শাহদীন মালিক
যে কথা আমরা কখনো বলতে পারিনি বা সাহস করিনি, শ্রদ্ধেয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সে কথাটিই বলেছেন। শুধু বলেছেন বললে কথাগুলোকে খাটো করা হবে। কারণ, কথাগুলো তিনি বলেছেন নতুন প্রধান বিচারপতিকে অভিনন্দন ও সংবর্ধনা জানাতে গিয়ে; ৪ ফেব্রুয়ারি, আপিল বিভাগের প্রধান বিচারকক্ষে, বিচারপতি ও বহু আইনজীবীর উপস্থিতিতে।
পুনরাবৃত্তি হবে, তবু পাঠকদের হালকা করে মনে করিয়ে দিই, অ্যাটর্নি জেনারেল কী বলেছিলেন। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী ‘…মাহবুবে আলম মনে করেন, আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি বিরাট অংশ ইতিমধ্যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।’ প্রথম আলো বলছে, ‘… রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তার বক্তব্যে কোনো কোনো বেঞ্চে বিচারপতির বেঞ্চ কর্মকর্তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া, আদালতের রায় নিয়ে জাল-জালিয়াতি, বিশেষ বিশেষ কোর্ট বিশেষ বিশেষ আইনজীবীর কোর্ট হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গসহ বিচারালয়ে অনিয়মের বেশ কয়েকটি দিক উঠে এসেছে …।’
প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন ‘… সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টি হলো, বিশেষ বিশেষ কোর্ট বিশেষ বিশেষ আইনজীবীর কোর্ট হয়ে গেছে এবং অনেক সময় অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর কাছ থেকে ব্রিফ নিয়ে তাঁদের নিয়োগ করা হচ্ছে। বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিরা অনেকে জেনে গেছেন, কোন কোর্টে কাকে নিয়ে গেলে মামলা জেতা যাবে। এটা তো ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ বিষয়ে অনেকেই ছুটছেন বিচারপতিদের সন্তান, স্ত্রী যাঁরা আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত আছেন তাঁদের দিকে, এই চিন্তা করে যে তাঁদের নিয়ে গেলে হয়তো মামলা জেতা যাবে। বিচারপতিদের আত্মীয় বা সন্তানেরা আগেও এই পেশায় ছিলেন, কিন্তু কখনো এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এখন কেন বিচারপ্রার্থীদের আচরণ এরূপ হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।...’ (প্রথম আলো, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)
দুর্নীতি নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও অনেক কথা বলেছেন। আবারও ধন্যবাদ।
কয়েক মাস আগের কথা, আদালত ভবন থেকে বেরোতেই পাশে রাখা ঝকঝকে তকতকে দামি গাড়ি, কোর্টের গেটে থাকা কর্মচারীকে ঔৎসুক্যভরে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়িটা কার? তিনিও গর্বভরে উত্তরে জানালেন, গাড়িটা সাবেক এক বিচারপতির তরুণ আইনজীবী পুত্রের। তাঁর শ্বশুর দিয়েছেন।
ছোটবেলা থেকেই এই গোছের শ্বশুরের কথা শুনছি। তখন থেকেই জানি, ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তার দামি কিছু, অর্থাৎ অনেক ভারী সোনার গয়না, দামি ঘড়ি, কয়েক বিঘা জমি ইত্যাদি তাঁরা পেতেন শ্বশুরের কৃপায়।
বিচারপতিদের পুত্র-কন্যাদের বিবাহ-শাদি তো আর বন্ধ করা যাবে না, তবে পিতা-মাতা বিচারপতি থাকাকালীন পুত্র-কন্যাদের প্র্যাকটিসের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় তরুণ পুত্র-কন্যাদের ওকালতির আয়ুষ্কাল হবে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর, তার মধ্যে পিতা-মাতা বিচারপতি থাকবেন চার থেকে পাঁচ বছর। অতএব, নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। তা ছাড়া, ওই সময়টা আদালতের বাইরে আইনসংক্রান্ত অন্য অনেক কাজ যেমন কোম্পানি, ব্যাংক বা যেকোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা, শিক্ষকতা, গবেষণা, আইনসংক্রান্ত এনজিও ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের দুয়ার তো খোলা থাকবে।
অবশ্য মজার ব্যাপার হলো, শ্বশুরের কাছ থেকে মহাদামি গাড়ি উপহার পাওয়া ওই তরুণ আইনজীবীকে এখন নাকি কোর্টে আর বেশি দেখা যায় না। পিতার অবসরের কিছুদিনের মধ্যেই নাকি তাঁর আইনি জ্ঞান-বিদ্যা-কৌশল ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে।
২.
আমরা যাঁরা মোটামুটি সকাল-বিকেল সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় ঘুরি, তাঁরা প্রায় সবাই জানি আদালতের খবর। যাতে ভুল-বোঝাবুঝি না হয়, সে জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও বলছি, বাজে কর্মচারী-কর্মকর্তার আদালত আঙুলে গোনা যায়। সংখ্যা খুবই অল্প। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে একটাও তো বাজে আদালত থাকার কথা নয়। যেগুলো বাজে, দুর্গন্ধময়, সেগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। এই কাজটা দুর্নীতি দমন কমিশনের, এটা অ্যাটর্নি জেনারেলের নয়, আইনজীবীদের নয়, বিচারপতিদেরও নয়। অনেকেই বলতে পারেন যে অ্যাটর্নি জেনারেল যখন দুর্নীতির অভিযোগ আনছেন, তখন খোদ অ্যাটর্নি জেনারেলকেই সেটা প্রমাণ করতে হবে। দুর্নীতি প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা অ্যাটর্নি জেনারেলের নেই, এটা কেবল আছে দুর্নীতি দমন কমিশনের।
দুর্নীতি দমন কমিশন জানতে চাইলে বিজ্ঞ আইনজীবীদের অধিকাংশই লেনদেনে জড়িত গুটিকয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু ঘুষের টাকা জমা হওয়া ব্যাংক হিসাবের অ্যাকাউন্ট নম্বর তো আমরা বলতে পারব না। চাইলে মার খাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেই অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়ার আইনগত ক্ষমতা একমাত্র দুদকের। সম্পত্তির হিসাবও চাইতে পারে একমাত্র দুদক। বলা বাহুল্য, ঘুষের তদন্ত বা অনুসন্ধান করা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবে দুদক অভিযোগ দায়ের করার পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করার প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির দপ্তরে থাকবে।
৩.
আদালতের সমস্যা অনেক। মামলার জট, অদক্ষতা-অযোগ্যতাসহ সমস্যার ফিরিস্তি দীর্ঘায়িত করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এসব সমস্যার কারণে আদালতের প্রতি বিচারপ্রার্থীদের আস্থায় খুব বেশি চিড় ধরে না। দীর্ঘসূত্রতার কারণে খরচ বাড়ে, বিরক্তিও বাড়ে, তবে শেষতক ন্যায়বিচার হয়।
কিন্তু অন্যায়, অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, রাজনৈতিক প্রভাব, টেলিফোনে নির্দেশ, দুর্নীতি-এগুলো অনেক বড় সমস্যা। অন্যদিকে একজন অদক্ষ বা অযোগ্য লোককে রাতারাতি দক্ষ ও যোগ্য কর্মীতে পরিণত করা যায় না। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতি উপড়ে ফেলা যায় সাততাড়াতাড়ি। সবাইকে তো আর ধরতে হবে না, কয়েকজনকে ধরলেই বাকিগুলো গর্তে ঢুকে পড়বে।
আদালতের ওপর আক্রমণ আসছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। রক্ষা করতে এই মুহূর্তে প্রয়োজন দুদকেরও সাহায্য। আবারও বলছি, এই কাজটা একমাত্র দুদকের। আর অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলব, আমরাও দুদককে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে এক পায়ে খাড়া। বলা বাহুল্য, দুদককে আইন অনুযায়ী, নিয়ম মেনে তদন্ত করতে হবে, তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হবে এবং ঠিকমতো মামলা দায়ের ও পরিচালনা করতে হবে।
তবে সমস্যা তো একটু আছেই, বেসিক ব্যাংকের মতো দুদক খালি ট্যাংরা-পুঁটি খোঁজে এবং ধরে, রুই-কাতলার ধারেকাছেও যায় না। মাঝে মাঝে শুধু ডেকে লোক দেখানো আলাপ-আলোচনা করে। একইভাবে আদালতের ঘুষ-দুর্নীতি দূর করতে দুদক হয়তো দৌড়াবে শুধু পিয়ন-চাপরাশিদের পেছনে। রাঘববোয়ালেরা থাকবে বহাল তবিয়তে। হয়তো রেট আরও বাড়বে, গুটিকয়েক পছন্দের আইনজীবীর কামাইও বাড়বে, বাড়বে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ আর শুধু কমবে আদালতের ওপর আস্থা। কেননা, রাষ্ট্র এখন ওদের, দুর্নীতিবাজদের। রাষ্ট্র আর আমাদের নয়।
তবে কথা এখানেই শেষ নয়। আমাদের রাষ্ট্রে আবার আমাদের নিজেদের করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। শুরুর পথের যাত্রী হওয়ার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে আবারও ধন্যবাদ।
- ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক
উৎসঃ প্রথম আলো prothomalo.com