না। রায়ে বলা হয়েছে যে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনও শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। এছাড়াও আপিল বিভাগের সব বিচারপতিই দেশের ‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’কে বিচারক ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি বিবেচনা করেছেন।

অনেকেই এ কথাগুলোকে আদালতের পর্যবেক্ষণ বলে হাল্কা ভাবে দেখার চেষ্টা করলেও বাস্তবতা হলো এই পর্যবেক্ষণ অগ্রাহ্য করবার কোনও উপায় নেই; কারণ আদালত যখন কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তখন সেই সিদ্ধান্তের একটি ব্যাখ্যা রায়ে থাকে আর আদালত যেসব যুক্তির ওপর নির্ভর করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছান, সেই যুক্তিগুলো অর্থাৎ তার মতামতও ভবিষ্যতের জন্য বিচারিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সুতরাং এই পর্যবেক্ষণগুলোও ভবিষ্যতে দৃষ্টান্ত হিসাবে আসতেই পারে। আর সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ মতে আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোনও বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয়।

এই রায়ে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল বা আমলের সমালোচনা করা না হলেও এই রায়ের প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। আদালতের রায়ে কখনোই সবপক্ষ আহ্লাদিত হয় না, হওয়া সম্ভবও না। আর সে কারণেই সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল করে, প্রতিকার চায়। এক্ষেত্রেও সংক্ষুব্ধ পক্ষের রিভিউ করার সুযোগ ছিল, আছে। কিন্তু আমরা দেখলাম পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর প্রথম তিন দিন সরকার পক্ষ বজ্রাহত অবস্থায় থাকলেও তারপর যথারীতি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিচারবিভাগের ওপর। যে ভাষায় বিচারপতিদের আক্রমণ করা হয়েছে তা পত্রিকায় প্রকাশ করলেও আদালত অবমাননার ভয় থাকে। সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু ৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন যে ‘আমরা আহত, ক্ষুব্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত’ যদিও তিনি বিচার বিভাগের পর্যবেক্ষণ যে ‘এখনই বিচারবিভাগ অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে ভালো অবস্থায় এবং তাও পানিতে নাক উঁচু করে রেখেছেন তারাও ডোবার পথে’ এর সাথে সহমত পোষণ করেন। ওনার প্রতিক্রিয়াই কিছুটা প্রকাশযোগ্য তাই লিখলাম।

কিন্তু এর পরপরই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গণপূর্তমন্ত্রী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু,  আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রচার সম্পাদক হাসান মাহমুদ এবং আওয়ামী নেতা শেখ ফজলে নূর তাপস যে ভাষায় রায়ের সমালোচনা করেছেন তা শুধু শিষ্টাচার বর্হিভূত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণই নয় বরং যে কোনও সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাতেই পরিষ্কার আদালত অবমাননা। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে তাদের বক্তব্যই এই রায়ের পর্যবেক্ষণের যথার্থতা আবারও প্রমাণ করার সাথে সাথে তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনারও স্বাক্ষর রেখে গেছে।

এরমধ্যেই ভীষণভাবে সমালোচিত হয়েছে মাননীয় প্রধান বিচারপতির সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বৈঠক। দলীয় সূত্র মতে আলোচনার মাধ্যমে দুটি পথের সন্ধান করছে আওয়ামী লীগ। প্রথমত, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পর্যবেক্ষণের কিছু অংশ বাদ দেওয়ার ব্যপারে প্রধান বিচারপতিকে রাজি করানো। নতুবা পুনবিবেচনার আবেদন করা হলে আওয়ামী লীগের চাওয়া পূরণ হবে, এমন নিশ্চয়তা আদায় করা। অর্থাৎ রিভিউ করার আগেই রিভিউ এর ফলাফল নিশ্চিত করা। এটুকুই কি বিচারবিভাগ সংক্রান্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের যথার্থতা প্রমাণ করে না? এই রায় ঘোষণার আগেও মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন সময় স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে দেশে আইনের শাসন নেই, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে খেয়ে নিতে আসছে, সরকার নিম্ন আদালতকে কব্জা করার পর এখন উচ্চ আদালতকেও কব্জা করতে চায়, বিচার বিভাগ পানিতে নাক উঁচু করে রেখেছে, তারাও ডোবার পথে।

এই রায়ের বেশির ভাগ অংশই সাধারণ মানুষের মনের কথা। রায়ে যেহেতু কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য না করে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে তাই দেশ ও জাতির জন্য অনেক বেশি মঙ্গলজনক হতো যদি রাজনৈতিক দলগুলো, প্রতিষ্ঠানগুলো, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গগুলো এই রায়ের আলোকে আত্মসমালোচনা, আত্মপলব্ধি, আত্মজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিশুদ্ধ ও পরিমার্জিত করায় মনোযোগী হতো। কিন্তু তাতো হওয়ার নয়। মাননীয় প্রধানবিচারপতি যতই বলুন রায় নিয়ে রাজনীতি না করার কথা দিনের শেষে ‘আমিত্বের আসক্তি’ আর ‘আত্মঘাতি উচ্চাভিলাষ’ থেকে ক্ষমতাশালীদের মুক্তি নাই। তাই যাই আমার স্বার্থের বিপক্ষে যায় তাই ষড়যন্ত্র, ইতিহাস বিকৃতি, ধৃষ্টতা, ভুল, মিথ্যা, ইনটলারেবল, দুঃসাহস, ইমম্যাচিওরড, শান্তি কমিটির কাণ্ড। হোক না সেটা সর্বোচ্চ আদালতের রায়।

লেখক: সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি 
উৎসঃ .banglatribune.com

Saturday, August 19, 2017

বিচার-বিভাগের সাথে সঙ্ঘাত একনায়কতন্ত্রের পথে শেষ ধাপ - ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন

 

 

দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ একনায়কতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে, বিচার-বিভাগের সাথে সঙ্ঘাত এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ। নির্বাচন প্রক্রিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে, সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে সংসদ গঠিত হয়েছে তাতে কোনো বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় সরকার চলতে পারে না।। অথচ বলা হচ্ছে, এই সংসদকে অকার্যকর বলা চলবে না। এখন আছে শুধু বিচার বিভাগ। এই বিচার বিভাগ যদি ধ্বংস করা যায়, অধীনস্থ করা যায়, তাহলে তো হয়ে গেল। একনায়কত্ববাদী শাসন কায়েমের শেষ পর্যায়ে এসে এগুলো করা হয়। একদলীয় শাসনে এই বিরোধ অনিবার্য ছিল।


বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৭, দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত সাংবাদিক আলফাজ আনামের সাথে সাক্ষাতকারে তিনি এই বক্তব্য দেন।

সাক্ষাতকারটি নিচে দেয়া হলো -


নয়া দিগন্ত : সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে এখন বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর পরিণতি কী হতে পারে বলে মনে করেন?
মইনুল হোসেন : দেশ একনায়কতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে। বিচার বিভাগের সাথে যে সঙ্ঘাত এটি শেষ ধাপ। নির্বাচনপ্রক্রিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে, সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে সংসদ গঠিত হয়েছে তাতে কোনো বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় সরকার চলতে পারে না।। অথচ বলা হচ্ছে, এই সংসদকে অকার্যকর বলা চলবে না। এখন আছে শুধু বিচার বিভাগ। এই বিচার বিভাগ যদি ধ্বংস করা যায়, অধীনস্থ করা যায়, তাহলে তো হয়ে গেল। একনায়কত্ববাদী শাসন কায়েমের শেষপর্যায়ে এসে এগুলো করা হয়। একদলীয় শাসনে এই বিরোধ অনিবার্য ছিল।

নয়া দিগন্ত : এই বিরোধ তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলবে?
মইনুল হোসেন : আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকেই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। বঙ্গবন্ধুকে যে বাকশালের দিকে সমাজতন্ত্রের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হলো, এটি আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাইরে ছিল। তাকে বুঝানো হয়, যদি সমাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রেখে আপনি কিছু করতে পারবেন না। বর্তমান সরকার কারা চালাচ্ছে আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ চালাচ্ছে বলে আমি মনে করি না। আওয়ামী লীগের যে ঐতিহ্য নীতি আদর্শ ছিল, তা তো দেখি না। এখন নির্বাচন নেই, জনগণের ভোটের অধিকার নেই। নির্বাচন হওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই। সমস্যা হচ্ছে- দেশে না আছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, না আছে রাজনীতি। ফলে সংবিধান কী, গণতন্ত্র কী এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। তাদের একমাত্র চিন্তা ক্ষমতায় আছি, ক্ষমতায় থাকব, ক্ষমতা ছাড়ব না। একই কাজ বঙ্গবন্ধুকে করতে হয়েছে। তিনি এভাবে নির্বাচন ছাড়া প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। একদলীয় সংসদ হয়ে গেল। এখনকার সংসদও একই।
 
নয়া দিগন্ত : আপনি তো চতুর্থ সংশোধনীর সময়ে সংসদ সদস্য ছিলেন। এখন কি মিল খুঁজে পাচ্ছেন?
মইনুল হোসেন : হ্যাঁ, মিল খুঁজে পাচ্ছি। সেদিকে ক্ষমতাসীনেরা যাবেই এবং যাচ্ছে। কারণ, আওয়ামী লীগের ওপর সওয়ার হয়েছে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি। ফলে এই পদক্ষেপগুলোকে সেভাবে দেখতে হবে। বিচার বিভাগের সাথে সঙ্ঘাতে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। আসলে তারা বিচার বিভাগকে নতজানু রাখতে চায়। বিচার বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে রাখতে চায়। বঙ্গবন্ধুর সময় এমন করা হয়েছিল। তিনি ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন, সংসদের হাতে দেননি।
সে সময় বঙ্গবন্ধুর ওপর এ ধরনের শক্তি সওয়ার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অসুবিধা ছিল, তিনি দেশে আসার পর হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এসে যে পরিস্থিতি দেখলেন, তা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে তার সরকার ব্যর্থ হচ্ছিল। একমাত্র বামপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। জাসদ বিভিন্ন স্থানে মানুষ খুন করল। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে এমন হওয়ার কথা ছিল না। চিন্তাশীল রাজনীতিবিদের অভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারালাম। এরপর আওয়ামী লীগের চার নেতাকে হারালাম।

নয়া দিগন্ত : অনেক দেশের পার্লামেন্টে তো বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা আছে।
মইনুল হোসেন : দেখুন, আমাদের আজকের যে সংসদ আর ইংল্যান্ডের বা ভারতের সংসদ এক নয়। এসব দেশে দুটো হাউজ নিয়ে পার্লামেন্ট হয়। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের যে অংশ লিডার থাকে প্রাইম মিনিস্টার, তারা কিন্তু ইমপিচ করে না। হাউজ অব কমন্স করে না। হাউজ অব লর্ডস ইমপিচ করে। সেখানে বিচারপতিদের বিচার করা হয়। আমরা যদি ভারতের ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া দেখি তাহলেও সেখানে দু’জন বিচারক এবং একজন আইন বিশেষজ্ঞ থাকেন। বিচার তারা করেন। শাস্তি অর্থাৎ ইমপিচমেন্ট হবে কি না, তা ঠিক করে পার্লামেন্ট।

নয়া দিগন্ত : তাহলে ষোড়শ সংশোধনীতে অভিসংশনপ্রক্রিয়া কি যথাযথ ছিল না?
মইনুল হোসেন : না, না। এই সংসদ পারে না। যে সংসদে প্রধানমন্ত্রী নেতা। এটা তো সরকারের হাতে চলে গেল। বিচারপতিদের বিচারের ক্ষমতা তো সংসদের হাতে থাকছে না, আসলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে চলে গেল। সংবিধান তো প্রধানমন্ত্রীকে এই ক্ষমতা দেয়নি। আসলে তো কারো রাজনৈতিক চিন্তা নেই। ফলে আমরা অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি। রাজনীতিকেরা বলছেন, তোমরা আমাদের কাছে আসো আমরা তোমাদের বিচার করব। এ অবস্থায় বিচারপতিরা বুঝেশুনে আত্মহত্যা করতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্ট তো সংবিধানের রক্ষক। সংবিধান তো প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষক করেনি, সংসদকেও করেনি। জনগণ-প্রদত্ত সংবিধান। এই সংবিধান তো আওয়ামী লীগই প্রণয়ন করেছিল।

নয়া দিগন্ত : সরকারের মন্ত্রীরা তো বলছেন, তারা জনগণের প্রতিনিধি। সংসদ সদস্যরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন। সংসদকে অস্বীকার করলে তো প্রধান বিচারপতির নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এমন যুক্তি তারা তুলে ধরছেন।
মইনুল হোসেন : তারা যদি জনগণের প্রতিনিধি হন, সংবিধানের অধীনে হয়েছেন। সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান তো বলেনি তারা বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারবেন। সুপ্রিম কোর্ট যে অধিকার চাইছে, তা তো সংবিধান তাকে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের রক্ষক এটা তো সংবিধান বলছে। জনগণের প্রতিনিধি হয়েছেন আইন প্রণয়নের জন্য। বিচারপতিদের বিচার করার জন্য তো করা হয়নি। আইন প্রণয়নের মধ্যে বিচারপতিদের শাস্তি দেয়ার কথা আসবে কেন?

নয়া দিগন্ত : সরকারের মন্ত্রীরা তো প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়েছেন।
মইনুল হোসেন : আসলে যারা সংবিধানের অর্থ বোঝে না, অথবা যাদের সংবিধানের প্রতি কোনো সম্মান নেই, তারা তো সবই বলতে পারে। তারা তো এখন ক্ষমতায় থাকা নিয়ে ব্যস্ত। বিশে^র কোনো দেশে এমন নজির আছে মন্ত্রী বিচারপতিদের পদচ্যুতি বা চাকরিচ্যুতি চান। বিচারপতিরা স্বাধীন। এই স্বাধীন হওয়ার অর্থ কী তাদের আরেকজন চাকরিচ্যুতি করবে। পার্লামেন্ট তো স্বাধীন নয়, মন্ত্রীরাও স্বাধীন নন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয়। একমাত্র স্বাধীন হচ্ছে বিচার বিভাগ। এর অর্থ কি তারা বোঝে? তাদের এসব কথায় দুঃখ লাগে, আমরা জাতি হিসেবে ছোট হয়ে যাচ্ছি। আমরা তো এত মূর্খ বা অজ্ঞ ছিলাম না। এ দেশে সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হকের মতো রাজনীতিক ও মানিক মিয়ার মতো সাংবাদিক ছিলেন। গণতন্ত্রের জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি। এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে এসব কথা শুনলে সত্যি কষ্ট হয়।

নয়া দিগন্ত : সামরিক শাসনমালের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে আসার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ কী স্বাধীন অবস্থান ফিরে পাবেন বলে মনে করেন?
মইনুল হোসেন : প্রথম কথা হলো শূন্যতা তো থাকতে পারে না। আজকে বারবার সামরিক শাসনের কথা বলা হচ্ছে। সামরিক শাসন যদি এতই খারাপ হয়ে থাকে সামরিক শাসনের অধীনে কারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল? সেই পার্লামেন্টকে কেন অবৈধ বলা হচ্ছে না। সামরিক শাসনে আমলে হোক আর যে আমলে হোক সংসদ যা বৈধ করেছে তা এখন সংবিধানের অংশ। এতটুকু বোঝার মতো পার্থক্য তারা যদি করতে না পারে, এর চেয়ে দুঃখ আর কী হতে পারে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানের কাঠামো হয়ে গেছে। নির্বাচিত সংসদ বৈধতা দিয়েছে। যারা এখন প্রশ্ন তুলছে সামরিক শাসনামলে তারা তো নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এখন অবৈধ হয়ে তারা কী জেলে যাবে?

নয়া দিগন্ত : বিচারপতি নিয়োগ নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে বিষয়টি কিভাবে দেখেন?
মইনুল হোসেন : অবশ্যই। আসলে বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারটা সংসদের দেখা দরকার। কিন্তু তারা বিচারপতি অপসারণ নিয়ে ব্যস্ত। তারা তো বলতে পারে সংসদের একটি কমিটির মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ হবে। কারা বিচারপতি হবে তা জনগণ জানতে পারবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচারপতি নিয়োগ প্রকাশ্য হয়। গোপনে গোপনে বিচারপতি নিয়োগ করবেন, আর পরে তাদের অপসারণ করতে চাইবেনÑ এটা তো হয় না।

নয়া দিগন্ত : আপনি বলছিলেন শূন্যতা থাকতে পারে না।
মইনুল হোসেন : অবশ্যই। একটা আইন বাতিল হয়ে গেলে আগে যা থাকে তা কার্যকর হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়েছে।

নয়া দিন্ত : আপনা আপনি পুনঃস্থাপন হবে, না সংসদে বিল আনতে হবে?
মইনুল হোসেন : এ নিয়ে দ্বিমত আছে। আমার মত হচ্ছে, আপনি যে আইন দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করেছিলেন, সেই আইন যদি অবৈধ হয় তাহলে তো আগেরটা বহাল থাকবে। কারণ এটাকে শুধু বেআইনি নয় অবৈধ বলা হয়েছে। এ নিয়ে আরো আলোচনা হতে পারে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে, যদি এর পরিবর্তন করতে হয় তাহলে প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু আপনার অধীনে থাকতে হবে কেন? এমন প্রস্তাব তারা দিতে পারে যার মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়।

নয়া দিগন্ত : সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলছেন, আমরা এখন জাজেস রিপাবলিকে বাস করছি। তার এই মতকে কিভাবে দেখেন?
মইনুল হোসেন : বিচারপতি খায়রুল হক মনে হয় নিজের মানসম্মান সম্পর্কে সচেতন নন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করার জন্য তিনি তার রায়ে যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো তিনি কিভাবে লিখেছিলেন। এমন রায়ের দৃষ্টান্ত তো দুনিয়াতে পাওয়া যাবে না। তিনি রায় দিয়েছেন নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। কোন দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হয়? তিনি অত্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাবিত ব্যক্তি। এর পরও তাকে সম্মান করতে চাই। কিন্তু এমন লোক প্রধান বিচারপতি ছিলেন ভাবতে লজ্জা লাগে। পঞ্চম সংশোধনী তিনি বাতিল করেছেন। অথচ এটি তার মামলার বিষয়বস্তু ছিল না। মুন সিনেমা হলের মামলা থেকে টেনে এনে তিনি পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছিলেন।

নয়া দিগন্ত : আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি রায় নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়ে থাকতে পারেন।
মইনুল হোসেন : তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। তার ক্ষমতা আইন দিয়ে নির্ধারিত। তার কাজ একমাত্র আইন পর্যালোচনা করা, রায়ের সমালোচনা করা নয়। যে আইনে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন সেখানে বলা আছে, তিনি আইন দেখবেন। আইন সংশোধন বা যুগোপযোগী করা যায় কি না, এসব দেখবেন। তিনি কিভাবে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কথা বলেন? তিনি কিভাবে এ ধরনের নিম্নমানের একটি সংবাদ সম্মেলন করেন? তিনি যে রাজনৈতিক প্রভাবিত তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, যদি সংসদ সদস্যরা ইমম্যাচিউর হয় তাহলে বিচারপতিরাও ইমম্যাচিউর। এটা কোনো যুক্তি হলো? তিনি পাগল হলে সেও পাগল এ ধরনের যুক্তি আর কী। অদ্ভুত সব কথা।

নয়া দিগন্ত : আইনমন্ত্রী বলেছেন, তারা রায়ের পর্যালোচনার কিছু বিষয় এক্সপাঞ্জ চাইবেন, বিষয়টি কিভাবে দেখেন?
মইনুল হোসেন : আইনমন্ত্রী তালিকা করুক কী তারা বাদ চাইবেন। কিন্তু তারা সংসদে ও বাইরে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন সে বক্তব্যগুলো আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। তারা এর আগে বলেছেন সংসদে বিচারপতিদের আসতে হবে। ব্যাখ্যা করতে হবে কিভাবে এই আইন অসাংবিধানিক হলো। তখন তো এ কথা আসবে সংসদে বিচারকদের নিয়ে যেসব বলা হয়েছে সেগুলো এক্সপাঞ্জ করেন। প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে এমন কী বলেছেন যা নিয়ে জনগণের মধ্যে, টকশোতে বা সংবাদপত্রে আলোচনা নেই। যেমন সংসদ সদস্যরা ইমম্যাচিউর, এ কথা বহুভাবে বলা হয়েছে। তারা ব্যবসায় করেন। রাজনীতির চেয়ে ব্যবসায় যাদের মুখ্য তারা তো রাজনীতিবিদ হিসেবে ইমম্যাচিউর। এমন কথা তো রাষ্ট্রপতিও বলেছেন, আজকাল রাজনীতিবিদেরা ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন। সংসদ অকেজো, এ কথা কে না বলছে? সংসদ তো আসলেই অকেজো। দেশের বাস্তবতায় প্রধান বিচারপতিকে এসব কথা বলতে হয়েছে। আমি মনে করি, এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের চুপচাপ থাকা ভালো। যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে তিক্ততা আর বাড়ানো ঠিক হবে না।

নয়া দিগন্ত : এসব পর্যবেক্ষণ কি এড়িয়ে যাওয়া যেত না?
মইনুল হোসেন : বিচারপতিদের তো ধাক্কা দেয়া হয়েছে। ধাক্কা না দিলে হয়তো তারা এসব বিষয় নিয়ে দূরে থাকত। আরেকটি দিক হচ্ছে, পর্যবেক্ষণে যা এসেছে তা আগে বিভিন্নভাবে অনেকে বলেছে। এসব নতুন কিছু নয়। সংবিধান হচ্ছে সুশাসনের একটি কাঠামো। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের রক্ষক। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্যই দেখতে পারে সুশাসন আছে কি নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কি না। তাদের এগুলো দেখা দায়িত্ব, কারণ, তারা সংবিধানের রক্ষক। সংবিধান মেনে যদি সংসদ না হয়, সংবিধান লঙ্ঘন করে ফাঁকি দিয়ে নির্বাচন হয়, তা দেখার অধিকার সুপ্রিম কোর্টের আছে। সুপ্রিম কোর্ট সহজে এগুলো করতে চায় না। কারণ তারা চায় রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি দিয়ে এগুলোর সমাধান করুক। সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দল আছে, সংবাদপত্র আছে, তারা এগুলো দেখবে। এখন তো বিরোধী দলও নেই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নেই। কিন্তু সংবিধান রক্ষা করতে হলে সুশাসন রক্ষার কথা আসবে। এখনো সুপ্রিম কোর্টের ওপর মানুষের বেশি আস্থা আছে।

নয়া দিগন্ত : মন্ত্রীরা যেভাবে বিচার বিভাগ সম্পর্কে কথা বলছেন, তাতে কি আদালত অবমাননা হয় ?
মইনুল হোসেন : নিশ্চয় আদালত অবমাননা হচ্ছে। কিন্তু আদালত সব ব্যাপারে কনটেম্পট আনে না। কারণ, আদালতকে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা সব বিষয়ে চিন্তা করতে হয়। দেশটা যখন পাগলামোর ভেতরে আছে, তখন এসব নিয়ে কনটেম্পট করা ঠিক হবে না। শুধু মন্ত্রীরা কেন বিচারপতি খায়রুল হকের বক্তব্য নিশ্চিতভাবে আদালত অবমাননা। আপনি রায়ের সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু বিচারকের সমালোচনা করতে পারেন না। সবাইকে বুঝতে হবে বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন না থাকে, তাহলে আমার আপনার কারো অধিকার রক্ষা করার আর কেউ থাকবে না। সুপ্রিম কোর্ট দুর্বল হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার গ্যারান্টি থাকবে না।

Saturday, August 12, 2017

সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় খুবই সঠিক হয়েছে - বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী

সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী
সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী বলেছেন, সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় খুবই সঠিক হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে গেলে মাসদার হোসেন মামলায় আমরা বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের মাধ্যমে যা অর্জন করেছিলাম, তার বিসর্জন ঘটবে।

 ২০০১ সালের ১ মার্চ থেকে ২০০২ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা মাহমুদূল আমীন চৌধুরী আরো বলেছেন, সব থেকে দুর্ভাগ্য হলো খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য। তিনি প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়েছেন। এর আগে এক মামলায় তাঁর তো আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি হয়েছিল। তিনি কীভাবে গলাবাজি করেন, তা বিস্ময়কর। কীভাবে দুজন দণ্ডিত ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন?


সাবেক এই প্রধান বিচারপতি আরো বলেন,  সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক’র সংবাদ সম্মেলন করা সমীচীন হয়নি।

 দৈনিক প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাতকারে মাহমুদূল আমীন চৌধুরী উপরিউক্ত বক্তব্য দেন।

পুরো সাক্ষাতকারটি পড়ুন - https://goo.gl/rssYDw

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ই পূর্বপরিকল্পিত

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন




আইন কমিশন একটি স্বাধীন কমিশন যার দায়িত্ব দেশের আইনসমূহ পর্যালোচনা করা এবং সংবিধানের আলোকে প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনে সুপারিশ করা। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মতোই আইনের বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে আইন কমিশনকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। দলীয় রাজনীতির ঠিকাদারির বা সরকারের তলপিবাহক হওয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। আইন কমিশন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুবিচার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে প্রধানত আইনসমূহের বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে। স্বাধীন আইন কমিশন স্বাধীন বিচার বিভাগের এক সহযোগী শক্তি।

কিন্তু আইন কমিশনের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের কোনো রায়ের সমালোচনা করার এখতিয়ার নেই। ফলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান জনাব খাইরুল হক যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের সমালোচনা করেছেন, দেশকে জনগণের প্রজাতন্ত্রের নয়, বিচারকদের প্রজাতন্ত্র বলে কটাক্ষ করেছেন সেটা তার ক্ষমতার বাইরে। নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়েই সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট সম্পর্কিত রায় নিয়ে ক্ষমতাবহির্ভূত সমালোচনা করেছেন ও রায়ের বিরুদ্ধে চড়াও হওয়ার পাশাপাশি অশালীনভাবে রায়টির বিরোধিতা করেছেন বিচারপতি খায়রুল হক। কোনো যুক্তি দিয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে খণ্ডনের চেষ্টা তিনি করেননি। তার যুক্তি হল পার্লামেন্টের সদস্য বা এমপিদের যদি অপরিপক্ব বা ইমম্যাচিউরড বলা হয়, তবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদেরও ইমম্যাচিউরড বা অপরিপক্ব বলতে হবে। এমন বাড়াবাড়ির কী কারণ থাকতে পারে? তিনি কি ভুলে গেছেন এই রায়ের পক্ষে সুপ্রিমকার্টের ৭ জন প্রবীণ আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মত দিয়েছেন? যার মধ্যে আছেন ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো সিনিয়র আইনজীবী, যারা সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা সবাই ইমম্যাচিউরড!

যা সত্য তা হল, সরকারের আশপাশে এমন কিছু লোকের সমাগম রয়েছে, যারা অন্ধ ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তারা সরকারকে বোকা মনে করে। তাই নিজেরা বুদ্ধিমান সেজে সরকারকে বিভ্রান্ত করে সরকার ও জনগণের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনছে। সরকার এখন অব্যবস্থার মধ্যে আছে। এ মুহূর্তে তারা পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করছে।

জনাব খায়রুল হক কোনোরূপ যুক্তি দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের মোকাবেলা না করে বলে দিলেন দেশে জনগণের নয়, বিচারপতিদের প্রজাতন্ত্র চলছে। তিনি আরও বলেন, এই রায় পূর্বনির্ধারিত এবং আগে থেকেই পূর্বপরিকল্পিত রায় দেয়া হয়েছে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রে। বিচারপতিরা বিচার্য বিষয়ের যুক্তিতর্ক ছাড়াই পূর্বনির্ধারিত, পূর্বপরিকল্পিত বা প্রিপ্লানড রায় দেন- এমন বক্তব্য সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কাছ থেকে এলে আমাদের তার দেয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়টি নিয়ে আলোচনা করতে হয়। তিনি কি কোনো পূর্বনির্ধারিত ও পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আইন সম্পর্কিত সংবিধানের সেই সংশোধনীটি বাতিল করেছিলেন? তার সে রায়ের মাধ্যমে বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান দুর্বল পার্লামেন্ট গঠন করা হয়েছে। বিচারপতিদের বিচার সম্পর্কিত রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে খায়রুল হক বলেছেন, এ ধরনের রায়ে সামরিক শাসন প্রবর্তনের কাজটিকে সাহায্য করা হয়েছে। দেশের পার্লামেন্ট ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

বিভিন্ন সময় কথায় কথায় আমাদের সামরিক শাসনের ভয় দেখানো হয়। সংসদের সমালোচনা ও রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ষোড়শ সংশোধনী রায়ে পর্যবেক্ষণ দেয়ার পর সে ধরনের কথা আবারও বলা হচ্ছে। সামরিক শাসন কীভাবে আসে। এটা তো সবারই জানা, সামরিক শাসন আনার পেছনে রাজনীতিকদেরই ভূমিকা ছিল। তাদের ব্যর্থতা বা অনেক ক্ষেত্রে তারাই নিজেদের স্বার্থে সামরিক শাসন টেনে এনেছেন।
 
জনাব খায়রুল হক যখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে পূর্বপরিকল্পিত বলে নজিরবিহীনভাবে সমালোচনা করেন (এর আগে কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের রায় নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেননি), তখন বাস্তবতা হচ্ছে তিনি কোনো ঐক্যবদ্ধ বা সর্বসম্মত রায়ের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় দেননি। তিনি নিজের কাস্টিং ভোট (সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য নিজের ভোটকে অতিরিক্ত হিসেবে ব্যবহার করা) দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ওই রায় দেন। অথচ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের যে রায় বর্তমান প্রধান বিচারপতি দিয়েছেন, সব বিচারপতির সর্বসম্মত রায় ছিল এটি। এমনকি অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ৭ জন আইনজীবীর সবাই এই রায়ের পক্ষে মত দিয়েছেন।


তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সময় খায়রুল হকের যুক্তি ছিল নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার নির্বাচিত নয়। নির্বাচন হতে হবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে। অর্থাৎ নির্বাচনের জন্য সংসদ ভাঙতে হবে না। আইনসভাসহ নির্বাচিত সরকারের অধীনে বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন করতে হবে। তিনি এভাবে তার রায়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অসম্ভব করে দিলেন! তিনি অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে প্রধান প্রধান আইনজীবীর মতামতকে অগ্রাহ্য করলেন। হাইকোর্টের বিচারপতিদের তিনজনের দেয়া রায়ের (তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে রায় দেন) প্রতি গুরুত্ব দিলেন না। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অপর তিনজন বিচারপতির ভিন্নমত পোষণের কোনো মূল্য দিলেন না। এভাবে জনগণের নির্বাচন অসম্ভব করে তিনি জনগণের প্রজাতন্ত্রের কথা বলছেন! তার দেয়া রায়ের জন্য যে স্বাধীনভাবে জনগণের ভোটের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠন করা সম্ভব হয়নি সেটা প্রধানমন্ত্রীও স্বীকার করেছিলেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও নিয়মরক্ষার নির্বাচন বলার মাধ্যমে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, এমন একটি পার্লামেন্টের জন্য খায়রুল হকের দরদ একটু বেশিই মনে হয়েছে। যে পার্লামেন্টে কার্যকর বিরোধী দল থাকে না সে পার্লামেন্টকে কার্যকর পার্লামেন্ট বলা কোনো সুচিন্তিত কথা নয়।


তিনি যদি স্বাধীনভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন পদ্ধতির দিকে তাকাতেন তাহলে জানতে পারতেন কোনো দেশেই পার্লামেন্ট ব্যবস্থায় সংসদ না ভেঙে নির্বাচন হয় না। এমনকি ভারতের দিকে তাকালেও বুঝতে পারতেন। আর এটা তো সহজ কথা যে, সংসদ ভেঙে দেয়ার পর নির্বাচিত সরকার থাকে না। উন্নত দেশে সরকার ভাঙার পর কেউ প্রশ্ন তোলে না বিধায় রানিং প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান সীমিত একটা অস্থায়ী সরকার করে দেয়।

জনাব খায়রুল জনগণের নির্বাচন অসম্ভব করে স্বৈরতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করেছেন। তার কাছে বর্তমান সংসদের দুর্বলতা কোনো দুর্বলতা নয়। এখন বিচার ব্যবস্থাকেও যদি সংসদের অধীনস্থ করা যায় তাহলে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে যাবে। সে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার বক্তব্যে এখানে মনে হবে যে তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নয়, সরকারকে রক্ষার জন্য ক্ষমতাবহির্ভূত বক্তব্য রেখেছেন। জনগণের প্রজাতন্ত্র থাকলে জনাব খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে থাকতে পারতেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়কে যদি তার ভাষায় পূর্বনির্ধারিত ও পূর্বপরিকল্পিত বলা হয় তাহলে সেটাই হবে যুক্তিযুক্ত।

  •     ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
উৎসঃ jugantor.com

ছয় মাসেই উল্টো কথা

আলী রীয়াজ
আলী রীয়াজ
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এই বিষয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা দরকার। এর মধ্যে সরকারের আইনি ভাষ্য দেওয়ার দায়িত্ব আইনমন্ত্রীর, বিশেষ করে যেহেতু এই বিষয়ে সরকার আপিল আবেদন করেছিল, যা খারিজ হয়ে গেছে এবং যার ফলে সংসদে পাস করা একটি সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেহেতু সরকারের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য আইনমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবারই কথা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের নয় দিন পরে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সংবাদ সম্মেলনের আগেই আমরা সরকারের ক্ষুব্ধ অবস্থানের কিছু উদাহরণ পেয়েছি।

রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের যে সাময়িক অস্বস্তি ও নীরবতা ছিল, তা অর্থমন্ত্রীর কথার মধ্য দিয়ে অবসিত হয়; মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উষ্মাও আর অবিদিত নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে ‘জনমত গড়ে তোলার’ কথা বলার পর মন্ত্রীদের জন্য এই নিয়ে মন্তব্যের আর কোনো বাধা থাকেনি এবং তাঁরা তার সদ্ব্যবহারে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই একজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।

এতৎসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কেননা প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য বিচারপতি হক সংবাদ সম্মেলন করতে দেরি করেননি, এমনকি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আগেই তাঁর এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই রায় এবং প্রধান বিচারপতি বিষয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলোর ভিত্তি এবং নৈতিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ এই কারণে যে তিনি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আছেন এবং তা লাভজনক পদ বলেই বিবেচিত (কামাল আহমেদ, ‘যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়!’ প্রথম আলো ১০ আগস্ট ২০১৭)। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যকে কেবল আইনি ব্যাখ্যা বলে বিবেচনা না করে রাজনৈতিক অবস্থান বলেই বিবেচনা করব, কেননা তাঁর এসব বক্তব্য রায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা রাজনীতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চরিত্রের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক


তদুপরি তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য, যা জুন মাসে সংসদে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় এবং ১ আগস্টের পরে জনসমক্ষে দেওয়া মন্তব্যের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি, তার প্রতিধ্বনি শুনতে কষ্ট হয় না। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার যেসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তার একটি হচ্ছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও দেশে কোনো জনপ্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এই কথাগুলো নতুন নয়, কেননা গবেষকেরা ও সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই তা বলে আসছেন, জীবনযাপনেও তা বোধগম্য; এই রায় এই বক্তব্যের নৈতিক অবস্থানকে জোরদার করেছে। বিচারপতি খায়রুল হকের আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্মে সংবাদ সম্মেলন সেই কথা আবার প্রমাণ করেছে এবং ৯ আগস্ট আমরা আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছি বললে অতিরঞ্জন হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে বিচারপতি হকের অতীতে দেওয়া রায়, অবস্থান এবং বক্তব্যের যে বিরোধ রয়েছে, সেটা কোনো অবস্থাতেই আমরা অবহেলা করতে পারি না। বিশেষ করে আদালতের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং ক্ষমতার বিভাজন সম্পর্কে তিনি এই বছরের গোড়াতেও যে কথা বলেছেন, তার একটি বড় রকমের পার্থক্য আমরা দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের বিস্মৃত হবার উপায় নেই যে সুপ্রিম কোর্টের যে বিভক্ত রায় দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যের অবসান ঘটিয়েছিল এবং একই সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার কাজ করেছিল, সেই আদালতের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক; সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে সুনির্দিষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই ব্যবস্থা বাতিলের যে রায়, সেখানে তিনজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন (প্রথম আলো, ১১ মে ২০১১)। এই রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিচারপতি হক অবসরে যান।

এই রায়ের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি যে অনুধাবন করতে পারেননি তা নয়, তাঁকে এই বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরিরা শুনানির সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, যা রায়ের পূর্ণাঙ্গ ভাষ্যেই আছে, অর্থাৎ বিচারপতি হক সেটা জানতেন এবং এই বিষয় রায়ে উল্লেখের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রায়ের সম্পূর্ণ ভাষ্যের জন্য ১৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে—সেপ্টেম্বর ২০১২ সাল পর্যন্ত। আর ইতিমধ্যে ৩০ জুন ২০১১ বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশের সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে, যা সুস্পষ্টভাবে দেশের উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনার অসংগতিপূর্ণ এবং তার পরিপন্থী। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হক রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার ফাঁকে এ কথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি যে পঞ্চদশ সংশোধনীটি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু বা স্পিরিটের বিরুদ্ধে। যদিও ক্ষমতাসীন দল বারবার ওই রায়কেই ব্যবহার করেছে এই সংশোধনীর বৈধতার জন্য। ক্ষমতাসীন দল যখন এই রায়ের স্পিরিট উপেক্ষা করেছে, সেই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিছুই বলেননি। উপরন্তু ২০১২ সালে দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তাঁর লেখা রায়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অমীমাংসিত মতবিরোধ রয়েছে, তার সমাধান নিহিত আছে এবং এতে সংকটও কেটে যাবে (দৈনিক মানবজমিন, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২)। অবশ্যই সংকট কাটেনি, আর সেই সমাধান কী, তার কোনো ব্যাখ্যা পাঁচ বছর পরেও আমরা পাইনি, কিন্তু একটি সর্বসম্মত রায়কে ‘অগণতান্ত্রিক’ ও ‘অপরিপক্ব’ বলে বর্ণনা করার জন্য তিনি দেরি করেননি।

বিচারপতি হকের বক্তব্য যে বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে এই ধারণাই দেয় যে সংসদের করা আইন বা বিধান বাতিল করার ক্ষেত্রে আদালতকে নির্দিষ্ট সীমানা মেনে চলতে হবে যে বিচারকেরা কতটুকু পারবেন। অথচ বিচারপতি হক এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করবে, কিন্তু সেই আইন arbitrary হলো কি না, despotic হলো কি না, তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু বিচারকগণের ওপর ন্যস্ত, যাঁরা জনপ্রতিনিধি নন। এ কারণে আমরা (ইংল্যান্ডে) Dr. Bonham (১৬১০) এর মামলায় দেখতে পাই যে প্রধান বিচারপতি Sir Edward Coke বলেছেন যে Rule against bias দ্বারা কলুষিত কোনো আইনের বৈধতা থাকতে পারে না। অবশ্য তখনো Bill of Rights (১৬৮৯) আসেনি, যা King in Parliament–কে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে। এখানেই আইনের শাসনকে অর্থবহ করে মহিমান্বিত করার দায় ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত’ (বিডিনিউজ২৪, ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭; http://opinion. bdnews24.com/bangla/archives/45207)। শুধু তা-ই নয়, তিনি এ-ও বলেছিলেন যে
‘যদি নির্বাহী বিভাগ অবৈধ আদেশ দেয়, আদালত তা সংশোধন করতে পারে। জাতীয় সংসদ যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন প্রণয়ন করে, তাও সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি ঘোষণা করতে পারে।’

আমরা নিশ্চয়ই তাঁর এই সাক্ষাৎকারের এ বক্তব্য অনুধাবন করতে পারি যে ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু কি তাই নয়? আগের সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রেও কি একই ধারণাই কাজ করেনি? আজকে বিচারপতি হক কেন তবে রাজনীতিবিদদের ভাষায় এই সমালোচনায় প্রবৃত্ত হলেন, সেটা যে কাউকেই কেবল বিস্মিত করবে না, অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দেবে।

এটা আমরা লক্ষ করি, বিচারপতি হকের তুলনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং অনেক অরাজনীতিবিদসুলভ। তিনি যে একথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে ‘দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আছে’, সেটা নিশ্চয়ই তাঁর দলের অন্যদের জন্যও শিক্ষণীয়। আশা করি তাঁরা সেটি লক্ষ করবেন। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সবকিছুর সঙ্গেই আমি একমত। ৯৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা সরকার আদালতে উপস্থাপন করেছিল কিন্তু তা যে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, সেটা এই রায়েই স্পষ্ট। এখন তার পুনরুক্তি এতে নতুন কিছু যোগ করেনি। আইনমন্ত্রী যে ‘আপত্তিকর পর্যবেক্ষণ’ একপাঞ্জ করার আবেদন করবে বলে মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলেই বিবেচিত হতে পারে। কেননা তা একদিকে এক নতুন ধারা তৈরি করবে কি না, এবং প্রশ্ন উঠবে প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে যাঁরা একমত হয়েছেন, তাঁদের কোন অংশ গ্রহণযোগ্য হবে এবং কোন অংশ হবে না?

তা ছাড়া আইনমন্ত্রী ৭০ অনুচ্ছেদবিষয়ক যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা-ও কতটা বাস্তবোচিত, সেটা বিবেচনা করা দরকার। কেননা, বিচারপতি খায়রুল হকও সেই প্রসঙ্গে বলেছেন। এই রায়ের প্রধান বিষয় ৯৬ অনুচ্ছেদ হলেও তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ৭০ অনুচ্ছেদ, এই অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও বিষয়, ফলে এ নিয়ে আলোচনা করা খুব জরুরি।

  • আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
        উৎসঃ prothom-alo.com

Thursday, August 10, 2017

যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়!


কামাল আহমেদ


আমরা এখন বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বাস করছি, কথাটি বলেছেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক ষোড়শ সংশোধনীকে বেআইনি ঘোষণা করে বাতিল করায় অপ্রত্যাশিতভাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এসব কথা বলেছেন। তাঁর পাশে ছিলেন আরেকজন সাবেক বিচারপতি। তাঁদের এই অতিমাত্রায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ধারণা হতে পারে যে তাঁরাই বরং অবসরজীবন থেকে রাজনীতির জগতে পা রাখার চেষ্টাকে জোরদার করছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ের সমালোচনার কাজটি আইন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না, সেই প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। আইন কমিশন আইন, ১৯৯৬-এর ৬ নম্বর ধারায় কমিশনের কার্যাবলির যে তালিকা দেওয়া আছে, তাতে কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সমালোচনা অন্তর্ভুক্ত নেই।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় সম্পর্কে নাগরিক হিসেবে মতপ্রকাশের অধিকারের কথা অবশ্য তিনি বলতেই পারেন। কিন্তু তিনি বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের একটি লাভজনক পদে আসীন এবং সেই দপ্তরের স্থাপনা এবং সুবিধা ব্যবহার করে তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করতে পারেন না। তাঁর নিজের ঘোষিত রায়েই অবশ্য বলা আছে যে অবসর গ্রহণের পর বিচারপতি প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ গ্রহণ করতে পারেন না। সংবাদ সম্মেলনে তিনি কমিশনের আরেকজন সদস্য সাবেক বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির এবং কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিমকেও পাশে রেখেছিলেন। বিচারপতিদেরও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ রাখার যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ’প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারীর দায়বদ্ধতা আছে, কারও না কারও কাছে দায়বদ্ধতা আছে।’ আইন কমিশনের চাকরির কারণে সংসদের কাছে জবাবদিহি করায় তাঁর অভ্যস্ত হয়ে ওঠাটা প্রশংসনীয়। তবে বিচারপতিদেরও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে, এমন দাবি করার আগে তিনি তাঁর নিজের লেখা রায়গুলো একবার পড়ে নিলে ভালো করতেন।
 
জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন ও সেই আমলে জারি করা সামরিক আইন, আদেশ ও বিধানগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। কিন্তু পরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণার কারণে বিতর্কিতও হয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে তিনি যে মামলায় পঞ্চম সংশোধনীকে বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন, সেই সময়ও ওই বেঞ্চে তাঁর সহযোগী বিচারপতি ছিলেন এ টি এম ফজলে কবির। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে তিনি লিখেছিলেন, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র, যা আইনগতভাবে গঠিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়, কোনো ব্যক্তি দ্বারা নয় (Bangladesh is a Sovereign Democratic Republic, governed by the Government of laws and not of men.)
পরের বাক্যেই তিনি লিখেছিলেন যে বাংলাদেশের সংবিধান সার্বভৌমত্বকে ধারণ করে এবং এটিই দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য সব আইন, কাজ এবং কার্যধারাকে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তিনি আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ উল্লেখ করে বলেন যে এগুলো সংবিধানের সৃষ্টি এবং সংবিধানের বিধানগুলোই এগুলোর সম্পর্কের বন্ধন। আইনসভা আইন করে, নির্বাহী বিভাগ তা প্রয়োগ করে এবং বিচার বিভাগ সেগুলোর সংবিধানসম্মত হওয়া নিশ্চিত করে।
 
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বর্তমান আপিল বিভাগও বলেছেন সার্বভৌমত্বের ধারক হচ্ছে সংবিধান। সংসদ সার্বভৌম নয়, সংবিধানের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা সংসদের নেই। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবির সামরিক শাসনের সময়ে সংশোধিত সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের পরিবর্তনকে মার্জনা করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৯৫ অনুচ্ছেদ, যাতে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ওপর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না যে তখন তাঁর আশা ছিল যে একদিন প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ তাঁর আসবে এবং তখন বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি একেবারে দর্শকের সারিতে নেমে যেতে বাধ্য হতে চাননি।
 
সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন, জাতীয়তা ও নাগরিকত্বের মতো বিষয়গুলোতেও সামরিক শাসনামলে জারি করা সংশোধনীগুলো তিনি মার্জনা করে বৈধতা দিয়েছিলেন। অথচ এখন তিনি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই হলো প্রথম মামলা, যেখানে আদি সংবিধানের বিধানকে বাদ দিয়ে “মার্শাল ল প্রভিশনস”কে গ্রহণ করা হয়েছে।’ শত্রু সম্পত্তি হিসেবে মুন সিনেমা হলের মালিকানা অধিগ্রহণ এবং তার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন সরকারি আদেশের বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলার রায়ে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণার জন্য তিনি তখন প্রশংসিত হলেও সামরিক শাসনের যেসব অংশকে তিনি বৈধতা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলোর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কি না, এখন সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে তাঁর আগের অবস্থানের সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনীর প্রতিক্রিয়ার অমিলই বেশি। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বিস্তৃত।
 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা রয়েছে। বিশেষত অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৫ মাস পর তিনি ওই রায়টি লিখেছিলেন। অথচ তাঁর বিশদ রায় প্রকাশের আগেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে, যাতে তাঁর রায়ের অন্তত একটি নির্দেশনা উপেক্ষিত থেকে গিয়েছিল। তিনি অবসরে যাওয়ার আগে তাঁর রায়টি দিয়ে গেলে ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করা সম্ভব হতো না বলেই অনেকের বিশ্বাস। তাঁর রায়টিতে সাতজনের বেঞ্চের তিনজন ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। আর সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল ঘোষিত রায় এবং লিখিত রায়ের আদেশের মধ্যে ফারাক দেখা দেওয়ায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের বিষয়টিকেই অনেকের মতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল ও অস্থির করে তুলেছে।

এই পটভূমিতে ষোড়শ সংশোধনীর রায়-সম্পর্কিত বিতর্কে বিচারপতি খায়রুল হকের মন্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে আরও কিছুটা উত্তাপ যোগ করেছে, সন্দেহ নেই। আদালতের রায় বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির এ যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়। কিন্তু এতে যে দেশে গণতন্ত্র বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে, সে কথা বলা যাচ্ছে না।
- প্রথম আলো