মো: মতিউর রহমান
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকেই একাদশ সংসদ নির্বাচন তথা জাতীয় নির্বাচন করবে বলে মনে হয়। আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কোনো দল বা জোট পরপর দুইবার ক্ষমতায় যেতে পারে না। এর কারণ হলো এক দিকে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি তথা লুটপাট, দলীয় ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মাস্তানি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি, অন্য দিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া, মামলা-মোকদ্দমা ও জেল-জুলুমে হয়রানি এবং শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও নেতাকর্মীদের ধরাপাকড়, দমন-পীড়ন করা।
উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জঙ্গিবাদের হুমকিকে রাজনীতিকীকরণ করেছে। এর সুযোগ নিয়ে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা এখনো যেন জরুরি অবস্থায় আটকে আছেন। এ কারণে জনগণ ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সুযোগ পেলে বা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটায়। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা সহায়ক যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এ ধরনের সরকারের দরকার নেই বলে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন। আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সংবিধানকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এ দাবিকে অসাংবিধানিক রূপ আখ্যা দিয়ে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠে আর জায়গা নেই বলে অন্যদের উঠতে নিষেধ করার মতো।
জাতি হিসেবে আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ হলেও জনগণ এত দ্রুত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর আন্দোলনের কথা ভুলে যায়নি। সেই আন্দোলনে জনজীবনের চরম নৈরাজ্য নেমে এসেছিল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পুরো দেশকে অচল করে দিয়েছিল। এমনকি বাসে আগুন দিয়ে মানুষমারা হয়েছিল। আর আন্দোলনের অংশ ও কৌশল হিসেবে কথিত জনতার মঞ্চ এক দিকে যানবাহন চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছিল, অন্য দিকে সৃষ্টি করেছিল প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা।
প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী এ ধরনের কার্যক্রমে যোগদান করতে পারে না। এমন হঠকারী কাজ একটা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তুল্য এবং সেই কারণে দেশদ্রোহিতার শামিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করা ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে পড়ে না। জনতার মঞ্চ ছিল একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের মঞ্চ। অন্য দিকে, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতির ভাষাগত ও জাতিগত অস্তিত্বের লড়াই।
ভাবতে অবাক লাগে যে, সেই আওয়ামী লীগ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামগন্ধও সহ্য করতে পারছে না। তারা ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘দানব’ বলে প্রচার করেছে। আর এখন সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালেও তো দেশের সংবিধান ছিল। সংবিধানের জন্য জনগণ নয়, জনগণের জন্যই সংবিধান।
অতীতে প্রয়োজনে একাধিকবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেননা, সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, চিরদিন অপরিবর্তনীয়। আর ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ব্যতিক্রমধর্মী সরকার। সেনাসমর্থিত ওই সরকার তৎকালীন সেনাপ্রধানের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে জনতুষ্টিমূলক এমন কতকগুলো কাজ হাতে নেয়, যা ছিল তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর স্পিরিটের পরিপন্থী। তাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ছিল মূলত আইওয়াশ। এর আবরণে তারা নিজেদের পদ ও পদমর্যাদা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আখের গুছিয়ে নেন। এ কারণে মইন ইউ আহমেদের পক্ষে বছরের পর বছর বিদেশে আয়েশি জীবনযাপন এবং আরেকজন জেনারেলের পক্ষে পাঁচ তারকা হোটেল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অন্যদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াও শিকার হন। অবশ্য শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি দৃশ্যত তীব্র উষ্মা প্রকাশ করলেও তিনি কিন্তু এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রত্যক্ষ বেনিফিশিয়ারি।
এ ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন ও বিস্ময় রয়েছে। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মইন ইউ আহমেদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন না কেন? মইন ইউ আহমেদকে বিদেশ যেতে দিলেন কেন এবং লে. জেনারেল মাসুদউদ্দীন চৌধুরীকে দীর্ঘদিনের জন্য অস্ট্র্রেলিয়ায় হাইকমিশনার করে পাঠালেন কেন? এটা একধরনের দ্বিচারিতা। প্রতিপক্ষ অভিযোগ করেছে, ভারতের মধ্যস্থতায় সেনাপতিদের সাথে আপস করেই নাকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আরূঢ় হয়েছিল।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য অতীতের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মন্দ বলা যাবে না। এক-এগারোর আগের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। উচ্চ আদালত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ) সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি উচ্চ আদালতের মতের অনুরূপ সুপারিশ করলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা পাল্টে যায় এবং তার অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। ক্ষমতায় থেকে এবং সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার অতীত অভিজ্ঞতা মোটেও শুভ হয়নি। আর আওয়ামী লীগের অধীনে অতীতে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারেনি। এর ব্যতিক্রম ছিল ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি সব ক’টিতে জয়ী হয়। সুতরাং অংশগ্রহণমূলক হওয়াই শুধু অন্বিষ্ট নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়াও জরুরি।
ক্ষমতাসীন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আগে ‘দানব’ বললেও হালআমলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার লক্ষ্যে মহাসড়কে ওঠা ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা’ বজায় রাখা ধুয়া তুলেছেন। ভাবখানা এমন যে, উন্নয়নে শুধু তাদের দলেরই পারঙ্গমতা আছে, অন্য কোনো দলের নেই। এর মধ্যে একটা অহঙ্কার এবং আত্মম্ভরিতার ভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য, এ দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অতীতে ক্ষমতায় ছিল এমন সব দলেরই অবদান আছে। উন্নয়ন কারো একচেটিয়া অধিকার ও পারঙ্গমতার বিষয় হতে পারে না। যদি তাই হয়, তাহলে তো বর্তমান সরকারের দৃঢ়োক্তি (না দম্ভোক্তি?) অনুযায়ী তাদের কালনিরবধি ক্ষমতায় রাখতে ও থাকতে হয়। সে ক্ষেত্রে তো ভোটারবিহীন নির্বাচন কিংবা ক্ষমতা জবরদখল বৈধ হয়ে যেতে পারে গুরুত্বহীন। সে অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুরুত্বহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, উন্নয়ন বলতে শুধু নির্মাণ কাজ বা বস্তুগত উন্নয়নকে বোঝায় না। গণতন্ত্র তথা আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং কর্তৃত্ববাদী তথা একচেটিয়া শাসনের মনোভাব থাকলে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মুক্ত গণমাধ্যম না থাকলে রাষ্ট্রের সার্বিক ও প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। ভৌত উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় অন্যসব উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। গণতন্ত্রের উন্নয়ন হলে এর অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটবে।
ক্ষমতাসীনদের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার মোহ তাদের ভালোই ধরেছে। আর এ কারণেই বিরোধী নেত্রীকে জেলে রেখে সরকারি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আগাম ভোট চাওয়া শুরু হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা সংবাদ শিরোনাম করেছেন খালেদা জিয়া কোর্টে, শেখ হাসিনা ভোটে। গণতন্ত্রের এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলো, অধিকারের সমতা যা বেপরোয়াভাবে হরণ করা হয়েছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘ক্ষমতার গুরুতর অসাম্যের মধ্যে নিহিত থাকে অবিচার।’ গণতন্ত্র আজ রাহুগ্রস্ত। প্রশাসন ও পুলিশ দলীয় ব্যাধিগ্রস্ত, সুশাসন নির্বাসিত। আর নির্বাচন কমিশন নিয়ে সবাই সংশয়গ্রস্ত। নির্বাচনকে মাথায় রেখে সংসদ সদস্যদের ইচ্ছামাফিক প্রকল্প গ্রহণ করায় এবং নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া ও ভোটকেন্দ্রে সেনা মোতায়েনের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, এমন নির্বাচনের আশা সুদূরপরাহত বলে মনে হয়।
- লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
- নয়াদিগন্ত/১৮-৩-১৮