Search

Monday, August 21, 2017

একটি রায় ও কিছু কথা

রুমীন ফারহানা

পহেলা আগস্ট ঘোষিত হলো আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির সর্বসম্মত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়। এই রায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সাথে সাথে বিচারকদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধিও প্রণয়ন করেছে। রায় ঘোষণার পর থেকেই এটি নিয়ে নানা মহলের তর্কবিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা, বিশ্লেষণ, পক্ষ-বিপক্ষে লেখা চলছে। এটি যে আরও কিছুদিন আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। রায়টি বাংলাদেশের সংবিধান, বিচার বিভাগ বা আইনসভার জন্যই কেবল গুরুত্ব বহন করে না বরং তা বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিরও একটি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। এই রায়ের শুরুতেই এটি স্পষ্ট করা হয়েছে যে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক কিনা এর উত্তরে যুক্ত আছে আমাদের সাত যুগ ( ১৯৪৭ - ২০১৬) এবং বিশেষভাবে গত সাড়ে চার যুগের (১৯৭১-২০১৬) রাজনৈতিক ইতিহাসের কতগুলো গভীর ও জটিল ইস্যু এবং ঘটনাবলী।

এই গভীর ও জটিল ইস্যু এবং ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এখানে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি রাষ্ট্র পরিচালনায় ঘটে যাওয়া নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি, অদূরদর্শিতা যেমন ক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনীতি, রাজনীতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রীকতা বা আমিত্বের ব্যাপক প্রসার যার অনিবার্য পরিণতিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে ক্ষমতাধর ‘দৈত্য’ তৈরি, নিরপেক্ষ ও হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচনের অভাবে অবিকশিত গণতন্ত্র, ঝুঁকিপূর্ণ মানবাধিকার, অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি, অকার্যকর সংসদ, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাহী বিভাগের অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া আচরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সহ নানা বিষয় ওঠে এসেছে। এতে সংসদ এবং সাংসদদের মোটামুটি অযোগ্য হিসাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকার পরিচালনার ধরন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

রায়ে মূলত যে বিষয়গুলো ওঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘অদূরদর্শী রাজনীতিকরণ’ যাকে একটি সংক্রামক রোগ হিসাবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে এর ফলে মানুষ এমন ভবিষ্যত চিন্তা করতে পারছে না যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরো জাতি, কোনও একজন ব্যক্তি নন। যে গণতন্ত্রের কথা বর্তমানে বাংলাদেশে বলা হয় তার ব্যাপারে রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও মেকী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এটি করা হয়েছে লজ্জাজনক ভাবে সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ রায়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দল, ব্যক্তিসহ গোটা দেশ ও জাতির ইতিহাস বিশ্লেষণের এক পর্যায় বলা হয়েছে এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা আছি যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না কিন্তু খারাপ লোকেরা আরও লুটপাটের জন্য বেপরোয়া। ক্ষমতার দাম্ভিকতা এবং অপব্যবহার দেখানোর ক্ষেত্রে বাঁধা দেওয়ার মতো কোনও নজরদারি বা তদারককারী প্রতিষ্ঠান নেই। এমন কী কোনও একটি জনপ্রতিষ্ঠানকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়নি। এ রায়ে বারবার এসেছে I'ness বা আমিত্ব ও ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার কথা। ‘আমাদের লোক’ কিংবা ‘আমি একাই সব’ এই আত্মঘাতী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হয় না। রায়ে বলা হয়েছে যে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনও শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। এছাড়াও আপিল বিভাগের সব বিচারপতিই দেশের ‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’কে বিচারক ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি বিবেচনা করেছেন।

অনেকেই এ কথাগুলোকে আদালতের পর্যবেক্ষণ বলে হাল্কা ভাবে দেখার চেষ্টা করলেও বাস্তবতা হলো এই পর্যবেক্ষণ অগ্রাহ্য করবার কোনও উপায় নেই; কারণ আদালত যখন কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তখন সেই সিদ্ধান্তের একটি ব্যাখ্যা রায়ে থাকে আর আদালত যেসব যুক্তির ওপর নির্ভর করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছান, সেই যুক্তিগুলো অর্থাৎ তার মতামতও ভবিষ্যতের জন্য বিচারিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সুতরাং এই পর্যবেক্ষণগুলোও ভবিষ্যতে দৃষ্টান্ত হিসাবে আসতেই পারে। আর সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ মতে আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোনও বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয়।

এই রায়ে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল বা আমলের সমালোচনা করা না হলেও এই রায়ের প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। আদালতের রায়ে কখনোই সবপক্ষ আহ্লাদিত হয় না, হওয়া সম্ভবও না। আর সে কারণেই সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল করে, প্রতিকার চায়। এক্ষেত্রেও সংক্ষুব্ধ পক্ষের রিভিউ করার সুযোগ ছিল, আছে। কিন্তু আমরা দেখলাম পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর প্রথম তিন দিন সরকার পক্ষ বজ্রাহত অবস্থায় থাকলেও তারপর যথারীতি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিচারবিভাগের ওপর। যে ভাষায় বিচারপতিদের আক্রমণ করা হয়েছে তা পত্রিকায় প্রকাশ করলেও আদালত অবমাননার ভয় থাকে। সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু ৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন যে ‘আমরা আহত, ক্ষুব্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত’ যদিও তিনি বিচার বিভাগের পর্যবেক্ষণ যে ‘এখনই বিচারবিভাগ অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে ভালো অবস্থায় এবং তাও পানিতে নাক উঁচু করে রেখেছেন তারাও ডোবার পথে’ এর সাথে সহমত পোষণ করেন। ওনার প্রতিক্রিয়াই কিছুটা প্রকাশযোগ্য তাই লিখলাম।

কিন্তু এর পরপরই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গণপূর্তমন্ত্রী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু,  আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রচার সম্পাদক হাসান মাহমুদ এবং আওয়ামী নেতা শেখ ফজলে নূর তাপস যে ভাষায় রায়ের সমালোচনা করেছেন তা শুধু শিষ্টাচার বর্হিভূত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণই নয় বরং যে কোনও সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাতেই পরিষ্কার আদালত অবমাননা। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে তাদের বক্তব্যই এই রায়ের পর্যবেক্ষণের যথার্থতা আবারও প্রমাণ করার সাথে সাথে তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনারও স্বাক্ষর রেখে গেছে।

এরমধ্যেই ভীষণভাবে সমালোচিত হয়েছে মাননীয় প্রধান বিচারপতির সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বৈঠক। দলীয় সূত্র মতে আলোচনার মাধ্যমে দুটি পথের সন্ধান করছে আওয়ামী লীগ। প্রথমত, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পর্যবেক্ষণের কিছু অংশ বাদ দেওয়ার ব্যপারে প্রধান বিচারপতিকে রাজি করানো। নতুবা পুনবিবেচনার আবেদন করা হলে আওয়ামী লীগের চাওয়া পূরণ হবে, এমন নিশ্চয়তা আদায় করা। অর্থাৎ রিভিউ করার আগেই রিভিউ এর ফলাফল নিশ্চিত করা। এটুকুই কি বিচারবিভাগ সংক্রান্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের যথার্থতা প্রমাণ করে না? এই রায় ঘোষণার আগেও মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন সময় স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে দেশে আইনের শাসন নেই, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে খেয়ে নিতে আসছে, সরকার নিম্ন আদালতকে কব্জা করার পর এখন উচ্চ আদালতকেও কব্জা করতে চায়, বিচার বিভাগ পানিতে নাক উঁচু করে রেখেছে, তারাও ডোবার পথে।

এই রায়ের বেশির ভাগ অংশই সাধারণ মানুষের মনের কথা। রায়ে যেহেতু কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য না করে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে তাই দেশ ও জাতির জন্য অনেক বেশি মঙ্গলজনক হতো যদি রাজনৈতিক দলগুলো, প্রতিষ্ঠানগুলো, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গগুলো এই রায়ের আলোকে আত্মসমালোচনা, আত্মপলব্ধি, আত্মজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিশুদ্ধ ও পরিমার্জিত করায় মনোযোগী হতো। কিন্তু তাতো হওয়ার নয়। মাননীয় প্রধানবিচারপতি যতই বলুন রায় নিয়ে রাজনীতি না করার কথা দিনের শেষে ‘আমিত্বের আসক্তি’ আর ‘আত্মঘাতি উচ্চাভিলাষ’ থেকে ক্ষমতাশালীদের মুক্তি নাই। তাই যাই আমার স্বার্থের বিপক্ষে যায় তাই ষড়যন্ত্র, ইতিহাস বিকৃতি, ধৃষ্টতা, ভুল, মিথ্যা, ইনটলারেবল, দুঃসাহস, ইমম্যাচিওরড, শান্তি কমিটির কাণ্ড। হোক না সেটা সর্বোচ্চ আদালতের রায়।

লেখক: সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি 
উৎসঃ .banglatribune.com

No comments:

Post a Comment